রুপোর চামচ মুখে নিয়ে জন্মায় না সবাই। জীবনযুদ্ধের প্রতিযোগিতায় ধনীর সন্তানেরা দরিদ্রদের তুলনায় গোড়া থেকেই এগিয়ে থাকে। তাদের অনেকেরই জীবন গড়ে ওঠে সহজভাবে। ভাগ্যবান তারা। তাদের সাফল্যকে অবশ্যই ছোট করা যায় না; কিন্তু যাঁরা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও নিজেদের চেষ্টায় বড় হয়েছেন, তাঁদের সাফল্য অনেক বেশি কৃতিত্বের দাবি রাখে। একটি দরিদ্র এবং প্রায় অশিক্ষিত পরিবারে জন্মে এবং বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েও নিজের চেষ্টায় লেখাপড়া শিখেছিলেন আমার বাবা। তারপর তিনি লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে। ছোট থেকে বড় হওয়ার একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত তিনি। অপরপক্ষে, তাঁর সঙ্গে তুলনা করলে আমি তেমন কোনো কৃতিত্বই দাবি করতে পারি না। কারণ একজন হেডমাস্টারের পরিবারে জন্মে আমি যেটুকু লেখাপড়া লিখেছি, তা তো হওয়ারই কথা! কিন্তু শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে যায় যখন চিন্তা করি কত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের গড়ে তুলেছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রধান ঐতিহাসিক সিরাজুল ইসলামকেও একই কারণে জানাই গভীর শ্রদ্ধা। অদম্য ও অসীম সাধনার জন্য তাঁরা পূজনীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
সিরাজুল ইসলামের পিতা এবং বড় ছয় ভাই সামান্যই লেখাপড়া জানতেন। পিতা চিঠিপত্র লিখতে পারতেন, এই মাত্র। বংশের মধ্যে শিক্ষিত হয়েছিলেন একমাত্র তাঁর এক চাচা। তিনি দেওবন্দ গিয়ে লেখাপড়া শিখে এসেছিলেন এবং সুফি পীরে পরিণত হন। তাঁদের আর্থিক অবস্থাও ভালো ছিল না। বালক সিরাজকে তাঁর পিতা অথবা বড় ভাইয়েরা লেখাপড়া শিখতে বলেননি কখনো। লেখাপড়ার জন্য কাগজ-কলমও কিনে দেননি। তাঁরা যা বারবার বলতেন, তা হলো: হুঁকোয় তামাক সাজিয়ে আনতে। সাত-আট বছরের বালকের পক্ষে সেটা মোটেই সহজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত তামাক সাজানোর পাইকারি আদেশের ভয় থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেই তিনি লেখাপড়া শেখার নাম করে চলে যান কয়েক মাইল দূরে মামার বাড়িতে।
তাঁর লেখাপড়ার বিশেষ কোনো সুযোগ অথবা পরিবেশ ছিল না মামার বাড়িতে। পাঠশালার মতো একটা বস্তু ছিল বটে; কিন্তু সেখানে ছেলেরা জড়ো হয়ে খেলাধুলা ও দুষ্টামি ছাড়া অন্য কিছুই করত না। তবে সেখানে মাঝেমধ্যে বর্ণ আর নামতা মুখস্থ করার ড্রিল হতো। এতে সিরাজের উৎসাহ ছিল না। তার ওপর মামার বাড়িতে আগ্রহব্যঞ্জক কাজও জুটে গিয়েছিল। তিনি সেখানে জাল বোনা শিখে তাঁর মামা-মামিকে উৎসাহের সঙ্গে সাহায্য করতে শুরু করেন। খুশি হয়ে তাঁরাও এটাকে স্বাগত জানান। তাই মামার বাড়িতে দুই বছর থাকলেও প্রায় নিরক্ষরই থাকেন সিরাজ। শেখার মধ্যে শিখেছিলেন নাম সই করতে আর কিছু নামতা। ওদিকে তিনি যে লেখাপড়া শিখছেন না, সেটা একসময় তাঁর পরিবার জানতে পারল। তারপর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ডাক এল। কিন্তু বাড়িতে তামাক সাজানো ছাড়া করার মতো তেমন কিছু ছিল না। নবীনগরের হাওর এলাকায় স্কুল-কলেজ তখনো খুব সামান্যই ছিল। সিরাজ অতঃপর ভর্তি হলেন দূরের এক জুনিয়ার মাদ্রাসায়।
একালের মতো তখনকার মাদ্রাসায় কড়া শাসনের মধ্যে কেবল ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হতো না, বরং কিছু ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ও খানিকটা শেখানো হতো। ফলে তিনি সেখানেই খানিকটা লেখাপড়া শিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। অচিরেই আরবি আর উর্দু পড়তে এবং লিখতে শিখে ফেলেছিলেন এবং কিম্্ আশ্চর্যম্্! আরবি আর উর্দুর সঙ্গে খানিকটা বাংলা ও ইংরেজিও শিখে ফেলেন।
লেখাপড়া খানিকটা শিখলেন বটে, কিন্তু লেখাপড়ায় সত্যি সত্যি তাঁর উৎসাহ ছিল না। স্কুলের শিক্ষা তাঁকে ভাবাতে পারেনি, মনের মধ্যে আগ্রহও জাগিয়ে তোলেনি। পাঠ্যবইতে যা লেখা থাকত অথবা মাস্টাররা যা বলতেন, তাকে তাঁর খুব মামুলি মনে হতো। মনে হতো: এ তো জানা কথা! অর্থাৎ লেখাপড়াকে আদৌ চ্যালেঞ্জিং মনে হয়নি তাঁর। এর কারণ তখনকার (এমনকি, এখনকার) শিক্ষাব্যবস্থা, পাঠ্যপুস্তক সর্বোপরি অর্ধশিক্ষিত শিক্ষকেরা। লেখাপড়াকে এতটা বিরক্তিকর মনে হওয়ার প্রধান কারণ তাঁর স্বাভাবিক প্রতিভা। জুনিয়র মাদ্রাসায় পড়ার সময় যাতে তিনি সত্যি আনন্দ পেতেন, তা হলো ফুটবল খেলা। ভালো খেলতে পারতেন তিনি। অন্য জায়গা থেকে খেলার নিমন্ত্রণও পেতেন। ফুটবল খেলে আর নামমাত্র লেখাপড়া শিখে তাঁর দিনগুলো ভালোই কাটছিল সেই জুনিয়ার মাদ্রাসায়। কিন্তু সেই সুখের দিনগুলো শেষ হয়ে গেল—কারণ জুনিয়ার মাদ্রাসার দৌড় অষ্টম শ্রেণী অবধি।
তারপর সিরাজ গিয়ে ভর্তি হলেন একটি হাইস্কুলে। স্কুলটি সবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চালাক-চতুর একটি ছাত্র পেয়ে হেডমাস্টার বেশ খুশি হলেন। কিন্তু লেখাপড়ায় আগ্রহের অভাব আর ফুটবলে দারুণ উৎসাহ দেখে হেডমাস্টারের হতাশ হতে দেরি হয়নি। তার ফলে একদিন সিরাজের ভাগ্যে জুটল বেতের পিটুনি। এতে অবশ্য তাঁকে বিশেষ কোনো দোষ দেওয়া যায় না। আগেই বলেছি, শিক্ষার বিষয় এবং শিক্ষাপদ্ধতি—উভয়ই তাঁকে হতাশ করেছিল। কী হবে ওই সব রচনা বইয়ের আবোল-তাবোল পড়ে? তিনি নিজেই একটা রচনা বই লিখে ফেললেন। গাছপালা, পশুপাখি, দেশ ইত্যাদি নিয়ে তিনি লিখেছিলেন এই রচনা বইটি। এও তাঁর অসামান্য প্রতিভারই পরিচয় দেয়। অন্তত দশম শ্রেণীর কোনো সাধারণ ছাত্র নিজে রচনার বই লিখে ফেলে না—অন্য বইগুলোতে আগ্রহের বিষয় না থাকলেও।
সিরাজের সত্যিকার মনোযোগটা ফুটবলে থাকলেও তিনি প্রথম শ্রেণীতে ম্যাট্রিক পাস করলেন। প্রথম শ্রেণী পাওয়া তখন জিপিএ-৫ পাওয়ার মতো অত সহজ ছিল না। তা ছাড়া, প্রথম শ্রেণীটা খুব গুরুত্বপূর্ণও নয়, কারণ অনেক অঘাও প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে শেষ পর্যন্ত অশিক্ষিতই থেকে যায়। সিরাজের জন্য প্রথম শ্রেণীটা অবশ্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। কারণ টাকার জন্য কারও ওপর তাঁর নির্ভর করতে হলো না।
তিনি যে কলেজে ভর্তি হলেন, সেটা সবে স্থাপিত হয়েছিল। তাই ভালো ছাত্র হিসেবে তাঁর বিশেষ খাতির ছিল। তাঁর হোস্টেলে থাকা, খাওয়া-দাওয়া সবই ছিল বিনা পয়সায়। কিন্তু যাকে পড়ুয়া ছাত্র বলা হয়, তিনি তা ছিলেন না। ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতেন তিনি। তার ওপর রাজপুত্রের মতো চেহারা, একটি প্রেমেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। এসব শুনে কলেজের প্রিন্সিপাল মহা বিরক্ত হলেন। একদিন তাঁর রাগটা প্রহারের রূপ নিল। কলেজে পড়ার সময়ও তাই সিরাজ আরও একবার শিক্ষকের হাতে মার খেলেন। মারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল কি না জানা নেই, কিন্তু এবারও তিনি পাস করলেন প্রথম শ্রেণীতে। এটিও তাঁর জীবনে আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেছিল। এই প্রথম শ্রেণীর সুবাদেই তিনি পেয়েছিলেন ট্যালেন্ট স্কলারশিপ। সেকালে শিক্ষা বিভাগ যেসব ভালো কাজ করেছিল, তার মধ্যে একটা ছিল এই বৃত্তি প্রদান। এর জন্য প্রথমেই এককালীন পাওয়া যেত ৭০০ টাকা আর মাসে মাসে যদ্দূর মনে পড়ছে, ৭৫ টাকা। ৭৫০ টাকা মানে একালের ১০ হাজার টাকারও বেশি।
সিরাজ ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলে। বিষয়: ইতিহাস। একবার এখানে আসার পর তিনি আর কোনো দিন পেছনে ফিরে তাকাননি। তাঁর উন্নতি হয়েছে ধাপে ধাপে। চার বছর পরে—১৯৬২ সালে তিনি ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন।
অনেকেই আছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল করে বেরিয়ে আসার পর যাঁরা মনে করেন, তাঁদের আর শেখার কিছু বাকি নেই। একটি চাকরি পেয়ে তাঁরা ধন্য হয়ে যান; অতঃপর বেশি কিছু করার কথা তাঁরা আর ভাবেন না। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর যাঁরা সত্যিকার লেখাপড়া শুরু করেন, সিরাজুল ইসলাম এই দ্বিতীয় দলের লোক। দশম শ্রেণীতে বসেই যিনি রচনা বইগুলোকে অনাকর্ষণীয় মনে করে নিজেই রচনা বই লিখেছিলেন, তাঁর পক্ষে এটাই স্বাভাবিক। বস্তুত, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করে তিনি ইতিহাসের সত্যিকার ছাত্র হন। অতঃপর তিনি যথাসময়ে বৃত্তি পেয়ে লন্ডনে যান পিএইচডি করতে। এই পিএইচডি বস্তুটাও এমএ পাস করার মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। একবার এই ডিগ্রি হলে অনেকেই নিজেদের সর্বজ্ঞ বিবেচনা করেন এবং তাঁদের পিএইচডি অভিসন্দর্ভটিকে একমাত্র কুমিরের ছানা হিসেবে দেখিয়ে স্বর্গারোহণ করেন। তাঁদের জীবনে সবই হয় রুটিনমাফিক। সিরাজেরও সবই হয়েছিল সোজা পথে হাঁটার মতো।
যা রুটিনমাফিক হয়নি তা হলো লেখাপড়া। সিরাজ ইতিহাসকে ভালোবেসে ফেলেন এবং মৌলিক চিন্তা করতে শেখেন। তিনি একটা কথা জেনেছিলেন: নাল্পে সুখম্্ অস্তি—অল্পে সুখ নেই। লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড অ্যাফ্রিকান স্টাডিজে লেখাপড়ার সময় তিনি তাঁর তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পেয়েছিলেন দুজন নামকরা অধ্যাপককে। জে বি হ্যারিসন আর কীর্তি নারায়ণ চৌধুরীকে। শেষের জন নীরদ চৌধুরীর সন্তান। তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে প্রথমজনই তাঁকে ভাবতে এবং বিশ্লেষণ করতে শেখান। তিনি তাঁর ছাত্রের আগ্রহের দুয়ারটা খুলে দেন। পিএইচডির জন্য সিরাজ বিষয়বস্তু হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন বহু চর্চিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে। এ বিষয়ে একেবারে মৌলিক কাজ করা কঠিন। তা সত্ত্বেও মৌলিক কাজ হিসেবে তাঁর অভিসন্দর্ভটি পণ্ডিতজনদের অকুণ্ঠ প্রশংসা লাভ করেছিল। তাঁর দ্বিতীয় গবেষণাও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে।
লন্ডন থেকে তিনি দেশে ফিরে আসেন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে—’৭২ সালের গোড়ার দিকে। এরপর কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি সহযোগী অধ্যাপক এবং তারপর পুরো অধ্যাপক পদ লাভ করেন। একালের মতো সে আমলে কয় বছর পড়ালেন, খবরের কাগজে কয়টা রচনা লিখলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে কোন দলকে ভোট দিলেন, সেই পাটীগণিতের হিসাব দিয়ে প্রফেসর হওয়া যেত না। ২০ বছর পড়িয়েও আমি তো কোনোকালে প্রফেসর হতে পারিনি! কিন্তু প্রফেসর হওয়ার রাস্তাটা সেকালে বন্ধুর থাকলেও এন্তার প্রফেসর ছিলেন। আর একালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কে প্রফেসর নন, সেটা হিসাব করাই বোধহয় সহজ। সিরাজ প্রফেসর হয়ে ধন্য হননি; তিনি প্রফেসর হয়েই বরং প্রফেসর পদের মর্যাদা বাড়িয়েছিলেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রফেসর ছিলেন না, কিন্তু প্রফেসরদের গুরু ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকার সময় তিনি কেবল ইতিহাস নয়, নানা বিষয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন করেন। আমি যাঁদের জানি, তাঁদের মধ্যে যাঁরা বিচিত্র বিষয় নিয়ে প্রভূত লেখাপড়া করেছেন, তাঁদের একজন সিরাজুল ইসলাম। দেশে ফেরার পর তিনি যথারীতি গবেষণা করতে থাকেন। গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হতে থাকে দেশ-বিদেশের জার্নালে। আর বক্তৃতা করার জন্য তিনি সফর করতে থাকেন দেশে দেশে। এটাকে আমার কাছে বিশেষ উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয় না। তাঁর সত্যিকার কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৮২ সালে, তিনি যখন এশিয়াটিক সোসাইটিতে যোগদান করেন। তিনি নিজের পেনশনের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে এবং লাখ লাখ টাকার লোকসান স্বীকার করে নিয়ে সোসাইটিতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি যোগ দেওয়ার পর অবহেলিত এবং নামে-মাত্র টিকে-থাকা এশিয়াটিক সোসাইটির পুুনর্জন্ম হয়েছিল। সে সময় এশিয়াটিক সোসাইটি এত তুচ্ছ একটি প্রতিষ্ঠান ছিল যে, তার অবস্থান ছিল ফজলুল হক হল থেকে গুলিস্তানের দিকে যাওয়ার সময় প্রথম ডান দিকে যে রাস্তাটা পড়ে, সেই রাস্তার কোণে অবস্থিত জাদুঘরের একটা কক্ষে। মাসে ভাড়া ১২ টাকা।
সেই ১২ টাকা ভাড়ার এশিয়াটিক সোসাইটি এখন তিনটি বড় ভবনে বিস্তৃত, যা ছিল স্বল্প কিছু বৃদ্ধ অধ্যাপকের সভা এবং আড্ডা, সেটা এখন পরিচিত হয়েছে পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা কাজের জন্য। এই প্রতিষ্ঠানের কল্যাণে যেসব কাজ গত ১০ বছরে করা হয়েছে, তার কোনো নজির বাংলাদেশে নেই। সিরাজই প্রথম ভেবেছিলেন বাংলাদেশের একটি প্রামাণ্য ইতিহাস লেখার কথা। এশিয়াটিক সোসাইটির উদেযাগে পণ্ডিতজনদের একত্র করে তিনি তিন খণ্ডে প্রকাশ করেছিলেন সেই ইতিহাস।
কিন্তু তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ বাংলাপিডিয়া। পশ্চিমবঙ্গ থেকে একবার এ রকমের একটি কাজের উদেযাগ নেওয়া হয়েছিল। তার মান বেশ উন্নত হলেও শেষটা শুরুর মতো হয়নি। ভারতকোষের সূচনা হয়েছিল গুরুত্বের সঙ্গে, কিন্তু শেষ হয়েছিল কোনোমতে সংক্ষেপে নমঃ নমঃ করে। এ রকম ব্যর্থপ্রায় নজির থাকা সত্ত্বেও সিরাজ বাংলাপিডিয়া প্রকাশের উদেযাগ নিয়েছিলেন এবং তাতে সাফল্যের পতাকা উড়িয়েছিলেন। এই এনসাইক্লোপিডিয়া রচনার জন্য তিনি কয়েক শ পণ্ডিতকে একত্র করেছিলেন। যে দেশে পণ্ডিতদের অনেকেই কাজের থেকেও হাঁকডাক বেশি ছাড়েন, সেই অনুৎসাহী পণ্ডিতদের একত্র করে তাঁদের দিয়ে লিখিয়ে নেওয়াই একটা বিশাল কৃতিত্ব। তিনি সেই এনসাইক্লোপিডিয়া প্রকাশ করেন ১৯০৩ সালে।
একই সঙ্গে এই এনসাইক্লোপিডিয়া তিনি প্রকাশ করেছিলেন ইংরেজি এবং বাংলা—এই দুই ভাষায়। সেখানেই শেষ নয়, বিনা মূল্যে তা পাওয়া যায় ইন্টারনেটে আর ১০০ টাকার চেয়েও কম দামে পাওয়া যায় সিডিতে। কেবল তাই নয়, তিনি কিশোরদের জন্য এই একই এনসাইক্লোপিডিয়ার একটি সংস্করণের কথা চিন্তা করেন। প্রকাশের পর দেখতে না দেখতেই বাংলাপিডিয়ার প্রথম মুদ্রণের সব কপি শেষ হয়ে যায়। তারপর তা একাধিকবার মুদ্রিত হয় এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হচ্ছে তার পরিবর্ধিত এবং সংশোধিত সংস্করণ।
সিরাজুল ইসলামের উদ্যোগে এশিয়াটিক সোসাইটি গর্ব করার মতো আরও প্রকাশ করেছে ২৮ খণ্ডে ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা নামে আমাদের গাছপালা আর ফুলের এনসাইক্লোপিডিয়া। এও তাঁর অমর কীর্তি হয়ে থাকবে। তাঁর আরেকটি অসাধারণ কাজ হলো ১১ খণ্ডে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি এনসাইক্লোপিডিয়া। তাঁর সর্বসাম্প্রতিক কাজ হলো ঢাকা নগরের ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ইংরেজি-বাংলায় ২০ খণ্ডে প্রকাশিত ঢাকার চার শো বছর। এই গ্রন্থমালা তিনি লিখিয়েছেন ২০০ পণ্ডিত ব্যক্তির অবদান দিয়ে।
বছর দেড়েক আগে তিনি যে প্রকল্প হাতে নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন, তাহলো: বাংলা ভাষা থেকে অন্য ভাষায় এবং অন্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় কম্পিউটারের মাধ্যমে অনুবাদ করার পদ্ধতি নির্মাণের। ইন্টারনেটে পড়তে গেলে অন্যান্য ভাষায় যেসব তথ্য দেখা যায়, সেসব ভাষা জানা না থাকায় আমরা তা বুঝতে পারি না। আবার ওই সব ভাষাভাষীরাও বাংলা বুঝতে পারেন না। অথচ বাংলা একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বৃহৎ আন্তর্জাতিক ভাষা। সে জন্য কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয় অনুবাদের ব্যবস্থা অবশ্যই থাকা উচিত। সেই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজেই তিনি হাত দিয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রকল্পের তিনজন বিশেষজ্ঞ তিন দেশে চলে যাওয়ায় প্রকল্পটি আপাতত স্থগিত রাখতে হয়েছে।
কয়েক দিন আগে ঢাকায় এক বাড়িতে খানা তখনো হয়নি, পিনার সময় সিরাজের কথা উঠতেই এক অধ্যাপক বললেন, কত ভুল আছে বাংলাপিডিয়ায়। অন্যের কীর্তিকে ছোট করে দেখা আমাদের মজ্জাগত। সিরাজ নিজের হাতে সবটা লেখেননি, এর দায়দায়িত্বও তাঁর একার নয়। প্রসঙ্গত, তাঁর বাংলাপিডিয়া আর সংস্কৃতিকোষ-এর একজন সম্পাদকের কথা মনে পড়ছে, যিনি ‘অ্যানসেস্টর ওয়ারশিপে’র অর্থ করেছিলেন, ‘পূর্বপুরুষরা যে পদ্ধতিতে পূজা করতেন।’ এই পণ্ডিতদের নিয়েই তাঁর কাজ করতে হয়েছে। সুতরাং কাজের গুণগত মান সর্বত্র সমান হয়নি। কিন্তু কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে।
আমরা বাঙালিরা কথা বলতে ভালোবাসি। চোদ্দ পুরুষের কল্পিত-গৌরব নিয়ে বীরদর্পে ভিন্ন মতাবলম্বীদের মাথা ফাটাই। কিন্তু কাজ করতে বললে কচ্ছপের মতো নিজেকে গুটিয়ে নেই। বিস্ময় লাগে যখন চিন্তা করি আমাদের মতো সেই কর্মবিমুখ লোকদের দিয়ে তিনি তাঁর পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত করলেন কেমন করে! একেই বলতে পারি অসাধ্য সাধন। তিনি কী করে এটা করলেন, সেই রহস্য জানার জন্য আমি কৌতূহল প্রকাশ করেছিলাম।
তিনি বললেন, তিনি একাকী নন, সবাইকে একত্র করে কাজ করতে পছন্দ করেন—সমমনা ও বিমনাদের সবাইকে। তা ছাড়া, তিনি কাজ করার জন্য সরকারি অর্থের দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকেন না। তিনি জানেন, চেষ্টা করলে ভালো কাজে সাহায্য করার লোকের অভাব নেই। সে রকমের ব্যক্তি এবং নানা প্রতিষ্ঠানের সহায়তা নিয়েই তিনি বাংলাপিডিয়া, ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা, কিশোরদের বাংলাপিডিয়া, সাংস্কৃতিক জরিপ, বাংলাদেশের ইতিহাস, চার শো বছরের ঢাকা—সবই লিখিয়েছেন, সবই প্রকাশ করেছেন। যেহেতু সমবেত চেষ্টার কাজ, সে জন্য কেউ কেউ মনের মধ্যে খানিকটা আপত্তি নিয়ে হলেও কাজটাকে নিজেদের বলে গণ্য করেছেন। সিরাজ কাজে বাধা পেয়েছেন কম। তাঁর কাজে ভুল করার লোক ছিল অল্পই। আমরা স্বভাবতই কাজ না করলেও অন্যে যাতে কাজ করতে না পারে, তার জন্য যথাসাধ্য তৎপরতা দেখাই।
গবেষণা ও প্রকাশনার কাজ ছাড়া এশিয়াটিক সোসাইটিকে একটি বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে আগের কেউই এমন অসামান্য ভূমিকা পালন করেননি। যে প্রতিষ্ঠান অবস্থিত ছিল জাদুঘরের ১২ টাকা ভাড়ার একটি ঘরে, সেই প্রতিষ্ঠানের এখন সংরক্ষিত তহবিলেই আছে ২০ কোটি টাকা। আর প্রতিদিনের কাজ করার তহবিলে আছে পাঁচ-ছয় কোটি টাকা। এ টাকা সরকারি টাকা নয়। যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারি টাকায় চলে—রেলগাড়ি আর ডাকঘর থেকে শুরু করে গোটা দেশ—সবই চলে লোকসান দিয়ে। নিজেরা ব্যয় নিজেরা করতে পারে অথবা চলার মতো আয় করতে পারে না। সিরাজ তার ব্যতিক্রমধর্মী অত্যুজ্জ্বল একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সেটাকে টিকিয়ে রাখা কি সম্ভব?
এ প্রশ্ন করছি এ জন্য যে, পয়লা জানুয়ারি থেকে সিরাজ এশিয়াটিক সোসাইটির কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। এরপর তিনি নিশ্চয় তাঁর নিজের লেখাপড়ার কাজ চালিয়ে যাবেন। কিন্তু এশিয়াটিক সোসাইটি? ১৯৮২ থেকে ২৯ বছর এশিয়াটিক সোসাইটি বললে সিরাজকে মনে হতো আর সিরাজুল ইসলাম বললে এশিয়াটিক সোসাইটিকে মনে পড়ত। অতঃপর এই বিরাট প্রতিষ্ঠানটিকে চালানোর মতো এমন একজন লোককে কি পাওয়া যাবে, যিনি একাধারে পণ্ডিত ব্যক্তি এবং সংগঠক? কেউ কি ধরে রাখতে পারবেন এই প্রতিষ্ঠানকে? এই প্রতিষ্ঠানের গৌরবকে? এই প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডকে?
২৮ অক্টোবর সিরাজের জন্মদিন। তিনি যে বয়সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে এশিয়াটিক সোসাইটিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার সর্বোচ্চ শিখরে, সে বয়সে আমাদের দেশে অনেকেই বানপ্রস্থে যান এবং মালা জপতে জপতে নিজেদের দিন গুনতে থাকেন। সিরাজ অঘটনঘটনপটীয়ান। সমগ্র জাতির তরফ থেকে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত তাঁর কৃতী ও কীর্তির জন্য। জয়তু সিরাজ!
গোলাম মুরশিদ
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৮, ২০১১
Ashek Ullah
We are proud for him and pray peaceful long life .