‘ছবি আঁকার জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন আছে, তা আমি মনে করি না; শিল্পচর্চা একান্তই ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ’—এভাবেই শুরু করলেন শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী। শিল্পীর কাজের ধরন, আগ্রহের বিবিধ রকমফের আর সংগ্রহের বৈচিত্র্যই তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থিত: ছাপচিত্রের মেশিন, বিশেষ সুবিধাসংবলিত ডিজাইন টেবিল, বড় ইজেলে সাঁটানো তৈলচিত্রের জন্য প্রস্তুত ক্যানভাস, আর দেয়াল ঢেকে ফেলা বিশাল বইয়ের আলমারি।
শিল্পী এবং শিল্পের অবারিত স্বাধীনতায় তাঁর অগাধ বিশ্বাস।
বাবা শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর সান্নিধ্যে শিশুদের চেয়ে একটু বেশি ছবি আঁকার ক্ষেত্রে সুবিধা পেয়েছেন তিনি। সারাক্ষণই রং-ক্যানভাস-ব্রাশের মধ্যে ছোটাছুটি করে বেড়ে ওঠা। শৈশবের কিছু স্মৃতি এখনো আলোড়িত করে তাঁকে; বাবা দেবদাস চক্রবর্তী সব সময় বসে কাজ করতেন, চারপাশে সব রঙের টিউব এলোমেলো ছড়িয়ে থাকত। তিনি হয়তো কখনো বলতেন কোবাল্ট ব্লু বা প্রুশিয়ান ব্লুর টিউব খুঁজে দিতে। ‘আমি তখনো পড়তে শিখিনি। তবে রঙের নাম শুনে ঠিকমতোই খুঁজে বের করে দিতাম! অর্থাৎ আমার দেখার চোখ নিজের অজান্তেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল।’ এ ছাড়া তিনি শৈশবে পারিবারিকভাবে সান্নিধ্য লাভ করেন কবি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান আজিজুল হক, সিকান্দার আবু জাফর, চিত্রশিল্পীদের মধ্যে কামরুল হাসান, রশীদ চৌধুরী, কাজী আব্দুল বাসেত, কাইয়ুম চৌধুরী, মুর্তজা বশীর প্রমুখের। আর সে সময়ের রাজনৈতিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর মানস গঠনে। ‘চিন্তাভাবনায় আমরা স্বাধিকারের জন্য এবং একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য উদগ্রীব ছিলাম। আর বর্তমান সময়ে এ ধরনের পারস্পরিক সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এখন আমরা ইনডিভিজ্যুয়ালিটিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছি।’ এই আত্মকেন্দ্রিকতা সমাজকে, জীবন ধারণকে ক্রমেই জটিল করে তুলছে বলে মনে করেন তিনি।
নিজের ছবি আঁকার পরিপাটি পরিবেশটি তৈরি করে নিয়েছেন উত্তরায়। কোলাহলমুক্ত নিরিবিলি সবুজে ঘেরা একটি বাড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময়ই চোখে পড়ে বিভিন্ন শিল্পীর করা পেইন্টিং, স্কাল্পচার, মুখোশ, ড্রইংয়ের সমৃদ্ধ সংগ্রহ।
ঘরে ঢুকেই বিশাল খোলামেলা পরিসর। এক পাশে বসার আয়োজন, আর সারি সারি বইয়ের আলমারি। একটি দেয়ালে দেশের বিখ্যাত শিল্পীদের অঙ্কিত আত্মপ্রতিকৃতি আর ঘরজুড়ে শিল্পী গৌতম চক্রবর্তীর বিভিন্ন সময়ে আঁকা চিত্রকর্ম।
শিল্পীর ছাপচিত্রের প্রতি ভীষণ আগ্রহ রয়েছে। এক পাশে রয়েছে ছাপচিত্রের দুটি মেশিন।
এর পাশের ঘরেই ইজেল, ক্যানভাস, রং-তুলি আর কাগজের বড় বড় রোল। ছবি আঁকার সব ধরনের সরঞ্জামে পরিপূর্ণ চমৎকার একটি স্টুডিও। আর তার পাশের ঘরেই রয়েছে শিল্পীর গ্রাফিক্স ডিজাইনের কাজের জন্য পূর্ণ একটি আয়োজন। অর্থাৎ শিল্পীর যখনই যে মাধ্যমের প্রয়োগে শিল্প সৃজনের ইচ্ছা হয়, তার সুব্যবস্থা রয়েছে সর্বত্র। অধিকাংশ শিল্পীর জন্যই হয়তো ঈর্ষণীয় এই আয়োজন।
একটা ইন্টেলেকচুয়াল এক্সারসাইজের ভেতরে তাঁর শৈশবের সময়টা কেটেছে। পারিবারিক পরিবেশটা খুব সাধারণ ছিল না। তাঁর বেড়ে ওঠার পারিপার্শ্বিক আবহকে শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আগ্রহ তৈরির পশ্চাৎপট হিসেবে বিবেচনা করা যায়। ‘এটা খুব যে পরিকল্পনামাফিক তা নয়। আমার বাবা-মা কখনোই কোনো কিছু চাপিয়ে দেননি আমাদের। পরে ছবি আঁকাটাই মাথায় চেপে যায়। এমন হয়েছে যে বাবার কমপ্লিট ক্যানভাসে আমি নতুন করে ছবি এঁকেছি। কারণ, অনেক সময় খালি কোনো ক্যানভাস পাচ্ছিলাম না ছবি আঁকার জন্য।’
ফেলে আসা চমৎকার শিল্পিত অতীতের জন্য প্রায়ই স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠেন শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী। ছবি আঁকার মতোই একটি প্রশান্ত স্বদেশ ভেতরে লালন করেন তিনি। ক্রমাগত ভেঙে যাওয়া সম্পর্কগুলো মানুষকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে দিচ্ছে। সম্পর্কের উষ্ণতাই একমাত্র সুন্দর সমৃদ্ধ সমাজের ভিত্তি হতে পারে। ‘আমাকে বললে আমি সেই পুরোনো সময়টাকেই বেছে নেব। মানবিক সম্পর্কটা ভীষণ জরুরি। পশ্চিমের অনেক বিষয় আমরা অ্যাডাপ্ট করার জন্য আকুল হয়ে থাকি, তবে পশ্চিম তার অনেক বিষয় পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটা দিবস করে তারা পালন করে—বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, মা বা পরিবার দিবস; অথচ এখন তারাও পরিবর্তন চায়। না পাওয়া আর হাহাকার থেকেই তো এসব আসে।’
২০০৪ সালে শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী প্রতিষ্ঠা করেন ‘গ্যালারি কায়া’। শিল্প-শিল্পীর সঙ্গে জীবনকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়েই জীবনযাপন। প্রতিদিনের ব্যস্ততা কাটিয়ে যতটা সম্ভব মগ্ন থাকেন সৃজনশীলতার আনন্দময় ভুবনে।
শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী: জন্ম ১৯৬৫ সালে, ঢাকায়। ১৯৭৫ সালে ভর্তি হন শান্তিনিকেতনের পাঠ্যভবনে । পরে ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষে মায়ের মৃত্যু ও পারিবারিক নানা কারণে কলাভবনে পড়া ছাড়তে হয়। পরে ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বিএফএ সম্পন্ন করেন। এ পর্যন্ত দেশে-বিদেশে ছয়টি একক প্রদর্শনী এবং বহু যৌথ প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন।
সিলভিয়া নাজনীন
Leave a Reply