সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্তের কাব্যাভিসার
আখতার হুসেন
অনুবাদ কবিতাসমগ্র: শামসুর রাহমান \ প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, \ প্রকাশকাল: সেপ্টেম্বর ২০১১ \
প্রচ্ছদ ও অলংকরণ: কাইয়ুম চৌধুরী \ মূল্য: ৩৫০ টাকা
সাহিত্য-শিল্প ও কলামনস্ক জার্মানরা এ রকম একটা কথা বলে থাকেন যে, বিশ্বের প্রধান প্রধান ভাষার কবি-সাহিত্যিক ও কলারসিকদের লেখা বা রচনাকর্ম পড়ার জন্য আমাদের ঢালাওভাবে বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজন পড়ে না। আমাদের মাতৃভাষা জার্মানেই তাদের প্রায় সমুদয় রচনাকর্ম পাওয়া যায়। কথাটা প্রসঙ্গত শুনেছিলাম একজন জার্মান শিক্ষাবিদের মুখ থেকে। যেকোনো সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক ঋদ্ধির মূলে ক্রিয়াশীল থাকে বিশ্বের অপরাপর ভাষা বা জাতিগুলোর সাহিত্য আর শিল্পের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পারস্পরিক চলমান প্রক্রিয়া। এই চলমান প্রক্রিয়ার অন্যতম বাহন বা মাধ্যম হলো নিজের দেশে অন্য দেশ বা অন্য ভাষার সাহিত্যকর্মের অনুবাদকর্ম, শিল্পকলার অন্য সব মাধ্যমের নিরন্তর আদান-প্রদান।
পাকিস্তান আমলের সেই অনুদার ও রাজনৈতিক রক্ষণশীল পরিবেশে যখন আমাদের প্রধান কবি শামসুর রাহমানের আগে-পরে করা অনুবাদগ্রন্থ রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা, রবার্ট ফ্রস্টের নির্বাচিত কবিতা এবং পাকিস্তানের মরমি কবি খাজা ফরিদের নির্বাচিত কবিতা বের হয়েছিল, তখন সেটা একটা ঘটনাই হয়ে উঠেছিল। দুই মেরুর দুই কবির কবিতার এই অনুবাদ সংকলনগুলো রাহমানীয় কাব্য-শৈলিতায় সমুজ্জ্বল। স্মর্তব্য, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে শুরু করে বিংশ শতকের প্রায় সাতের দশকের শেষাশেষি সময়পরিসরে সেইকালের বাংলাদেশে নানা প্রকাশনা সূত্রে বিশ্বসাহিত্যের কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের অনুবাদ হলেও, তার সংখ্যা ছিল এক অর্থে অঙ্গুলিমেয়। উর্দু ও ফারসি থেকে যেসব গ্রন্থ অনুবাদ করা হয়েছিল, সেগুলোর অনুবাদগত মান ছিল নিম্নস্তরের। সেই প্রেক্ষাপটে বিংশ শতকের ছয়ের দশকের সূচনাকাল থেকে যখন আমাদের দেশের উদার ও আধুনিক সাহিত্য-কারুকারেরা অনুবাদকর্মে আত্মনিবেদিত হন, আমরা পেতে থাকি চমৎকার সব অনূদিত গ্রন্থ। কিন্তু সেসব গ্রন্থের বেশিরভাগই ছিল গদ্যের। সেই প্রেক্ষাপটে রবার্ট ফ্রস্ট ও খাজা ফরিদের কবিতা শামসুর রাহমানের অনুবাদে প্রকাশিত হওয়ামাত্র দ্রুতই তা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। দৃষ্টি কেড়েছিল কাব্যামোদী মহলের।
সদ্য প্রকাশিত এই গ্রন্থের ভূমিকায় ঠিকই বলা হয়েছে, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শামসুর রাহমান ধারাবাহিক বা দীর্ঘ অনুবাদে নিবিষ্ট হয়েছেন কোনো অনুবাদ প্রকল্পের অংশভাক হয়ে। ভিন্ন ভাষার কবিতা পড়তে পড়তে স্বতঃস্ফূর্ত অনুপ্রেরণায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অনুবাদের খাতা টেনে নেওয়ার ঘটনা তাঁর ক্ষেত্রে খুব কমই ঘটেছে।’ আসলেও তাই। ফলে শামসুর রাহমানের অনুবাদ কবিতাসমগ্র গ্রন্থে রবার্ট ফ্রস্ট ও খাজা ফরিদের নির্বাচিত কবিতার পাশাপাশি আমরা পাঁচটি মহাদেশের মাত্র ১০ জন কবির কবিতার অনুবাদ পড়ার সুযোগ পাই। এই ১০ জন কবির এই কবিতাগুলো প্রথমা প্রকাশন প্রথম প্রকাশ করেছিল ‘হাওয়ায় ভেসে আসা স্বর’ শিরোনাম দিয়ে। অনুবাদ কবিতাসমগ্র-তে শেষোক্ত গ্রন্থের কবিতাগুলোও স্বাভাবিকভাবেই সংকলিত হয়েছে।
শামসুর রাহমানের অনুবাদ কবিতাসমগ্র পাঠককে কবি অনূদিত সমুদয় কবিতার পাঠ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছে। সংকলন হিসেবে এর মূল্য শুধু এখানেই শেষ হয়ে যায় না। এটি মূল্যবান আরও একটি দিক থেকে যে, আমাদের প্রধান কবি কেবল স্বকৃত কবিতার পরতে পরতে আধুনিকতার ছাপ রাখেননি, তাঁর অনূদিত কবিতাতেও তা সমভাবে স্বাক্ষরিত। সেই বিখ্যাত কবিতা, ইংরেজিতে যার শিরোনাম ‘স্টপিং বাই উডস অন আ স্নোয়ি ইভিনিং’-এর অনুবাদ করেছেন তিনি ‘শীত সন্ধ্যায় বনের কিনারে’ শিরোনামে। তার শেষ চারটি পঙিক্তর অনুবাদ, অন্য আরও অনেক কবি-মহারথীর অনুবাদের পরও, শামসুর রাহমানের অনুবাদ সবচেয়ে যথাযথ এবং হূদস্পর্শী, অন্তত আমার কাছে, যার উচ্চারণটা এ রকমের:
কাজল গভীর এ-বন মধুর লাগে,
কিন্তু আমার ঢের কাজ বাকি আছে।
যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে,
যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে।
খাজা ফরিদের কবিতার অনুবাদেও শামসুর রাহমানের অনুবাদ-শক্তির পরিচয় বিধৃত। ‘কে বধূ সুন্দরী’ কবিতা তাঁর অনুবাদে হয়ে উঠেছে পরম রমণীয়। মন্দাক্রান্তার দোলায় হয়ে উঠেছে অপরূপ এক কবিতা, মনেই হয় না অনুবাদ পড়ছি। যেমন:
কে বধূ সুন্দরী সোনালি সাজ প’রে,
মোহিনী চোখ মেলে মধুর প্রেমাবেশে,
ওষ্ঠে নিয়ে তার মদির প্রলোভন
কে বধূ সুন্দরী সেখানে ঝলোমলো?
একই ধরনের অনুবাদ-সৌকর্যগত মান তিনি রক্ষা করেছেন পাবলো নেরুদা, হোর্হে লুইস বোর্হেস, পল এলুয়ার, তাদেউশ রোজেভিচ, ই ই কামিংস, মার্সেলিনো দোস সান্তোস, জানানা গুসমাও, কাইফি আজমি, সিম হান এবং ই সাঙ-হোয়ার কবিতার অনুবাদে।
গ্রন্থের শেষে দেওয়া এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থ তিনটি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় টীকাভাষ্য, ভূমিকা এবং কবি পরিচিতি এই গ্রন্থকে সবিশেষ গুরুত্ববহ করে তুলেছে। কবি-অনুবাদক সাজ্জাদ শরিফ এই সংকলনের জন্য যে ভূমিকা লিখেছেন, সেটি মূল্যবান এ কারণে যে, শামসুর রাহমানের সার্বিক কবি-জীবনের পাশাপাশি তাঁর অনুবাদ-প্রয়াসের পটভূমি এবং এক্ষেত্রে তাঁর কৃতীর যথাযথ মূল্যায়নও তাতে ভাস্বর।
মুদ্রণ-সৌকর্যে অনুপম এই গ্রন্থের পেছনে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর করা প্রচ্ছদপটটি যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি ভেতরের অঙ্গসজ্জাও।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ১৪, ২০১১
Leave a Reply