মানুষ যখন প্রকৃতির হন্তারক
মশিউল আলম
জীববিজ্ঞানীর সমাজভাবনা—জিয়া উদ্দিন আহমেদ \ অনুপম প্রকাশনী \ ফেব্রুয়ারি ২০১১ \ প্রচ্ছদ ধ্রুব এষ \
পৃষ্ঠা ১১২ \ দাম ১৫০ টাকা
বিজ্ঞান বিকাশের ফল দৃশ্যমান হয় প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। বিশ্বের সবখানে একই ধারায় বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটে না; বরং কোনো কোনো অঞ্চলে বিজ্ঞান পুরোপুরি অনুপস্থিত থেকে যায়। কিন্তু প্রযুক্তি পৌঁছে যায় পৃথিবীর একদম প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত।
যদিও বাংলাদেশ এখনো মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় উঠে আসতে পারেনি, তবু এ দেশে আধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও ব্যবহার পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর থেকে খুব কম নয়। প্রযুক্তির প্রসারের ফলে একদিকে প্রকৃতিকে শোষণ করে জীবিকা নির্বাহের সুযোগ ও পরিধি যেমন বেড়েছে, তেমনই অনেক সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক সম্ভাবনাও ক্রমেই পরস্ফুিট হচ্ছে। এককালে যে মানুষ বিপুল-বিশাল পরাক্রমশালী প্রকৃতির বুকে অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামেই সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকত, আজ সেই মানুষ প্রকৃতিকে কেবল পরাস্তই করেনি, তাকে ধ্বংস করতেও উদ্যত হয়েছে। এই ধ্বংসলীলায় তাকে সাহায্য করছে প্রযুক্তি, যে প্রযুক্তি বিজ্ঞানের দান।
এ দেশে বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একান্তই বিজ্ঞানের মানুষ। সামাজিক ভাবনার জগতে তাঁদের বিচরণ কম। দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি—এসব তাত্ত্বিক বিষয়ের সঙ্গে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির যোগ এ দেশে নিতান্তই ক্ষীণ। প্রকৌশল বিদ্যালয়ে ও অন্যত্র মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ে বিদ্যার্জনের পাশাপাশি পাঠ্যক্রমে সমাজবিজ্ঞান পাঠের নির্দেশনাও থাকে বটে, কিন্তু গৌণ বিষয় বলে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সেদিকে কম থাকে। বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদের সমাজ নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই—এমন একটি প্রবণতা সাধারণভাবে চালু রয়েছে।
জীববিজ্ঞানীর সমাজভাবনা নামের একটি বই হাতে পেয়ে এই কথাগুলো মনে এল। বইটি লিখেছেন জিয়া উদ্দিন আহমেদ, একজন উদ্ভিদবিদ। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে পড়িয়েছেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি কিছু সময় অধ্যাপনা করেছেন। বস্তুত তিনি এখনো অতিথি অধ্যাপক হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। তাঁর একটি বড় অবদান বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির ২৮ খণ্ডে রচিত এনসাইক্লোপিডিয়া অব ফ্লোরা অ্যান্ড ফনা (বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণী জ্ঞানকোষ) শিরোনামের কোষগ্রন্থলহরীর তিনি প্রধান সম্পাদক। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ও যুক্তরাজ্যের ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন ফাউন্ডেশনের তিনি একজন নির্বাচিত ফেলোও বটে।
জিয়া উদ্দিন আহমেদ জীববিজ্ঞানী বলেই কি না জানি না, জনসংখ্যা ও জনঘনত্ব এবং এর সম্ভাব্য সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট প্রভাবগুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত। বইটির প্রথম লেখাটিই জনঘনত্ব বিষয়ে। জনঘনত্বের ফলে প্রকৃতি-পরিবেশ যে অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হচ্ছে, তা তিনি একজন সমাজসচেতন বিজ্ঞানীর মতোই ব্যাখ্যা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে তিনি একটি উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন বইটির শুরুতে: ‘মানুষের লোকালয় যদি কেবলই একান্ত মানবময় হয়ে ওঠে, এর ফাঁকে ফাঁকে যদি প্রকৃতি কোনোমতে প্রবেশাধিকার না পায়, তাহলে চিন্তা ও কর্ম ক্রমশ কলুষিত, ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে নিজের অতলস্পর্শ আবর্জনার মধ্যে আত্মহত্যা করে।’ এ উদ্ধৃতি ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে জিয়া উদ্দিন আহমেদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
জ্বালানি হিসেবে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার নিয়েও একটি প্রবন্ধ রয়েছে এ বইতে; এখানেও বাংলাদেশের মতো উচ্চ জনঘনত্বের দেশে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাব্য বিপদগুলোর কথা তিনি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ তুলে ধরেছেন, সেই সঙ্গে এ বিষয়ে নিজের বিকল্প ভাবনাও উপস্থাপন করেছেন। আবহাওয়ামণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কেও লিখেছেন একটি প্রবন্ধ। বইটির অন্যান্য প্রবন্ধের শিরোনামগুলোর দিকে চোখ বোলালেই এর বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়: ‘জনারণ্যে অরণ্য’, ‘পুষ্টির প্রত্যাঘাত’, ‘ফসলবৈচিত্র্য’, ‘উচ্চশিক্ষা: লোকরঞ্জনের বিষয় নয়’, ‘বিজ্ঞান পরিকল্পনা: আশা-নিরাশার চালচিত্র’।
বিশিষ্ট উদ্ভিদবিদ ও নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা বইটির ফ্ল্যাপে লিখেছেন, ‘আমাদের দেশে বিজ্ঞানীরা গবেষণাপত্র ছাড়াও পাঠ্যবই ও জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনা লিখে থাকেন, কিন্তু বিজ্ঞান ও সমাজের সম্পর্ক বিষয়ে লেখেন খুবই কম।’ জিয়া উদ্দিন আহমেদের এ বই সেই ঘাটতির খুব সামান্য অংশ হলেও পূরণ করবে। দ্বিজেন শর্মার ভাষায়: ‘বাংলাদেশে অত্যধিক জনঘনত্বের পরিণতি সম্বন্ধে লেখকের পূর্বাভাস একাধারে চিন্তাকর্ষক ও ভীতিপ্রদ, তবে আছে আশঙ্কার সঙ্গে আশার কথাও।’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০১১
Leave a Reply