এবারের (২০১১) সাহিত্যে নোবেলজয়ী সুইডেনের কবি টোমাস ট্রান্সট্রয়মার সাধারণ বাংলা পাঠকদের কাছে পরিচিত না হলেও বিদ্বজ্জনেরা তাঁর সম্পর্কে মোটামুটি খোঁজখবর রাখেন বলে মনে করা যেতে পারে। কারণ, সম্ভাব্য নোবেলজয়ী হিসেবে তাঁর নাম আলোচিত হচ্ছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। ১৯৯৩ থেকে বর্তমান বছরের নোবেল জেতা পর্যন্ত প্রতিটি বছরই মনোনীত ব্যক্তিদের তালিকায় তাঁর নাম থেকেছে এবং বেশ কয়েক বছর ধরে নোবেল কমিটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণার বেশ আগে থেকেই অন্ততপক্ষে সুইডেনের সাংবাদিকেরা তাঁর বাড়ির বাইরে অবস্থান নিয়ে বসে থাকতেন এবং নাম ঘোষণার পর হতাশ হয়ে ফিরে যেতেন। এবারও তেমনি ছিলেন তাঁরা। আর বাড়ির ভেতরে আশা-নিরাশার দোদুল্যমানতা নিয়ে অন্য বছরগুলোর মতো অপেক্ষা করছিলেন কবি নিজে ও তাঁর স্ত্রী মনিকা। স্টকহোমের স্থানীয় সময় বেলা একটার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পাঁচ মিনিট আজ পর্যন্তও যখন টেলিফোন বাজেনি, তখন তাঁরা ভাবলেন, এবারও তাহলে হোল না! আর কবির মূল লেখার সুইডিশ প্রকাশিকা ইভা বোমিন বিগত অনেকগুলো বছরের নিষ্ফল অপেক্ষার হতাশার কারণে এবার আর টেলিভিশনের কাছে বসেনইনি। কিন্তু বেলা একটা বাজার ঠিক চার মিনিট আগে টেলিফোনটি বেজে উঠল এবং কবিকে জানিয়ে দেওয়া হলো এবার তিনিই সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারটি পেয়েছেন। ১৯৯০ সালে কবির ৫৯ বছর বয়সে পক্ষাঘাতের ফলে শরীরের পুরো ডান দিকটাই অবশ। সীমিত আকারে চলাফেরা করেন চাকাওয়ালা চেয়ারে বসে। আর কথা বলেন কিংবা বলতে পারেন, খুবই কম। তা-ও জড়িয়ে জড়িয়ে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কবিতার উৎসারণ খানিকটা কমে এলেও, সৌভাগ্যক্রমে একেবারে থেমে যায়নি। ১৯৩১ সালের ১৫ এপ্রিল জন্ম তাঁর। তাই ৮০ বছর বয়সে আংশিক পঙ্গুত্ব নিয়ে বহু প্রত্যাশিত এই নোবেলজয় কবির জীবনে তাই এক বিরাট প্রাপ্তি।
পৃথিবীর প্রায় ষাটটির মতো ভাষায় অনূদিত হলেও টোমাস ট্রান্সট্রয়মার (Tomas Transtromer এভাবেই উচ্চারিত হয়) বাংলায় এখনো অনূদিত হয়েছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। তাঁর সম্পর্কে আমার নিজের আগ্রহও খুব বেশি পুরোনো নয়। নোবেলের মনোনীত ব্যক্তিদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় বারবার তাঁর নাম আসতে থাকলে সুইডেন-প্রবাসী এবং উপসালা (Uppsala) বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আমার এক ভাগনের কাছে ধরনা দিলে তার বদান্যতায় ইংরেজি অনুবাদে ট্রান্সট্রয়মারের গোটা দুয়েক গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ পেয়ে যাই। সে-ও ২০০৬ সালের একেবারে শুরুতে। তাঁর কবিতাগুলো পড়ে আমি একেবারে অন্য আরেকটি জগতের সন্ধান পেয়ে যাই যেন। সেই থেকেই ভেবে আসছিলাম, তাঁকে নিয়ে বাংলায় পরিচিতিমূলক কিছু একটু লিখব। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি বর্তমান এই লেখার আগ পর্যন্ত। সংগীত ও কাব্যপ্রীতি বাঙালির রক্তে যেন মিশে আছে। অথচ ভাবলে দুঃখ হয়, টোমাস ট্রান্সট্রয়মারের কবিতার মতো এক অনবদ্য কাব্যধারার রসাস্বাদন থেকে তারা এত কাল বঞ্চিত থেকেছে। ভালো অনুবাদ হলে এখন হয়তো খণ্ডিত আকারে হলেও এই সুযোগ তারা পাবে বলে আশা করা যায়।
এ প্রসঙ্গে অনুবাদ, বিশেষত কাব্যের অনুবাদ নিয়ে বিদগ্ধ মহলের বিরূপ মনোভাবের কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে আসে। আর এই বিরূপতার যৌক্তিক কারণও যে নেই, তা নয়। যেকোনো ভাষার মৌলিক কবিতার পাঠকমাত্রই জানেন, মানোত্তীর্ণ কবিতা যতখানি না অর্থ বহন করে, তার চেয়ে অনেক বেশি বহন করে ভাব। আর এই ভাব তৈরিতে তাত্ত্বিক, দার্শনিক কিংবা আবেগিক বিষয়ের উপস্থাপনে কবি যে চিত্রকল্প, বাক্যপ্রকরণ, শব্দ-দ্যোতনা কিংবা কখনো কখনো অত্যন্ত হূদয়গ্রাহী ও ছন্দময় অনুপ্রাসের ব্যবহার করেন, কিংবা আনেন, তাঁর সংস্কৃতি-বলয়ের উপমা-উৎপ্রেক্ষা ও পৌরাণিক অনুষঙ্গ, তার ভাষান্তর অনেক ক্ষেত্রেই শুধু কষ্টসাধ্য নয়, অসম্ভব। এসব কথা ভেবেই হয়তো রবার্ট ফ্রস্ট বলছিলেন, অনুবাদে যে জিনিসটি হারিয়ে যায়, সেটিই হচ্ছে কাব্য কিংবা কবিতা। কথাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচিত হয়ে আসছে বোদ্ধামহলে। কিন্তু তাই বলে অনুবাদ এবং কবিতার অনুবাদও থেমে তো নেই-ই; বরং বাড়ছে দিন দিন। কারণ, পৃথিবীব্যাপী শিক্ষা-সংস্কৃতির ক্রমাগত প্রসারের ফলে অন্যের সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহও বাড়ছে দিন দিন। আর একমাত্র অনুবাদ ছাড়া তা মেটাবার আর কোনো পথই নেই।
অনুবাদ নিয়ে এখানে এতগুলো কথা বলার কারণ আছে। ইংরেজি ব্যতিরেকে অন্যান্য বিদেশি সাহিত্য—তা গদ্য কিংবা কাব্য যা-ই হোক—আমরা প্রধানত ইংরেজি অনুবাদেই পড়ি। আর তার সামান্য যা কিছু বাংলায় তরজমা করা হয়, তারও অধিকাংশই আবার ইংরেজি অনুবাদ থেকে অনূদিত। মূলটি আসলে যে কেমন ছিল, সে সম্পর্কে প্রায়ই আমরা কোনো ধারণা করতে পারি না। টোমাস ট্রান্সট্রয়মারও আমি যতখানি পড়েছি, তার সবটুকুই ইংরেজি তরজমায়। কারণ অতি সহজ—আমি সুইডিশ ভাষার বিন্দুবিসর্গও জানি না। ইংরেজি অনুবাদে যে বই দুখানি আমি পড়েছি তার একটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কবি এবং ট্রান্সট্রয়মারের বিশেষ বন্ধু বরার্ট ব্লাইয়ের নির্বাচিত ও অনূদিত The half Finished Heaven এবং অন্যখানি হচ্ছে রবার্ট হাস (Robert Hass) সম্পাদিত Selected Poems 1954-1986। দ্বিতীয় বইখানিতে রবার্ট ব্লাই ছাড়াও ট্রন্সট্র্যামারের অন্য সব ইংরেজি অনুবাদকের নির্বাচিত অনুবাদে সমৃদ্ধ। রবার্ট ব্লাইয়ের সংগ্রহখানিতে মাঝারি আকারের একটি ভূমিকা রয়েছে। ওটি পড়ার আগেই আমি বেশ কটি কবিতা পড়ে ফেলি এবং এক ধরনের ধাক্কা খাই। কবিতাগুলোর ইংরেজি অবিশ্বাস্য রকমের সহজ, জটিলতাহীন ও একরোখা ধরনের। নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের অতি সাধারণ ঘটনা, চারপাশের নৈসর্গিক বস্তু কিংবা দৃশ্যের সরল বর্ণনা—এ কেমন ধরনের কবিতা। এ ভাব আমার মনে এসেছিল। কিন্তু ওই পরিচিত ঘটনা, সাধারণ নিসর্গ উদ্ভট একটা ডিগবাজি খেয়ে কেমন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন, অস্পষ্ট ও সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে যেন তাঁর সাধারণত ছোট ছোট কবিতাগুলোর শেষ দিকে গিয়ে। পাঠক তখন অবাক হতে বাধ্য। রহস্যময় হয়ে ওঠে পুরো বিষয়টিই। এর আগে এমন কোনো কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। অনুবাদে কি তাহলে এর রূপ কিছুটা পাল্টে গেল? রবার্ট ব্লাইয়ের ভূমিকা পড়ে জানলাম, শব্দের পরে শব্দ, বাক্যের পরে বাক্য, চিত্রকল্পের পরে চিত্রকল্প একেবারে অবিকৃত রেখেই এই কবির কবিতা অনুবাদ করা যায় এবং করা হয়েছেও তা-ই। পড়েও খটকা লাগেনি কোথাও। তখন মনে হলো, রবার্ট ফ্রস্ট কখনো কখনো সত্য হলেও, সব সময় সঠিক নন, অন্তত টোমাস ট্রান্সট্রয়মারের বেলায় তো নয়ই। অন্তত আরও একজন মহৎ কবির কাব্য রচনা সম্পর্কে দেওয়া ব্যবস্থাপত্র নাকচ করে দিয়েছেন ট্রান্সট্রয়মার। স্তেফান মালার্মে বিশ্বাস করতেন, কাব্যে রহস্য থাকা উচিত এবং নিজ নিজ রচনায় এমন রহস্য তৈরি করতে কবিদের উৎসাহ জোগাতেন তিনি। বাস্তবতার যে ক্ষণ কিংবা স্থানটি কবিতার উৎস প্রয়োজনে সেই বন্ধনটুকু ছিঁড়ে ফেলে রহস্য তৈরির পথও বাতলে দিয়েছিলেন মালার্মে। কিন্তু সে পথ মাড়াননি ট্রান্সট্রয়মার। তাঁর কবিতায় দৈনন্দিন পার্থিব ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্র খুব শক্ত করেই ধরে রাখা হয়, কিন্তু তথাপিও রহস্য, অস্পষ্টতা ও বহু অর্থের সম্ভাবনা কোনোমতেই ম্লান হয়ে ওঠে না, এমনকি বারবার পড়ার পড়ও। একটি কবিতার কিছু অংশের বাংলা অনুবাদ পড়লেই তাঁর কবিতার ধরন সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা যাবে, আশা করি। কবিতাটির নম ‘খোলা জানালা’ আর অনুবাদটুকু তাৎক্ষণিকভাবে আমার নিজেরই করা।
‘দোতলায়
খোলা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
একদিন সকালবেলা দাড়ি কামাচ্ছিলাম।
রেজারের বোতামটি টিপে দিলাম।
মৃদু গুঞ্জরণ শুরু করে দিল সেটি।
বাড়তে বাড়তে তা ক্রমাগত জোরে বোঁ-বোঁ
শুরু করল।
তারপরে পরিণত হলো ঘরঘর শব্দে।
হয়ে গেল একটি হেলিকপ্টার।
আর ওই ঘরঘরানির গন্ডগোল ভেদ করে
একটি কণ্ঠস্বর—পাইলটের সেটি—
চেঁচিয়ে উঠল:
“চোখ খোলা রাখুন!
এ সবকিছুই শেষবারের মতো দেখছেন
আপনারা”।
এরপর গ্রীষ্মের ওপর খুব নিচু হয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যেতে দেখা গেল গোলাপ। দেখা গেল সবুজের হরেক রকমের আঞ্চলিক কথ্যরীতি। বিশেষ করে বাড়ির দেয়ালগুলোর লাল রং। আর দেখা গেল রোদের মধ্যে গোবরে লেপটে থাকা চিকচিক করা গুবরে পোকা। শিল্প-কারখানা। ছাপাখানা কনুইয়ে ভর করে করে হাঁটছিল আর ঠিক সেই মুহূর্তে একমাত্র গতিহীন বস্তু ছিল মানুষ। তারা যেন পালন করছিল তাদের নীরবতার মুহূর্ত। আর ক্যামেরার একেবারে আদি যুগে ছবি তোলার জন্য লোকেরা যেমন কাঠের মতো শক্ত হয়ে ঠায় বসে থাকতো, ঠিক তেমন অনড় স্থির হয়ে ছিল গির্জার অঙ্গনে সমাহিত মৃতেরা।
এরপর কবি বলেন, …
“ঠিক কোন দিকে যে আমি মাথা ঘোরাব তা যেন বুঝতে পারছিলাম না—
ঘোড়ার যেমন
আমার দৃষ্টিও তেমনভাবে বিভক্ত হয়ে গেল”।’
কবিতাটি এখানেই শেষ। অতি সহজ ভাষা, বর্ণনা সরল, ঘটনায় নেই কোনো জটিলতা; আর বোঝাও যাচ্ছে প্রায় সবটুকু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি যে বলতে চাইলেন কবি, তা ধোঁয়াশাচ্ছন্নই যেন থেকে গেল।
ট্রান্সট্রয়মারের কবিতা লেখা শুরু তুলনামূলকভাবে তরুণ বয়সে। তাঁর পূর্বপুরুষ সুইডেনের দ্বীপপুঞ্জে ‘পাইলট’ হিসেবে কাজ করে বাণিজ্যিক ও অন্যান্য নৌযান এগিয়ে নিয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁর বাবা ছিলেন সাংবাদিক। এই সাংবাদিক বাবা ও নার্স হিসেবে প্রশিক্ষিত মায়ের সঙ্গে যখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, তখন তাঁর বয়স মাত্র তিন বছর। এর পর থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত মা-ই ছিলেন তাঁর জীবনের সব। স্টকহোমের নিম্নবিত্ত পরিবারের বসবাসের এলাকায় একটি অ্যাপার্টমেন্টেই মার সঙ্গে বেড়ে ওঠেন ট্রান্সট্রয়মার। তবে স্কুল শেষ করে স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রিও অর্জন করেছেন তিনি। বিষয় ছিল মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস ও সাহিত্য। কর্মজীবনে তিনি মনস্তত্ত্ববিদ হিসেবেই কাজ করেছেন—কখনো জেলখাটা কয়েদিদের মধ্যে, কখনো কিশোর অপরাধীদের মধ্যে আবার কখনো বা মাদকাসক্তদের নিয়ে। এদেরকে পরামর্শ দিয়ে সংশোধনের চেষ্টাই ছিল তাঁর মূল কাজ। পশ্চিমা দেশগুলোর বড় কোনো লেখক-কবির মতো সার্বক্ষণিক সাহিত্যচর্চার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। সে কারণে সুদীর্ঘ জীবনেও তাঁর লিখিত কবিতা ও আত্মজীবনীমূলক ক্ষুদ্র একটি বই মিলিয়ে মোট ছাপানো পৃষ্ঠার সংখ্যা তিন শর কাছাকাছি মাত্র। আর ১১টি বা তার চেয়ে সামান্য দু-একটি বেশি কাব্যগ্রন্থগুলোও ক্ষীণকায়। তার মাত্র ২৩ বছর বয়সে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ হওয়ার আগে ১৯৫৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় মাত্র ১৭টি ছোটখাটো কবিতা নিয়ে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। নাম ১৭টি কবিতা। তবে ওই ছোট ছোট ১৭টি কবিতাই খুব মৃদু কিন্তু অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে জানান দিয়েছিল, সুইডিশ সাহিত্যে তো বটেই, ইউরোপীয় এমনকি বিশ্ব সাহিত্যে নতুন এক কবির আবির্ভাব ঘটেছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৪, ২০১১
Leave a Reply