আবদুল্লাহর পিতা ওয়ালীউল্লাহ্ পীর-বংশের সন্তান। আগে অনেক মুরিদান ছিল; কিন্তু কালক্রমে মুরিদানের সংখ্যা কমে যাওয়ায় পূর্বপুরুষদের মতো নবাবি হালের পরিবর্তে নিদারুণ দৈন্যদশায় দিন কাটাতে হচ্ছিল। এককালে ঐশ্বর্য ও সম্ভ্রম থাকলেও এখন নিতান্ত দরিদ্র, বলতে গেলে ভিক্ষা-উপজীবী।
আবদুল্লাহর বিয়ে অনেক দিন আগে হয়েছিল। তার শ্বশুর সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস পিতার আপন খালাতো ও মায়ের ফুফাতো ভাই। আবার সেই ঘরে শ্যালক আবদুল কাদিরের সঙ্গে একমাত্র বোন হালিমার বিয়ে আবদুল্লাহর পিতামহীর জীবদ্দশায় তাঁর আগ্রহেই সম্পন্ন হয়েছিল। যদিও আবদুল কুদ্দুসের এই বৈবাহিক সম্বন্ধে আপত্তি ছিল, কিন্তু মায়ের সনির্বন্ধ অনুরোধ এড়াতে পারেনি বলেই এই বিয়ে হয়েছিল। আবদুল্লাহর শ্বশুর মধ্যবিত্ত হয়েও তাঁর মধ্যে বড়লোকি আত্মম্ভরিতা বিরাজমান ছিল। তাই কন্যা সালেহাকে শ্বশুরালয়ে বেশি দিন রাখতেন না। এমনকি আবদুল্লাহর পিতার কঠিন অসুখ শুনেও তিনি পুত্রবধূ ও কন্যাকে পাঠাননি, এমনকি মৃত্যুর পরেও।
আবদুল্লাহর পিতা ওয়ালীউল্লাহ্ পুত্রকে প্রথমে মাদ্রাসায় দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজি না শিখতে পারলে দুরবস্থা ঘুচবে না। তাই আবদুল্লাহ যখন মাদ্রাসায় ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলো, তখন তাকে বাধা দেননি। অথচ তার শ্বশুর সৈয়দ সাহেব ইংরেজি শিক্ষাকে খুব সুনজরে দেখেননি। উপন্যাসে তাই দেখি, ‘…তোমাকে ইংরেজি পড়তে দিয়ে তোমার বাপ বড়ই ভুল করেছিলেন—এখন বুঝে দেখ বাবা, খোদাতালার ইচ্ছে নয় যে তুমি ওই বেদীনী লোভে পড়ে দীনদারী ভুলে যাও।’ এমনকি পুত্র আবদুল কাদির মাদ্রাসায় পড়তে তার অমত পোষণ করে ইংরেজি পড়ার ব্যাপারে অটল মনোভাব ব্যক্ত করে, তখন তিনি তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে দ্বিধা করেন না।
প্রগাঢ় শরাফতি অহমিকায় তিনি মনে করতেন, ‘যারা শরীফজাদা তাদের উচিত দীন ইসলামের উপর পাকা হয়ে থাকা। ইংরেজি পড়া, কি চাকরি করতে যাওয়া ওসব দুনিয়াদারী কাজে ইমান দোরস্ত থাকে না…।’ তাই বাড়ির মহিলাদের এক কোরআন ও ইসলামি পাঠ ছাড়া অন্য কিছু বরদাশত করতেন না। সালেহা তার পিতার খুব অনুগত ছিল এবং শৈশব থেকে তাঁকে অনুকরণ করে আসছে। পিতার মতো সেও মনে করত, ‘ইংরেজি পড়লে খোদার উপর আর লোকের তেমন বিশ্বাস থাকে না।’ পিতার রক্ষণশীল খানদানি আভিজাত্যের বলয়ে সালেহা পীরের মুরিদ হয়ে নিজেকে নামাজ ও ওজিফাতে দ্বিগুণ উৎসাহে নিয়োজিত রেখেছে।
সালেহা আবদুল্লাহর স্ত্রী, তাই উপন্যাসের নায়িকা। কিন্তু নায়িকা হয়েও পার্শ্বচরিত্র ছাড়া আর কিছু নয়।
পার্শ্ব চরিত্রেরও কখনো কখনো জোরদার ভূমিকা থাকে। যা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক যে কোন ক্ষেত্রেই হতে পারে। কিন্তু এখানে সালেহার উপস্থিতি কিংবা ভূমিকা নেই বলাটাই অনেকাংশে সত্য। যার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক সমাজ-সংসারে একদা নারীর অবস্থান কিরূপ ছিল সেটাই মূলত চিত্রিত করেছেন। সালেহাকে চিত্ররূপ দিতে গিয়ে মুসলিম সমাজে সেই সময়ের নারীর অবস্থান কেমন, সেটাই প্রাধান্য পেয়েছে। পরনের কাপড় ও দরজায় ইসলামি আদর্শের প্রতীকরূপে সবুজ বর্ণের রং। সমাজে নারী নিশ্ছিদ্র অবরুদ্ধে, তাই খোপকাটা জালের মতো শাড়ি। দরজার বন্ধ খড়খড়ির ভেতর দিয়ে বলতে চেয়েছি, ধর্মীয় চেতনা ও পিতার আভিজাত্যবোধের যূপকাষ্ঠে সে অন্তরীণ। স্বামী আছে কিন্তু স্বামীর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত দরজার একটা পাট খুলে প্রাণহীন সালেহা সজল করুণ দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে, ঘরের জানালার ওপরে ঝিনুকের মাঝের খোলায় কোরআনের আল্লাহ লেখা একটি ছবি। জানালায় লম্বালম্বি শিক, সেখানে সূর্যের রক্তিমাভা নিয়ে বাতাসে হালকাভাবে কেঁপে ওঠে পর্দা। সেই পর্দাও যেন লোহার শিকে আবদ্ধ। মেঝেতে জায়নামাজ বিছানো, ধর্মীয় আচার-নিষ্ঠায় সার্বক্ষণিকভাবে নিয়োজিত থাকার জন্য।
প্রসংগত, আবদুল্লাহ্ উপন্যাসে নায়িকা নেই। অবশ্য প্রচলিত অর্থে নায়কের প্রেম- জীবনের না হলেও দাম্পত্য জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে সালেহাই নায়িকা, কিন্তু নায়িকার ভূমিকা তার নয়। সে একজন সাধারণ নারী, একটি পার্শ্বচরিত্রের ঊর্ধ্বে সে ওঠেনি। তার কোনো হূদয়াবেগেরই পরিচয় পাওয়া যায় না, উপন্যাসের ঘটনা আবর্তনে তার ভূমিকা নগণ্য।
আবদুল্লাহ শিক্ষিত ও উদার। সে সংস্কারমুক্ত হয়ে বাঁচতে চায়। তাই তার স্ত্রী সালেহা যখন তাকে পায়ে ধরে সালাম করার জন্য নত হয়, তখন তাকে বাহুবেষ্টনে আবদ্ধ করে। সালেহা স্বামীর এরূপ আচরণকে মনে করে বেহায়াপনা, অন্যায়। সালেহা বলে, ‘আপনি বড় অন্যায় করেন।’ ‘আবদুল্লাহ চৌকির ওপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী অন্যায় করি?’
…সালেহা কহিল, ‘এই-এই-সালাম করতে দেন না আর কি! এতে যে আমার গোনাহ হয়।’ স্ত্রীর মুখে গোনাহর কথা শুনে আবদুল্লাহ বলে, ‘…আজকাল তোমার নামাজ আর ওজিফায় যে রকম বান ডেকেছে, তাতে হয়তো আমি ভেসেই যাব।…’
‘সালেহা অসহিষ্ণু হইয়া উঠিয়া কহিল, খোদার কাজ করতে আপনি মানা করেন?’ ‘আবদুল্লাহ কৃত্রিম ভয়ের ভাব দেখাইয়া দাঁতে জিভ কাটিয়া কহিল, তওবা তওবা, তা কেন করব? তবে কিনা সংসারের কাজও তো মানুষের আছে…’, ‘কেন, আমি নামাজ পড়ি বলে কি সংসারের কাজ আটকে যাবে?’ ‘নামাজ পড়লে আটকায় না বটে, কিন্তু অত লম্বা ওজিফা জুড়ে বসলে আটকায় বৈকি!…
কাজী ইমদাদুল হক আবদুল্লাহ্ উপন্যাসে লিখেছেন, ‘…কথাটা সালেহার ভালো লাগিল না। সে তাহার পিতার বড়ই অনুগত ছিল এবং শৈশব হইতে এ সকল ব্যাপারে তাঁহারই অনুকরণ করিয়া আসিতেছে। তাহার উপর আবার সম্প্রতি পীর সাহেবের নিকট মুরীদ হইয়া দ্বিগুণ উৎসাহে ধর্মের অনুষ্ঠানে আপনাকে নিয়োজিত করিয়াছে। তাহার বিশ্বাস জন্মিয়া গিয়াছে যে, এইরূপ কঠোর অনুষ্ঠানই পরকালে বেহেশত লাভের উপায়, ইহাই সর্বপ্রথম কর্তব্য।…সংসার সম্বন্ধে ইহার অধিক কোনো কর্তব্য আসিতে পারে না; তাই আজ তাহার স্বামী খোদার কাজ অপেক্ষা সংসারের কাজের গুরুত্ব অধিক বলিয়া মত প্রকাশ করিতেছেন মনে করিয়া সালেহা বিরক্ত, ক্ষুণ্ন এবং রুষ্ট হইয়া উঠিল। সে উষ্ণতার সহিত বলিয়া ফেলিল, হোক, তবু খোদার কাজ আগে, পরে আর সব।’
কাজী ইমদাদুল হক রচিত একমাত্র উপন্যাস আবদুল্লাহ্। ১৯৩৩ সালে রচিত এ উপন্যাস বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের সময়সীমায় প্রবাহিত মুসলিম জীবনবিশ্বাস এবং জীবন-যন্ত্রণার শিল্পিত ভাষ্য। আবদুল্লাহ্ এ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র। যিনি কুসংস্কার আর পীর-প্রথার বিরুদ্ধে সদা সোচ্চার। যাঁর জীবনদৃষ্টি ছিল অসাম্প্রদায়িক নতুন এক সমাজের। চরিত্রের এই মৌল আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিকের অন্তর্দৃষ্টি, প্রত্যয় ও প্রত্যাশার গভীর যোগসূত্র মেলে। উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে: ‘আশীর্বাদ করি, তোমরা মানুষ হও, প্রকৃত মানুষ হও—যে মানুষ হলে পরস্পর পরস্পরকে ঘৃণা কত্তে ভুলে যায়, হিন্দু মুসলমানকে, মুসলমান হিন্দুকে আপনার জন বলে মনে কত্তে পারে। এই কথাটুকু তোমরা মনে রাখবে ভাই,—অনেকবার তোমাদের বলেছি, আবার বলি, হিন্দু-মুসলমানে ভেদজ্ঞান মনে স্থান দিও না। আমাদের দেশে যত অকল্যাণ, যত দুঃখ-কষ্ট, এই ভেদজ্ঞানের দরুনই সব। এইটুকু ঘুচে গেলে আমরা মানুষ হতে পারবো—দেশের মুখ উজ্জ্বল কত্তে পারব।’
বাংলা সাহিত্যের প্রধান যে ১২ জন নারী চরিত্র নিয়ে ‘বাংলা সাহিত্যের নায়িকা’ শিল্পকর্ম সিরিজের সৃষ্টি। তার মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গৌণ চরিত্র হলো আবদুল্লাহ্ উপন্যাসের সালেহা। যার উপস্থিতি খুবই সামান্য। তবে স্বল্পসময়ের হলেও সালেহা এ উপন্যাসের প্রধান নারী চরিত্র। যিনি আবদুল্লাহ্র দয়িতা। সুতরাং উপস্থিতি গৌণ হলেও আবদুল্লাহ্র কাছে তাঁর অবস্থান হ্রস্ব নয়। আলোচ্য উপন্যাসের নারী চরিত্র প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক, গবেষক বিশ্বজিৎ ঘোষের মন্তব্য হলো: আবদুল্লাহ্ উপন্যাসে নারী আছে, কিন্তু কোন নারী-চরিত্র নেই যারা ব্যক্তিত্বে-প্রেমে-সংগ্রামে-সত্তায় সমুজ্জ্বল। কারণ একটাই, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুসলিম সমাজে নারীর ব্যক্তিত্ব-বিকাশের চরম অবরোধ। তবে এখানে লেখকের ব্যর্থতা ঢাকবার পুরোপুরি অবকাশ নেই, সালেহা-হালিমা বা রাবেয়ার বেশ কিছু পূর্বেই মোহাম্মদ নজিবর রহমানের (১৮৭৮-১৯২৩) শব্দস্রোতে আমরা পেয়েছিলাম ব্যক্তিত্বসচেতন আনোয়ারা চরিত্র—তারও ছিল একই সমাজপটভূমি।
আবদুল্লাহ্ উপন্যাসের পরিচ্ছদসংখ্যা ৪১ কাজী ইমদাদুল হক লিখেছেন প্রথম ৩০ পরিচ্ছেদ, বাকি ১১টি পরিচ্ছেদ লিখেছেন কাজী আনোয়ারুল কাদীর, যা পরিমার্জন ও পরিশোধন করেন কবি শাহাদাৎ হোসেন। কাজী ইমদাদুল হকের অসুস্থতাজনিত কারণ এবং মোসলেম ভারত (১৯২০) পত্রিকা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবদুল্লাহ্ শুধু কাজী ইমদাদুল হকের রচনা হয়ে থাকেনি। কিছুটা হলেও অন্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সেই অংশে আমরা দেখতে পাই, সালেহার মৃত্যু হয়েছে। নায়ক আবদুল্লাহ দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছে। তাঁর জীবনে এসেছে নতুন নারী মালেকা। এরই মধ্যে সৈয়দ সাহেব ও মীর সাহেবের মৃত্যু হয়। একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে। কিন্তু ঝড় ওঠেনা, আলোড়ন ও সৃষ্টি হয় না। উপন্যাসের মতো নয়, সবই ঘটে উপন্যাসের খসড়া সংক্ষিপ্তসারের মতো। অবশ্য একথা জানা যে, ইমদাদুল হক এই অংশের একটা সংক্ষিপ্তসার লিখে গিয়েছিলেন। এই খসড়ার কিছু কিছু সম্প্রসারণ করেছেন আনোয়ারুল কাদীর।
আবদুল্লাহ্ উপন্যাস পাঠান্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত ছিল এরকম: ‘দেখলুম যে ঘোরতর বুদ্ধির অন্ধতা হিন্দুর আচারে হিন্দুকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করেছে, সেই অন্ধতাই চাদর ত্যাগ করে লুঙ্গি ও ফেজ পরে মুসলমানের ঘরে মোল্লার অন্ন জোগাচ্ছে। এ কি মাটির গুণ? এই রোগবিষে ভরা বর্বরতার হাওয়া এদেশে আর কতদিন চলবে? আমরা দুই পক্ষ থেকে কি বিনাশের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরস্পর পরস্পরকে আঘাত ও অপমান করে চলব? লেখকের লেখনীর উদারতা বইখানিকে বিশেস মূল্য দিয়েছে।’
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ বারোটি উপন্যাসের নায়িকা চরিত্রের মধ্যে আবদুল্লাহ্র সালেহাকে আঁঁকতে গিয়ে আমি কিছুটা সমস্যায় পড়লেও অন্যরম মজা পেয়েছি। প্রথমে রীতিমত হতাশ ছিলাম। কেননা শুন্যের ওপর থেকে আমি কি করবো? পরে মনে হলো, একবারে শুন্য তো নয়, সামান্য হলেও ধারণা পাওয়া যায়। এর সঙ্গে আমি যুক্ত করলাম তখনকার সমাজ বাস্তবতা। কেমন ছিল ওই সময়ের নারীর জীবন ও সংসার। সবমিলিয়ে আমি সালেহাকে পূর্ণাঙ্গ অবয়বে আঁঁকতে পেরেছি। যার মধ্য দিয়ে উপন্যাস আবদুল্লাহ্র একটি নির্যাস রঙে ও রেখায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।
মুর্তজা বশীর
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২৮, ২০১১
Leave a Reply