সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১) বাংলা সহিত্যের খ্যাতিমান গল্পকার,ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার। তাঁর প্রথম উপন্যাস লালসালু। অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: চাঁদের অমাবশ্যা, কাঁদো নদী কাঁদো, নয়নচারা, দুই তীর ও অন্যান্য গল্প, বহিপীর, তরঙ্গভঙ্গ প্রভৃতি।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিখ্যাত উপন্যাস লালসালু। প্রধান নারী চরিত্র জমিলা, সূক্ষ্ম প্রতিবাদ ও কোনো কিছু মেনে না নেওয়া তার সহজাত বৈশিষ্ট্য। তার স্বামী, অর্থাৎ মজিদের প্রথম স্ত্র্রী রহিমা। জমিলার বয়স মজিদের অর্ধেকেরও কম। ১৮-১৯ বছরের যুবতী। মজিদ যখন বলে, রূপ দিয়া কি হইবো? মাইনষের রূপ ক-দিনের? ক-দিনেরই বা জীবন তার?
এই কথাটি জমিলাকে বিদ্রোহী করে তোলে। আমার চিত্রকর্মে বিদ্রোহী ভাবটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। তবে আমি ঔপন্যাসিকের মতো কবরের ওপর পা তুলে দিয়ে বিদ্রোহ ভাবটা দেখানোর চেষ্টা করিনি। আমার প্রথম থেকেই ভাবনা ছিল, আমাকে অন্য রকম একটা কিছু করতে হবে। আমি শেষাবধি সেটাই করেছি। আমি যেটা করেছি, সেটা হলো—টিনের ঘরের দুয়ারে হেলান দিয়ে কেশবিন্যাসরত জমিলা। উঠোনের একপাশ বেড়া দিয়ে ঘেরা। অনতিদূরে লালসালু দিয়ে ঢাকা কবরের একাংশ দেখা যায়। তার পাশে টিনের চাল, পেছনে একটা বেড়ার বাড়ির মাথার কিছু অংশ। গ্রামের পরিবেশ বোঝানোর জন্য পেছনের চালে কলাগাছের কিছু অংশ। এ ছাড়া ঘরে ওঠার যে সিঁড়ি তা শানবাঁধানো নয়। তালগাছের তিনটে গুঁড়ি দিয়ে সিঁড়ির ধার বানানো। ঘরের কোণে একটা বদনা। তার সামনে পানি রাখার জন্য বড় আকৃতির একটা মাটির মটকা।
প্রসঙ্গত, লালসালু সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত প্রধানতম একটি উপন্যাস। এর পটভূমি ১৯৪০ কিংবা ১৯৫০ দশকের বাংলাদেশের গ্রামসমাজ হলেও এর প্রভাব বা বিস্তার কালোত্তীর্ণ। উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৪৮ সাল। এটি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ রচিত প্রথম উপন্যাস। এটি পরে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়। পরে এটির ওপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
উপন্যাসে বর্ণিত জমিলার ভেতরের সত্তাটাকে আমি যথাসাধ্য ফ্রেমে বন্দী করার চেষ্টা করেছি। আমি দেখাতে চেয়েছি প্রকৃতির আদরে বেড়ে ওঠা জমিলাকে। তার ভরা যৌবনের রূপে, সবুজ ডোরা কাটা লাল পাছা ফেরা শাড়ির অন্তর্গত সৌন্দর্যে। যার সামনে একটা গোল আয়না, পাশে একটা তেলের শিশি। এই ভঙ্গিতে আমি যত না বিদ্রোহ তার চেয়ে বিষণ্নতাকে বেশি করে ফুটিয়ে তুলেছি। কেননা জমিলার শরীর ও মনে যে বিষণ্নতা, তা-ই তার বিদ্রোহ। তার চোখে শত্রুর আভা, যা ভেদ করতে সে অস্থিরতার আশ্রয় নেয়, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে ফেরে। লক্ষণীয়, আমি যথাসম্ভব সময়কে ধরার চেষ্টাও করেছি। টিনের ঘর, খাট, পাঞ্জাবি, লুঙ্গি, মাটির বদনার মতো উপাদান-উপকরণকেও আমি যথাসম্ভব ধরার চেষ্টা করেছি।
উপন্যাসে দেখা যায়, জমিলা অবলীলায় বলছে, ত্যানার (মজিদ) অযু নাই।
আবার, মজিদ যখন বলে, রূপ দিয়া কি হইবো? মাইনষের রূপ ক-দিনের? ক-দিনেরই বা জীবন তার?
তখন জমিলার প্রতিক্রিয়া লেখকের ভাষায় এ রকম: ক্ষিপ্রগতিতে জমিলা স্বামীর পানে তাকায়। শত্রুর আভাস পাওয়া হরিণের চোখের মতোই সতর্ক হয়ে ওঠে তার চোখ।
অন্যত্র, ঝাঁপটা খুলে মজিদ দেখল লাল কাপড়ে আবৃত কবরের পাশে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে জমিলা, চোখ বোজা, বুকে কাপড় নেই। চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বলে সে বুকটা বালকের বুকের মতো সমান মনে হয়। আর মেহেদি দেওয়া তার একটা পা কবরের গায়ের সঙ্গে লেগে আছে। পায়ের দুঃসাহস দেখে মজিদ মোটেই ক্রুদ্ধ হয় না। এমনকি তার মুখের একটি পেশিও স্থানান্তরিত হয় না।
উপন্যাসে আছে, ক্ষিপ্রগতিতে জমিলা স্বামীর পানে তাকায়। শত্রুর আভাস পাওয়া হরিণের চোখের মতোই সতর্ক হয়ে ওঠে তার চোখ। আমি উপন্যাসের ব্যাপারে খুবই সতর্ক ছিলাম। উপন্যাস আর চিত্রকর্ম এক নয়। উভয়ই শিল্প, কিন্তু মাধ্যমগত ভিন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। উপন্যাসে যা আছে, যেমনভাবে আছে, আমি সেটা দিইনি। আমি নির্যাসটা নিয়েছি, তারপর যা করেছি, আমার মতো করে করেছি। আমিই তার স্রষ্টা হয়ে উঠেছি। তাই জমিলার ভরা যৌবন ব্যর্থ হওয়ার দিকটাকেই আমি গুরুত্ব দিয়েছি। একজন মানুষের শরীর খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তাকে অস্বীকার করা যুক্তিযুক্ত নয়। তাই জমিলার রূপের দিকটাকেই আমি তুলে ধরেছি। আমি জমিলার অবয়বের মধ্য দিয়ে এসব বিষয়কে সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছি। আমি দেখিয়েছি, তার বেশ লম্বা চুল, আয়েশি ভঙ্গিতে উদাসীন হয়ে বসে থাকা। চুল আঁচড়ানোর ভঙ্গিমা। আমার ছবিতে আমি জমিলার চোখে ব্যথা, চেহারায় বিষণ্নতা দেখিয়েছি। তার আদুল গায়ের অংশবিশেষ দেখিয়েছি। আমি মনে করি, এসবই জমিলার প্রতিবাদ।
আমি মনে করেছি, জমিলার এই ভঙ্গিতে তার সব প্রতিবাদ কথা বলেছে। আমার মনে হয়েছে, পীরের বাড়িতে একটা মেয়ের স্বাভাবিকভাবে পর্দানশিন থাকার কথা। যেমনটা দেখা গেছে, প্রথম বউ রহিমার ক্ষেত্রে। স্বামী মজিদের প্রতিটি কথা তার কাছে অবশ্য পালনীয়। কোথাও কোনো নড়চড় নেই। মজিদের কোনো ধূর্ততা, শঠতা, ভণ্ডামি কোনোটাই তার চোখে পড়ে না। অন্যদিকে জমিলা একেবারেই উল্টো পথে চলে। আমার মনে হয়েছে, এভাবে চিত্রায়িত করার মধ্য দিয়ে আমি জমিলা চরিত্রের প্রতিবাদের রূপরেখা যথার্থভাবে অঙ্কন করতে পেরেছি। এখানে একটা জিনিস লক্ষণীয়, কবর যে আচ্ছাদনে আবৃত অর্থাৎ লালসালু। সেই আচ্ছাদনের রং লাল, আর তার পাড়ের রং হলুদ। সেই জিনিসটি আমি করেছি চুলের ফিতে লাল রং করার মধ্য দিয়ে। যেটা কিছুটা অযত্নে মাটিতে পড়ে সিঁড়ির ধাপে এলিয়ে আছে। অর্থাৎ জমিলার কাছে ওই লালসালুর কোনো গুরুত্ব নেই। এভাবেই আমি লালসালুর ভেতর দিয়ে জমিলাকে প্রকাশ করেছি।
১৯৮৯ সালের শেষের দিকে আমি একটা বহুজাতিক কোম্পানির বর্ষপঞ্জির জন্য চিত্রকর্ম অঙ্কন করি। যার বিষয় ছিল বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী ১২ জন লেখকের বিখ্যাত ১২টি নারী চরিত্র। সে উপন্যাসগুলো হলো: কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ, নজিবুর রহমান সহিত্যরত্নের আনোয়ারা, জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, আবুল মনসুর আহমদের জীবনক্ষুধা, মোজাম্মেল হকের জোহরা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু, হুমায়ুন কবিরের নদী ও নারী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের পদ্মরাগ, আবুল ফাত্তাহ কোরেশির সালেহা, অদ্বৈতমল্ল বর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর রাইনন্দিনী।
এগুলো আমি এঁকেছিলাম অ্যাক্রিলিক রং দিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে চিন্তাভাবনা করছিলাম, আমি আবার ফিগারেটিভ কাজের দিকে ফিরে যাব। দীর্ঘ ২৫ বছর আমি ফিগারধর্মী ছবি আঁকিনি। মনের তাগিদ থেকে আমি এই কাজ করেছি। আমি আমার দেশের যে ঐতিহ্য পালযুগের চিত্রকলা, কালিঘটের চিত্রকলা এগুলোর ভেতর দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করার চেষ্টা করেছি।
১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের তিন মাসের ফেলোশিপ নিয়ে আমি লন্ডন চলে যাই। সেখানকার নানা মিউজিয়ামে আমি এই কাজগুলোকে পর্যবেক্ষণ করি। পরবর্তী সময়ে ভারত সরকারের আইসিসিআর স্কলারশিপ নিয়ে ১৯৮৮ সালে একই বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি। বিশেষ করে সেখানকার হেরিটেজ। দিল্লি, বেনারস, কলকাতার নানা অঞ্চল ঘুরে আমি এই কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করেছি।
আমার প্রথম থেকেই পরিকল্পনা ছিল কাজগুলোতে আমি ভিন্নমাত্রা যোগ করব। উপন্যাসে যে রকম আছে, তেমন না করে নতুনভাবে প্রকাশ করব।
কাজগুলোতে আমাকে প্রচুর খাটতে হয়েছে। প্রতিটি বই পড়া ছাড়াও উপন্যাসগুলো নিয়ে যেসব লেখালেখি হয়েছে, সেগুলোও পড়তে হয়েছে। প্রতিটি লেখার মূল নির্যাস অনুসন্ধান করতে হয়েছে। একটা কথা আমি বলতে চাই, উপন্যাসের ইলাসট্রেশান আমি করিনি। আমি একটা ক্রিয়েটিভ কাজের মতো এগুলোকে সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছি।
আমার মনে পড়ে, কাজ করার সময়ের স্মৃতি। ১৯৮৯ সাল, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। আমার হাতে তেমন কোনো অর্থ নেই। মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম চেয়েছি। যা থেকে তিন মাসের বাকি ঘরভাড়া শোধ করব ও সংসারের অন্যান্য খরচ চালাব। যদিও তখন আমি পূর্ণ প্রফেসর। তবে সেই সময় প্রফেসরদের বেতন-স্কেল এখনকার মতো ছিল না। আমি ১০ হাজার টাকার স্কেলে চাকরি করতাম। এক ধরনের মানসিক অস্থিরতার মধ্যে সময়গুলো কাটছিল। ঠিক এ সময় কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই ফোনে আমাকে জানাল, আপনি যদি এক দিনের জন্য ঢাকায় আসতে পারেন তাহলে খুব ভালো হয়। আমি ঢাকায় এলাম। বহুজাতিক একটা কোম্পানির বর্ষপঞ্জি করার জন্য। আমি এমনিতে ফরমায়েশি কাজ বইয়ের প্রচ্ছদ, ইলাসট্রেশান, ক্যালেন্ডার করি না। কেননা, এখানে শিল্পীর স্বাধীনতা থাকে না। পছন্দ-অপছন্দ থাকে না। সবকিছু অন্যের ইচ্ছেমতো করতে হয়।
তাঁদের বললাম, আমি কাজটা করব। আমাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে। ভালো-মন্দ, সুনাম-দুর্নাম সম্পূর্ণ আমার। তাঁরা রাজি হলেন। আমি আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে যাই বইগুলো পড়ার জন্য। সব বইয়ের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। কিছু বই আমার বন্ধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরের কিউরেটর শামসুল হোসেন ও বাংলার অধ্যাপক ভূঁইয়া ইকবাল জোগাড় করে দিলেন। প্রথম পড়ি জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, তারপর কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ। এভাবে সব বই পড়ে শেষ করি। আমি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুক্ষুধাও পড়ি এবং আঁকি। কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়, যারা বাংলাদেশের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছে, শুধু তাদের লেখা উপন্যাসের নারী চরিত্র নিয়ে কাজটি সম্পন্ন করা হবে। তাই মৃত্যুক্ষুধার কাজটিকে বাদ দেওয়া হয়। এবং এর পরিবর্তে যোগ করা হয়, অদ্বেতমল্ল বর্মনের তিতাস একটি নদীর নাম।
ছবিগুলো কীভাবে আঁকব এ নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। আমার একটাই ভাবনা ছিল, কাজগুলো যেন উপন্যাসের মতো হয়ে না যায়। দেখে যেন মনে না হয় উপন্যাসের ইলাসট্রেশান করেছি। বইগুলো পড়তে পুরো আগস্ট মাস লেগে যায়। সেপ্টেম্বরের প্রথম থেকেই আঁকা শুরু করি। প্রথম আঁকি জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসের নারী চরিত্র টুনিকে। আর সবশেষে আঁকি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝির কপিলাকে। প্রথমে আমি ড্রয়িংগুলো করি। তারপর রং লাগানো শুরু করি। সব কাজ শেষ হয় সেপ্টেম্বরের শেষাশেষি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১
Leave a Reply