স্টকহোমে কবির বাড়িটি লোকে লোকারণ্য। সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার, রেডিও-টিভির ভাষ্যকার, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজনের বিশাল জনসমাগম সামাল দিতে মনিকা ট্রান্সট্রয়মার হিমশিম খাচ্ছিলেন। সিঁড়িতে দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। এই বাড়িতে এর আগেও এসেছি কবি টোমাস ট্রান্সট্রয়মারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে, কবির সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে। কিন্তু এত জনসমাগম দেখিনি। দেখিনি পুলিশ। মনিকাই দরজা খুলে দিয়েছেন হাসিমুখে। দিনটি ৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার। স্টকহোমের আকাশে হেমন্তের হালকা মেঘ। কিছুক্ষণ আগেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এই বাড়িটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দু।
সবাই যখন ছোট হলঘরটিতে একত্র হলাম, মনিকা এসে হেসে বললেন, ‘অপূর্ব, অভূতপূর্ব। এমনটি হবে ভাবিনি।’ ভাবনা আমাকেও বাধা দিচ্ছিল। ২০০১ সালে যখন নোবেল পুরস্কারের শতবর্ষ পূর্তি হলো তখন ভেবেছিলাম, এবার হয়তো একজন সুইডিশ পুরস্কৃত হবেন। সুইডিশ কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে এর আগে সাতজন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। সর্বশেষ যুগ্মভাবে পেয়েছেন এভিন জনসন ও হ্যারি মার্টিসন ১৯৭৪ সালে, আজ থেকে প্রায় ৩৭ বছর আগে। অবশ্য ১৯৯১ থেকেই টোমাস ট্রান্সট্রয়মার নোবেল তালিকায় জোরালোভাবে বিচরণ করছিলেন। নোবেল পুরস্কারের শতবার্ষিকীতে পেলেন ভি এস নাইপল, ভেবেছিলাম টমাসের সুযোগটি কি ফসকে গেল? মনিকার ভাবনা জানতে চেয়ে ফোন করেছি। ম্লান হেসে বলেছেন, ‘আশা ছিল তবে আশাহত হইনি।’ না, মনিকা আশাহত হননি। স্বামীর সৃষ্টিকর্মের ওপর অগাধ বিশ্বাস, বিশ্বাস নিয়েই অপেক্ষা করেছেন আর স্বামীকে উৎসাহ দিয়েছেন নতুন সৃষ্টিকে। অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। ঘরের গোলটেবিলের পাশে বসে আছেন সদ্য নোবেল বিজয়ী টোমাস ট্রান্সট্রয়মার, মুখখানা লাজুক তবে খুশিতে উজ্জ্বল রক্তিম। ঘরের চারদিকে বই, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তাকগুলো পূর্ণ। পাশে পিয়ানো, যা তিনি প্রতিদিন বাজান, দেয়ালে ঝোলানো মা হেলমির পোর্ট্রেট, যিনি ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা, পিতা মারা যাওয়ার পর মা-ই কবিকে লালনপালন করেছেন।
‘তুমি কি জানতে? প্রশ্ন রাখলাম মনিকার কাছে।
‘একেবারেই না।’ বলল মনিকা, ‘আমরা ঠিক করেছিলাম প্রতিবারের মতো এবারও রেডিওর সামনে বসে খবরটা শুনব, কে পাচ্ছে এ বছর। ঠিক একটা বাজার কয়েক মিনিট আগে সুইডিশ একাডেমির সেক্রেটারি পিটার এঙ্গলুন্দ টেলিফোন করেন।’ মনিকা আর টমাসের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস উপচে পড়ছে। এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে টিপ্স পেয়েছিলাম যে ট্রান্সট্রয়মার সেলুন থেকে চুল বিন্যাস করে এসেছেন, একাডেমি থেকে টেলিফোন পেতে পারেন। সে কথা জানাতেই মনিকা বললেন, ‘তা নয়, সেলুনে সময় নেওয়া ছিল আগেই, আমরা থিয়েটারে যাব বলে।’
কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই কবি হওয়া যায় না।
তবে ভাগ্য গুণে কবিদের সংস্পর্শে আসা যায়। এভাবেই ট্রান্সট্রয়মার, ইউরান পাল্ম, সিভ ভিদেরব্যারী, অরনে ইউহানসনের মতো সুইডিশ কবিদের সংস্পর্শে এসেছিলাম। এর মধ্যে মনিকা আর ট্রান্সট্রয়মারের একাগ্রতা সংস্পর্শের মধুরতা বাড়িয়ে দিয়েছিল। ইতিমধ্যে ট্রান্সট্রয়মারের কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করে ফেলেছিলাম। সেগুলো আবার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিতও হয়েছিল। যোগসূত্রটা এভাবেই দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছিল। এ সময় সুইডেনস্থ বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির ইকোনমিক কাউন্সিলার সাহিত্যমোদী আজীজ রহমান ট্রান্সট্রয়মারের কবিতার ওপর কাজ করছিলেন। ট্রান্সট্রয়মার সমসাময়িক সময়ে সুইডেনের অন্যতম কবি। তাঁর ওপর যত কাজ হবে, ততই বাংলা কাব্যসমাজ তাঁকে জানতে পারবে। আমিও চাচ্ছিলাম আজীজ রহমানের কাজটা এগিয়ে যাক। অবশ্য সুইডেনপ্রবাসী গজেন ঘোষ ট্রান্সট্রয়মারের ওপর কাজ আগেই শুরু করেছিলেন। তবে আজীজ রহমানের শুভ সন্ধ্যা, হে সুন্দর গভীরতা বইটি ছিল আধুনিক সুইডিশ কবিতা থেকে শুরু করে ট্রান্সট্রয়মারের সামগ্রিক কর্মের ওপর আলোচনা ও বিভিন্ন কবিতার অনুবাদ। কাজটি সময়সাপেক্ষ তবুও আজীজ রহমান কাজটি এগিয়ে নিতে সচেষ্ট ছিলেন। বিশেষ এই কাজটির জন্যই টোমাস ট্রান্সট্রয়মারের সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজন দেখা দিল।
কবির সঙ্গে বিস্তারিতভাবে আলোচনা, তাঁর মতামত নেওয়া প্রয়োজন ছিল। ১৯৯০ সালে হঠাৎ এক স্ট্রোকে কবি বাকশক্তি হারান। তাই পত্নী মনিকা তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী। কবি টোমাস ট্রান্সট্রয়মার সে সময় থাকতেন স্টকহোম থেকে ১১৫ কিলোমিটার দূরে ভেস্তারোস নামক শহরে। আজীজ সাহেব টেলিফোন করে জানালেন স্বীয় পরিবারসহ সবাইকে নিয়ে টমাসের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন আমাকেও সঙ্গী হতে হবে। কবির সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগটা হারাতে চাচ্ছিলাম না। হেমন্তের এক রোদ্রৌজ্জ্বল সকালে আমরা স্টকহোম থেকে রওয়ানা দিলাম। দেখা হওয়ার সময় বেলা দুইটা। তখন কবিগৃহের সম্মুখে এসে দাঁড়ালে কবিপত্নী মনিকা সাদর সংবর্ধনা জানালেন। মনিকা আর টমাসের সঙ্গে সেই আমার প্রথম দেখা।
কবি বাকশক্তি হারালেও বোধহীন নন। গলা জড়িয়ে এলেও দু-একটা শব্দ বলতে পারেন, স্বল্প হলেও লিখতে পারেন আর সর্বোপরি সবই বুঝতে পারেন। আমাদের দেখেই কবির উচ্ছ্বাস বেড়ে গেল, হুইল চেয়ারে বসেই সবার সঙ্গে হাত মেলালেন। মুখে উচ্ছল হাসি। সুইডিশ আর বাংলা কবিতা, কবি আর সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হলো। মনিকা আমাদের কথাগুলো কবিকে ধীরে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। টোমাস ট্রান্সট্রয়মার বাংলার কবিদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথকে চেনেন। চেনেন গভীরভাবে। কথা হলো নজরুল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমানকে নিয়ে। জীবনানন্দের নির্জনতার সঙ্গে গভীরভাবে মিল আছে টোমাস ট্রান্সট্রয়মারের। টোমাস আমাদের পিয়ানো বাজিয়ে শোনালেন। আর মনিকা আপ্যায়ন করলেন কফি আর কেক দিয়ে। কবি সান্নিধ্যে মুগ্ধতায় কয়েকটি ঘণ্টা কেটে গেল।
কিছুদিন পর ভেস্তরোসের পাট চুকিয়ে কবি বাসা বাঁধলেন স্টকহোমে।
এই সময় আমরা আয়োজন করলাম প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তিন প্রধান কবির সৃষ্টি নিয়ে কবিতা-সন্ধ্যা। তিন কবির মধ্যে ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, টোমাস ট্রান্সট্রয়মার আর শামসুর রাহমান। কবিগুরু বিগত, শামসুর রাহমান তখন অসুস্থ, আসতে পারেননি। তবে এসেছিলেন টোমাস ট্রান্সট্রয়মার আর দীর্ঘ বাণী পাঠিয়েছিলেন শামসুর রাহমান। তিন কবির বাংলা—বাংলা থেকে সুইডিশ, সুইডিশ থেকে বাংলা কবিতার পাঠে জ্বলে উঠেছিল হলঘর। একাগ্রচিত্তে টোমাস শুনেছেন তাঁর সুইডিশ কবিতার বাংলা অনুবাদ। এর পর থেকেই টোমাস আর মনিকার সঙ্গে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে যোগাযোগটা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
মনিকাকে বলেছিলাম টোমাস সর্ম্পকে কিছু একটা লিখে আমায় দিতে।
মনিকা আমার অনুরোধ রেখে সুইডিশে লিখে পাঠিয়েছিলেন দীর্ঘ এক নিবন্ধ। নিবন্ধের শেষে লিখেছিলেন, ‘১৯৯০ সালে স্ট্রোকে টমাসের ডান অংশটি প্যারালাইজ হয়ে গেলে ভেবেছিলাম, আমাদের জীবন থেকে কবিতা হারিয়ে গেল। কিন্তু তা নয়, কবিতা ফিরে এসেছে আরও গভীরতা নিয়ে। টোমাস আরও একাগ্রতা নিয়ে কবিতা লিখছেন এখন। কেন্দ্রবিন্দুটি আগের মতোই রহস্যে ভরা জীবনের প্রচ্ছন্নতা। ঠিক যেমন এই হাইকুটিঃ
মানবপক্ষী
ফুলে ছাওয়া আপেল গাছ
বৃহৎ রহস্য।
Leave a Reply