সৈয়দ বেলাল: এক শহীদের কাহিনি
তাহের বেন জেলোউন
রূপান্তর: শওকত হোসেন
সৈয়দ বেলাল তাঁর নাম, বয়স তিরিশ বছর, বিবাহিত। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। একজন ধর্মপরায়ণ মুসলিম, রাজনৈতিক কর্মী বা বিক্ষোভকারী নন। চাকরি করেন, কোনোভাবেই আর দশজনের চেয়ে ভিন্ন কিছু নন। সাহেরেঈয়া ট্রেন স্টেশনের কাছে থাকতেন তিনি। ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি বিকেলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এজেন্টদের কাছ থেকে রাত ১০টায় একটি তদন্তকাজে সহায়তা করার জন্যে আল রামল এলাকার স্থানীয় পুলিশ স্টেশনে রিপোর্ট করতে বলে টেলিফোন আসে তাঁর কাছে। ‘সাথে একটা কম্বল নিয়ে আসবেন,’ পরামর্শ দেওয়া হয় তাঁকে, ‘লাগতে পারে।’
সৈয়দ বেলাল ছিলেন দরিদ্র মানুষ; সহজ, বিনয়ী, একজন সাধারণ নাগরিক। এভাবে পুলিশ স্টেশনে ডেকে নেওয়ায় খুশি হওয়ার কথা নয় কারোরই। কিন্তু নিজেকে দায়ী করার মতো কিছু ছিল না বলে একটা ট্যাক্সিতে করে পরিষ্কার মনে সময়মতোই হাজির হয়েছিলেন সৈয়দ বেলাল। তাঁর সঙ্গে কেউ ছিল না। জীবনের শেষ বিন্দুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার কথা জানতেন না তিনি। কারও পক্ষে কী করেই বা জানা সম্ভব সেটা? সৈয়দ বেলালের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধের রেকর্ড ছিল না, দেশের পুলিশ বাহিনীর সংস্পর্শে কোনো দিনই আসতে হয়নি তাঁকে। আসলে তাঁকে বেছে নেওয়ার এটাই কারণ: নিপাট সাধারণ মানুষ।
পরিচয় নিশ্চিত করার ভেতর দিয়ে শুরু হলো জিজ্ঞাসাবাদ: একেবারেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। শান্ত রইলেন সৈয়দ। জিভের ডগায় এসে পড়া প্রশ্ন উচ্চারণের সাহস হলো না তাঁর: ‘আমি এখানে কেন? আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ আছে? আমাকে নিয়ে কী করতে যাচ্ছেন আপনারা? কী অপরাধ করেছি আমি?’
কিছুই বললেন না সৈয়দ, তাঁদের প্রশ্নের যথাসাধ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করলেন, তারপর ব্যাপার কোন দিকে গড়ায় দেখার অপেক্ষায় রইলেন।
আকস্মাৎ লোকজন তাঁকে ভিন্ন একটা কামরায় নিয়ে এল। ঠেলতে ঠেলতে সাউন্ডপ্রুফ বেসমেন্টে নিয়ে এল তাঁকে। এখান থেকে বাইরে শব্দ যাওয়ার উপায় নেই, নির্যাতন চালানোর জায়গা। সবই ভেবে রেখেছিল পুলিশ। প্রতিবেশীদের বিরক্ত করা যাবে না। শব্দ বা ভীতিকর কিছু চলবে না, কারণ জোরে আঘাত করা হলে নাগরিকেরা আর্তনাদ করে ওঠে বলেই মনে হয়। চিৎকার করে তারা। তাতে নিপীড়নকারীর কানে লাগে, শব্দ শুষে নেওয়ার জন্য দেয়ালের সাঁটা কর্কে ফাটল ধরতে পারে।
এই সব বেসমেন্টে কোনো দিনই পা রাখেননি সৈয়দ। এগুলোর কথা শুনেছিলেন তিনি। এগুলো টর্চার চেম্বার, জানা ছিল তাঁর। কিন্তু শাস্তি পাওয়ার মতো কিছুই করেননি তিনি…ঘণ্টাখানেক আগেও নির্মল ছিল তাঁর মন, কিন্তু এবার ভয় পেয়ে গেলেন। গত কয়েক দিনের ঘটনাবলির কথা মনে করে ভাবলেন, ‘এমন কারও সঙ্গে কি কথা বলেছি যেটা উচিত হয়নি? হয়তো ষড়যন্ত্রে জড়িত কারও সঙ্গে আমাকে দেখা গেছে। দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা চালানো ভয়ংকর কোনো সন্ত্রাসী? নাহ্, আমি স্কুলে গেছি, নিজের কাজ সেরে আবার বাড়ি ফিরে গেছি—স্ত্রীর কাছে থাকা দরকার ছিল আমার—সাত মাস চলছে ওর। ও ক্লান্ত হয়ে পড়ুক চাই না আমি, তাই বাবা-মা প্রায়ই আমাদের সাহায্য করতে আসে। খোদার হাতে নিজের জীবন সঁপে দিয়েছি আমি। হায়, সেটাই কি তবে ওদের খেপিয়ে তুলেছে? খোদা? নিশ্চয়ই সর্বশক্তিমানের কাছে দিশার সন্ধান করে, এমন যে কাউকেই সন্দেহ করে ওরা!’
‘গত শনিবার মাঝরাতের দিকে কী করছিলে তুমি?’
‘বাসায় ঘুমাচ্ছিলাম।’
প্রথম চড়। প্রশ্নটা আবার জিজ্ঞেস করল তারা। তারপর বলল, চার্চ অব টু সেইন্টস নামের এক কপ্টিক গির্জার কাছাকাছি দেখা গেছে তাঁকে। ওখানে ৩১ ডিসেম্বর রাতে এক লোক নিজেকে উড়িয়ে দিয়ে তেইশ জনকে হত্যা আর নব্বই জনেরও বেশি লোককে আহত করেছে।
দুঃখজনক ঘটনাটার কথা সৈয়দের কানে এসেছিল বটে, তিনি জবাব দিলেন, ‘মুসলিম হিসেবে’ তিনি মানুষ হত্যা করেন না।
এরপর শুরু হলো আসল অত্যাচার। সত্যি না হলেও তাঁর মুখ থেকে জবানবন্দী আদায় করতেই হবে। সে রকমই হুকুম রয়েছে। পুলিশের দরকার একজন দোষী লোকের। নিপীড়নে কাজ না হলে হাওয়া থেকে অপরাধীকে বের করে আনবে তারা। তাই ঘটবে সৈয়দ বেলালের কপালে। নিজেকে ইসলামের কঠোর পরিপালনের সমর্থক সালাফি মতবাদের অনুসারী হিসেবে স্বীকার করে নিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর মানে এই নয় যে তিনি সন্ত্রাসী, বিশেষ করে সালাফিরা যেখানে ঐশী বিধানের আক্ষরিক প্রয়োগে বিশ্বাস করে। এবং কোরানের কোথাওই ধর্মসভা চলার সময় গির্জায় বোমা পেতে রাখার কথা বলা হয়নি। কিন্তু আমলই দিল না পুলিশ। তাঁকে স্বীকার করতেই হবে। ধর্মপ্রাণ মুসলিম সৈয়দ নিজেকে শাহাদতের হাতে তুলে দিয়ে স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলেন। খোদা তাঁকে এমনি বিপদের ভেতর দিয়ে তুলে নিতে চাইলে, আল্লাহর ইচ্ছা যদি তাই হয়ে থাকে, তিনি কী করতে পারেন? কিছুই স্বীকার করলেন না সৈয়দ। তিনি কিছুই করেননি, তো স্বীকার করার মতো কিছুই নেই তাঁর। নির্যাতনকারীরা তাঁকে নিয়ে আরও কষ্টকর নিপীড়নের পথ ধরে খেটে মরল। পুলিশ একাডেমিতে এসব কৌশলের শিক্ষা পেয়েছে তারা। প্রবীণেরা এমনকি পূর্ব জার্মানিতে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতেও অংশ নিয়েছে। ঠিকমতো নির্যাতন করার জন্য চাই সত্যিকারের নৈপুণ্য। সেই নাসেরের আমল থেকেই মিসরীয় পুলিশ প্রায়ই এক্ষেত্রে নিজেদের আলাদা করে এসেছে।
সৈয়দ ছিলেন ৩১ ডিসেম্বরের বোমাবর্ষণ ঘটনার আদর্শ অপরাধী। নিরীহ ছিলেন তিনি, কিন্তু সেটা নিয়ে আটককারীদের মাথাব্যথা ছিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দ্রুত ফল দেখতে চেয়েছেন। পরদিন সকালে মিডিয়ার সামনে সন্ত্রাসীদের উপস্থাপন করতে চান তিনি। নিপীড়কদের তাগিদ দিয়ে চললেন আল রামল এলাকার পুলিশপ্রধান। কিন্তু খুব খারাপ। সব রকম কষ্ট সহ্য করে, নির্যাতনের অত্যাধুনিক কৌশল প্রয়োগ সত্ত্বেও স্বীকার করে নেওয়ার মতো কিছু না থাকায় কিছুই স্বীকার করলেন না সৈয়দ বেলাল। আঘাতের ফলে ক্ষতবিক্ষত, কালশিটে পড়া রক্তাক্ত দেহে হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। সবার জন্যই দীর্ঘ রাত ছিল সেটা। হতভাগ্য সৈয়দ বেলাল আর নির্যাতন করে ক্লান্ত হয়ে বাড়িতে স্ত্রী-সন্তানদের কাছে যেতে ইচ্ছুক ঘাতক, উভয়ের জন্যই। পুলিশপ্রধানের পক্ষেও এক দীর্ঘ রাত, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুসংবাদ দিতে পারবেন না তিনি। আর মন্ত্রী মহোদয়—সকালে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেওয়ার সময় অবশ্যই তাঁকে নির্যাতনের মুখে সন্দেহভাজনের প্রাণ হারানোর খবর দিতে হবে।
৬ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার বিকেলে স্থানীয় হাসপাতালের সামনে ফেলে যাওয়া হলো লাশ। নজর রাখল পুলিশ। একজন পুরুষ নার্স লাশটা দেখতে পেয়ে ভেতরে নিয়ে যায়। মৃতের কাছে পরিচয়পত্র পেয়ে পরিবারের কাছে খবর পাঠায় সে। এদিকে তাদের মুখ বন্ধ রাখার প্রয়াসে সৈয়দ বেলালের ভাই ইব্রাহিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হাসপাতালে এলেন বাবা-মা, ছেলেকে শনাক্ত করে শরীরের স্পষ্ট নির্যাতনের চিহ্নের ছবি তুললেন। ক্ষুব্ধ, শোকার্ত অবস্থায় অভিযোগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁরা, কিন্তু অবিলম্বে নাক গলাল পুলিশ, পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল, ইব্রাহিম এখন তাদের হাতে, পরিবার ঝামেলা করলে আরেকটি ছেলের ভাগ্যেও তার ভাইয়ের মতো একই ঘটনা ঘটবে।
অশ্রু আর প্রার্থনা বাদে বাবা-মার জন্য আর কিছুই রইল না। মুসলিম সপ্তাহের পবিত্রতম দিন শুক্রবারের ঝামেলা এড়াতে পুলিশ সে রাতেই ছেলেকে কবর দেওয়ার হুকুম দিল তাদের। আলোচনা করার চেষ্টা করলেন বাবা-মা, কিন্তু লাভ হলো না। দাবি প্রত্যাহার না করলে ইব্রাহিম মুক্তি পাবেন না। ওঁরা জানতেন পুলিশ তাকে মেরে ফেলতে দ্বিধা করবে না। শেষ পর্যন্ত মাঝরাতের ঠিক আগে কবর দেওয়া হলো সৈয়দ বেলালকে।
এভাবেই হোসনি মোবারকের অধীনে কাজ করে পুলিশ।
(গ্রান্টা সাহিত্য ম্যাগাজিন থেকে)
তাহের বেন জেলোউন: মরক্কোর ফরাসি ভাষার কবি ও লেখক। জন্ম ১ ডিসেম্বর ১৯৪৪। বছর কয়েক ধরে নোবেল পুরস্কারের জন্য এই লেখকের নাম আলোচনায় আসছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২১, ২০১১
Leave a Reply