একাত্তরের বন্ধু ও শত্রুর সন্ধানে
আখতার হুসেন
১৯৭১ বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া: হাসান ফেরদৌস \ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন \ প্রকাশকাল: নভেম্বর ২০০৯ \ প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী \ মূল্য: ৩০০ টাকা
তাঁর এই বইয়ের ভূমিকাতেই হাসান ফেরদৌস আমাদের জানান দিচ্ছেন, ‘১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত হয় সে কথা ঠিক, কিন্তু সে যুদ্ধের অনেক ঘটনাই ঘটে রণাঙ্গনের বাইরে, বহু দূরে। কখনো পর্দার সামনে, কখনো পর্দার অন্তরালে সংঘটিত সে যুদ্ধে অনেকে ছিলেন বাংলাদেশের বন্ধু, কেউ কেউ শত্রু।’ তিনি আরও জানান, ‘শত্রুদের অনেকেই ইতিমধ্যে চিহ্নিত ও নিন্দিত। তাঁদের মধ্যে দুই প্রধান চরিত্র হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার।’
এহেন ভূমিকা স্বভাবতই মুহূর্তে আমাদের গ্রন্থের গভীরে প্রবেশের আগ্রহকে উসকে দিতে সাহায্য করে। বিশেষ করে, একাত্তরের কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চালচিত্রটিও তার বিশাল ক্যানভাসসমেত আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই বই পড়ার সময় আমরা যদি বিংশ শতকের পাঁচ, ছয় ও সাতের দশকে দুই পরাশক্তি তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলা ঠান্ডাযুদ্ধজনিত পরিস্থিতি হিসাবের মধ্যে রাখি, তাহলে এই বইয়ে বিবৃত ঘটনার ধারাক্রম বোঝার ব্যাপারটি সহজ হবে বলেই আমার ধারণা। উল্লিখিত দুই পরাশক্তির একটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় বিরোধিতা করেছিল, অন্যটি করেছিল সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা। হাসান বহুরৈখিকভাবে এসব তথ্যই তুলে ধরেছেন নানা গ্রন্থ ও দলিলের সূত্র এবং সুবাদে। এই গ্রন্থের পাঠে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জানবাজিধরা সমর্থক শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে রিচার্ড নিক্সন কোন দৃষ্টিতে দেখতেন, তাঁকে তিনি যে ‘দ্যাট বিচ’ বলে সম্বোধন করতেন, বিশেষ করে, ব্যক্তিগত আলাপচারিতার সময়, হাসান এ রকম বিরল তথ্যও তুলে ধরেছেন হোয়াইট হাউসে নিক্সনের কথোপথনের রেকর্ডিং ও সেখানে কর্মরত তখনকার কর্মকর্তাদের স্মৃতিচারণাগত উৎস থেকে। বিস্মিত হতে হয় হাসানের প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহের সপ্রাণ আগ্রহ ও প্রয়াসের ব্যাপারটি দেখে।
মোট ১২টি অধ্যায়ে বিভক্ত এই গ্রন্থের শিরোনামগুলো থেকেই বোঝা যায়, প্রাবন্ধিক-গবেষক হাসান ফেরদৌসের অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি কত দিকে প্রসারিত। অধ্যায়গুলোর শিরোনাম হচ্ছে ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে হোয়াইট হাউস’, ‘কূটনীতি: পর্দার আড়ালে, পর্দার বাইরে’, ‘উ থান্ট: পক্ষে না বিপক্ষে’, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত’, ‘একাত্তরে চীন: ফিরে দেখা’, ‘ভুট্টো: জন্মের মিথ্যুক’, ‘একাত্তর: একজন বালুচ নেতার চোখে’, ‘একাত্তরে গণহত্যা ও ভুট্টোর “তওবা”’, ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান: স্বীকৃতির খেলা’, ‘বাল্টিমোর: ১৪ জুলাই ১৯৭১’, ‘সিডনি শ্যানবার্গের ১৯৭১’ ও ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’।
প্রতিটি অধ্যায়ে সংশ্লিষ্ট তথ্যের প্রাচুর্যে যেমন মন ভরে ওঠে, তেমনি সেই মনকে এই খেদেরও বশবর্তী করে যে এত দিনে কোথায় ছিল এত সব তথ্য! এবং এই গ্রন্থের পাঠ শেষে আমরা এই বোধে জারিত হই যে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনুকূলে আন্তর্জাতিক পরিসরে কত সংগঠন, কত ব্যক্তি, নারীপুরুষ নির্বিশেষ অবদান রেখেছেন—তাঁদের স্বীকৃতিতে এখনো একটি স্মারকস্তম্ভ গড়ে উঠল না কেন?
এই গ্রন্থের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় এর পরিশিষ্ট। সেই গুরুত্বের উল্লেখ করতে গিয়ে হাসান জানান, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শুরু একাত্তরে নয়, তার অনেক আগে। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্তের শুরু অনেক আগে থেকে। বামপন্থী আন্দোলন ঠেকানোর নামে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থবিরোধী যে ভূমিকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করে, এখানে সংযোজিত পঞ্চাশ দশকের ঘটনাভিত্তিক দুটি লেখায় সে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।’ এই লক্ষ্য থেকেই হাসান ফেরদৌস বিংশ শতকের নয়ের দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবমুক্ত করা সিআইএর গোপন দলিল ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের সাহায্যে তুলে ধরেছেন, কীভাবে কমিউনিস্ট তথা বামপন্থীদের দমনের নামে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে সূচিত বহুদলীয় রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ধারাকে আমেরিকা প্রভাবিত এ দেশীয় ও পশ্চিম পাকিস্তানি এজেন্টরা বাধাগ্রস্ত করেছিল, যুক্তফ্রন্ট ও সরকারকে কীভাবে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল এবং বাধানো হয়েছিল আদমজী পাটকলে সেই ভয়াবহ দাঙ্গা, যাতে নিহত হয়েছিল ৬০০-রও বেশি শ্রমিক-কর্মচারী। এসব তথ্য হাজির করার পর হাসান গ্রন্থের উপসংহার টানছেন এই বলে যে, ‘আমেরিকাকে খুশি করা ও নিজেদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাই ছিল পাকিস্তানি নেতৃত্বের লক্ষ্য। খুব বেশি দিন নয়, সে ঘটনার দেড় দশক পরেই পূর্ব বাংলায় জন্ম নেবে আরেক যুক্তফ্রন্ট, যার পরিণতিতে প্রতিষ্ঠিত হবে স্বাধীন বাংলাদেশ।’ বস্তুত, তা-ই হয়েছে।
পরম দালিলিক মর্যাদাসম্পন্ন গ্রন্থ ১৯৭১ বন্ধুর মুখ শত্রুর ছায়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা। লেখককে আন্তরিক অভিনন্দন বহুল পরিশ্রমসাপেক্ষ এ রকম একটি গ্রন্থের জনক হওয়ার জন্য।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ২১, ২০১১
Ashraful Hoque Zehadi
বইটির প্রথম ২০ পৃষ্ঠার ছবি দিতে পারবেন?
খুব উপকার হতো ভাই।