নেই
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
অনেক দিন পর খাবার-টেবিলে বসলাম, বউমার পীড়াপীড়িতে। বউমার নাম টুম্পা, কিন্তু মমতা ওকে আকিমুন্নেছা নামেই ডাকত। মেয়েটি মন খারাপ করত, কিন্তু মুখে কিছু বলত না। তার এই পোশাকি নামটা নিয়ে সে বিব্রত। মমতার মুখে ওই নাম শুনে তার নিশ্চয় বিরক্তি লাগত। কিন্তু আশ্চর্য মেয়ে! মুখ ফুটে এক দিনও বলেনি, ‘মা, আমাকে টুম্পা বলে ডাকবেন।’ আজ মমতা নেই, এক মাস ধরেই নেই। এই এক মাস আমার কীভাবে কেটেছে, আমি নিজেই জানি না। এক সীমাহীন শূন্যতায় ভেসে বেড়িয়েছি; কোনখানে, কোন দিগন্তে একটা ঠাঁই মিলবে, সেই প্রশ্নও নিজেকে করিনি। মমতার সঙ্গে আমার জীবনটা এমনভাবে মিশে গিয়েছিল, তাকে ছাড়া একটা মুহূর্তও কল্পনা করতে পারিনি। সেই মমতা তিন দিনের জ্বরে ভুগে চলে গেল। আমাকে একটুখানি সুযোগ দিল না দুহাত দিয়ে তাকে ধরে রাখতে, আমার জীবনে তাকে ফিরিয়ে আনতে। এখন মমতার ওপর আমার প্রচণ্ড অভিমান। সেই অভিমান আমাকে নাওয়া-খাওয়া ভুলিয়েছে, আমাকে চোখের জলে ভাসিয়েছে। একসময় ভেবেছিলাম, মমতার সহযাত্রী হব। কিন্তু আমাকে তা হতে দেয়নি বউমা। আমাকে জোর করে স্নানঘরে পাঠিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে। মমতাকে যাতে ভুলে থাকি, সে জন্য আমার পাশে বসে দিনের কাগজ পড়ে শুনিয়েছে। গল্প করেছে। টুম্পার হাতে আমাকে ছেড়ে দিয়ে রাজু অফিসে গেছে। আমি বুঝতে পারি, রাজুর ভেতরেও অনেক কষ্ট। কিন্তু ছেলেটি ছোটবেলা থেকেই চাপা স্বভাবের। তার কষ্ট যেটুকু, তা আমি তার শুধু চোখে পড়তে পারি—এর বাইরে তার কষ্টের কথা আমার জানা সম্ভব নয়। হয়তো টুম্পা জানে। কিন্তু টুম্পা জানলেও এ নিয়ে সে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলবে না।
আজ নাশতার টেবিলে রাজু বসেছে মুখ নিচু করে। তাকে দু-একটা টুকটাক প্রশ্ন করছে টুম্পা। রাজুর কথা বলার অভ্যাস নেই। সে দু-এক শব্দে উত্তর দিচ্ছে। আজ টুম্পা নেমেছে মমতার ভূমিকায়, কিন্তু ভূমিকাটা সে পছন্দ করছে না, এ রকম মনে হচ্ছে। তারও খাবারে মনোযোগ নেই, কিছুটা উদাস হয়ে সে দেখছে জানালার বাইরের বাতাবি লেবুর গাছটা, অথবা গাছে বসা দুটি খঞ্জনা পাখি।
সবই তাহলে আছে। জানালার বাইরে সকাল আছে, রোদ আছে, বাতাবি লেবুর সবুজ ছায়া আছে, খঞ্জনা দুটিও আছে, খাবার-টেবিলটা আছে, তার ওপর পাতা খয়েরি ওয়েলস্কিনের ঢাকনাটা আছে, সে ঢাকনার ওপর পানিভর্তি স্মার্নফের বোতল আছে, রয়্যাল হালাল চানাচুরের বৈয়াম আছে, পাঁচ-ছটা সোজা ওল্টানো পানির গ্লাস সাজানো আছে, ডাবরের চ্যবনপ্রাসের কৌটা আছে, প্রাণের মধুর বোতল আছে। সবই তো আছে। প্লাস্টিকের চামচ-স্ট্যান্ড, দেশলাইয়ের বাক্স, অখোলা বিয়ের দাওয়াতপত্র, লবণদানি, মার্জারিনের কৌটা, তেরোটি পিঁপড়া—না, আরও—মার্জারিনের কৌটা বেয়ে লাইন ধরে উঠছে। কোথায় যাচ্ছে তারা? অথবা ফিরছে? ফিরছে তাদের তিন কামরার ফ্ল্যাটটিতে, যেখানে সবই আছে, আগের মতোই? শুধু একজন নেই?
এই সময় রান্নাঘরে শব্দ হতো, কখনো হাসি ভেসে আসত ভাঙা চুড়ির মতো টুংটাং; অস্থির আনাগোনা চলত মমতার, ‘আকিমুন্নেছা’ ‘আকিমুন্নেছা’ বলে ডাকত টুম্পাকে, তার ওপর রাগও দেখাত—কখনো কখনো—কিন্তু সারাটা সকাল একটা সপ্রাণ সুর বাজিয়ে যেত।
সেই কথা নেই, হাসি নেই, প্রাণের সাড়া নেই।
নেই।
একটা সময় রাজুর নাশতা খাওয়া শেষ হবে। একসময় সে তৈরি হয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলবে, ‘বাবা, যাই। তুমি ভালো থেকো।’ তারপর মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাবে। আজ টুম্পাকেও একসময় বলতে হবে, ‘বাবা, যাই।’ টুম্পার স্কুল শুরু হয়েছে। কত আর ছুটি পাবে মেয়েটা। এখন সারা দিন আমার কাটবে বারান্দায় সেই চেয়ারটাতে বসে, যা মমতা আমাকে পনেরো বছর আগে কিনে দিয়েছিল এক ফার্নিচার মেলা থেকে। সেই চেয়ারে বসে আমি দিনের আলোর বাড়া-কমা দেখব, চোখ ভরা শূন্যতায় একটা ছায়ার আদল খুঁজে বেড়াব। এখন টুম্পা আরেক কাপ চা নিয়ে এসেছে। ঠিক এই জায়গাটাতে দাঁড়িয়ে মমতা বলত, ‘ইক্যুয়াল ছাড়াই চা-টা খাও। কেন শুধু শুধু কেমিক্যাল খাবে, বলো?’
ইক্যুয়ালের শিশিটা আছে, আমার চায়ের বাদামি পোরসেলিনের কাপটা আছে, টেবিলের ওপর ঘুরতে থাকা সিলিংফ্যানের ছায়াটা আছে, টেবিলের এক কোণে ওয়ান ব্যাংকের ক্যালেন্ডারটা আছে, আটটা কোস্টারের একটা সেটও আছে।
কোথাও এসবের থাকার কোনো বিড়ম্বনা নেই, বিরতি নেই, নড়চড় নেই। শুধু বোবা এই জিনিসগুলোকে একজন যে আনন্দিত ভাষা দিত প্রতিদিন, যে ভাষায় সারা সকাল-দুপুর এগুলো আমার সঙ্গে কথা বলত, সে-ই নেই।
নেই।
২
মায়ের চলে যাওয়াটা বাবার জন্য এত বড় আঘাত হবে, আমি সেটা ভাবতে পারিনি। এই এক মাসে বাবার বয়স বেড়েছে যেন কুড়ি বছর। হাসিখুশি মানুষ আমার এই বাবা, এখন দেখলে মনে হয় যেন পাথরের তৈরি। হাসিখুশি সব উধাও হয়েছে। খাবার-টেবিলে বসে আছেন, যেন কেউ তাঁকে এখন তাঁর মৃত্যুদণ্ড পড়ে শোনাবে। না, ভুল বললাম, মৃত্যুদণ্ড পেলে বাবা বেঁচে যান। এই এক মাস বাবা আছেন জীবন্মৃত। জীবনে যেটুকু তিনি আছেন, তা আছেন টুম্পার জন্য। আমি কোনো সাহায্য করতে পারছি না—পারার ক্ষমতাও আমার নেই।
মা যে আমাদের জীবনে এতখানি জায়গাজুড়ে আছেন, এটি, আশ্চর্য, মা বেঁচে থাকতে আমার মনে হয়নি। একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে গিয়েছিলাম চাঁটগায়। মাস দুয়েক ছিলাম। প্রতিটি দিন আমার কাছে কী দুর্বিষহ ঠেকত! মাকে ছাড়া কিছুতেই যেন চলত না। তারপর মা একদিন বললেন, ‘চলে আয়।’ আমি ফিরে এলাম। অবাক! এক বছর গচ্চা দিয়ে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। আমার বন্ধুরা সব আমার সিনিয়র হয়ে গেল। কিন্তু একবারের জন্যও আমার খারাপ লাগেনি। বাবাও কী সহজে মেনে নিলেন! সেই থেকে নিয়ে মাকে ছেড়ে কদিন ঘরের বাইরে থেকেছি, হাতের সবগুলো আঙুলে তার বোধহয় হিসাব হয়ে যায়।
হায়!
মা চলে যাওয়ায় বাবা পড়েছেন অকূলপাথারে। কিন্তু আমি? মাকে হারানোর কষ্টে আমার ভেতরটাও কি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে না? ভাগ্য, টুম্পা আছে। টুম্পার সঙ্গে মায়ের কোনো দিন সদ্ভাব হয়নি; কেন, ভেবে পাই না। হয়তো মা একটুখানি ডিমান্ডিং ছিলেন, সে জন্য। হয়তো টুম্পার স্বাধীনতাটা একটুখানি ছেঁটে দিয়েছিলেন মা, সে জন্য। টুম্পা আমাকে এ নিয়ে কোনো দিন কিছু বলেনি, আমিও জিজ্ঞেস করিনি। আমার ভয় হতো, এতে টুম্পা এমন কিছু বলবে, যা আমাকে কষ্ট দেবে। অথবা, আরও যা ভয়, কোনোক্রমে মা জেনে ফেললে তাঁর অশান্তি হবে। কী মায়া ছিল মায়ের, সবকিছুর জন্য! আমার বন্ধুরা কী দারুণ ভক্ত ছিল তাঁর! এই কিছুদিন আগেও বাইরে থেকে ফিরতে রাত হলে মা জেগে থাকতেন। টুম্পাকে আমার সঙ্গে যেতে দিতেন না, বলতেন, ‘আকিমুন্নেছা, তুমি না গেলে ছেলেটা তাড়াতাড়ি ফিরবে।’ দু-একবার টুম্পা কান্নাকাটি করেছে, কিন্তু তাতে মা কষ্ট পেয়েছেন। কষ্ট পেলে মায়ের কেন জানি রাগটা বাড়ত। সেই রাগের ঝাপটা যেত আমার ওপর দিয়ে। আর তাতে টুম্পার কান্না বাড়ত।
টুম্পাকে মা আকিমুন্নেছা কেন ডাকতেন, টুম্পা কেন নয়, তা নিয়ে ওর একটা ক্ষোভ ছিল। আমি মাকে জিজ্ঞেস করতে রাগ করেছিলেন, বলেছিলেন, ‘আকিমুন্নেছা নামের একটা অর্থ আছে। টুম্পার কোনো অর্থ নেই। অর্থহীন নামে কেন ডাকব ঘরের বউকে?’
মনে আছে, মাকে যেদিন প্রথম জানালাম টুম্পার কথা, টুম্পাকে যে বিয়ে করতে যাচ্ছি সে কথা, মা আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। সে এক ভজকট কাণ্ড। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, বাবাকে দূতিয়ালিতে লাগিয়ে মাকে রাজি করিয়েছিলাম। মায়ের আপত্তি ছিল টুম্পার বয়স নিয়ে। অবাক, ওর বয়স ছিল তখন চব্বিশ, অথচ আপত্তি তো থাকার কথা ছিল আমার বয়স নিয়ে। তেত্রিশ বছর কি বিয়ের জন্য একটু বেশিই না? ভাগ্যিস, টুম্পার সঙ্গে পরিচয়টা হয়েছিল রুমির বাড়িতে। টুম্পা রুমির কাজিন, অথচ বিয়ের পর একদিন যে এল, তারপর আর রুমির পা পড়েনি এ বাড়িতে।
সেই টুম্পাকে কী সহজে মা মেনে নিলেন! বিয়ের তিন বছর কী সুন্দর একটা জীবন আমরা সবাই মিলে কাটিয়ে দিলাম! সেই জীবনের বড় শক্তিটার জোগান দিতেন মা। স্নেহ দিতেন, ভালোবাসা দিতেন, যত্ন দিতেন। প্রতিটি মুহূর্ত ভরিয়ে রাখতেন মা—তাঁর ছায়া দিয়ে, তাঁর স্পর্শ-ঘ্রাণ-সুষমা দিয়ে, তাঁর মমতা দিয়ে। মায়ের নামটাই ছিল এক জাদুর। এই নামের প্রতি সারা জীবন মা সুবিচার করে গেছেন।
অথচ আজ মা নেই।
অবাক, খাবার-টেবিলটা অবিকল আছে, ঠিক যেভাবে মা রেখে গিয়েছিলেন। টুম্পাকে বলিনি, অথচ একটা কিছুও টেবিলের এদিক-সেদিক করেনি সে। নিশ্চয় টুম্পাও স্মৃতিকাতর, আমি সেটি বুঝি। টেবিলে মায়ের হাতের স্পর্শটা লেগে আছে, একটু বুলিয়ে দেখলেই টের পাব। টেবিলজুড়ে মায়ের ঘ্রাণ। তাঁর হাসি বাজে ঘরজুড়ে। তাঁর দৃষ্টি, তাঁর স্নেহ। সবই টের পাই, যদি চোখটা বন্ধ করে রাখি। কিন্তু চোখ খুললেই চোখ বাঁধিয়ে দিয়ে বাস্তব আমাকে জানায়, নেই।
আমি বাবার জন্য কাঁদব, না নিজের জন্য? একটি মাস আগেও মা ছিলেন ঘরজুড়ে। এমনকি দিন তিনেক যে বিছানায় ছিলেন, তখনো। শেষ দিন যখন ঘোলাটে চোখ খুলে আমাকে খুঁজছিলেন, রুগ্ণ হাতটা অনেক কষ্টে তুলে আমার চুলে আস্তে বুলিয়ে দিয়েছিলেন, সেদিনও মা ছিলেন বাড়িজুড়ে।
কী এমন হলো যে সব ছেড়ে মা চলে গেলেন? বাবাকে ছেড়ে? আমাকে ছেড়ে? এখন এ বাড়িতে হেঁটে বেড়ানোও একটা ভয়ানক কষ্টের বিষয়। এখন বাড়িজুড়ে শূন্যতা। সারা বাড়িতে হাহাকার। সেই হাহাকারে শামিল খাবার-টেবিলে ঘুরতে থাকা পিঁপড়াগুলোও। তারাও জানে, যার হাতের স্পর্শ থেকে ঝরে পড়া মধু ছিল তাদের প্রতিদিনের আহার, সেই মানুষটি আজ নেই।
নেই।
৩
আশ্চর্য এক বাড়ি, রাজুদের। এ বাড়িতে যেদিন প্রথম পা পড়ে আমার, মনে হয়েছিল বাড়িটা বড় মায়াময়। রাজুর সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকেই ওর মায়ের গল্প শুনে এসেছি। শুনে শুনে মনে হতো, যেন রক্ত-মাংস নয়, মায়া দিয়ে তৈরি মানুষ। বাবা সম্পর্কে রাজু তেমন কিছু বলত না। কিন্তু প্রথম দিন দেখেই মনে হয়েছিল, ভেতরে-বাইরে একজন খাঁটি ভালো মানুষ। সে ধারণায় এই তিন বছরেও কোনো উনিশ-বিশ হয়নি আমার। কিন্তু মা!
সে আরেক কাহিনি।
আমার বাবা সামান্য চাকুরে, ভাইবোন সবাই মিলে আমরা পাঁচজন। নিজের পছন্দে বিয়ে করাটাই ছিল আমার জন্য এক বিরাট বিপ্লব। সেখানে, বিয়ের কদিন পর বাড়ি গিয়ে মাকে রাজুর বাড়িতে আমার অভিজ্ঞতা বলার মুখটা সত্যি বলতে ছিল না। মাকে কোনো দিন বলতে পারিনি, প্রতিটি দিন কত বিচিত্র কষ্টে কাটত আমার। বিয়ের সিদ্ধান্তটা ছিল আমারই। বিয়ের পর যদি কপালে দুঃখ থাকে, তার ভারটাও নিশ্চয় আমার। ফলে, আমার প্রতিদিনের কষ্টের গল্পগুলো, এমনকি আমার ‘টুম্পা’ নামটি হারিয়ে যাওয়ার গল্পও তাঁকে বলা হয়নি। তুলি আপুকেও না, চম্পাকেও না। যেদিন দেখলাম, মায়ার শরীরের মানুষটির ভেতরে আমার জন্য কোনো মায়া নেই—যা আছে তা শুধুই এক নামহীন নির্মমতা—তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমার কষ্টের ভাগী কাউকেই করব না। এমনকি যে শিশুটি ভ্রূণের শরীরহীনতাতেই একদিন হারিয়ে গেল, সে যদি জন্ম নিত, তাহলে তাকেও না। রাজু কখনো জানেনি, কেন কত রাত আমি কেঁদে বালিশ ভেজাতাম। আমার নামটাকে বিকৃত উচ্চারণে যখন মা একটা ছুরির মতো চালাতেন আমার শরীরের ওপর দিয়ে, তখনো রাজুকে কিছু বলিনি। রাজু অন্ধ ছিল মাকে নিয়ে। মা ছিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য। এ বাড়িতে আমি ছিলাম একটা ছায়া; কায়া ছিলেন ওই একজনই, অন্তত রাজুর কাছে। এ নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলার কোনো অর্থ ছিল না, তর্ক করার তো নয়ই। মা আমাকে পরিশ্রমের পর পরিশ্রম করিয়েছেন। রাজুর চোখে তা ছিল মা-মেয়ের—শ্বাশুড়ি-বউমার নয়—বোঝাপড়া। প্রশিক্ষণ। জীবনের আনন্দিত পাঠদান ও গ্রহণ। যেখানে ওর মায়ের বিষয় জড়িত, সেখানে রাজু চক্ষুহীন। যেখানে মা, সেখানে রাজুর অন্য কোনো পক্ষ নেই।
এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছি অনেকবার, কিন্তু যাওয়া হয়নি রাজুর জন্যই। আর কিছুটা হয়তো বাবার জন্য। খুব আদর করে একটা হাত মাথায় রেখে বলতেন, ‘কটা দিন যাক, মা। সব ঠিক হয়ে যাবে।’ অবাক, বাবা যেখানে বুঝতেন, রাজুর সেখানে সবকিছু চোখ এড়িয়ে যেত। অথচ রাজু মানুষটা কী অসম্ভব ভালো! আমার জন্য ওর প্রচুর ভালোবাসা। প্রচুর উদ্বেগ। ভ্রূণটি হারিয়ে গেলে সারা রাত হাসপাতালে আমার হাত ধরে বসে ছিল সে। আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল। সারা রাত।
কিন্তু তা ওই মায়ের দৃশ্যে উদয় হওয়া পর্যন্তই। মায়ের সামনে তার কথা কমে যেত; সে উদাসীন হয়ে যেত। যেন এই টুম্পা হঠাৎ এসে পড়েছে একটা হাওয়ার মতো। কিছুদিন উদাসীন ঘুরে বেড়ালে হাওয়াটা নিজেই মিলিয়ে যাবে।
মায়ের চোখে তখন একটা ঝলক দেখতাম আমি। ঝলকটা আনন্দের। কেন যে তিনি ছেলেকে নিয়ে আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছিলেন, আমার কোনো দিন জানা হবে না। ফ্রয়েড সাহেবের বই পড়লে হয়তো জানা যায়, কিন্তু এসব কিছুতে উৎসাহ আমি এ তিন বছরে হারিয়ে ফেলেছি।
আমার জীবনটা চলতে চলতে একটা গুপ্তখালে আটকে পড়েছিল। এ কয় মাস কেন জানি আমার ডুবে যাওয়ার অনুভূতিটা খুব বেশি হতো। রাজুকে আঁকড়ে ধরে হয়তো মাথাটা পানির ওপরে তুলতে পারতাম—আর তা রাজুর জন্যই—কিন্তু শেষ দিকে সে ইচ্ছাটাও প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম।
একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে ধীরে ধীরে শেষ করছে, তিলে তিলে নিংড়ে নিচ্ছে প্রাণ, অথচ প্রাণ হারাতে যাওয়া মানুষটি ঘুরে দাঁড়ানোর বদলে নিজেকে সমর্পণ করছে আরও দ্রুত নিঃশেষ হওয়ার জন্য—এ এক অদ্ভুত চিত্রনাট্য, সন্দেহ নেই।
এই চিত্রনাট্যের শেষ দৃশ্যটি দেখার অপেক্ষায় ছিলাম, যখন ঘটল সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা। তিন দিনের রোগে ভুগে মানুষটা চলে গেলেন। শেষবার আমার দিকে যখন তাঁর সাদা, অস্বচ্ছ চোখ মেলে তাকালেন, যেন মনে হলো সারা জগতের বিপন্নতা সেখানে; জিততে থাকা একটা খেলা হাত ফসকে বেরিয়ে গেলে খেলোয়াড়দের যে রকম হয়।
আমার কান্না এসেছিল। মানুষটা চলে যান, আমি চাইছিলাম না। চাইছিলাম না রাজুর জন্য। মাকে হারিয়ে রাজু কি আর রাজু থাকবে?
আজ অনেক দিন পর সকালের খাবার-টেবিলে বসেছেন বাবা আর রাজু। দুজনই বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। দুজনের কান্না আমাকেও কাঁদিয়েছে। আমি দেখছি টেবিলজুড়ে মায়ের স্মৃতি, তাঁর স্পর্শ, তাঁর অধিকার আর কর্তৃত্ব। একটা গ্লাসও তাই এদিক-সেদিক করতে আমার ভয় হয়েছে। মায়ের ওষুধ, তাঁর চায়ের মগ, তাঁর ভিটামিনের শিশি—সব পড়ে আছে। খাবার-টেবিলজুড়ে স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু তিনি নেই।
এবং নেই একটা কালো করাল ছায়া, যা আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখত। নেই আমার নামহীনতা। আমার বিপন্নতা।
আজ সকালে জানালার বাইরে যে আলো, তাতে শুধুই স্বচ্ছতা; তা নিভিয়ে দেবে, তাকে ম্লান করে দেবে, সে রকম কষ্টের কোনো আনাগোনা আর নেই।
টেবিলে ঘুরতে থাকা পিঁপড়াগুলোও যেন আমাকে বলছে, তোমার চারদিকে যে একটা বেড়ি বাঁধা ছিল, সেটি আজ নেই। আজ তুমি আমাদের মতো ঘুরে বেড়াও।
আজ তোমার তুমি হতে আর কোনো বাধা নেই।
Leave a Reply