অনেককাল আগে ব্রাহ্মসমাজের তরুণ-তুর্কিদের মুখপাত্র হয়ে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই নামের একটি চটি পুস্তিকা লিখেছিলেন। ১৯২১-এ প্রকাশিত এই লেখায় ব্রাহ্মসমাজের রক্ষণশীল বৃদ্ধদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা হয়েছিল। অনুদার পরিবেশ ও আদর্শচ্যুতি রোধে তাঁদের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল জোরালো। প্রগতির উদার হাওয়া যাতে ‘সমাজে’র দেহে-মনে লাগে, এই ছিল তাঁদের প্রত্যাশা। আর সেই কারণে রবীন্দ্রনাথকে তাঁরা অপরিহার্য ও জরুরি মনে করেছিলেন।
সেদিনের ছোট পরিসরের ‘ব্রাহ্মসমাজ’ নয়, আজ ‘বাঙালিসমাজ’ নিয়ে কথা—যে সমাজে অবক্ষয়, অবনতি, স্খলন, বিকার, অনাচারের বিষবৃক্ষ নষ্ট মানুষের যত্নে-প্রযত্নে আলো-হাওয়া-জল পেয়ে সতেজ ও বৃহৎ হয়ে উঠেছে। এই পরিবেশে এমন একজন মানুষকে প্রয়োজন যাঁর আদর্শ, চেতনা ও প্রেরণায় সমাজদেহের ক্ষত সারিয়ে তাকে সুস্থ ও সচল করে তুলতে পারা যায়। এই প্রেক্ষাপটে লালন কেন প্রাসঙ্গিক, সেই বিবেচনার ভূমিকা হিসেবেই এই ক্ষুদ্র নিবন্ধ।
লালন জন্মেছিলেন ২৩৭ বছর আগে সংস্কারশাসিত বাংলার এক অখ্যাত গ্রামে। ১১৬ বছরের দীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর এই দীর্ঘজীবন বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। এই অভিজ্ঞতার বড় অংশই বেদনা আর বিস্ময়ের। জাত-পাত, সম্প্রদায়-বিদ্বেষ, শাস্ত্র-ধর্মের দুঃসহ প্রতাপ, শ্রেণী-পীড়ন, সামন্তশোষণ, সামাজিক অনাচার, নারীর নিগ্রহ, মনুষ্যত্বের অবমাননা, মানবতার লাঞ্ছনা, মানুষের জীবনকে স্থবির এবং সেই সঙ্গে বিষাদ-নৈরাশ্যে ডুবিয়ে রেখেছিল। লালনের কাল থেকে দুই শতকের বেশি সময় পরও এই পরিস্থিতি পাল্টায়নি। হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর রূপ বদলেছে, কিন্তু সমাজদেহ থেকে এর ছাপ পুরোপুরি মুছে যায়নি।
বারবার আঘাত এসেছে বাউল সম্প্রদায় ও লালনের ওপর। বাউল-ঘৃণার পরিচয় মিলবে মধ্যযুগের দু-একটি পুঁথি বা পদে। ওহাবি-ফরায়েজি আন্দোলনের ফলে বাউলদলন জোরালো হয়েছে। ‘জাতির পশ্চাতে’ যে ব্রাহ্মধর্ম ও গৌরবাদীদের মতো ‘লালন সম্প্রদায়ীরা’ও ‘খোঁচা মারিতেছে’—এমন অভিযোগ করেছেন কাঙ্গাল হরিনাথ। মৌলভি আবদুল ওয়ালির সমালোচনা থেকেও রক্ষা পাননি লালন ও বাউলেরা। এসব উনিশ শতকের কথা। এরই ধারাবাহিকতায় কয়েক দশক পর জারি হয় ‘বাউল ধ্বংস ফতোয়া’। এই ফতোয়ায় বলা হয়, ‘…ন্যাড়ার ফকিরগণ লালন সাহার সম্বন্ধে কোনই পরিচয় না জানিয়া হুজুগে মাতিয়া হিন্দু বৈষ্ণবগণের দেখাদেখি লালন সার পদে গা ঢালিয়া দিয়া মোছলমান সমাজের কলঙ্কস্বরূপ হইয়াছে ইহা অতিশয় পরিতাপের বিষয়।’ মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁও সায় দেন বাউলবিরোধিতায়। বাউল-ফকিরদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা থেকে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান, বাউলমতের প্রসার মুসলিম সমাজের চারিত্রিক ও নৈতিক অধঃপতনের একটি প্রধান কারণ। সরাসরি কিংবা খানিকটা আড়াল মেনে এই বাউল-নিগ্রহ বা লালন-নিন্দার প্রচার থেমে থাকেনি। আধুনিককালে, এমনকি হালেও যখন কথিত আধুনিক শিক্ষিত বাঙালি মতে-মন্তব্যে লালনকে খাটো বা খারিজ করতে চান, তখন আমরা বিচলিত ও অসহায় বোধ করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসময়ের উপাচার্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন রায় দিয়েছিলেন, লালনসহ অন্যান্য লোককবি যেসব গান রচনা করেছেন, তাতে নাকি ‘যথেষ্ট রসবোধের পরিচয় নাই’ এবং তা ‘গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট বলিয়া ভদ্রসমাজে স্থান করিয়া লইতে পারে নাই।’ আবার কিছুকাল আগে সুধীর চক্রবর্তী তো বলেই বসলেন, লালন ছিলেন ‘জারজ’। সুধীরের এই মন্তব্য সুধীজন ও বাউলেরা কীভাবে নেবেন, জানি না! অগণন ভক্ত এবং রবীন্দ্রনাথ থেকে অন্নদাশঙ্কর রায়ের লালন-অনুরাগ কি তবে এই ‘জারজ’ মন্তব্যের পাঁকে ডুবে যাবে? কী ভেবে এঁদের সম্পর্কে আগেই লালন লিখে গিয়েছিলেন: ‘পণ্ডিত কানা অহংকারে’। আশা আর আনন্দের কথা এই শহুরে শিক্ষিত অনুদার প্রতিক্রিয়াশীলদের অপ-মন্তব্যের জবাব দিয়েছেন শওকত ওসমান লালনকে নিয়ে গল্প লিখে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় উপন্যাস লিখে, শামসুর রাহমান কবিতা লিখে, আর তানভীর মোকাম্মেল ও গৌতম ঘোষ ছবি বানিয়ে, যেখানে লালন ফুটে উঠেছেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক মানবতাবাদী দার্শনিক, সাধক ও কবি হিসেবে।
লালন সম্পর্কে যে অবজ্ঞা-নিন্দা-বিদ্বেষ তা তো বিকারগ্রস্ত সমাজমনের প্রতিক্রিয়ার ফসল। কেন লালনকে এর শিকার হতে হয়? এক কথায় জবাব দিলে বলতে হয়, লালন সারা জীবন মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন, মানবতাবাদী দর্শন ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, ঘুণে ধরা সমাজটাকে বদলাতে চেয়েছিলেন, জাতধর্ম দূরে সরিয়ে মানুষকে মানবিক বোধে বিকশিত করার ব্রত নিয়েছিলেন। সামান্য মরমি ফকিরের এসব উল্টো ধারার কর্মকাণ্ড বরদাশত করবেন কেন সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষ! কেননা ধর্মের অছিলায়, শাস্ত্রের নামে, অর্থের জোরে, শক্তির দম্ভে সমাজ-ঘরের সব জানালা তাঁরা বন্ধ করে চিরস্থায়ী এক আঁধারের রাজ্য তৈরি করতে চেয়েছিলেন। লালন তাতে বাদ সেধেছিলেন বলেই না তিনি আলো সইতে না-পারা পেচক প্রজাতির মানুষের দুশমন হয়েছিলেন। পাষণ্ড, ব্রাত্য, ন্যাড়া—এসব গালমন্দ তাঁকে শুনতে-সইতে হয়। তবে আরোপিত কলঙ্ক আর নিন্দা সমকালেই, উত্তরকালে তো বটেই—বিবেকবান মানুষের সুবিবেচনার কল্যাণে লালনের গৌরবচিহ্ন হয়ে উঠেছিল।
লালনের তো শুধুই লেখার কথা ‘তিরপিনির তিরোধারে মীনরূপে সাঁই খেলা করে’, ‘আয় হারালি আমাবতী না মেনে’, ‘গেঁড়ে গাঙেরে ক্ষ্যাপা হাপুরহুপুর ডুব পাড়িলে’, ‘ধর চোর হাওয়ার ঘরে ফাঁদ পেতে’, ‘আজব আয়নামহল মণি-গভীরে’ কিংবা ‘ধর রে অধরচাঁদেরে অধ রে অধর দিয়ে’—এসব সাধনার গান, জটিল বাউলতত্ত্বের গান। কিন্তু অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণে তিনি জেনেছিলেন সমাজের আঁধার না ঘুচলে সাধনার আলো ফুটবে না। সাধন-ঘরানার বাইরে গিয়ে তাই তাঁকে লিখতে হলো সমাজকে জাগানোর গান, মানুষকে আলোকিত করার গান। সমাজের নানা কুরীতি ও অসংগতি ধরা পড়েছে লালনের চোখে। অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তিনি জেনেছিলেন: ‘কলিতে অমানুষের জোর/ ভালো মানুষ বানায় তারা চোর’। নীতি-নৈতিকতা হয়ে ওঠে কথার কথা: ‘তলে তলে তলগোঁজা খায়/ লোকের কাছে সতী কবলায়/ এমন সৎ অনেক পাওয়া যায়/ সদর যে হয় সেই পাতকী’।
মধ্যযুগের সহজিয়া কবি রূপকের ছলে উচ্চারণ করেছিলেন: ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণার জন্য লালন সেই রূপকের আড়াল তুলে দিয়ে সরাসরি বললেন: ‘অনন্তরূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই/ শুনি মানবের উত্তম কিছুই নাই/ দেব-দেবতাগণ করে আরাধন/ জন্ম নিতে মানবে’। পুনর্জন্মে বিশ্বাস ছিল না লালনের। তাই একবারের জন্য নশ্বর এই পৃথিবীতে আসার সুযোগ সুকৃতিতে সার্থক করে তোলার জন্য তাঁর ছিল একান্ত আকুতি: ‘কত ভাগ্যের ফলে না জানি/ মন রে পেয়েছ এই মানবতরণী/ বেয়ে যাও ত্বরায় সুধারায়/ যেন ভারা না ডোবে’। ‘জগৎ সত্য ব্রহ্ম মিথ্যা’—এই চেতনা যে অনেক খানিই লালনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, তাঁর গানে সেই পরিচয় একেবারে ঢাকা থাকেনি। ইহজাগতিকতার হাতছানিতে লালন সাড়া না দিয়ে পারেননি: ‘এমন মানব-জনম আর কী হবে/ মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে’। পরলোকে স্বর্গপ্রাপ্তির চাইতে দুনিয়ার ‘নগদ পাওনা’র প্রতিই তাঁর বেশি ঝোঁক ছিল—তাঁর গানে সেই কথাটিই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। মানুষই ছিল লালনের মনোভূমির কেন্দ্রে। তাই মানবজীবন, মানবগুরু, মানবভজনার কথা বারবার উঠে এসেছে তাঁর গানে। ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’, ‘ভবে মানবগুরু নিষ্ঠা যার/ সর্বসাধন সিদ্ধ হয় তার’, ‘আছে যার মনের মানুষ মনে তোলা সে কি জপে মালা’, ‘সেই মানুষে আছে রে মন যারে বলে মানুষ-রতন’, ‘মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/ সে কি অন্য তত্ত্ব মানে’—লালনের এসব পদ সাধনার প্রয়োজনে বাঁধা হলেও তা মূলত মানববন্দনারই গান। ‘মানুষ অবিশ্বাসে হয় না রে মানুষনিধি’—এই পদটি মানুষের প্রতি তাঁর গভীর আস্থা ও ভালোবাসার পরিচয় বহন করে। পাঠক! এই সঙ্গে আপনার নিশ্চয়ই স্মরণে আসবে, লালন-সাগরে অবগাহন করে তুলে আনা রবীন্দ্রনাথের মরমি মুক্তা-মণির কথা—তারই স্পর্শমাখা এই কথাটি: ‘মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ’।
বাউলের আবার জাত কী, ধর্ম কী? এসব ধুয়েমুছে ফেলেই তো সে ঘর-সংসার ছেড়ে ‘মনের মানুষ’কে খুঁজে ফেরার জন্য ‘সাধবাজারে’ এসে ঠাঁই নিয়েছে। লালনও তো জাত-ধর্ম-শাস্ত্র কিছুই মানেননি—গোত্র-বর্ণের বালাই নেই তাঁর কাছে। নারী ও পুরুষ—এই হলো মানুষের জাত। এর বাইরে আর কিছু নেই—লালন স্বীকার করেননি। এই সাধক নিজের চোখেই তো দেখেছেন—জাত-ধর্ম আর হিন্দু-মুসলমান—এই ভেদ-বিভেদের ফল কী ভয়াবহ, কলহ-বিবাদেই জীবন গেল—এ যেন ‘বসতবাড়ির ঝগড়া-কেজে মিটল না’। জাত-ধর্মের সুতা কেটে যৌবনের প্রথম প্রহরেই ঘর ছাড়তে হয়েছিল। তারপর তো ভাসতে ভাসতে খুঁজে পেলেন তাঁর ‘জীবনেরও জীবন সাঁই’ গুরুকে, দীক্ষা নিলেন সিরাজ সাঁইয়ের কাছে—বাউল হলেন—ধর্ম আর জাতের দাবি-দাওয়া রইল না। কিন্তু তাঁর না থাকলেও, কাছে-কোলের মানুষ যারা, তারা তো মানুষের পরিচয় খুঁজে ফেরে জাত-ধর্মের মধ্যেই—মানুষটি হিন্দু না মুসলমান? এরা লালনকে জেরবার করে তুলল তাঁর জাত-পরিচয় জানার জন্য। লালন এড়িয়েও পার পান না, জবাব দিতেই হলো: ‘সব লোকে কয় লালন ফকির হিন্দু কি যবন/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান’। এর পরও অতৃপ্ত জাত-সন্ধানীদের জানাতে হলো জাত-পাতের অসারতার কথা—যুক্তি দিয়ে বোঝালেন: ‘বিবিদের নাই মুসলমানী/ পৈতা নাই যার সেও তো বাওণী/ বোঝ রে ভাই দিব্যজ্ঞানী/ লালন তেমনি জাত একখান’। মধ্যযুগের ভারতের সন্ত-সাধকেরাও তুচ্ছ করেছেন জাতধর্মকে—কি কবির, রামদাস, কি পল্টু, রজ্জব, তুলসিদাস, কি দাদু—সবার মুখেই ওই একই কথা। লালন কী করে পেয়েছিলেন ‘পিঁড়েয় বসে পেঁড়োর খবর’? নাকি সব মরমির মন ও ভাব একই ছাঁচে ঢালা! এখানে স্থান-কাল সব হারিয়ে যায়—এক অদৃশ্য সুতায় বাঁধা থাকে শুধু মানবপ্রেমী সাধকের মরমি মন। কবির বড় ধন্দে পড়েছিলেন, কী করবেন তিনি, পূজা করবেন, না নামাজ পড়বেন; হজ করতে যাবেন, না তীর্থদর্শনে দিন কাটাবেন? অনেক ভেবে শেষে বললেন: ‘ভরম সব ভাগা, এক নিরঞ্জন সু মন লাগা’। কয়েক শতক পরে বাংলা মুলুকে জন্ম নিয়ে লালনেরও তা-ই মনে হলো: ‘যে যা ভাবে সেই রূপে সে হয়/ রাম-রহিম-করিম-কালা এক আত্মা জগৎময়’। জাত বিচারের গর্বকে খারিজ করে নিজেকেই সাক্ষী রেখে সাধক পল্টু বললেন: ‘পল্টু, উঁচি জাতকা, মাত্ কোই কর অহংকার/ সাহেবকা দরবার মে, কেবল ভক্তি পেয়ার’। চেতনা ও বিশ্বাসে লালন তো এঁদেরই উত্তরসূরি, তাই তিনিও বলে উঠলেন: ‘ভক্তির দ্বারে বাঁধা আছেন সাঁই/ হিন্দু কি যবন বলে তাঁর জাতের বিচার নাই’। সমাজ ছিল শ্রেণী-বর্ণ-গোত্রে বিভক্ত—জাতপাঁতের কঠিন নিগঢ়ে বাঁধা। লালন তাঁর দ্রোহের আগুনে এসব অসাম্য-বিভাজন পুড়িয়ে ছাই করতে চেয়েছেন: ‘জাত না গেলে পাইনে হরি/ কি ছার জাতের গৌরব করি/ ছুঁসনে বলিয়ে/ লালন কয় জাত হাতে পেলে/ পুড়াতাম আগুন দিয়ে’।
লালনের মনে ভাব এলে হামেশাই তাঁর গানের ‘পুনা মাছের ঝাঁক’ আসত। একতারায় আলতো আঙুল বুলিয়ে সুর তুলতেন গলায়। জন্ম নিত নানা রঙের নতুন নতুন ভাবের গান। তখন গানে মগ্ন সৌম্য-শান্ত এক মরমি সাধকের অনন্য ছবি আঁকা হয়ে যেত শিষ্য-শাবকদের চোখে। সেই সাধকই একদিন বিচলিত হয়ে উঠলেন, মনের মধ্যে ঝড় উঠল। তাঁর প্রাণের দোসর কুমারখালীর কাঙ্গাল হরিনাথকে বাঁচাতে হবে জমিদারের লাঠিয়ালের হাত থেকে। কাঙ্গাল তাঁর গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকায় জমিদারের প্রজাপীড়নের খবর ছেপে এদের রোষে পড়েছেন। একতারার বদলে হাতে উঠল বাঁশের লাঠি। ছেঁউড়িয়া থেকে শিষ্য-শাবক নিয়ে লালন ছুটলেন কুমারখালীতে। হাঁকিয়ে দিলেন জমিদারের লাঠিয়াল বাহিনীকে। প্রাণরক্ষা হলো প্রজাদরদি হরিনাথের। এ কথা শুনলে মনে হবে এ যেন কোনো কল্পকাহিনি। কিন্তু না, কাঙাল নিজেই তাঁর ডায়েরিতে লিখে গেছেন এই ঘটনার কথা। সাধক-বাউল বুঝিয়ে দিলেন অত্যাচার-অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, সত্য-ন্যায়ের পথে থাকা, মানুষের সম্ভ্রম-সম্মান রক্ষাই মানুষের ধর্ম—এ-ও ‘মানুষসত্য’ সাধনারই অঙ্গ। বাউলেরা যে সমাজবিচ্ছিন্ন নন, নির্জন সাধনাতেই যে শুধু তাঁদের জীবন কাটে না, এর প্রমাণ তো লালন হাতে-কলমে দিয়ে গেছেন। তাঁর কণ্ঠ বেজে উঠেছে প্রতিবাদে-বেদনায়: ‘রাজ্যেশ্বর রাজা যিনি/ চোরেরও শিরোমণি/ নালিশ জানাব কার কাছে’—এ কি শুধুই রূপক—বাস্তবতাবর্জিত তত্ত্বকথা? এখানে কি অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির প্রকাশ একেবারেই ঘটেনি?
নারীর জীবন কেমন ছিল লালনের কালে—আজ থেকে দুই শ বছর আগে? নারীকে কী চোখে দেখেছিলেন লালন—এসব কৌতূহল-জাগানো প্রশ্নের জবাবে এক নতুন লালনকে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃতপক্ষে বাঙালি নারী প্রথম মুক্তি পেয়েছে সাহিত্যে, প্রেমে-প্রতিবাদে-ব্যক্তিত্বে-আকাঙ্ক্ষায় প্রথম নারীকে আবিষ্কার করা যায় সাহিত্যে, যার সূচনা মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলিতে। এর পাশাপাশি লোকসাহিত্যেও নারীর আলাদা অস্তিত্বের স্বাক্ষর মেলে। কিছুটা পরোক্ষে বা রূপকের মধ্য দিয়ে হলেও বাংলার লোকজ মরমি সাধনা ও সাহিত্যেও বিশেষ করে, বাউলের সাধনা ও গানে নারী তার আপন মহিমা-মর্যাদা নিয়ে উপস্থিত। বাউলসাধনায় নারীর একটি ভিন্ন গুরুত্ব ও মূল্য আছে। নারী বা প্রকৃতি বাউলের সাধনসঙ্গিনী। বাউলমতের উদ্ভবের সঙ্গেও মাধববিবি নামের এক নারীর সম্পর্ক আছে। এই মরমিসাধনার আদি রূপের অনেক গুপ্ত-রহস্য নবী-দূহিতা হজরত ফাতেমা (রা.) জানতেন বলেও বাউল-ফকিরদের বিশ্বাস। বাউলের সাধনা ও উপলব্ধিতে নারীর রূপ-স্বরূপের যে পরিচয়-গুণ-মাহাত্ম্যের যে বৈশিষ্ট্য, তা সবচেয়ে আন্তরিকভাবে প্রকাশ পেয়েছে লালনের গানে।
সৃষ্টিরহস্যের গুপ্তভেদ ভেঙেছেন লালন তাঁর অনেক গানে। নারীই সৃষ্টির আধার। লালন তাই বলেন: ‘সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি করলেন সবারি’—কিন্তু ‘যুগে যুগে মাতা হন যোগেশ্বরী’। ধাঁধার আবরণ দিয়ে লালন আরও বলেছেন: ‘সাগরে ভাসে জগৎমাতা/ লালন বলে মা’র উদরে পিতা জন্মে’। সমাজ-সংসার-ধর্মের চাপ ও বিধান নারীকে ‘অবলা’ করে রেখেছে। সেই ‘অবলা’ কুলনারীও যে পুরুষের অহংকার-আধিপত্য খর্ব করতে পারে, তার দৃষ্টান্ত একেবারে বিরল নয়। প্রেম-প্রত্যাশী পুরুষকেও যে কখনো কখনো নারীর কাছে নতজানু হতে হয়, কৃষ্ণের তুলনা দিয়ে সেই কথাটিই বলেছেন লালন: ‘কোন প্রেমে বল গোপীর দ্বারে/ কোন প্রেমে শ্যাম রাধার পায়ে ধরে…’। নারীর মহিমা, শ্রেষ্ঠত্ব ও দৃঢ়তার পরিচয়ের প্রকাশ মেলে লালনের এই গানে: ‘মায়েরে ভজিলে হয় সে বাপের ঠিকানা/ নিগম বিচারে সত্য গেল তাই জানা’। এই বাণী পুরুষতন্ত্রের প্রাধান্যকে চূর্ণ করেছে। নারীর প্রতি লালনের যে শ্রদ্ধা, মনোযোগ ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি, তা তাঁর সমপ্রদায়ের দর্শন থেকেই তো এসেছে।
লালন জাত মানেন নি— শাস্ত্র মানেন নি— প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে আস্থা ছিল না— কোনো সামপ্রদায়িক পরিচয়েও মতি ছিল না। নির্বিচার অন্ধবিশ্বাসকে খারিজ করে সেখানে যুক্তিকে বসিয়েছেন। তাই সহজেই বলতে পারেন : ‘বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার / উদয় হয় না দিনমণি’। আচার ও সংস্কার ধর্মকে আচ্ছন্ন করে রাখলে তার কী দশা হয় সে-সম্পর্কে মশকরা করে লালন বলেছেন : ‘ভজা উচিত তবে ছড়ার হাঁড়ি / যাতে শুদ্ধ করে ঠাকুরবাড়ি’। ধর্মের ভড়ং-কে ব্যঙ্গ করে আবার গান বেঁধেছেন : ‘বেশ করে বোষ্টমগিরি/ রস নাই তার ফষ্টি ভারি/ হরি নামের ঢু ঢু তারি / তিনগাছি তার জপের মালা’। আচারনিষ্ঠা ও দানধ্যানের পুণ্যে ধর্ম নেই লালনের মতে : ‘হোম-যজ্ঞ-স্তব-দান-ব্রত/ ইহাতে সাঁই নাহি রত’। কোনো বিশেষ ধর্মের গণ্ডিতে তিনি বাঁধা পড়তে চান নি। ‘গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় / তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়’— লালনের এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে? তাই প্রাতিষ্ঠানিক সব ধর্ম সম্পর্কেই তিনি ছিলেন উদাসীন ও সংশয়ী। কোনো শাস্ত্রেই তাঁর আস্থা ছিল না। ঐশী কেতাব সম্পর্কে তাই তিনি বলেন : ‘এক এক দেশে এক এক বাণী/ পাঠান কি সাঁই গুণমণি/ মানুষের রচনা জানি / লালন ফকির কয়’। কী ভয়ঙ্কর কথা— কী দুঃসাহস! আর এই বক্তব্য পেশ করেছিলেন তিনি এক অজ্ঞ-অজ্ঞান-ধর্মান্ধ সমাজে বাস করে! লালন যদি আজ নব্য-ফতোয়াবাজদের সামনে এমন কথা উচ্চারণ করতেন, তাহলে তাঁর অবস্থা হয়তো মনসুর হাল্লাজের মতোই হতো। কথা আরো আছে। পুনরুত্থান-দিবস সম্পর্কেও তাঁর মনে ঘোরতর সন্দেহ জেগেছে : ‘রোজ-কেয়ামত বলে সবাই/ কেউ বলে না তারিখ নির্ণয়/ হিসাব হবে কি হচ্ছে ওে সদায়/ কোন্ কথায় মন রাখি রাজি’। মে’রাজ সম্পর্কেও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন : ‘মেয়ারাজের কথা শুধাবো কারে/ আদম তন আর নিরূপ খোদা/ নিরাকারে মিললো কি করে’। মক্কায় না গিয়ে ‘দিল-কাবা’য় হজ্ব করতে বলেছেন তিনি। নামাজ সম্পর্কেও তিনি যে কথা বলেছেন তা শরিয়তের চোখে ঘোর আপত্তিকর : ‘পড়গে নামাজ জেনেশুনে / নিয়েত বাঁধগে মানুষ-মক্কা পানে’। দ্বিত্ববাদের ধারণা প্রশ্রয় পেয়েছে তাঁর চিন্তায় : ‘যেহি মুরশিদ সেহি খোদা’ কিংবা ‘আল্লা-নবি দুটি অবতার’। এরপরেও কী কেউ বলবেন সাধকজীবনে আসার পর লালন বিশুদ্ধ হিন্দু কিংবা নিষ্ঠ মুসলমান ছিলেন? তাঁর ভাষ্যে এই বার্তাই পৌঁছে যায়, তিনি না ছিলেন হিন্দু— না ছিলেন মুসলমান, তার বদলে ‘মানুষ’ হতে চেয়েছেন। এই দুই সমপ্রদায়ের ধর্মকেই তিনি জানার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু মান্য করার কারণ বা যুক্তি খুঁজে পান নি।
পাপ-পুণ্য, স্বর্গ-নরক এসব বিষয়কেও লালন মোটেই আমলে নেন নি। পাপ-পুণ্যের ধারণাকে তিনি ‘দেশাচার’ বলে গণ্য করেছেন : ‘পাপ-পুণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই/ এই দেশে যা পাপ গণ্য অন্য দেশে পুণ্য তাই’। পাঠক! মনে পড়ে, বিদ্যাসাগর একবার বুলন্দ-আওয়াজে ঘোষণা করেছিলেন : ‘আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি’। তারো আগে লালনের মনে এই ভাবটিই তো জেগেছিল। মুসলমানের ‘বেহেশ্ত’ বা হিন্দুর ‘স্বর্গ’— লালন কোথাও যেতে চান নি, এ দুই-ই তাঁর কাছে ‘ফাটক সমান’ মনে হয়েছে।
লালন ছিলেন কালের অগ্রগামী পুরুষ। কিন্তু কাল বিরোধী ছিল। সমাজ-মন তৈরি ছিল না তাঁর কথা শোনা কিংবা তার তাৎপর্য বোঝার জন্যে। তাই তাঁকে অনেক আঘাত সইতে হয়েছে। মনের মধ্যে কখনো বেদনা— কখনো হতাশা জেগেছে, তাই হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস মিশিয়ে গান রচনা করেছেন : ‘এ দেশেতে এই সুখ হলো আবার কোথা যাই না জানি/ পেয়েছি এক ভাঙা নৌকা জনম গেলো ছেঁচতে পানি’। কিন্তু মানবগুরু লালন তো পরাভব মানতে পারেন না— হতাশার কাছে আত্মসর্ম্পণ তো তাঁর ধর্ম হতে পারে না! যাঁর তরঙ্গমুখর নদী হওয়ার বাসনা ছিল— দু’কূল ভাসানো স্রোতস্বিনী হওয়ার কথা ছিল, তিনি কীনা হয়ে রইলেন ‘আন্ধেলা পুকুরে’র ‘কূপজল’! কিন্তু লালন তো মানুষকে দিশা দিতে চান, তাই সুসময়ের জন্যে আশা জাগিয়ে রাখেন : ‘কবে হবে সজল বরষা, রেখেছি মন সেই ভরসা’। একদিন বর্ষা নামবে, নব-জলধারায় সিক্ত হবে এই রুক্ষ মাটি, সবুজে ভরে যাবে ফসলের মাঠ— সত্য হয়ে উঠবে লালনের স্বপ্ন।
উনিশ শতকে বাঙালি ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছিল। সেই ঘুম-ভাঙানিয়া ফেরিঅলা ছিলেন রামমোহন। কিন্তু তাঁর ডাক তো শুনেছিলেন শুধু কলকাতার মানুষ আর তার প্রতিধ্বনি জেগেছিল বাংলার দু’চারটি বড়ো মফস্বল শহরে। কিন্তু আঁধারে ঢাকা পড়ে রইলো বৃহত্তর বঙ্গদেশের গ্রামের পর গ্রাম। সেই গ্রামদেশে মাটির প্রদীপ জ্বালালেন লালন ফকির। পেশাদার ইতিহাসবিদেরা এ-বিষয়ে নীরব হয়ে রইলেন বাংলার সামাজিক ইতিহাস লিখতে গিয়ে। একবার অমলেন্দু দে কথাটি তুলেছিলেন আর অন্নদাশঙ্কর রায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন : ‘বাংলার নবজাগরণে রামমোহনের যে গুরুত্ব বাংলার লোকমানসের দেয়ালী উৎসবে লালনেরও সেই গুরুত্ব’।
লালন ফিরে এসেছেন আবার, দু’শতকেরও বেশি পথ উজানে পাড়ি দিয়ে— প্রদোষের অলো-আঁধারিতে ছায়ামূর্তির মতো তাঁকে দেখায়। কিন্তু তাঁকে ঘরে তুলে নেওয়ার— আসন পেতে বসতে দেওয়ার লোক কই? লালন ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছেন। একটা বড়ো শ্বাস ফেলে ফিসফিস করে থেমে থেমে বললেন : ‘দ্যাশটা ঘুরে আলাম। কিন্তু কইরে, মানুষ তো দ্যাখলাম না, কেউ হিন্দু কেউ মুসলমান, মানুষ কই? সবাই দেখি শাস্তর পড়ছে, ধম্মকম্মে ভারি মতি, কিন্তু মনে তো সব গিল্লদ পুরা! শহরে-গিরামে কতো কলের বাতি— কিন্তু অ্যাতো আঁধার ক্যান্ রে— মনের বাতি জ্বলবি কবে? তুরা কী সব মরে বাঁইচে আছিস্! গান কই— দিল্-জাগানো গান— সত্য-সুপথের গান— পিরিতি অমূল্যনিধির গান? ওরে ভুলাই, শীতল, মনিরুদ্দীন শিগিগর ছুটে আয়— জ্যান্তে-মরাদের জাগাতি হবি যে! ওরে আয় তোরা সব— গান ধর্— মানুষির গান— মানুষ হওয়ার গান…!’
লালন আমাদের দরোজায় দাঁড়িয়ে— তাঁকে কী আজ আমরা ফিরিয়ে দেবো?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২১, ২০১১
Leave a Reply