গালিবের কবিতা ছুঁয়ে
মুস্তাফা জামান আব্বাসী
হঠাৎ করেই গালিবের প্রেমে পড়ে যাইনি।
ফরিদা খানম, ইকবাল বানু, সুরাইয়া মুলতানিকার, মেহেদী হাসানের সঙ্গে নানা মাহফিলে গান গেয়ে ফিরেছি ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালিতে। ওদের কণ্ঠে টাটকা গজল, আমাদের ২০০ বছরের সম্পদ। গালিব, আত্তার, জোশ, আকবর, ফায়েজ, মাসরুর।
গালিবের জন্মের ২০০ বছর অতিক্রান্ত হলো। পুরো সময়টায় ছিল তাঁর রাজত্ব। শুধু আগ্রহীই নয়, ভূ-ভারতে গালিব এখন ক্রেজ। ঢেউ ছুঁয়েছে সুদূর আমেরিকায়—সুরের মেলা গালিব বিহনে যেন অসম্পূর্ণ। বাঙালির কণ্ঠে গালিব যেন দূর থেকে ভেসে আসা গজলের সুরভী, কোনো প্রাতে শোনা নজরুলের বাগিচার বুলবুলি।
যেবার প্রথম আগ্রায় যাই, সঙ্গে নতুন বিবাহিত পত্নী, লজ্জা তখনো কাটেনি। বললাম, ‘তাজমহলে কাকে খুঁজেছ?’
উত্তর পেলাম, ‘যাকে কাছে পেয়েছি, তাকেই খুঁজেছি তাজমহলে।’
তিনি কীভাবে জানলেন, যার কথা এটি তিনি আর কেউ নন, মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব। ২০০৮ সালে আমন্ত্রিত হয়ে যখন আবার দুজন গেলাম গালিব বিধৌত ইতিমদ্দৌলার বাগানে, আকবরের নিজ শহর ফতেপুর সিক্রির দালানে দালানে, নিজ দুর্গ সিকান্দ্রা, তাজমহলে এবং দিল্লির কুতুব মিনারে, কুয়াতে ইসলামে মোগলদের খুঁজতে, খুঁজে পাই সহজেই বিস্মৃত গালিব, সেই সঙ্গে আমার ফেলে আসা পৃথিবী। জীবন কত তাড়াতাড়ি তার পাখা গুটিয়ে নেয়। গালিবের জন্ম: ১৭৯৮, মৃত্যু: ১৮৭৯। মাত্র ৮১ বছর। কটি বা দিন। তাঁর মৃত্যুর কুড়ি বছর পর নজরুলের জন্ম: ১৮৯৯। গালিবের লেখা কবিতাগুচ্ছ সবার সামনে, যতবার খুশি গালিবে অবগাহন করতে পারি। তাহলে তিনি উপস্থিত এই কবিতার মাহফিলে। কবিরা চলে যান না, তাঁদের সেই মাহফিল হয় না পরিত্যক্ত। মাহফিলের আসরে বসেন, ‘ওয়াহ্ ওয়াহ্’ বলেন, আমি এদের দলে।
গালিব সফরে সঙ্গী পেতাম যদি নজরুলকে, বাঙালিরা খুঁজে পেত তাঁকে নতুন করে, প্রত্যক্ষ করতাম তাঁর চোখে নতুন হয়ে দেখা গালিব, যেমনটি হাফিজ উদ্ভাসিত হয়েছিলেন তাঁর নয়নের সামনে। বাঙালি উর্দু ভুলে গেছে, তাই গালিবের স্বাদ নেই, ফার্সি শেখেনি, তাই রুমি চেনে না। এই তো অবস্থা। এরা আমাদের কবি। এমন সময় এসেছে যখন বাঙালি নিজেকে ছাড়া কাউকেই চেনে না। দিল্লিতে গিয়ে দেখি মোশায়েরার হাজার মানুষ মনে রেখেছে কবিতার পঙিক্তগুলোকে, লজ্জায় মাথা লুকোই।
গালিবের ৫০টি গজল অনুবাদ করে রেখেছিলাম অনেক দিন আগে, সেগুলোকে নতুন চোখে আবার চোখ বুলালাম। দেখলাম, হাফিজ আমারই দিকে তাকিয়ে বললেন:
Said I one night to a pristine seer
[Who knew the secrets of whirling time]
Sir, you well perceive
That goodness and faith,
Fidelity and love
Have all departed from this sorry land
Father and son are at each other’s throat;
Brother fights brother, Unity and federation are undermined
Despite all these ominous sings,
Why have not Doomsday come?
Who holds the reins of the Final Catastrophe?
The hoary old man of lucent ken
Pointed towards Kashi and gently smiled
‘The Architect’, he said, ‘is fond of this edifice
Because of which there is color in life; He
Would not like it to perish and fall.’
২০০ বছর কিছুই নয়। গালিব ও কাতিব সমবয়সী হই, প্রেমের চোখটি ফিরে পাই, যখন বুঝতে পারি কী তাগিদে ভালোবাসার দৃষ্টিকে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন জীবনের শেষ দিন অবধি। উর্দু ভাষার জনমানসে প্রত্যাবর্তনে প্রধান উপকরণ গজল। বাহাদুর শাহ জাফরের প্রস্থানের পর গালিব ছিলেন শায়ের উল মুলক, প্রধান রাষ্ট্রকবি।
গালিবের জীবনী লিখতে বসিনি, নয় তাঁর কাব্যগাথার পূর্ণ গ্রন্থ। বইটি সাজিয়েছি এমনি করে, যাতে বাংলার নতুন জেনারেশন আবহটি খুঁজে পায়, খুঁজে পায় সেই বাগান, যা তাদের উত্তরাধিকার কিয়ামতের শেষ দিন পর্যন্ত। এতে আছে মোট ১২টি বিভাগ। আজ অল্প একটু।
গজল হচ্ছে সুরের অনুষঙ্গে প্রস্তুত। এতে আছে ছন্দ, মাত্রা, যতি, যা সঠিক সময়ে তবলার চাটির সঙ্গে একত্র হবে, না হলে গজল হবে না। কবি, তাঁর কণ্ঠ যতই প্রস্তুত হোক, মোশায়েরাতে তালে চললেও সব সময় সুরে না-ও চলতে পারেন। গজলের অনুবাদকদ্বয় পদ্যরানির সাধক হলেও তা ছিল প্রান্তিক অনুবাদ। প্রথম গজলটি, যা নিচে অনূদিত, কাহারবা তালে গীত হলে, রয়েছে আট মাত্রা। জানা সুরে ‘ইয়ে ন্য থিই’ চার মাত্রা, ‘হ্যমারি’ চার মাত্রা, ‘কিসমত কে ভিসাল’ চার মাত্রা, ‘ইয়ার হোতা’ চার মাত্রা। গজলের সুরে এর অনুবাদ হলে তা হবে নিচের চরণ, সংগীতসভায় গাওয়া চলবে। গজলটি হতে পারে নানা রাগে বিস্তারিত, গাওয়া যেত একাধিক তালে। ঝোঁকটি বুঝতে হবে, যা মোশায়েরা থেকে পাওয়া। গজলটি মেহেদী হাসানের কণ্ঠে এক, অন্য গায়কের কণ্ঠে অন্যভাবে শুনেছি। ঠাকুর বা নজরুলের বেলায় আছে সুরভঙ্গের দায়, গালিবের ক্ষেত্রে তা নয়। মেধাবী সুরকারের জন্য উন্মুক্ত। যার গলায় সুর নেই, সেও গাইবে মোশায়েরার টানে।
আসাদুল্লাহ খান গালিবের গজলের শের [Couplet] বেছে নিয়ে সাজিয়েছেন অনুবাদকেরা, যেমনটি নানা ফুল থেকে চয়ন করে গাঁথা হয় একটি মালা। লাভ এই—নানা ফুলের পাপড়ি ও সুবাস উপস্থিত, এককভাবে কেউ নেই। কলকাতার ৫ নম্বর পার্ল রোডের বাসায় ব্যক্তিগত আসরে ক্ষীণকণ্ঠে আবৃত্তিকারক আবু সায়ীদ আইয়ুব, বহু পরিচিত প্রবন্ধ সাহিত্যিক, পড়ছেন সদ্য লেখা গালিবের অনুবাদ, শ্রোতা গৌরী আইয়ুব, আসমা ও আমি। তখনো গ্রন্থরূপ পায়নি। উর্দু জানতাম, অনুবাদের আনন্দটুকু উপভোগ করছি। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় অনুবাদ করেছেন অন্যকে জিজ্ঞেস করে, অন্যরা ইংরেজি থেকে। উর্দু, বাংলা, ইংরেজি থেকে গজলের মেজাজে অনুবাদ করেছে অধম। স্বাদ আলাদা হতে বাধ্য।
গালিব উর্দু ভাষার একজন সূক্ষ্মতম কবি বিধায় তা দুরূহপাঠ্য। তাঁর অত্যুৎকৃষ্ট শেরের মর্মস্থলে পৌঁছানো উর্দু জানলেই হবে না, কবি বা সংগীতজ্ঞ হলেই হবে না, হতে হবে নিখাদ গালিবপ্রেমিক। যে পথে তাঁর গমন, সেখানে অন্য কবির স্থান নেই, তা তিনি যত বড়ই হোন। গালিবের ‘আহ এ বেতাসির’ শুধু তাঁর দীর্ঘশ্বাসই নয়, বরং পরাজয়ে ভেঙে পড়ার আওয়াজ পেরিয়ে মঙ্গলালোকে উত্তরণ।
গালিবের কবিতা আমার চরণে
১. ইয়ে ন্য থি হ্যমারি কিসমত কে ভিসাল ইয়ার হোতা আগর অওর জিতে রাহেত ইয়েহি ইনেতজার হোতা \
আমার চরণে:
এ ছিল না আমার কিসমত, বন্ধুকে পাব মিলনে
বহুকাল বেঁচে থাকলে প্রতীক্ষাই সার এ জীবনে।
২. চুপকে চুপকে মুঝকো রোতে দেখ্ পাতা হ্যয় অ্যগ্যর হ্যঁসকে ক্যরতে হ্যয় ব্যয়ান্-এ শওখি-এ গুফ্তার-এ দোস্ত
আমার চরণে:
চুপি চুপি এসে যদি কেউ দেখতে আসে আমার কান্না দেখবে হাসতে হাসতে বয়ান করছি নানা ছলনা।
৩. ইয়া র্যব ওয়োহ্ ন্য স্যমঝা হ্যয় ন্য স্যমঝেঙ্গে মেরি বাত দে অওর দিল্ উনেকা জো ন্য দে মুঝকো জঁবা অওর।
আমার চরণে:
হে রব, আমাকে বোঝেনি সে, কোনো দিনও বুঝবে না তার হূদয়কে কোরো আরও প্রশস্ত, আমাকে ভাষা দিয়ো না।
৪. ঈশ্ক্ প্যর জোর নেহি হ্যয় ওয়োহ আতশ গালিব কে ল্যগায়ে ন্য লাগে অওর বুঝায়ে না ব্যনে
আমার চরণে:
ঈশ্ক্-এ খাটবে না কোনো জোর, এ যে জ্বলন্ত আগুন, গালিব জ্বলবে না জ্বালালেই নিভবে না কোনো দিন নেভালেও।
৫. এক এক ক্যতরেকা মুঝে দেনা প্যড়া হিসাবে খুনে জিগার ব্যদিয়্যত-এ-মিজগ্ন্-এ ইয়ার থা
আমার চরণে:
দিয়েছি হিসাব আমি একটি একটি করে শোনিত বিন্দু জিগ্যরের আঁখি পল্লবে জিম্মি মোর হূদয় সিন্ধু।
২০ আগস্ট, ২০১১
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, অক্টোবর ০৭, ২০১১
Leave a Reply