রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান: সম্পর্কের খতিয়ান
আখতার হুসেন
রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ: ভূঁইয়া ইকবাল \ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন \ প্রকাশকাল: মে ২০১০ \ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: জয়নুল আবেদিনের স্কেচ অবলম্বনে কাইয়ুম চৌধুরী \ মূল্য: ৫০০ টাকা
প্রয়াত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর এ-রকমের একটা উক্তি কোথায় যেন পড়েছিলাম, তাতে তিনি বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ যেদিন অবিভক্ত বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন, সেদিন থেকেই হয়েছিল বাঙালি মুসলমানের নবজাগরণের সূচনা। ফলে এই গ্রন্থের শুরুতেই যখন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এ কে ফজলুল হকের সেই ঐতিহাসিক বৈঠকের ছবিটি মুদ্রিত অবস্থায় দেখি, তখন যথেষ্ট খুশির কারণ ঘটে। এভাবেই আমরা প্রবেশ করি এই গ্রন্থের অন্দরমহলে।
আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ এবং রবীন্দ্রপাঠের গরিবিয়ানা সত্ত্বেও এ-রকমের একটা উক্তি করতে চাই যে, বঙ্গের বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়কে তাঁর সমকালে রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র বসুর মতো করে আর কেউ বুঝতে পারেননি। বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কগত সমস্যার শিকড়ের সন্ধান যে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন, ভূঁইয়া ইকবালের এই গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ের পরতে পরতে তার পরিচয় ধরা আছে। এই গ্রন্থেই তাঁর রচনাবলি থেকে চিত ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে যে চরম সত্য তিনি তুলে ধরেন, সেই সত্যই তো বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িকতার মূলে, যে সাম্প্রদায়িক ছুঁৎমার্গ তাদের অকৃত্রিম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতে দেয় না। রবীন্দ্রনাথ তাকেই অভিহিত করেন ‘অভ্যস্ত পাপ’ বলে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্যাধি ও প্রতিকার প্রবন্ধে উল্লিখিত সমস্যার কথা তুলে ধরে অকপটে বলেন, ‘আর মিথ্যা কথা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরোধ আছে। আমরা যে কেবল স্বতন্ত্র তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ।…
‘আমরা জানি, বাংলাদেশের অনেক স্থানে এক ফরাশে হিন্দু-মুসলমানে বসে না—ঘরে মুসলমান আসিলে জাজিমের এক অংশ তুলিয়া দেওয়া হয়, হুঁকার জল ফেলিয়া দেওয়া হয়।
‘তর্ক করিবার বেলায় বলিয়া থাকি, কী করা যায়, শাস্ত্র তো মানিতে হইবে। অথচ শাস্ত্রে হিন্দু-মুসলমান সম্বন্ধে পরস্পরকে এমন করিয়া ঘৃণা করিবার তো কোনো বিধান দেখি না। যদি-বা শাস্ত্রের সেই বিধানই হয় তবে সে শাস্ত্র লইয়া স্বদেশ-স্বজাতি-স্বরাজের প্রতিষ্ঠা কোনোদিন হইবে না। মানুষকে ঘৃণা করা যে দেশে ধর্মের নিয়ম, প্রতিবেশীর হাতে জল খাইলে যাহাদের পরকাল নষ্ট হয়, পরকে অপমান করিয়া যাহাদিগকে জাতিরক্ষা করিতে হইবে, পরের হাতে চিরদিন অপমানিত না হইয়া তাহাদের গতি নাই।’
উল্লিখিত উচ্চারণকেই আমরা বহুভাবে সত্যে পরিণত হতে দেখি রবীন্দ্রনাথের সমকালে এবং তাঁর মৃত্যুরও বহুকাল পরে। এবং এখনো নানাভাবে। যাঁরা জাত রবীন্দ্রবিরোধী, তাঁদের কি রবীন্দ্রনাথের এই উচ্চারণ থেকে একটুও শিক্ষা নেওয়ার নেই?
রবীন্দ্রনাথ কতভাবে যে পিছিয়ে পড়া মুসলমান সম্প্রদায়ের সমীপবর্তী হওয়ার চেষ্টা করেছেন, ভূঁইয়া ইকবালের এই সম্পাদিত গ্রন্থ যেন তারই বিবরণ-ঠাসা লৈখিক-আধার। গ্রন্থের প্রথম ভাগে আছে মুসলমান প্রসঙ্গে ও মুসলমান সম্পাদিত সাময়িকপত্রে কবির নানা রচনা, দ্বিতীয় ভাগে আছে কবির উদ্দেশে ও তাঁকে লেখা মুসলমানদের চিঠিপত্র, নিবেদিত কবিতা, স্মৃতিকথা, মানপত্র, বক্তৃতা, শুভেচ্ছাবার্তা ও কবি সম্পর্কে সাময়িকপত্রে ব্যক্ত প্রতিক্রিয়া।
ইকবালের এই গবেষণাগ্রন্থ সূত্রেই আমরা জানতে পারি, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে ৩০টিরও বেশি প্রবন্ধ লিখেছেন। সম্পাদক জানিয়েছেন, কলেবর-স্ফীতির কথা ভেবে এই গ্রন্থে তার সমুদয় পরিচয় তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। উপন্যাস, ছোটগল্প এবং একটি নাটিকাতেও এই জটিল সম্পর্ক বিষয়ে তাঁর যে মত ব্যক্ত করেছেন কবি, তা-ও সংকলিত করা থেকে একই কারণে বিরত থেকেছেন তিনি। গ্রন্থের দ্বিতীয় ভাগে আছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুসলমান শিক্ষিত মধ্য ও উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের যোগাযোগ-সংক্রান্ত তথ্য। আছে কবিকে নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ, তাঁর সম্পর্কে মুসলমানদের মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া এবং তাঁকে লেখা তাঁদের চিঠিপত্র। ১৮ জন চারণ করেছেন কবির স্মৃতি। আছে মুসলমানদের সঙ্গে কবির যোগাযোগ-সংক্রান্ত একটি ক্রমিক বিবরণপঞ্জি। আছে চিত্রসূচি। তার সংখ্যাও কম নয়।
ভূঁইয়া ইকবালের ‘পূর্বলেখ’ শিরোনামের ভূমিকা যেমন স্বাভাবিকভাবে এই গ্রন্থের গুরুত্ব তুলে ধরেছে, তেমনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের নাতিদীর্ঘ ভূমিকাটিও হয়ে উঠেছে এই সংকলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মনে হয়েছে, তার ভূমিকাটি সংযোজিত না হলে যেন সংকলন গ্রন্থটি অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
আর যে যা-ই বলুক, আমি বলব, গবেষক-প্রাবন্ধিক, ভূঁইয়া ইকবালের ‘রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’ একটি বহুল পরিশ্রমলব্ধ কাজ এবং এই গ্রন্থের সম্পাদনা তাঁকে অবিস্মরণীয় করে রাখবে। অভিনন্দন ভূঁইয়া ইকবাল।
Leave a Reply