বিশ শতকের সূচনায় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতে বঙ্গভঙ্গ একটা ঐতিহাসিক ঘটনা। যার পক্ষে বিপক্ষে সংগঠিত হয় নানা জনমত। সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক উত্তাপ। অবশেষে ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর রদ হয় বঙ্গভঙ্গ। শতবর্ষ আগের সেই ঘটনার নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ উঠে এসেছে এই লেখায়।
বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত আকস্মিক বা প্রস্তুতিবিহীন উদ্যোগ ছিল না। বাংলা প্রদেশের বিশাল আয়তনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান প্রশাসনিক সমস্যা পরিস্থিতিকে ক্রমেই জটিলতর করে তুলেছিল। বিষয়টির জটিলতা নিয়ে ১৮৫৪ সাল থেকেই ঔপনিবেশিক সরকারের ভাবনা ও উদ্যোগের সূত্রপাত ঘটে। ধারাবাহিকভাবে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে বিভিন্ন প্রস্তাব, সুপারিশ ও মতামত পরবর্তী ৫০ বছরে গ্রহণ করা হলেও ফলপ্রসূ কোনো বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বাংলার সীমানা পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক সংস্কারের বিষয়টি তৎকালীন ভাইসরয় কার্জনের নজরে এলে আমলাতন্ত্রের দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে তাঁর বহুল কথিত ‘রাউন্ড অ্যান্ড রাউন্ড’ নোটটির পর শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ বাস্তবায়নের কার্যক্রম। ‘অক্লান্তকর্মা’ ভাইসরয় অতঃপর বাংলা বিভাগের পক্ষে জনমত তৈরির উদ্দেশ্যে শুরু করেন তাঁর পূর্ববাংলা সফর। সফরের শুরুতেই কার্জন আসেন ময়মনসিংহে। মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্ত আচার্যের আতিথ্য গ্রহণ করলেও মহারাজা বাংলা ভাগের প্রশ্নে অপারগতা জ্ঞাপন করেন। ঢাকায় নবাব সলিমুল্লাহর সমর্থন এককথায় পাওয়া যায়নি। ইংরেজ আমলাদের যথেষ্ট কাঠখড় পোহাতে হয়। সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে নবাবের সমর্থন লাভ করতে হয়। ঢাকার নবাবের সমর্থন পেলেও পূর্ববঙ্গের তৎকালীন মুসলিম সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক গুরুত্বকে সম্যক বুঝে উঠতে পারেনি। বিষয়টির গুরুত্ব বোঝার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে ওঠেনি। তাদের তরফ থেকে বাংলা ভাগের বিষয়ে কোনো দাবি বা প্রস্তাবও উত্থাপন করা হয়নি; বরং প্রাথমিক পর্যায়ে বাংলা বিভাগ নিয়ে পূর্ববঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায় দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল। বলা যায়, তাদের অবস্থান ছিল বাংলা ভাগের বিপক্ষেই। তবে রাজনৈতিক কারণে নয়, গৌণ কারণেই তাঁরা বাংলা ভাগের বিষয়টিকে বিবেচনায় এনে শঙ্কিত হয়েছেন। স্বয়ং সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গের বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে উৎসাহী সমর্থক ছিলেন না। চট্টগ্রামের সিরাজুল ইসলাম চিন্তিত ছিলেন, আসামের সঙ্গে পূর্ববঙ্গ যুক্ত হলে তাঁদের ‘সরাফত’ বা ‘খানদান’ ক্ষুণ্ন হবে। পক্ষান্তরে ঢাকার কাজেমউদ্দীন সিদ্দিকী বাংলা বিভাগের ফলে মহসীন ফান্ডের টাকা থেকে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা বঞ্চিত হতে পারে বলে শঙ্কিত ছিলেন। উল্লিখিত বিষয়গুলোর কোনোটিই রাজনৈতিক নয়। ফলে ১৯০৪ সালে কার্জনের জনসংযোগ সফরের পর পরিস্থিতির গুণগত পরিবর্তন ঘটে। সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পূর্ববাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের মূল অংশ একত্র হয়। কার্জনই তাদের একত্র হওয়ার জন্য উজ্জীবিত করেন। বাংলা ভাগের বিপক্ষেও মুসলমান সম্প্রদায়ের কেউ কেউ অবস্থান নেন। যেমন, টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারের জমিদার আবদুল হালিম গজনবী বা ফরিদপুরের জমিদার আলিমুজ্জামান। পেশাজীবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুল রসুল ও সৈয়দ শামসুল হুদা। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। তাঁরা মুসলিম জনমত তাঁদের পক্ষে আনতে পারেননি। মূল মুসলিম সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গ বা বঙ্গভঙ্গ-পরবর্তী সময়ে তাদের সমর্থন কংগ্রেস বা জাতীয়তাবাদীদের কাছে সমর্পণ করেনি। অসহযোগ আন্দোলনের সময় খেলাফত আন্দোলনের আলাদা মঞ্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছে। বস্তুত, বঙ্গভঙ্গের সময় থেকেই বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থানের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তী সময়ে এই স্বতন্ত্র অবস্থান শাসনতান্ত্রিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
মুসলিম সম্প্রদায়ের মতো নিম্নবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ও স্বদেশি আন্দোলনের বিরোধী ছিল। উদাহরণ হিসেবে, স্বদেশি আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা অশ্বিনীকুমার দত্তের শহর বরিশালের সমীপবর্তী ওড়াকান্দির নমঃশূদ্র জমিদারের স্বদেশি আন্দোলনের প্রতি তীব্র বিরোধিতার কথা স্মরণে আনা যেতে পারে। বঙ্গভঙ্গ কেবল সাম্প্রদায়িক বিরোধে সীমাবদ্ধ ছিল না, আন্তবর্ণ বিরোধের প্রসঙ্গটিও ছিল বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বঙ্গভঙ্গ-উত্তর বাংলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিভাজন ঘটে। নমঃশূদ্ররা বর্ণ-হিন্দুদের নেতৃত্ব মেনে নেয়নি। বিষয়টি কেবল বাংলার রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও সাম্প্রদায়িকতার মতো বর্ণপ্রথাজনিত কারণে সৃষ্ট সমস্যা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ, জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায় এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুদের দরকষাকষির সুযোগ তৈরি হয়। আইনসভায় এবং প্রশাসনিক পর্যায়ে আন্তসম্প্রদায় ও আন্তবর্ণের মধ্যে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারার দৃশ্যপর্বগুলো বঙ্গভঙ্গ-উত্তর বাংলায় দৃশ্যমান হতে থাকে।
বাংলার মুসলমানদের প্রতি সমর্থন আদায় করা ছিল কষ্টসাধ্য। বাংলার মুসলমানরা ছিল বিভক্ত সমাজ। একদিকে শহুরে আশরাফ শ্রেণী, অন্যদিকে গ্রামীণ আতরাফ। অতীতচারী, বুদ্ধিবৃত্তির দিক দিয়ে এদের অধিকাংশেরই ছিল না কোনো পটভূমি; স্বদেশ বা ভাষার প্রশ্নেও ছিল দ্বিধান্বিত। এ রকম একটা সমাজের মধ্যে নেতৃত্বহীনতাই ছিল স্বাভাবিক অবস্থা। এ রকম পরিস্থিতিতে কার্জনের ব্যক্তিগত উদ্যোগ এবং ইংরেজ আমলাদের ভূমিকা ছিল অনেকটা ‘সেনা অভিযান’ সফল করার মতো সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। তাঁরা সফলও হয়েছিলেন অনুগত মুসলিম নেতৃত্বের ঐতিহ্য প্রস্তুত করতে।
বিপরীতে কার্জন এবং ইংরেজ আমলারা বাংলা ভাগের প্রশ্নে অন্তর্দৃষ্টি দিতে পারেননি। তাঁরা ভাবতে পারেননি যে বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় বাঙালি হিন্দুদের অবস্থান, ভূমিকা ও কার্যক্রম কতখানি সুদূরপ্রসারী হতে পারে। বঙ্গভঙ্গ যেমন বাঙালি মুসলমানদের তাদের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে সচেতন করেছিল, তেমনি বাঙালি বর্ণ-হিন্দুদের মধ্যে সৃষ্টি করেছিল রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং দেশপ্রেমের গভীর ও বহুমাত্রিক প্রণোদনা। বস্তুতপক্ষে, মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আবেগ অনেকাংশে সীমিত থাকলেও পূর্ববাংলায় এই সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক অবস্থান সংহত হয়। অনেক জায়গায় মুসলিম সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে প্রতিরোধ করা হয় স্বদেশি আন্দোলনকে। ফলে অনিবার্য হয়ে ওঠে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। পাশাপাশি প্রতীয়মান হয় মুসলিম রাজনৈতিক এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দুর্বল অবস্থান। বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের অপরিণত অবস্থানকে বাড়তি পুষ্টি জুগিয়েছে ইংরেজ আমলাদের অবস্থান। বিশেষ করে, বাংলার তৎকালীন ছোট লাট অ্যানড্রু ফ্রেজার, পূর্ববাংলা এবং আসামের প্রথম ছোট লাট র্যামফিল্ড ফুলার এবং ভারত সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব হাবার্ট রিজলের বাংলা বিভাগসংক্রান্ত অবস্থান ছিল দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট। তাঁদের এই অবস্থানকে কার্জন দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর করেন। লন্ডনের ‘ইন্ডিয়া অফিস’ কার্জনের প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ পায়নি। তাঁর ব্যক্তিত্বের কাছে হার মানতে হয় ইন্ডিয়া অফিসকে। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করতে আর কোনো সময়ক্ষেপণ করতে চাননি (১৬ অক্টোবর, ১৯০৫) কার্জন।
আপাতদৃষ্টিতে বঙ্গভঙ্গ প্রশাসনিক সংস্কার বা সিদ্ধান্ত বলে প্রতীয়মান হলেও এর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার মাত্রার ব্যাপকতা ইংরেজ আমলা বা কার্জন সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেননি। হিন্দু জমিদার, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর তরফ থেকে তীব্র প্রতিবাদ উত্থাপিত হয় বঙ্গভঙ্গ প্রজ্ঞাপন ঘোষিত হওয়ার পর। ইংরেজ আমলারা বঙ্গভঙ্গ প্রশ্নে কর্মকৌশলের পরিচয় দিলেও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে পারেননি। রাজনৈতিকভাবে বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু জাতীয়তাবাদ তথা চরমপন্থী রাজনীতির বিকাশ ত্বরান্বিত করে।
বাঙালি বর্ণ-হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা ছিল তাদের জীবন-মরণ সমস্যা। বিশেষ করে, পূর্ববাংলার জমিদারেরা (যাঁদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু) চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিলুপ্তির আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কার্জন এ বিষয়ে আশ্বস্ত করার পরও বঙ্গভঙ্গকে তাঁরা সমর্থন করতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার পর কম যোগ্যতাসম্পন্ন মুসলমান প্রার্থীদের চাকরির সুযোগ করে দেওয়া হয়। সবশেষে রাজনৈতিকভাবে ও সংখ্যাগত বিচারে বিভক্ত বাংলায় বাঙালি হিন্দু সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। শ্রেণীগত বিচারে উল্লিখিত বিষয়গুলো তাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন হিসেবে বিবেচিত হয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য বিষয়গুলো ছিল প্রচণ্ড দহনশক্তিসম্পন্ন জ্বালানি। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার আগ থেকেই অখণ্ড বাংলায় জাতীয়তাবাদী ভাবপ্রবাহের শক্ত ভিত্তি প্রস্তুত ছিল। জাতীয়তাবাদী ভাবপ্রবাহের তাত্ত্বিক, নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং অর্থনৈতিক বুনিয়াদটা তৈরি করেছিলেন রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র, শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও রমেশচন্দ্র দত্ত। এই ভাবপ্রবাহের মূল প্রতিপাদ্য ছিল হিন্দু পুনর্জাগরণ। হিন্দু পুনর্জাগরণের আলোকেই পুনর্গঠিত হয় বাঙালি হিন্দুর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভিত্তি। জাতীয়তাবাদের ভাবতরঙ্গ সৃষ্টিতে বঙ্কিমের আনন্দমঠ, বিবেকানন্দের বেদান্তদর্শন বঙ্গভঙ্গের কালে এক জঙ্গি জাতীয়তাবাদের আবহ সৃষ্টি করে, যে আবহে বা পরিসরে বাংলাভাষী মুসলমানদের অন্তর্ভুক্তি ঘটেনি। উনিশ শতকের মনীষীদের কাছে বাংলাভাষী মুসলমানদের গুরুত্ব বা মর্যাদা কোনোটাই দৃশ্যমান ছিল না। বাঙালি হিন্দু নেতৃত্ব বাঙালি মুসলমানদের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রথম অনুভব করে বঙ্গভঙ্গের কালে। উদারপন্থী বা নরমপন্থী নেতৃত্ব, অর্থাৎ সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন অংশ বাঙালি মুসলমানদের ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে কাজ করলেও চরমপন্থী বা সন্ত্রাসবাদী অংশে বাংলাভাষী মুসলমানদের স্থান হয়নি। চরমপন্থীদের নেতা অরবিন্দ ঘোষ মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। তাঁর ভাষায় ‘এক অনিচ্ছুক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’ বা ‘যারা জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতক’। স্বদেশি আন্দোলন বাঙালি মুসলমানদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি। বাঙালি মুসলমানদের স্থানীয় নেতৃত্ব বয়কট-প্রতিরোধ করেছে। প্রতিরোধ পরিণত হয়েছে দাঙ্গায়। বয়কটকেন্দ্রিক সংঘাতের ঘটনাপ্রবাহ রবীন্দ্রনাথকে ভাবিত করেছে। বয়কটকেন্দ্রিক রাজনীতির মধ্যে তিনি লক্ষ করেছেন জবরদস্তি ও রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতার দিকটি। স্বদেশি আন্দোলনের কোনো কোনো কার্যক্রম, বিশেষ করে স্থানীয় শিল্পের বিকাশ এবং স্থানীয় পুঁজির লগ্নির বিষয়টি মুসলিম বণিকদের আকর্ষণ করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চা-শিল্পে, অস্ত্র খনিতে বা চট্টগ্রামের বণিকদের জাহাজ চলাচলে পুঁজির বিনিয়োগ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য।
অবশ্য সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়েই স্বদেশি আন্দোলন অব্যাহত থাকে। আইন অমান্য, বয়কট, হরতাল ক্রমেই সর্বভারতীয় রাজনৈতিক চরিত্র লাভ করে। স্বদেশি আন্দোলনের ইতিবাচক দিকগুলোর অন্যতম ছিল স্থানীয় শিল্পের ও স্থানীয় পুঁজির বিকাশ। স্বদেশি আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় জামশেদ টাটা প্রতিষ্ঠিত করেন ইস্পাত কারখানা। স্থানীয়ভাবে পুঁজি সংগ্রহ করে ভারতে বৃহৎ শিল্প গড়ে ওঠে স্বদেশি আন্দোলনের কালে। এই আন্দোলনে ভারতীয় বণিক শ্রেণী সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। ভারতীয় অর্থনীতিতে ধনিক শ্রেণীর পরিপূরক হিসেবে রাজনীতিতে কংগ্রেসের অবস্থান অনিবার্য হয়ে ওঠে।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ক্রমেই হয়ে ওঠে সনাতন ধর্মের পরিপূরক আরেকটি বিকল্প। এই বিকল্পের মূল ভিত্তি ছিল চরমপন্থা বা সন্ত্রাসবাদ। সন্ত্রাসবাদের মূল তাত্ত্বিক ছিলেন অরবিন্দ। এদের অর্থের মূল জোগান এসেছে পূর্ববাংলার মুক্তাগাছা এবং গৌরীপুরের জমিদারদের কাছ থেকে। জমিদারদের সম্প্রদায়গত অবস্থানকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মুসলমান রায়ত বা প্রজারা ঐক্যবদ্ধ হয়। তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে তাত্ত্বিকভাবে জোরদার করে ইব্রাহিম খাঁর লাল ইস্তেহার শীর্ষক পুস্তিকা। ওই পুস্তিকায় সরাসরি আহ্বান জানানো হয় জিহাদের, বয়কট করতে বলা হয় হিন্দু সম্প্রদায়কে। হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের দোলাচলে বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক উত্তাপের আঁচ স্বয়ং ভারতসম্রাট অনুভব করেন। তাঁরই উদ্যোগে অবশেষে বঙ্গভঙ্গ রদ হয় ছয় বছর পর, অর্থাৎ ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বরে। দুই বাংলা এক হয়। অখণ্ড বাংলায় মুসলমানরাই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হিসেবে মর্যাদা পায়। বাঙালি হিন্দু নেতৃত্বকে এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই আইনসভা ও স্থানীয় সরকারের রাজনীতি করতে হয়েছে ভারত ভাগের আগ পর্যন্ত। বঙ্গভঙ্গ হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব হলেও স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাব থেকে মুসলিম সম্প্রদায় মুক্ত হতে পারেনি। স্বদেশি আন্দোলনের প্রভাবে বাংলা ভাষাকে মুসলিম শিক্ষিত সমাজ মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। নিজেদের বাঙালি হিসেবে ভাবতে শুরু করে। বাঙালি হিন্দু বঙ্গভঙ্গ রদের পর রাজনৈতিক গুরুত্ব হারালেও রবীন্দ্রনাথের মধ্য দিয়ে তারা ভাবজগতের নেতৃত্ব অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়। স্বদেশি আন্দোলনের আগে ও পরে তাঁর মহৎ রচনাগুলো কেবল বাঙালিকে নয়, পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তের মানুষের কাছেও মহৎ রচনার দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। রবীন্দ্র-সৃষ্টির ভাবতরঙ্গ থেকে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায় নিজেদের খুব বেশি দিন দূরে রাখতে পারেনি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২১, ২০১১
Leave a Reply