বদরুজ্জামান আলমগীর রচিত ও কামালউদ্দিন কবির নির্দেশিত অহরকণ্ডল নিয়ে সেলিম আল দীন লিখেছেন যে কথাগুলো বলা উচিত। নিচে তাঁর ডায়েরির অংশবিশেষ
যে কথাগুলো বলা উচিত
লোকায়ত জীবনের মধ্যে খানিকটা বাইবেলের ফিউশন-অহরকণ্ডল। বাকিটা ছড়া-প্রবচন-ধ্রুপদী শব্দের ঘন গম্ভীর ধ্বনি। বাংলা নাট্যের সীমায় এ খুব অবাক হওয়ার মতো কাজ। নাট্য-ভূমিকায় লেখক যা বলেন তাতে তাঁর শিল্পভাবনার কৌশলটা বেশ বুঝতে পারা যায়। চরিত্রের নির্বিশেষকরণের বাড়তি প্রয়াস যে ওটা তাতে সন্দেহ নেই।
অহরকণ্ডলের গল্পটি আমাকে প্রথম শুনিয়েছিল নাসির উদ্দীন ইউসুফ। শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। দীনপুণ্য বাংলা নাট্যে এ রকম কেউ ভাবে নাকি-বলে নাকি-লেখে নাকি?
তারপর কামালউদ্দিন কবির আমাকে অহরকণ্ডলের পাণ্ডুলিপি পড়তে দেয়। লেখাটি পড়তে পড়তে দেখতে পাই কথকের বলার ভঙ্গিতে বিচিত্র সব চিত্র-উড়ে আসে কি মাটি ফুঁড়ে বেরোয়। ঘটনা-চরিত্রের মনোভঙ্গি-ইঙ্গিত-দ্ব্যর্থবোধকতা-সব মিলিয়ে অবাক হওয়ার মতো লেখা।
বুঝতে পারা যায়, বাংলা নাটক চলনে-বলনে আর উপনিবেশকালের শাসন অগ্রাহ্য করছে সচেতন শিল্পরীতির মাধ্যমে, যে রীতিটা উঠে এসেছে আবহমানকালের ধারায়-প্রাচীন ও মধ্যকালের বাংলা থেকে। তবে তাতে পাশ্চাত্য শিল্পরীতির ন্যায্য অংশটুকুই গৃহীত হয়েছে-বিশ্বসংস্কৃতির আধুনিক প্রবাহের ধারায়।
বর্ণনাত্মক বাঙলা নাটক যে বিশ্বনাটকের শিল্পযাত্রায় এক নতুনতর সংযোজন সে বিষয়ে আর সন্দেহ থাকে না, যখন দেখি আমাদের একদিনের ক্ষীণ-ভীরু চেষ্টাটা আজ বৃহত্তর শিল্পমণ্ডলবর্তী। একদিন নিজের রচনার ভিতরে নিঃসঙ্গের মতো নির্জনে বসবাস করতাম। আজ দেখি সেই চেষ্টা কতই না বিচিত্রতর ভিন্নধারায় বাহিত হচ্ছে।
রবীন্দ্রোত্তরকালে বাঙলা কবিতা ও উপন্যাসের চেয়েও বাঙলা নাটক নবতর অথচ ভূমিজ এবং অনঔপনিবেশীয় আঙ্গিকচেতনায় উদ্বুদ্ধ সে বিষয়টি সুস্পষ্ট ভাষায় বলা সংগত।
অহরকণ্ডল আমাদের নাট্যভাষায় এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ নাটকের পরিচালককে এ জন্য ভাষাপারিতোষিক দেই যে তিনি বলার ভঙ্গিটাকেই থিয়েটারে দাঁড় করাতে সমর্থ হয়েছেন। একটা নতুন থিয়েটার সৃষ্টির অঙ্গীকার না থাকলে অহরকণ্ডলকে মঞ্চে তুলে আনা সম্ভব হতো না।
পাশ্চাত্য নাট্যধারার বিশাল থাবার নিচে আমাদের এ সকল প্রয়াস-একদিন ভূমিভেদী বৃক্ষরূপে দাঁড়াবেই-এই বিশ্বাসে নিরন্তর নিজবীজ প্রোথিত করি বাঙালির শিল্পভূমিতে।
৩ মে ২০০৬
সূত্রঃ প্রথম আলো, জানুয়ারী ১৮, ২০০৮।
Leave a Reply