চিন্তামূলক বিবিধ রচনা
নতুন দিগন্তর অক্টোবর-ডিসেম্বর সংখ্যায় উপনিবেশকালের ভারত, ভারতের তৎকালীন রাজনীতি, ভারতের রাজনৈতিক সমস্যায় মার্কস-এঙ্গেলসের বিশ্লেষণ নিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে। উপনিবেশ ভারতের বিভিন্ন জনবিদ্রোহ নি্নবর্গের ইতিহাসপাঠে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠছে, যার একটি ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, আমাদের পাঠ্যপুস্তকের ভাষায় সিপাহি বিদ্রোহ। আহমেদ কামাল বিষয়টিকে তুলে এনেছেন মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। তাঁর ‘১৮৫৭-৫৮-র বিদ্রোহকে মার্কস ও এঙ্গেলেস কীভাবে দেখেছিলেন’ শিরোনামের রচনায় ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের সময়টিকে মার্কস ও এঙ্গেলস কীভাবে পাঠ করেছিলেন তার একটি ছবি আঁকা হয়েছে।
অন্যদিকে ভারত প্রশ্নে মার্কসের অবস্থান নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ আবুল কালাম। ভারত প্রশ্নে মার্কসের সমালোচনা করেছেন অনেকেই। কেউ কেউ মনে করেন, নিছক পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদ বিকাশের ধারা এবং তার সংকট বুঝতে চেয়েছিলেন মার্কস, এর বাইরের উপনিবেশিত বিশ্বব্যবস্থা তাঁর অনুধ্যান ছিল না। ‘ভারত প্রশ্নে মার্কস’ নিবন্ধে সৈয়দ আবুল কালাম এই সমালোচনাকে খণ্ডন করেছেন। প্রতিরোধের রাজনীতি নিয়ে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে দুটি প্রবন্ধই গুরুত্ববহ।
পাটশিল্প আমাদের দেশীয় শিল্প বিকাশের একটি প্রধান ক্ষেত্র। কিন্তু বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাতীয় সাম্রাজ্যবাদী উজির-নাজিরদের পরামর্শে এই শিল্প ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। আনু মুহাম্মদ ‘পাট, পাটশিল্প ও পাটভূমি’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই হননচিত্রটি উ্নোচিত করেছেন।
সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে আমেরিকার সামরিক নীতির ন্যক্কারজনক ভূমিকা ব্যাখ্যা করেছেন নৈবেদ্য চট্টোপাধ্যায়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন তাঁর ধারাবাহিক প্রবন্ধ ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’। ‘খুদে কর্জের খাতক’ প্রবন্ধে ঋণগ্রহীতাদের নিয়ে যে ভয়ঙ্কর রাজনীতি ও ব্যবসার জাল তৈরি হয়েছে তা উ্নোচন করতে চেয়েছেন ফারুক চৌধুরী।
নিয়মিত বিভাগে আছে গল্প, কবিতা ও গ্রন্থালোচনা।
খান মোহাম্মদ ফারাবী সংখ্যা
অকালপ্রয়াত কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও নাট্যকার খান মোহাম্মদ ফারাবীর জ্ন ১৯৫২ সালের ২৮ জুলাই। মারা গেছেন ১৯৭৪ সালের ১৫ মে ২২ বছর বয়সে। মৃত্যুর পর প্রকাশিত তাঁর ‘কবিতা ও অন্যান্য’, ‘মামার বিয়ের বরযাত্রী’, ‘এক ও অনেক’, ‘আকাশের ওপারে আকাশ’ ইত্যাদি গ্রন্থে ফারাবীর শক্তি ও সামর্থেøর পরিচয় আছে। ফারাবীর ৫৫তম জ্নবার্ষিকী উপলক্ষে ‘খান মোহাম্মদ ফারাবী সংখ্যা’ প্রকাশ করেছে সাহিত্য একাডেমী পত্রিকা। প্রকাশক ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমী।
বশীর আল্হেলাল লিখেছেন ‘ফারাবীঃ মানুষের অখণ্ড অস্তিত্বের অকালপ্রয়াত দার্শনিক’। সমাজের বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও বিকাশে বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি ফারাবীর বিশ্বাস ছিল। তিনি মার্কসবাদী মতাদর্শ অবলম্বন করেছিলেন। বশীর আল্হেলালের মন্তব্যঃ ‘ফারাবীর সামনে নানা রকম প্রভাব ছিল-শিল্প, দর্শন ও আদর্শের। নানা রকম প্রতিভাবান বন্ধু ছিল। প্রচুর পড়তেন। ছিল মেধা, পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা। এর মধ্য দিয়ে সাহিত্য কি মননে, দর্শনে তিনি যে পথ কেটে বেরোন, এক কথায় তাকে বলা যায় সমাজবাস্তবের পথ। গদ্যের দিকে বেশি ঝোঁকেন। তাতে তাঁর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।’
ফারাবীর কবিতাকর্ম নিয়ে আলোচনা করেছেন মাহবুব-উল-করিম।
ফারাবী অ্যালেন গিনসবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার বাংলা অনুবাদ করেছেন। ‘অ্যালেন গিনসবার্গ ও খান মোহাম্মদ ফারাবী’ শিরোনামে একটি তথ্যসমৃদ্ধ রচনায় নির্মলেন্দু গুণ বলেন, ‘ফারাবীর চমৎকার অনুবাদ শুধু যে শিল্পোত্তীর্ণ হয়েছে তাই নয়, এই সফল অনুবাদকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির হয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্বও পালন করে গেছেন। আমার বিশ্বাস, এই কবিতাটির জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে মার্কিন কবি অ্যালেন গিনসবার্গ যেমন বেঁচে থাকবেন, তেমনি ওই কবিতার সফল অনুবাদক হিসেবে খান মোহাম্মদ ফারাবীও (১৯৫২-১৯৭৪) পাশাপাশি বেঁচে থাকবেন।’
শেষে মুদ্রিত হয়েছে এই অকালপ্রয়াত লেখককে নিবেদিত কবিতা। এই বিশেষ সংখ্যাটির জন্য সম্পাদক জয়দুল হোসেনকে ধন্যবাদ জানাই।
‘নব্বইয়ের দশক’
শালুক-এর বর্তমান সংখ্যাটি বিশেষ সংখ্যা। বিষয়ঃ শৈল্পিক ও সক্রিয় নব্বইয়ের দশক। সম্পাদকীয়র একাংশঃ “শালুক-এর এ বিশেষ সংখ্যার কভারে খুবই সতর্কতার সঙ্গে উল্লেখ করেছি দুটি স্পর্শকাতর বিশেষণ ‘শৈল্পিক’ ও ‘সক্রিয়’। অর্থাৎ এখন আর কারোই বুঝতে বাকি থাকল না যে নব্বইয়ের দশকের দীর্ঘ সতেরো বছরের কাব্যসাধনার অন্তে তাদেরকে নিয়ে শালুক-এর এ বিশেষ আয়োজনের আসল অভিপ্রায় কী।···শালুক যাদেরকে মনে করে বিরামহীনভাবে সক্রিয় এবং তাদের কবিতাকে মনে করে অব্যাহতভাবে শৈল্পিক।”
শালুক ‘বিরামহীনভাবে সক্রিয়’ মনে করেছে ১৮ জন কবিকে। তাঁদের সাতটি করে কবিতা, ‘কেন লিখি’বিষয়ক তাঁদের কাব্যভাবনা ও জ্নতারিখ-জ্নস্থানসহ প্রত্যেক কবির প্রকাশনা তালিকা মুদ্রিত হয়েছে। নির্বাচিত কবিগণ-আলফ্রেড খোকন, আশরাফ রোকন, ওবায়েদ আকাশ, কাজল কানন, কুমার চক্রবর্তী, চঞ্চল আশরাফ, জফির সেতু, জাফর আহমদ রাশেদ, টোকন ঠাকুর, পাবলো শাহি, বায়তুল্লাহ্ কাদেরী, মজনু শাহ, মাহবুব লীলেন, মুজিব ইরম, মোস্তাক আহমাদ দীন, শাহ্নাজ মুন্নী, সরকার আমিন ও হেনরী স্বপন। কবি নির্বাচন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এমন নির্বাচনের দায়িত্ব যেমন শালুককে কেউ দেয়নি, তেমনি শালুকের এ অধিকার খর্ব করার এখতিয়ারও কেউ রাখে না।’ খুবই সত্য কথা। আমরা আর কী বলব।
শালুক-এর অন্যান্য বিভাগে আছে গল্প, কবিতা, শিল্প আলোচনা, একটি কবিতার পাণ্ডুলিপি, একটি মঞ্চনাটক, অনুবাদ ও বই আলোচনা।
শিল্পের প্রকরণ, ভাষা, তার প্রবাহ, ছন্দময়তা নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন সঞ্জয় দে রিপন (‘শিল্পের স্বরূপ সন্ধানে প্রকৃতির সাযুজ্যতা’)। ‘স্পেনীয় ভাষার কবিতা’ বিভাগটি সমৃদ্ধ। মূল স্প্যানিশ থেকে মিগেল এর্নানদেস, আগুস মোরালেস ও ওকতাভিও পাজের কবিতা অনুবাদ করেছেন ভাস্বতী ঠাকুরতা। ভালো লাগল মিগেল এর্নানদেসের ‘বাড়িগুলো সব চোখ’, তার কয়েকটি লাইন-‘বাড়িগুলো সব চোখ/জ্বলজ্বল করে আর দ্যাখে।/বাড়িগুলো সব মুখ/থুতু ফেলে, কামড়ায় আর চুমু খায়।/বাড়িগুলো সব হাত/ধাক্কা দেয়, আর শক্ত করে ধরে রাখে।’
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০০৮।
Leave a Reply