ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় : বিস্মৃত বই বিস্মৃত লেখক
আবদুশ শাকুর
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় বাংলা ভাষার এই অমর গল্পকার তাঁর মহাপ্রয়াণের শতবর্ষ পার না হতেই আজ মৃতপ্রায়, বিস্মৃত তো তিনি অনেককাল থেকেই। অমর লেখকের এই অকালমৃত্যু কিন্তু লেখকের দোষে নয়। তাহলে কার দোষে? অধ্যাপকের? অধ্যাপিতের? প্রকাশকের? পাঠকের? যার দোষেই হোক, দোষটা দূর করতে হবে। কারণ, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের (১৮৪৭-১৯১৯) অবিস্মরণীয় কৃতি চিরস্থায়ী হয়ে আছে কঙ্কাবতী উপন্যাসে, ভূত ও মানুষের বিচিত্র আখ্যানে মুক্তা-মালার সূচনায় এবং ডমরু-চরিত-এর অনবদ্য গল্পমালায়। রূপকথা এদের মধ্যে রূপক হয়ে দেখা দিয়েছে। চরিত্রগুলো এক-একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছে। কৌতুক রূপ নিয়েছে সমসাময়িক জাতীয় জীবনাচরণের তির্যক সমালোচনার। এখানে আমি তার সামান্য নমুনা পেশ করে পাঠক সমীপে প্রশ্ন রাখব—এই অভিনব সৃষ্টির ললাটলিপি কি বিস্মৃতি হতে পারে?
ত্রৈলোক্যনাথ প্রথম বই কঙ্কাবতী (১৮৯২) দিয়ে তাঁর জাত চিনিয়েছেন আর শেষ বই ডমরু-চরিত (১৯২৩) দিয়ে নিজের শীর্ষ ছুঁয়েছেন। লেখকের সকল বৈশিষ্ট্য এ-গল্পমালায় সম্পূর্ণ রঙে-রসে সমুজ্জ্বল হয়ে দেখা দিয়েছে। কাহিনির অপূর্বতার সঙ্গে অমূল্য রঙ্গকৌতুকের সমাবেশ এবং ভাষার সাবলীল স্বাচ্ছন্দ্য বইটিকে সব দিক দিয়ে পরম উপভোগ্য করে তুলেছে। তুলনারহিত ডমরু-চরিত বাংলাসাহিত্যে ত্রৈলোক্যনাথের অবিস্মরণীয় অবদান। অদ্ভুত কল্পনার উদ্দামতার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় চরিত্রের তীক্ষ ও রসোত্তীর্ণ সমালোচনায় এরা যে-সাহিত্যবস্তু পরিবেশন করেছে, তার আস্বাদন অন্যত্র অলভ্য।
গল্পগুলোর কথক ডমরুধরকে শ্রীমুখোপাধ্যায়ের মুক্তা-মালার ‘মূল্যবান্ তামাক ও জ্ঞানবান্ সর্প’ পর্বটির তিনুবাবুর উত্তরসূরি ভাবা যায়। তবে তিনু ডমরুতে উত্তীর্ণ হয়েছে অনেক মূল্য সংযোজনের পরে। যেমন, তিনুর গল্পের বিশুদ্ধ ফানের সঙ্গে ডমরুর গল্পে যুক্ত হয়েছে উজ্জ্বল উইট। গল্পকথক ডমরুধর একটি অসামান্য চরিত্র। বয়সে বৃদ্ধ, চেহারায় কালো এবং কদাকার, স্বার্থের প্রয়োজনে সর্ববিধ নীতিবোধ-বিবর্জিত। গল্পকথক তাঁর বন্ধু লম্বোদর ও শঙ্কর ঘোষদের কাছে তাঁর জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা সাতটি পর্বে বর্ণনা করেছেন। এই সাতটি গল্পের গর্ভে বিষ্কম্ভকস্বরূপ বহু অন্তর্গল্প রয়েছে, যেগুলোর প্রত্যেকটি যেন প্রত্যেকটিকে ছাড়িয়ে যায়—উদ্ভট কল্পনা আর উর্বর কৌতুকে।
পরশুরামের (১৮৮০-১৯৬০) কেদার চাটুজ্জের গল্পও চিরস্মরণীয়। বিখ্যাত ছোটগল্প গ্রন্থ ডায়লেকটিক-এর লেখক এবং আরও বিখ্যাত শিকারি কান্তি চৌধুরীর গল্পগুলোর কথক অমূল্যকুমার দাশগুপ্ত (১৯১৪-১৯৭৩) ওরফে ‘সম্বুদ্ধ’ও অবিস্মরণীয়। কিন্তু দুর্দান্ত ডমরুধরের কাছে এঁদের প্রত্যেকেই যেন এক-একটা চুনোপুঁটি। কান্তি চৌধুরীর অভিজ্ঞতা শিকারি জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কেদার চাটুজ্জেরও নেই ডমরুর মতো অনিঃশেষ দম। ডমরুর উদ্দাম কল্পনার লাগামহীন জের টেনে যাওয়ার ক্ষমতা অবিশ্বাস্য। মনে হয় যেন বইয়ের দুই মলাটের দেয়ালগুলো না থাকলে ত্রৈলোক্যনাথের কল্পনার ঘোড়া থামতই না।
ডমরুধর সর্বশক্তিমান। ক্ষমতা তাঁর সার্বভৌম। ইহলোক, পরলোক—সবই যেন তাঁরই লোক। সকল লোকেই তিনি বিরাজমান এবং সমান তৎপর। বাঘ, কুমির, ভূত, সুন্দরবনের চড়ুই পাখির মতো মশা—সবই যেন তাঁর একান্ত প্রণত প্রজা। আর অভিজ্ঞতা? খোক্কশের বাচ্চা নিয়ে আকাশে পৌঁছে বাচ্চাটিকে এক খণ্ড মেঘের সঙ্গে বেঁধে রেখে নভোমণ্ডল দেখা, রাহুর কামড় খাওয়া, সেখান থেকে এগিয়ে ব্রহ্মা—অবলোকন, অতঃপর ব্রহ্মাণ্ডের পরপারে অশ্বা—নামক আরেকটি মহাবিশ্ব ভ্রমণ, মায় খাস যমপুরীর অভিজ্ঞতা পর্যন্ত অর্জন করা—মোটকথা কিছুই বাকি নেই ভার্সেটাইল ডমরুধরের। ত্রৈলোক্যনাথের উদ্দাম কল্পনা যে চিরায়ত কথাকার মহামতি ঈশপকেও ইডিয়ট প্রতিপন্ন করে সে-উদাহরণটিই দিচ্ছি প্রথম উদ্ধৃতিতে:
‘একবার, দুইবার, তিনবার বিষম বল প্রকাশ করিয়া বাঘ পলাইতে চেষ্টা করিল। কিন্তু গাছে লেজের পাক, বাঘ পলাইতে পারিল না। অসুরের মতো বাঘ যেরূপ বল প্রকাশ করিতেছিল, তাহাতে আমার মনে হইল যে, যাঃ! লেজটি বা ছিঁড়িয়া যায়। কিন্তু দৈবের ঘটনা একবার দেখ! এত টানাটানিতেও বাঘের লাঙ্গুল ছিঁড়িয়া গেল না। তবে এক অসম্ভব ঘটনা ঘটিল। প্রাণের দায়ে ঘোরতর বলে বাঘ শেষকালে যেমন এক হ্যাঁচকা টান মারিল, আর চামড়া হইতে তাহার আস্ত শরীরটা বাহির হইয়া পড়িল। অস্থি-মাংসের দগদগে গোটা শরীর, কিন্তু উপরে চর্ম্ম নাই! পাকা আমের নীচের দিকটা সবলে টিপিয়া ধরিলে যেরূপ আঁটিটা হড়াৎ করিয়া বাহির হইয়া পড়ে, বাঘের ছাল হইতে শরীরটি সেইরূপ বাহির হইয়া পড়িল, কলিকাতার হিন্দু কসাই মহাশয়েরা জীবন্ত পাঁঠার ছাল ছাড়াইলে চর্ম্মহীন পাঁঠার শরীর যেরূপ হয়, বাঘের শরীরও সেইরূপ হইল। মাংসের বাঘ রুদ্ধশ্বাসে বনে পলায়ন করিল।…বাঘশূন্য ব্যাঘ্রচর্ম্ম সেই স্থানে পড়িয়া রহিল। আমার কি মতি হইল, গরম গরম সেই বাঘ-ছালের ভিতর আমি প্রবেশ করিলাম। ব্যাঘ্র-চর্ম্মের ভিতর আমার সূক্ষ্ম শরীর প্রবিষ্ট হইবামাত্র ছালটা সজীব হইল। গা ঝাড়া দিয়া আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। গাছ হইতে লাঙ্গুলটি সরাইয়া লইলাম। পাছে ফের পাক দেয়! তাহার পর দুই একবার আস্ফাালন করিলাম।…এখন এই নূতন শরীরের প্রতি একবার আমি চাহিয়া দেখিলাম। এখন আমি সুন্দরবনের কেঁদোবাঘ হইয়াছি—সেই যারে বলে রয়াল টাইগার। ভাবিলাম যে—এ মন্দ কথা নয়, এখন যাই, এই শরীরে বিবাহ-আসরে গিয়া উপস্থিত হই। এখন দেখি, সন্ন্যাসী বেটা কেমন করিয়া আমার কন্যাকে বিবাহ করে।…আলুম করিয়া আমি বরযাত্রীদিগের গাড়ীর নিকট উপস্থিত হইলাম। টপ টপ করিয়া তাহারা গাড়ী হইতে লাফাইয়া পড়িল ও যে যেদিকে পারিল পলায়ন করিল।’ (পৃ. ৭৯২-৭৯৩, ছাল-ছাড়ান বাঘ, ত্রৈলোক্যনাথ রচনাসংগ্রহ, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা)।
বাঘের চামড়া পরে নকল বাঘ সেজে ভয় দেখিয়ে উদ্দেশ্য সাধনের কথা আমরা ঈশপের ফেব্্ল্ ছাড়াও অনেক ক্লাসিক গল্পেই পড়েছি। কিন্তু সব গল্পেই ব্যবহূত হয়েছে মৃত বাঘের শুষ্ক-শীতল নির্জীব চর্ম। আমার জানামতে, ত্রৈলোক্যনাথই সাহিত্যের ইতিহাসে একমাত্র ‘বে-পরোয়া’ এবং ‘অকুতোভয়’ কথাকার—যাঁর কথকঠাকুর নকল বাঘ সাজতে গিয়ে নিজের শরীরটিকে সূক্ষ্ম বানিয়ে পরে ফেলেছেন জ্যান্ত একটি ‘রয়াল টাইগারে’র উষ্ণ-সিক্ত ‘সজীব’ চর্ম।
এবার একটা উদ্দাম কল্পনার সমপ্রসারিত নমুনা:
‘হঠাৎ আমার মাথা হইতে “আমি” বাহির হইয়া পড়িলাম। আমার শরীরটি তৎক্ষণাৎ মাটির উপর শুইয়া পড়িল। শরীর হইতে যে “আমি” বাহির হইয়াছি, তাহার দিকে তখন চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে, সে “আমি” অতি ক্ষুদ্র,…সে শরীর বায়ু দিয়া গঠিত। সেই ক্ষুদ্র শরীরে আমি উপর দিকে উঠিতে লাগিলাম।…মনে করিলাম…মৃত্যুর পর লোকের যে লিঙ্গশরীর থাকে, তাহাই এখন যমের বাড়ি যাইতেছে। ছাদ ফুঁড়িয়া আমি উপরে উঠিয়া পড়িলাম। শোঁ শোঁ করিয়া আকাশ-পথে চলিলাম। দূর-দূর-দূর—কতদূর উপরে উঠিয়া পড়িলাম, তাহা বলিতে পারি না। মেঘ পার হইয়া যাইলাম, চন্দ্রলোক পার হইয়া যাইলাম, সূর্যালোকে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সে স্থানে আশ্চর্য ঘটনা দর্শন করিলাম।
দেখিলাম যে, আকাশ-বুড়ী এক কদমগাছতলায় বসিয়া, আঁশবঁটি দিয়া সূর্যটিকে কুটি কুটি করিয়া কাটিতেছে, আর ছোট ছোট সেই সূর্যখণ্ডগুলি আকাশ-পটে জুড়িয়া দিতেছে। তখন আমি ভাবিলাম—‘ও! নক্ষত্র এই প্রকারে হয় বটে! তবে এই যে খণ্ডগুলি বুড়ী আকাশ-পটে ভালো করিয়া জুড়িয়া দিতে পারে না, আল্গা হইয়া সেইগুলি খসিয়া পড়ে। তখন লোকে বলে—“নক্ষত্র পাত হইল”।’ কিছুক্ষণ পরে আমার ভয় হইল যে—সূর্যটি তো গেল, পৃথিবীতে পুনরায় দিন হইবে কি করিয়া? আকাশ-বুড়ী আমার ভাব বুঝিয়া হাসিয়া বলিল—‘ভোরে ভোরে উঠিয়া আকাশে ঝাড়ু দিয়া সমুদয় নক্ষত্রগুলি জুড়িয়া আমি একত্র করিব। সেইগুলি জুড়িয়া পুনরায় আস্ত সূর্য করিয়া প্রাতঃকালে উদয় হইতে পাঠাইব। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আঁশবঁটি দিয়া সূর্য কাটিয়া নক্ষত্র করি, সকালবেলা আবার সেইগুলি জুড়িয়া আস্ত সূর্য প্রস্তুত করি। আমার এই কাজ।’ (পৃ. ৭৮৬, চিত্রগুপ্তের গলায় দড়ি—মোটা দড়ি নয়, প্রাগুক্ত)।
এ ধারার গল্পে হিউমারের সঙ্গে উইটের বুননে অঙ্কিত হয়ে যায় নানা রকমের উপভোগ্য নকশা। নকশার তলে তলে চলে তীব্র শ্লেষের সঙ্গে নির্মম সমাজ-সমালোচনা। শ্লেষের উৎস কিন্তু ত্রৈলোক্যনাথের সমাজকল্যাণ এবং দেশহিতৈষণার প্রেরণা—যা তাঁর সব গল্পেরই চালিকাশক্তি। হিন্দুধর্মের অর্থহীন আচার-আচরণের প্রতি তাঁর মর্মভেদী আক্রমণ রচিত হয়েছে যমপুরীর একটি বিচারের দৃশ্যে—একটি পরম পুণ্যাত্মার এবং আরেকটা চরম পাপাত্মার। আকাশ-বুড়ীর কাজ দেখে মজা পেয়ে ‘নভোমণ্ডলের সমুদয় ব্যাপারটা’ ভালো করে দেখার উদ্দেশ্যে ডমরুধর আকাশে বেড়ানোর কালে ধরা পড়লেন যমদূতের হাতে এবং বৃন্দাবন গুঁই নামের আরেকটি সূক্ষ্ম শরীরের সঙ্গে যমপুরীতে নীত হলেন। সেখানে প্রথমে বিচার শুরু হলো বৃন্দাবনের। খাতাপত্রে তাঁর আমলনামা দেখে যমরাজকে চিত্রগুপ্ত বললেন:
‘মহাশয়! এ লোকটি অতি ধার্ম্মিক, অতি পুণ্যবান। পৃথিবীতে বসিয়া এ বার মাসে তের পার্ব্বণ করিত, দীন-দুঃখীর প্রতি সর্ব্বদা দয়া করিত, সত্য ও পরোপকার ইহার ব্রত ছিল।’ এই কথা শুনিয়া যম চটিয়া গেলেন। তিনি বলিলেন—‘চিত্রগুপ্ত! তোমাকে আমি বারবার বলিয়াছি যে, পৃথিবীতে গিয়া মানুষ কি কাজ করিয়াছে, কি কাজ না করিয়াছে, তাহার আমি বিচার করি না। মানুষ কি খাইয়াছে, কি না খাইয়াছে, তাহার আমি বিচার করি। ব্রহ্মহত্যা, গো-হত্যা, স্ত্রী-হত্যা করিলে এখন মানুষের পাপ হয় না, অশাস্ত্রীয় খাদ্য খাইলে মানুষের পাপ হয়।…এই কথা বলিয়া যম নিজে সেই লোকটিকে জেরা করিতে লাগিলেন— “কেমন হে বাপু! কখনও বিলাতি বিস্কুট খাইয়াছিলে?”’
সে উত্তর করিল—‘আজ্ঞে না।’
যম জিজ্ঞাসা করিলেন—‘বিলাতি পানি? যাহা খুলিতে ফট্ করিয়া শব্দ হয়? যাহার জল বিজবিজ করে?’
সে উত্তর করিল—‘আজ্ঞে না।’
যম পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন—‘সত্য করিয়া বল, কোনোরূপ অশাস্ত্রীয় খাদ্য ভক্ষণ করিয়াছিলে কি না?’
সে ভাবিয়া-চিন্তিয়া উত্তর করিল—‘আজ্ঞা একবার ভ্রমক্রমে একাদশীর দিন পুঁইশাক খাইয়া ফেলিয়াছিলাম।’
যমের সর্ব্বশরীর শিহরিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন—‘সর্ব্বনাশ! করিয়াছ কি! একাদশীর দিনে পুঁইশাক! ওরে! এই মুহূর্ত্বে ইহাকে রৌরব নরকে নিক্ষেপ কর্। ইহার পূর্ব্বপুরুষ, যাহারা স্বর্গে আছে, তাহাদিগকেও সেই নরকে নিক্ষেপ কর্। পরে ইহার বংশধরগণের চৌদ্দপুরুষ পর্যন্তও সেই নরকে যাইবে। চিত্রগুপ্ত! আমার এই আদেশ তোমার খাতায় লিখিয়া রাখ।’
যমের এই বিচার দেখিয়া আমি তো অবাক। এইবার আমার বিচার। কিন্তু আমার বিচার আরম্ভ হইতে না হইতে আমি উচ্চৈঃস্বরে বলিলাম—‘মহারাজ! আমি কখন একাদশীর দিন পুঁইশাক ভক্ষণ করি নাই।’
আমার কথায় যম চমৎকৃত হইলেন। হর্ষোৎফুল্ল লোচনে তিনি বলিলেন—‘সাধু সাধু! এই লোকটি একাদশীর দিন পুঁইশাক খায় নাই। সাধু সাধু! এই মহাত্মার শুভাগমনে আমার যমালয় পবিত্র হইল। যমনীকে শীঘ্র শঙ্খ বাজাইতে বল। যমকন্যাদিগকে পুষ্পবৃষ্টি করিতে বল। বিশ্বকর্মাকে ডাকিয়া আন—ভূঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ সত্যলোক পারে ধ্রুবলোকের উপরে এই মহাত্মার জন্য মন্দাকিনী-কলকলিত, পারিজাত-পরিশোভিত কোকিল কুহরিত, অপ্সরাপদ-নূপুর-ঝুনঝুনিত হীরা-মাণিক-খচিত নূতন একটি স্বর্গ নির্ম্মাণ করিতে বল।’ (পৃ. ৭৮৭-৭৮৮, প্রাগুক্ত)
সমাজসচেতন ত্রৈলোক্যনাথ সর্বক্ষণই জীবনসংলগ্ন। কোথাও জাতির চরিত্রসমালোচনা, যেমন ব্যাং সাহেব। তিনি সর্বদা ‘হিট্ মিট্ ফ্যাট্’ এবং ‘হিশ্ ফিশ্ ড্যাম্’ জাতীয় শব্দাদি দিয়ে কথা বলেন। কারণ বাঙ্গালা কথা কইলে তাঁর জাত যাবে—লোকে ভাববে তিনি ‘নেটিভ’। কোথাও সমাজের চরিত্রসমালোচনা যথা ‘লুলু’ গল্পে ভূতের কথা:
‘আমরা ভারতীয় ভূত, ভারতের বাহিরে আমরা যাইতে পারি না। সমুদ্রের অপর পারে পদক্ষেপ করিলে আমরা জাতিকুল ভ্রষ্ট হইব। আমাদের ধর্ম কিঞ্চিৎ কাঁচা। যেরূপ অপক্ক মৃত্তিকা-ভাণ্ড জলস্পর্শে গলিয়া যায়, সেইরূপ সমুদ্রপারের বায়ু লাগিলেই আমাদের ধর্ম ফুস্ করিয়া গলিয়া যায়, তাহার আর চিহ্নমাত্র থাকে না, ধর্ম্মের গন্ধটি পর্যন্ত আমাদের গায়ে লাগিয়া থাকে না। কেবল তাহা নহে, পরে আমাদের বাতাস যাঁহার গায়ে লাগিবে, দেবতা হউন কি ভূত হউন, নর হউন কি বানর হউন, তিনিও জাতিভ্রষ্ট হইবেন।’ (পৃ. ১৭৬, লুল, প্রাগুক্ত)
কালাপানি পার হলেই ধর্মহানি হওয়ার এবং তার প্রায়শ্চিত্ত করার যে বিভীষিকা সে যুগে হিন্দুদের মাথার ওপর উদ্যত থাকত, এই ‘ভৌতিক’ ব্যঙ্গ তারই প্রতি। যেসব স্বজন এবং সমাজপ্রধানগণ জাতিচ্যুতির ভয় দেখিয়ে দুই-দুইবার অত্যন্ত শিক্ষামূলক এবং সম্মানজনক বিলাতযাত্রা থেকে ত্রৈলোক্যনাথকে নিরস্ত করেছিলেন—এই সুতীক্ষ ব্যঙ্গবাণ তাঁদেরই মর্মস্থান লক্ষ করে নিক্ষিপ্ত। (প্রথমবার তাঁকে সঙ্গে নিতে চান স্যার উইলিয়াম হান্টার ১৮৭৫ সালে বিলেত যাবার সময়। দ্বিতীয়বার তাঁকে বিরত করা হয় ১৮৮২ সালে হল্যান্ডের আমস্টারডামে আন্তর্জাতিক শিল্পপ্রদর্শনীতে যাওয়া থেকে, যেখানে তিনি আমন্ত্রিত হয়েছিলেন—ভারতীয় শিল্পদ্রব্যের চমৎকার একটি ইনভেন্টরি তৈরি করে পাঠানোর পরিপ্রেক্ষিতে। তবে অনুরূপ বাধা অগ্রাহ্য করে তিনি ১৮৮৬ সালে একবার এবং পরে আরেকবার ব্রিটেন ও ইউরোপের বহু দেশ সফর করেন। কিন্তু ফিরে এসে যথাবিধি প্রায়শ্চিত্তও করতে হয় তাঁকে)।
আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে ত্রৈলোক্যনাথের ‘লুলু’ গল্পের উল্লিখিত ভারতীয় ভূতটি রূপক হিসেবেও স্বীকৃতি পেতে পারে। ভূতটির মূল তাৎপর্য নিম্নোক্ত উদ্ধৃতিতেই অনুধাবনীয়:
‘আমীর বলিলেন—“আমি একখানি খবরের কাগজ খুলিবার বাসনা করিয়াছি; সম্পাদক ও সহকারী-সম্পাদকের প্রয়োজন। ডিবের ভিতর যে ভূতটি ধরিয়া রাখিয়াছি, তাহাকে সহকারী-সম্পাদক করিব। আর তোরে মনে করিয়াছি, সম্পাদক করিব।” গোঁগোঁ বলিল—‘আমি যে লেখাপড়া জানি না।’ আমীর বলিলেন—‘পাগল আর কি! লেখাপড়া জানার আবশ্যক কি? গালি দিতে জানিস ত’?’ গোঁগোঁ বলিল—‘ভূতদিগের মধ্য যে-সকল গালি প্রচলিত আছে, তাহা আমি বিলক্ষণ জানি।’ আমীর বলিলেন—‘তবে আর কি! আবার চাই কি? এত দিন লোকে মানুষ ধরিয়া সম্পাদক করিতেছিল, কিন্তু মানুষে যা-কিছু গালি জানে, মায় অশ্লীল ভাষা পর্যন্ত, সব খরচ হইয়া গিয়াছে; সব বাসি হইয়া গিয়াছে। এখন দেশশুদ্ধ লোককে ভূতের গালি দিব। আমার অনেক পয়সা হইবে।’ (ভূতের তেল, পৃ. ১৬৬-১৬৭, প্রাগুক্ত)
‘লুলু’ গল্পটির অন্তে পরিকল্পনামতে সংবাদপত্র প্রকাশ করে আমীর গোঁগোঁ-ভূতকে পত্রিকাটির সম্পাদকের পদে বসিয়ে দিলেন। ফল নিম্নরূপ :
‘একে ভূত সম্পাদক, তাতে আবার চণ্ডুখোর ভূত—গুলির চৌদ্দ পুরুষ। সে সংবাদপত্রের সুখ্যাতি রাখিতে পৃথিবীতে আর স্থান রহিল না। সংবাদপত্রখানি উত্তমরূপে চলিতে লাগিল, তাহা হইতেও আমীরের বিলক্ষণ দুই পয়সা লাভ হইল। গোঁগোঁ যে কেবল আপনার সংবাদপত্রটি লিখিয়া নিশ্চিন্ত থাকেন, তাহা নহে। সকল সংবাদপত্র অফিসেই তাঁর অদৃশ্যভাবে গতায়াত আছে। অন্যান্য কাগজের লেখকেরা যখন প্রবন্ধ লিখিতে বসেন, তখন ইচ্ছা হইলে কখনও কখনও গোঁগোঁ তাঁহাদিগের ঘাড়ে চাপেন। ভূতগ্রস্ত হইয়া লেখকেরা কত কি যে লিখিয়া ফেলেন, তাহার কথা আর কি বলিব!’ (লেখকদল সাবধান, পৃ. ১৭৮-১৭৯, প্রাগুক্ত)
এই ‘ভৌতিক’ ব্যঙ্গের লক্ষ্য ত্রৈলোক্যনাথের কালের সাংবাদিক-সাহিত্যের হেয় অংশটি। এমন নির্মম ব্যঙ্গেরও হেতু ছিল যথেষ্টই। একশ্রেণীর শিক্ষা-সংস্কৃতিহীন সাংবাদিক এবং তাদের কুরুচিপূর্ণ কটুভাষণ সেকালের বহু সংস্কৃতিবানেরই ক্লেশের কারণ ছিল।
তবে ত্রৈলোক্যনাথের যাবতীয় শ্লেষেরই উৎস ছিল জাতি ও সমাজের প্রতি মমত্ববোধ। তেমনি জীবনের প্রতি সহানুভূতির নিদর্শনও জ্বলজ্বলে মণিমুক্তোর মতো ছড়ানো রয়েছে তাঁর বিবিধ রচনায়। মুক্তা-মালায় বর্ণিত পাঁঠা ব্যবসায়ী নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ শ্রীযুক্ত শ্রীল গোলোক চক্রবর্তী মহাশয়ের বীভৎস গল্পটি স্মরণ করা যাক :
“পাঁঠাকে ফেলিয়া ঠাকুর মহাশয় তাহাকে সেই খোঁটায় বাঁধিলেন। তাহার পর তাহার মুখদেশ নিজের পা দিয়া মাড়াইয়া জীয়ন্ত অবস্থাতেই মুণ্ডদিক হইতে ছাল ছাড়াইতে আরম্ভ করিলেন। পাঁঠার মুখ গুরুদেব মাড়াইয়া আছেন, সুতরাং সে চীৎকার করিয়া ডাকিতে পারিল না। কিন্তু তথাপি তাহার কণ্ঠ হইতে মাঝে মাঝে এরূপ বেদনাসূচক কাতরধ্বনি নির্গত হইতে লাগিল যে, তাহাতে আমার বুক যেন ফাটিয়া যাইতে লাগিল। তাহার পর তাহার চক্ষু দুইটি! আহা! আহা! সে চক্ষু দুইটির দুঃখ আক্ষেপ ও ভর্ৎসনাসূচক ভাব দেখিয়া আমি যেন জ্ঞান-গোচরশূন্য হইয়া পড়িলাম। সে চক্ষু দুইটির ভাব এখনও মনে হইলে আমার শরীর রোমাঞ্চ হইয়া উঠে। আমি আর থাকিতে পারিলাম না। আমি বলিয়া উঠিলাম—‘ঠাকুর মহাশয়! ঠাকুর মহাশয়! করেন কি? উহার গলাটা প্রথমে কাটিয়া ফেলুন। প্রথম উহাকে বধ করিয়া তাহার পর উহার চর্ম্ম উত্তোলন করুন।’
ঠাকুর মহাশয় উত্তর করিলেন—‘চুপ! চুপ! বাহিরের লোক শুনিতে পাইবে। জীয়ন্ত অবস্থায় ছাল ছাড়াইলে ঘোর যাতনায় ইহার শরীরের ভিতরে ভিতরে অল্প অল্প কাঁপিতে থাকে। ঘন ঘন কম্পনে ইহার চর্ম্মে একপ্রকার সরু সরু সুন্দর রেখা অঙ্কিত হইয়া যায়। এরূপ চর্ম্ম দুই আনা অধিক মূল্যে বিক্রীত হয়। প্রথম বধ করিয়া তাহার পর ছাল ছাড়াইলে সে চামড়া দুই আনা কম মূল্যে বিক্রীত হয়। জীয়ন্ত অবস্থায় পাঁঠার ছাল ছাড়াইলে আমার দুই আনা পয়সা লাভ হয়। ব্যবসা করিতে আসিয়াছি, বাবা! দয়ামায়া করিতে গেলে আর ব্যবসা চলে না।’” (পৃ. ৩১৩, প্রাগুক্ত)।
গল্পটির উচ্চতর একটি স্তরও কল্পনা করা যায়। সেখানে এটি খুবই কার্যকর একটি রূপক। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন :
‘ব্রাহ্মণ-নির্দেশিত সমাজবিধি সমগ্র জাতির ওপর যুগ-যুগান্তর ধরে যে নিষ্ঠুর কশাইবৃত্তির আচরণ করে এসেছে—এ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। এই সমাজের বিধানেই তিন বছর বয়সের বিধবা শিশুকে একাদশীর নিরম্বু উপবাস করাবার জন্যে প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দিনে ঘরের মধ্যে তালাবন্ধ করে রাখা হয়—অসহ্য তৃষ্ণায় সে ঘরের শুকনো মেজে চাটতে চাটতে বুক ফেটে মরে যায়। এই সমাজের বিধানেই আশি বছরের কুলীন তিনশো বিধবা রেখে গঙ্গালাভ করে—এই ব্রাহ্মণের নির্দেশেই সতীমেধের আদিম উল্লাস চলতে থাকে। ত্রৈলোক্যনাথের কালে এদের অনেক কিছুই বাস্তবে অবস্থিত ছিল, তারা তখন পর্যন্ত ইতিহাসে পরিণত হয়নি। এ যেন বাঙালী জাতির—বিশেষ করে বাংলা দেশের নারীর ওপরে হিংস্র সামাজিক অত্যাচারের একটি প্রতীক চিত্র।’ (বাংলা গল্প-বিচিত্রা, পৃ. ২৬৬-২৬৭, না.গ.র.খ-৯, মিত্র ও ঘোষ, কলকাতা)
শ্রীগঙ্গোপাধ্যায় অনবধানবশত মেয়েটির বয়স তিন বছর লিখেছেন। আসলে গল্পটিতে আট বছর বয়সে বিয়ের দুই মাস পরে বিধবা হওয়া, কুন্তলা-নামের মেয়েটির বয়স ছিল নয় বছর (পৃ. ৮৬৯-৮৭০, প্রাগুক্ত)। উল্লেখ্য, উক্ত একাদশীর দিনে কড়া জ্বরাক্রান্তও ছিল ‘নিষ্ঠাবান’ ব্রাহ্মণগুরু শুক্লাম্বর ঢাকমহাশয়ের বিধবা শিশুটি (“জ্বরে কুন্তলার কাঠ ফাটিতেছে।…মা একটু জল দাও…মা! পিপাসায় আমার বুক ফাটিয়া যাইতেছে…একটুখানি দাও। কেবল মুখটি ভিজাইয়া দাও”)। যাতে মা বা কেউ জল দিতে না পারে এবং রোগিণী নিজেও চুরি করে জল খেতে না পারে, ঢাকমহাশয় ‘সেজন্য সন্ধ্যার সময় কুন্তলাকে নীচের তলার এক ঘরে বন্ধ করিয়া চাবি দিয়া দিলেন।’
আরও উল্লেখ্য যে এমন নির্মম শিশুহত্যার ‘কথা যখন চারিদিকে প্রচারিত হইল, তখন দেশশুদ্ধ লোক ঢাকমহাশয়কে ধন্য ধন্য করিতে লাগিল। সকলে বলিল—কি দৃঢ় মন! কি ধর্ম্মের প্রতি আস্থা! এরূপ পুণ্যবান লোক কলিকালে হয় না। তাঁহার প্রতি লোকের এত ভক্তি হইল যে, এক মাসের মধ্যে তাঁহার একশতের অধিক নূতন শিষ্য হইল।’
Leave a Reply