সব পাখি ঘরে ফেরে : আহমদ রফিক, জানুয়ারি ২০০৭, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, প্রচ্ছদঃ অশোক কর্মকার, ৯৪ পৃষ্ঠা, ১০০ টাকা
লিখিত সব বাক্যই সাহিত্য হয়ে উঠতে পারে না। আবার সাহিত্যের প্রচলিত যে শ্রেণীকরণ-সবকিছু সেই মানদণ্ডে বিবেচিত হবে, এমনও নয়। বরং সাহিত্যের প্রচল শ্রেণীবিন্যাসের বাইরে আরও কিছু খোলা জানালা আছে, যেখান থেকে কখনো কখনো মৃদুমন্দ হাওয়া আসে; এবং হাওয়া আসে গঠনবৃত্ত ভেঙেই। বৃত্তের ভাঙন থেকেই গঠিত হয় নতুন বৃত্ত। তবে কোনো গ্রন্থকে যদি রচয়িতা একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীবদ্ধ করে তোলেন, তখন সেই বৃত্তভাবনা মাথায় না রেখে উপায় কী! তার পরও মাধ্যমের খোলস জড়িয়েই কোনো কোনো বই নির্দিষ্ট মাধ্যমকে ছাড়িয়ে যায়-বৃত্ত ভেঙে ফেলতে চায়। আহমদ রফিক রচিত সব পাখি ঘরে ফেরে এমনই একটি বই। গ্রন্থের সূচনা অংশে লেখক জানিয়ে দেন-‘গল্প-উপন্যাসের আদলে লেখা হলেও এ রচনা ঠিক উপন্যাস নয়, নয় ব্যক্তিবিশেষের জীবনচরিত বা জীবনকথা; বরং বলা যেতে পারে, এটা বিশেষ প্রেক্ষাপটে রচিত ব্যক্তিকাহিনীর খণ্ডচিত্র; এবং এ ছাড়া রয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রধর্মী ঘটনাবলির চালচিত্র।’ কিন্তু গ্রন্থের শেষ বাক্যে পৌঁছে সব পাখি ঘরে ফেরে ‘ব্যক্তিকাহিনী’কে স্পর্শ করেই ব্যক্তির বৃত্তকে ভেঙে ছুঁয়ে গেছে সমাজ-মানসের বৈচিত্র্যময় অলিগলি।
বইয়ে লেখকের নিজের ব্যক্তিজীবনের ঘটনাপ্রবাহ উপস্থাপিত হয়েছে চরিত্রের নাম বদল করে। কাহিনীর কুশীলবেরা যেহেতু আহমদ রফিকের চেনা মহলের বাসিন্দা, ফলত লেখক গ্রহণ করেছেন এই আড়ালচারিতা। ‘কী আশ্চর্য, আপনি এমন করছেন কেন?’ জিজ্ঞাসাসূচক বাক্যটির মাধ্যমে শুরু হয়েছে কাহিনীবৃত্ত। এরপর লেখক বর্ণনা করেছেন তাঁর স্ত্রীর অ্যাস্টোসাইটোমা গ্রেড ফোরে আক্রান্ত হওয়া এবং তার পরবর্তী হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটে বেড়ানোর বৃত্তান্ত। লেখকের বর্ণনায় এই কাহিনীর নায়িকা সীমা এবং নায়ক আশিক। এদেরকে ঘিরে রয়েছে আরও কিছু চরিত্র-রিমা, মনীষা, রাহুল, ডা· শরিফ, ডা· শাহিন, ডা· তানিম, তরী, জরী···। মোটকথা, সীমাকে কেন্দ্র করেই যেন এসব চরিত্র বেড়ে ওঠে।
সব পাখি ঘরে ফেরের প্রথম পর্বে সার্জারির উদ্দেশ্যে সীমাকে একটি আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। লেখকের ভাষ্যে-‘নতুন হাসপাতালটা শহরের প্রায় কেন্দ্রস্থলে। প্রবল শব্দদূষণ আর বায়ুদূষণের পরিবেশে একটি আধুনিক চিকিৎসার হাসপাতাল।’ শ্লেষটা কিন্তু প্রথম থেকেই টের পাওয়া যায়। চিকিৎসা-ব্যবস্থাপনা তথা হাসপাতালের পরিবেশ, পেশাদারি, সেবার মান প্রভৃতি প্রসঙ্গে বইটিতে রয়েছে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন। আর এভাবেই দেশের অত্যাধুনিক হাসপাতালগুলোর বিজ্ঞাপনি আলোর নিচে আঁধারের খেরখাতা, যে অন্তঃসারশূন্যতা সে সবও চোখের আলোয় ধরা পড়ে। হাসপাতালের সুকঠিন নিয়মাবলির ফোকর গলে যে ‘ফসকা গেরো’ বিদ্যমান, তার চিত্র আঁকতে লেখক তুলে ধরেন-‘সংরক্ষিত এলাকায়ও, আশিক অবাক হয়ে দেখে, মেয়ে পুরুষ শিশু চিৎকার করে কথা বলছে, সেই সঙ্গে মোবাইলে সশব্দ আলাপ। মনে হয় যেন জমজমাট মেলা। এ নিয়ে প্রশ্ন করে যে জবাব পেয়েছে, তা-ও বড়ো অদ্ভুত। আশিকের মনে হয়েছে কারণটা বাণিজ্যিক, বেশি কড়াকড়িতে রোগী কমবে, লাভের গুড় নিয়মনীতিতে খেয়ে নেবে।’ এর পাশাপাশি আমাদের হাসপাতালগুলোর বাণিজ্যের আরেকটি নমুনাও অস্পষ্ট থাকে না-‘এ হাসপাতালে লাভের কতো দরোজা যে খুলে রাখা হয়েছে, ভাবতে পারবেন না। নিচের ফার্মেসি তার একটা নমুনা।’ বাণিজ্য প্রসঙ্গে রয়েছে আরও শ্লেষোক্তি-‘তাই বলে ভাববেন না, আমাদের ক্লিনিক বা প্রাইভেট হাসপাতালগুলো এদিক থেকে ধোয়া তুলসীপাতা। যে যেমন পারে নিংড়ে নিচ্ছে। এ ক’বছরের মধ্যে কতগুলো হাসপাতাল বাজারে এসেছে দেখেছেন?’ প্রশ্নচিহ্নটা ভাবতে বাধ্য করে। সব পাখি ঘরে ফেরে এ রকম অসংখ্য জিজ্ঞাসাবিন্দু পাঠকের সামনে উ্নোচন করে আজকের করপোরেট দুনিয়ার কঙ্কাল। একজন গল্পকার-ঔপন্যাসিকের আড়ালে আহমদ রফিকের সমাজ-বিশ্লেষণের যে ক্ষমতা, সেটি এ গ্রন্থের অনন্য প্রাপ্তি। তাই লেখক যখন চিকিৎসকদের প্রসঙ্গে বলেন-‘কেন যে এ দেশের মননশীল চিকিৎসকেরাও তাদের মোটা মোটা কেতাবের বাইরে কোনো পড়ার জিনিসে হাত দেয় না! অথচ পশ্চিমা দেশে তো ব্যাপারটা একেবারে ভিন্ন।’ তখন আমাদের বর্তমান সমাজ-বাস্তবতায় উক্তিটির যথার্থতা অস্বীকারের উপায় থাকে না।
সব পাখি ঘরে ফেরেতে শুধু চিকিৎসা-কাঠামোর চালচিত্র নয়, বিধৃত আছে এমন এক ঢাকার চিত্র- যখন রাজধানীর অনেকাংশে ছিল উপশহরের আবহ। ‘সিদ্ধেশ্বরী-মালিবাগ-খিলগাঁ-মগবাজারে গাছপালার ঘের, হালকা গন্ধে ভরা বুনো ঝোপ, গাছগাছালির ছায়ায় কাঁচা মাটির পথ ধরে চলতে গিয়ে মনে হয়েছে উত্তর ঢাকা যেন তার বহুকালের চেনা প্রাকৃত তরুণী।’ এই ‘প্রাকৃত তরুণী’, ঢাকার মায়াবী বর্ণনায়, সেকালের ঢাকার আলো গন্ধে ম-ম করছে সব পাখি ঘরে ফেরের পৃষ্ঠা। ফলে ইতিহাসে আগ্রহীরাও এর থেকে জুটিয়ে নিতে পারেন নিজস্ব খোরাক। তবে এ ইতিহাস রচিত হয়েছে সাহিত্যের আলোকমালায়; যে কারণে তা শুধু ইতিহাসের খাঁচায় আবদ্ধ না থেকে পেয়েছে সাহিত্যের মায়াবী বিস্তার।
অন্যদিকে বাঙালি মুসলমানের সংশয়-দোলাচলকেও লেখক স্পর্শ করেছেন-‘এদের কেউ কেউ প্রার্থনায় বিশ্বাসী, নিঃশব্দে দোয়া দরুদ পড়ে।’ কিংবা ‘তাই আরেক নিরীহ প্রশ্নের জবাবে বিশেষজ্ঞ সার্জন যখন জবাব দেন-দ্যাখেন তাবিজ-কবজ দিয়ে কিছু হয় কি না’, তখন চরম সংকটমুহূর্তে মুসলমান মন, এমনকি বিজ্ঞানমনস্ক মুসলমান মনের বৈপরীত্য বর্ণনা প্রসঙ্গে আশিকের মুখে লেখক আহমদ রফিক জুড়ে দিয়েছেন একটি প্রশ্নসূচক বাক্য-‘এমন জবাব আশা করেনি কেউ?’ লেখকের মনোভঙ্গিতে এখানেও কি দোলাচল উপস্থিত?
সব পাখি ঘরে ফেরে শুরু হয়েছে সীমার ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে, শেষ হয়েছে মৃত্যুদৃশ্যে-‘সন্ধ্যার পাখির মতো সীমার স্বজনেরা এখন ঘরে ফিরবে। কিন্তু ফিরবে না এক সময়ের প্রাণবন্ত সীমা।’ এর মাঝে যে শূন্য স্তর, সেখানে সীমার সঙ্গে আশিক অর্থাৎ লেখকের পরিচয় প্রণয়-দিনযাপন-সবকিছুই বিবৃত। গ্রন্থটি পড়তে পড়তে ব্যক্তিগত দ্মৃতি আলেখ্যের আড়ালে, কখনো একে মনে হতে পারে ইতিহাসের সেলুলয়েড, কখনো এখানে লভ্য সমাজের নির্মোহ বিশ্লেষণ, আবার গল্পের বাক্ভঙ্গিও দৃশ্যমান। ফলে, যদিও এই ব্যক্তিকাহিনীর খণ্ডচিত্র গল্প-উপন্যাসের আদলে রচিত; তার পরও একে সাহিত্যের প্রচল মাধ্যমের বাইরে ভিন্ন কোনো নামে ডাকতে পারেন পাঠক।
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০০৮।
আকাশ নিল
আমি লজ্জাতুন নেসা বই চাই