বাবু-ইংরেজি আর সাহেবি বাংলা
মাহবুব আলম
সাহেবরা অনেক কষ্ট স্বীকার করে বাংলা শিখেছিলেন, কিন্তু তা যে কোন পর্যায়ের ছিল তার উদাহরণ: জেলা পরিদর্শনে এক কৃষকের সঙ্গে সাহেবের কথোপকথন: সাহেবের প্রথম প্রশ্ন, ‘টোমাডিগের গুড়ামে ডুড়বেক্কা কেমন আছে?’ (তোমাদের গ্রামে দুর্ভিক্ষ কেমন?) ‘ডুড়বেক্কা’ কী, কৃষকটির অজানা। ভাবল, হয়তো বা কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম হবে। কিন্তু কেমন আছে? এর উত্তর কী দেবে? কৃষকটি অনেক ভেবেচিন্তে উত্তর দিল, ‘বেমার আছে।’
সময় উনিশ শতকের মাঝামাঝি। জাত খোয়ানোর ভয় আর খ্রিষ্টান হওয়ার আশঙ্কা কেটে গিয়ে বাঙালি ইংরেজি শিখতে উঠেপড়ে লাগাল। অতিরিক্ত প্রণোদনা ছিল সামাজিক প্রতিপত্তি ও সরকারি চাকরি পাওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা। দক্ষ শিক্ষক এবং প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক হাতের কাছে না থাকলেও কাজ চালানোর মতো অভিধাননির্ভর একধরনের ইংরেজি অল্প সময়ের মধ্যেই গড়পড়তা বাঙালির আয়ত্তে এসেছিল। তবে এই বিদেশি ভাষাটির কাঁচা ঘুঁটি পাকা হওয়ার আগেই একে চাকরির বাজারে টেনে আনায় ভিতটি নড়বড়ে রয়ে যায়। এসব ত্রুটি সত্ত্বেও ইংরেজি ভাষার বিজয়রথ এগিয়ে চলছিল। এর ফল হয়েছিল দুটি—যেসব বাঙালি সময় ব্যয়ে ইংরেজি শিখেছিলেন, তাঁদের মুখে ফুটল অনাবশ্যক ইংরেজি শব্দবহুল এক বিচিত্র বাংলা বুলি। তবে যাঁরা যথার্থ ইংরেজি শিখে প্রকৃত শিক্ষিত হয়েছিলেন, তাঁরা এ দলের বাইরে ছিলেন। দ্বিতীয়টি—স্বল্পশিক্ষিত সামান্য কিছু ইংরেজি জানা বাঙালির একধরনের ভুলেভরা ইংরেজির আবির্ভাব ঘটল তাঁদের কলমে ও বুলিতে। অফিস, আদালত ও সদাগরি হাউসে। একেই সাহেবরা পিঠ চাপড়ানোর ভঙ্গিতে এবং কৌতুক করে নাম দিয়েছিলেন ‘বাবু-ইংলিশ’।
প্রথম দলে যাঁদের উল্লেখ করা হলো, সেসব ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালির ভাষা ভরে উঠেছিল ইংরেজি শব্দ ও বাক্যবিন্যাসের টইটমু্বরে। প্রয়োজন ও অপ্রয়োজনে যত্রতত্র ইংরেজি শব্দের হাস্যকর ব্যবহারে সে যুগের বাঙালি তার ইংরেজিজ্ঞানের জাহির করতে গর্ব অনুভব করত।
বিয়ের আসরে ইংরেজিওয়ালারা তখন একে অপরের নাম জিজ্ঞাসা করছে, ‘হোয়াট ডিনোমিনেশন পুট হয়োর পাপা’। ডিকশনারি মুখস্থ করাও বেশ একটা কৃতিত্বের বিষয় বলে প্রচলন ছিল সমাজে। আরও ছিল ইংরেজি বানান জিজ্ঞাসা করে একে অন্যের বিদ্যার বহর মাপার রেওয়াজ। ব্যাকরণ প্রণালি বা ব্যাকরণবিধি প্রভৃতি শেখানোর দিকে নজর ছিল না কারও। কেবল ইংরেজি শব্দ ও তার অর্থ কণ্ঠস্থ করানো হতো।
ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের আধিক্যে বাঙালির দৈনন্দিন কথোপকথন যে কতখানি ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল, তার একটি নমুনা পাওয়া গেছে সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার পাতায়।
‘মশায়, লাস্ট নাইটে বড় ডেঞ্জারে পড়েছি, আঙ্কলের কালারা (কলেরা) হয়েছে। পলস্ বড় উইক হয়েছিল। আজ মর্নিংয়ে ডাক্তার এসে অনেক রিকবার করেছে। এখন লাইফের হোপ হয়েছে।’ বাংলা করার মধ্যে বিদেশি শব্দের ফোড়ন দেওয়া অবশ্য বাঙালির নতুন কিছু নয়, আজ থেকে শ-তিনেক বছর আগেও বাংলা ভাষায় ছিল ‘যবনী মিশাল।’ ১৭৭৮ সালে হ্যালহেড তাঁর বাংলা ব্যাকরণের ভূমিকায় লিখেছিলেন, ‘এ দেশের কম্পাউন্ড ইডিয়ম ব্যবহারে যে যত দিশি ক্রিয়াপদের সঙ্গে আরবি-ফারসি বিশেষ্যের ফোড়ন দিতে পারে, তার তত কইয়ে-বলিয়ে হিসেবে নাম ফাটে।’ এ বদ-অভ্যাস আজও অনেকেরই রয়ে গেছে।
বাবু-ইংলিশ বলতে সাধারণত বোঝায় অনাবশ্যক শব্দবহুল, বিশেষণের অপ্রয়োগে খঞ্জ, ব্যাকরণ শিথিল একধরনের ইংরেজি। এই বিচিত্র কিন্তু কার্যকরী ইংরেজি ব্যবহার হয়েছে প্রথমে ব্যবসা-বাণিজ্যের অংশীদার, পরে মনিব বনে যাওয়া ইংরেজের অনুগ্রহ ও কৃপালাভের আশায়। সাহেব ভজনাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য, বিদেশি প্রভুর সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সোপান। জাগতিক প্রাপ্তির লক্ষ্যে সাহেব প্রশস্তি করে চাকরির দরখাস্ত পেশ করা, কোর্ট-কাছারিতে বক্তৃতা করা আর মানপত্র রচনায় বাবু-ইংলিশের এক নিজস্ব শৈলী গড়ে উঠেছিল। একে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপও অব্যাহত থেকেছে বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত।
বাবু-ইংলিশের বিচিত্র রসের দু-একটি উদাহরণ হাজির না করা পর্যন্ত এই আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। প্রথম গল্পটি এ রকম—শোনা যায় সে আমলে চাকরি পাওয়া নিয়ে খুব কাড়াকাড়ি হতো। আগে ভালো দরখাস্ত পাঠাতে পারলে কিছুটা সুবিধার সম্ভাবনা থাকে। তাই অনেক চাকরিপ্রার্থী অগ্রিম খবরের সন্ধানে শ্মশানঘাটে গিয়ে সদ্যমৃত চাকরিজীবীদের নামধাম খুঁজে বের করত, মৃত ব্যক্তি কোন দপ্তরে, কী পদে চাকরি করেছিলেন—সব জেনে দরখাস্ত পাঠাত মৃতের চাকরিস্থলে। ইংরেজি ভাষায় লেখা সেই দরখাস্তের শুরুটি ছিল এ রকম—‘লার্নিং ফ্রম বার্নিংঘাট (শ্মশানঘাট) দেট এ পোস্ট হেজ ফলেন ভ্যাকেন্ট, আই বেগ টু অ্যাপ্লাই ফর দি সেম।’
দ্বিতীয় গল্পটি আরও মজার। একটি সদাগরি হাউসের বার্ষিক বাজেট তৈরি প্রায় শেষ পর্যায়ে। কোম্পানির বড় সাহেব অনাবশ্যক বিবেচনায় কয়েকটি বরাদ্দ কেটে দিতে কলম তুলেছেন। এমন সময় অধস্তন কর্মচারী ছুটে এল সাহেবকে থামাতে। কর্মচারী বলতে চাইল যে বরাদ্দগুলো তিনি কেটে দিতে চাচ্ছেন, তা নানা কারণে অত্যাবশ্যকীয়। কিন্তু এত কথা বোঝানোর মতো ইংরেজি তার পেটে ছিল না। তাই সাহেবকে অনুনয় করে বললেন, ‘নো কাট, নো কাট। রিজন হ্যাজ (কারণ আছে), অর্থাৎ বরাদ্দগুলো কাটবেন না, এগুলো রাখার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। বলাবাহুল্য, সাহেব ব্যাপারটা বুঝে বরাদ্দগুলো রেখে দিলেন। এভাবেই পরস্পরের ভাষার অজ্ঞতায় একধরনের সহাবস্থানের জন্ম নিয়েছিল শাসক আর শাসিতের মধ্যে। তা না হলে ভাষাবিভ্রাটের ঠেলায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও কাজকর্ম শিকেয় উঠত। বাবু-ইংলিশ ছোট একটু ধন্যবাদ অবশ্যই প্রাপ্য, অন্তত এই কারণে।
এবার শেষ গল্পটি। জনৈক ‘নেটিভ বয়’, তার বেতন কমানোর জন্য দুঃখ জানিয়ে ইংলিশম্যান কাগজে ইংরেজিতে একটি চিঠি পাঠিয়ে জানাচ্ছেন,
…I am a poor native boy rite butiful English and rite good sirkulars for Mateland Sahib…very cheap, and gives one rupees eight annas per diem, but now a man say he makes better English, and put it all rong and gives me one rupes…
অথচ কী দুঃখের কথা। ছেলেটি যে শুধু ‘ভাল’ ইংরেজিই লিখতে পারে তা-ই নয়, তার অন্য গুণও আছে। সে লিখছে—
`I make poetry (কবিতা) and country Korruspondanse.’
চিঠিটি পড়ে ‘নটিভ বয়ে’র মনিব মেটল্যান্ড সাহেবের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল জানা যায়নি।
বাবু-ইংলিশের বিকাশ প্রসারে সাহেবদের কি প্রচ্ছন্ন উসকানি ছিল না? কালা আদমিদের জবান-কলম থেকে তাদের মতো পরিশীলিত ভাষা বের হোক, সব ওপরওয়ালা সাহেবই কি মনেপ্রাণে চাইতেন? নেটিভরা সাহেবদের অধীনে মুখ বুজে চাকরি করে কাটিয়ে দেবে এতেই তো তাদের মোক্ষ—ভালো ইংরেজি লেখা বা বলার কী প্রয়োজন!
বঙ্কিমচন্দ্রের মুচিরাম গুড় জীবনের সূচনাতেই সাহেব-মনস্তত্ত্বের এই নিগূঢ় সত্যটি ধরে ফেলে জীবনভর সফলতার মুখ দেখেছেন। কালেক্টরের পেশকারের খালি পদের জন্য মুচিরাম বড় আগ্রহান্বিত। দরখাস্ত লেখার মতো বিদ্যা না থাকায় মুচিরাম আরেকজনকে ধরে দরখাস্ত লেখাল, যে দরখাস্ত নিখিল মুচিরাম তাহাকে বলিয়া দিল, ‘‘দেখিও যেন ভালো ইংরেজি না হয়। আর দরখাস্তের ভিতর যেন গোটা কুড়ি ‘মাই লার্ড’ ‘ইউর অনার’ থাকে।’’ মুচিরামের প্রজ্ঞা ব্যর্থ হয়নি।
ইন্টারভিউয়ের সময় অনেক বড় ইংরেজিনবিশ এবং ‘কেদো কেদো স্কলারশিপহোল্ডার’ বাদ পড়ল। তাঁদের দোষ তাঁরা শেক্সপিয়ার, মিলটন, বেকন পড়েছিলেন। এত বিদ্যা সরকারি কাজের জন্য অপ্রয়োজনীয়। ‘অনেক প্রার্থী শামলা মাথায় দিয়া চেন ঝুলাইয়া পরিপাটি বেশ ধরিয়া আসিয়াছিলেন, সাহেব দৃষ্টিমাত্র তাহাদের বিদায় দিলেন।’ কারণ, এত সচ্ছল ব্যক্তিদের এসব কাজে মন বসবে না, অবশেষে মুচিরামের ভুল ইংরেজিতে লেখা দরখাস্ত পড়ে সাহেব সন্তুষ্টির হাসি হাসলেন। মুচিরামের সঙ্গে কথা বলে খুশি হয়ে তাকে পেশাজীবীতে বহাল করলেন সাহেব। ইংরেজ প্রভুদের অনুগ্রহ আর প্রশ্রয় না পেলে বাবু-ইংলিশ কি পুষ্পিত হয়ে আজও সুবাস ছড়াত? মনে হয় না।
বাঙালির বাবু-ইংলিশ যদি কৌতুকের বশে জারিত হয়, তবে সাহেবের কষ্ট করে পরীক্ষায় পাস করা বাংলা ভাষা ছিল ভয়াবহ। তখনকার ইংরেজ সিভিলিয়ানদের দেশীয় ভাষা শেখা ছিল বাধ্যতামূলক। পাস করলে চাকরিতে জুটত অতিরিক্ত মোটা ভাতা। এত সব আকর্ষণীয় সুবিধা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ সাহেব আমলার বাংলা জ্ঞান ছিল জোড়াতালি দেওয়া। সে সময়ের ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি সমাজে সাহেবদের কারও কারও বাংলায় পারদর্শিতা নিয়ে মুখোমুখি কয়েকটি গল্প চালু ছিল। এমন একটি গল্প কৃষ্ণনগর কলেজের ইংরেজ অধ্যক্ষ ই লেথব্রিজকে নিয়ে। সাহেব নাকি বাংলা পরীক্ষায় পাস করে অনেক টাকা পুরস্কার পেয়েছিলেন। তাঁর বাংলা পরীক্ষায় ইংরেজিতে অনুবাদের জন্য একটি বাক্য ছিল, ‘রাজা বিক্রমাদিত্যের দুই মহিষী ছিল।’ সাহেব এর যে ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন, তার অর্থ দাঁড়ায়, ‘রাজা বিক্রমাদিত্যের দুটি মাদী মহিষ (সি বাফেলো) ছিল।
আর একজন বাংলা ভাষায় পারদর্শী সাহেব ‘দ্যাট রিমার্কএবল লেডি’র বাংলা অনুবাদ করেছিলেন, ‘ঐ মন্তব্যা মহিলা’; এমনকি যে বিদূষী ইংরেজ মহিলা বঙ্কিমের বিষবৃক্ষের ইংরেজি অনুবাদ করে প্রচুর সুনাম কিনেছিলেন, তিনিও গোপালউড়ের যাত্রার অনুবাদ করেছিলেন, ‘জার্নি অব ফ্লাইং গোপাল’।
সে আমলের অধিকাংশ সাহেব প্রশাসকের পরিশ্রম করে শেখা বাংলা উচ্চারণ, শব্দচয়ন সাধারণ মানুষের জন্য তো দূরের কথা, শিক্ষিতজনেরও বোধগম্য হতে সময় লাগত। বক্তা ও স্রোতা উভয়ের জন্য প্রায়ই তা হতো বিভ্রান্তিকর। বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা থেকে বাংলা ভাষায় দক্ষ প্রজাহিতৈষী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিনওয়েল সাহেবের দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। সাহেবের জেলায় দুর্ভিক্ষ দেখা গেছে। তিনি সরেজমিনে দুর্ভিক্ষের অবস্থা দেখতে বেরিয়ে ঘোড়ায় চড়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। পথে এক কৃষকের সঙ্গে দেখা। সাহেব বাংলা পরীক্ষায় পাস করে পুরস্কার পেয়েছেন। সুতরাং সেই কৃষকের সঙ্গে বাংলা ভাষাতেই কথাবার্তা শুরু করবেন। সাহেবের প্রথম প্রশ্ন ‘টোমাডিগের গুড়ামে ডুড়বেক্কা কেমন আছে?’ (তোমাদের গ্রামে দুর্ভিক্ষ কেমন?) ‘ডুড়বেক্কা’ কী কৃষকটির অজানা। ভাবল হয়তো বা কোনো ব্যক্তিবিশেষের নাম হবে। কিন্তু কেমন আছে? এর উত্তর কী দেবে?
যদি বলে যে ডুরবেক্কাকে চেনে না, তবে সাহেবের এক ঘা চাবুকের মার পিঠে পড়বে। যদি বলে যে ভালো আছে, তবে তাকে হয়তো ডেকে আনতে হুমুক হবে। তখন কী হবে? কৃষকটি অনেক ভেবেচিন্তে উত্তর দিল, ‘বেমার আছে।’ সাহেব বুঝে উঠতে পারলেন না। দুর্ভিক্ষ কী করে অসুস্থ হয়। নিশ্চয়ই কৃষকটি তার কথার অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। একটু ঘুরিয়ে আবার জিজ্ঞাস করলেন, ‘ডুড়বেক্কা কেমন আছে? অধিক আছে কি কম আছে?’—এবার কৃষকটির চোখ খুলে গেল। তার মাথায় ঢুকল এ যখন সাহেব, তখন হাকিম না হয়ে যায় না। হাকিম যখন জানতে চাচ্ছে ডুড়বেক্কা অধিক আছে না অল্প আছে—তখন ডুড়বেক্কা অবশ্যই একটা নতুন ট্যাক্সের নাম। এখন যদি বলি, ‘আমাদের গ্রামে সে ট্যাক্স নাই, তবে বেটা এখনই ট্যাক্স বসাইয়া যাইবে।’ অতএব মিছা কথা বলাই ভালো। সাহেব আবার একই প্রশ্নটা করলে কৃষক উত্তর দিল, ‘হুজুর, আমাদের গায়ে ভারী ডুড়ক্কো আছে?’ সাহেব ভাবলেন, ‘হুম! আই থট অ্যাজ মাচ।’ তদন্তে সন্তুষ্ট হয়ে সাহেব ফিরে গেলেন। বুদ্ধিমান কৃষকের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? চাষা আসিয়া গ্রামে রটাইল, ‘একটা সাহেব টাকায় আট আনা হিসাবে ট্যাক্স বসাইতে আসিয়াছিল, চাষা মহাশয়ের বুদ্ধি-কৌশলে বিমুখ হইয়াছে।
সাহেবি বাংলার কার্যকারিতা বোঝাতে এর চেয়ে ভালো উদাহরণ চোখে পড়ে না। বঙ্কিম নিজে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সাহেবদের সঙ্গে গাঁ-গঞ্জে সারাজীবন কাজ করেছেন। দুর্ভিক্ষকে ডুড়বেক্কা বলা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট তার ঢের দেখা ছিল বলেই মিনওয়েল সাহেবের দৃষ্টান্ত দিতে পেরেছেন।
বাবু-ইংলিশ নিয়ে ঠাট্টা মশকরার প্রত্যুত্তরে বাঙালি লেখকেরাও ইংরেজের বিকৃত উচ্চারণ নিয়ে ঠাট্টা করতে ছাড়েননি। রঙ্গ পত্রিকা বসন্তক এ বিষয় নিয়ে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। তার সারাংশবিশেষ উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
‘সহরের ও পল্লিগ্রামের কৃষ্ণ বিষ্ণু গোচ বাঙ্গালী ইংরেজী লেখক সকলে বাবু-ইংলিশ নিয়ে বড় মাথা কোটাকুটি কর্ত্তে মেতেছেন আর আমাদের মত নোক সকল তফাতে দাঁড়ায়ে তামাসা দেখছে।…আজকাল বিলাতের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত অধ্যাপক যিনি কলকাতায় অনেক দিন ওরিএন্টাল স্কলার বলে কবলাতেন, লেখা বক্তৃতা পাঠ কর্ত্তে ২ বলেছিলেন—“এই ভিড্যালয় এই সমানে পুনর্বার সমাপিত হইলেন”। আর কলিকাতায় মিশনারীগিরী করে বয়েস গুড়য়ে লঙসাহেব…দ্বারবানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হোতা কে হয় তুমি না তোমার দাদা হয়?’ বাঙালিরা কি এর চেয়ে খারাপ ইংরেজি শিখেছিল?
শিক্ষিত বাঙালিরা উনিশ শতকের মধ্যেই ইংরেজি ভাষাটিকে পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পেরেছিল। বাবু-ইংলিশ তত দিনে ইতিহাসের হাস্যকর অধ্যায়। সে আমলেও বাঙালির মধ্যে যাঁরা লেখাপড়া শিখেছিলেন, তাঁদের ইংরেজি ভাষার লালিত্যে সাহেবরা বিস্মিত হতেন। আর এখন তো বাঙালির ইংরেজি সাহিত্যকর্ম আন্তর্জাতিকভাবে নন্দিত ও স্বীকৃত। সাহেবরা যাঁরা বাংলা শিখেছিলেন, তাঁরাও যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় সেই উনিশ শতকেই দিয়েছিলেন। সিভিলিয়ান বিম্স্ বাংলা ব্যাকরণে সুপণ্ডিত ছিলেন। বাঙালি ভাষাবিদদের সঙ্গে তাঁর এ নিয়ে যথেষ্ট তর্ক ও মতবিনিময় হয়েছিল। অনেক আইসিএস অফিসার চাকরি শেষে অক্সফোর্ড ক্যামব্রিজে বাংলা ভাষার অধ্যাপনা করেছেন। আর হাল আমলেও প্রাঞ্জল ও স্বচ্ছ বাংলা গদ্য লিখেছেন ফাদার দ্যাতিয়েন ও ডিমক সাহেব। কালস্য কুটালা গতি!
Leave a Reply