গৌরবের অসামান্য দলিল
হাসিনা আহমেদ
‘১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের পত্রপত্রিকা’: প্রকাশক: ইনস্টিটিউট অব বেঙ্গল স্টাডিজ, পরিবেশক: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, মূল্য: ৪০০ টাকা
জীবনে বেঁচে থাকার মতো একই সঙ্গে গর্ব, হতাশা, কষ্ট, হাহাকার- অহংকারের বেদনার আর দেশকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার সময় মানুষের জীবনে হয়তো একবারই আসে। বাংলাদেশের মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে সেই সময় ছিল মুক্তিযুদ্ধ। সব বয়সী মানুষ যেন জীবনের সবটুকু দিয়েই তুলি টেনেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সেই শ্বাসবদ্ধ দিনগুলোয়। মাঠের লড়াইয়ের পাশাপাশি যুদ্ধ চলেছে সমান তালে পত্রপত্রিকায়, শিল্পীদের আঁকা কার্টুনে, আকাশ-বাতাস কাঁপানো স্লোগানে, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মহড়ায়। পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম গৌরব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। তাই এই যুদ্ধ শুধু যে মুক্তিকামী মানুষকেই নাড়া দিয়েছে তা নয়, বিশ্বের গণমাধ্যমেও এটি ছিল সাড়া জাগানো ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের এই নয় মাসে যুদ্ধ সংগঠিত করতে, মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত করতে, গনগনে দৃঢ় মনোবল ও প্রত্যাশা তৈরিতে এবং জনমত গঠনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ও স্বাধীনতার সপক্ষে মুক্তাঞ্চল, মুজিবনগর এবং বিদেশে বাঙালিদের উদ্যোগে প্রকাশিত নিয়মিত ও অনিয়মিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা।
একাত্তরে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ দলিল আমাদের সামনে হাজির করেছেন গবেষক হাসিনা আহমেদ। বইটির প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যেতে যেতে যেকোনো পাঠকেরই মনে হবে, তিনি সেই রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত ও একই সঙ্গে বিজয়ের, গৌরবের দিনগুলো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের চিঠি যেন একেকটি যুদ্ধের ময়দানের ঘোষণা।
প্রধান তিনটি অধ্যায়ে সজ্জিত আছে বইটি। এর বাইরে আছে উপসংহার ও তথ্যপঞ্জি। পরিশিষ্টও যথেষ্ট তথ্যবহুল। হাজির করা হয়েছে বহু দুর্লভ অনুমতিপত্র, প্রকাশিত কয়েকটি পত্রিকার আলোকচিত্র, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কাঠামোসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
গ্রন্থটিতে ৬৫টি পত্রিকার যুদ্ধকালীন সময়সীমা ২৫ মার্চ থেকে ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। সংগত কারণেই অনেক পত্রিকার প্রকাশক ও সম্পাদকের ক্ষেত্রে ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু একটি বিশ্বাস ও আদর্শকে সামনে রেখে এই স্বল্প সময়ে এত পত্রিকা প্রকাশ নিশ্চয়ই বিশ্বের দরবারে একটি ঐতিহাসিক ঘটনাই। এসব পত্রিকার দলিলের ওপর ভর করেই গবেষক লেখক হাসিনা আহমেদ আমাদের জানান, যুদ্ধময় দিনগুলোয় এ দেশে মূলত দুই ধরনের পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। একদিকে মুজিবনগর, মুক্তাঞ্চল ও অন্যান্য জায়গা থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য, মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণের মনে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও প্রত্যাশা সৃষ্টি করে যুদ্ধকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে দেওয়া। অপরদিকে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক সরকর কর্তৃক প্রকাশিত পত্রিকাগুলো জয়গান করেছে পাকিস্তানি শাসনের এবং প্রচার করেছে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, ভারত সম্পর্কে উদ্দেশ্যমূলক বিভিন্ন মিথ্যা সংবাদ। যেমন—মুক্তিযোদ্ধাদের আখ্যায়িত করা হয়েছে রাষ্ট্রবিরোধী, দুষ্কৃতকারী, অনুপ্রবেশকারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, ভারতীয় চর, ভারতীয় এজেন্ট ইত্যাদি বিশেষণে। ১৯৭১ সালের জমিনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকিতে থেকেও এই পত্রপত্রিকাগুলো প্রকাশ করেছেন অকুতোভয় সেই সাহসী সন্তানেরা। পত্রিকাগুলোর মধ্যে ছিল অমর বাংলা, অগ্রদূত, অগ্নিবাণ, আমার দেশ, আমোদ, ইশতেহার, উত্তাল পদ্মা, ওরা দুর্জয় ওরা দুর্বার, গণমুক্তি, গ্রেনেড, জয় বাংলা-১, জয় বাংলা-২, জয় বাংলা-৩, জয় বাংলা-৪, জন্মভূমি, জাগ্রত বাংলা, জাতীয় বাংলাদেশ, দাবানল, দুর্জয় বাংলা, ধূমকেতু, নতুন বাংলা, প্রতিনিধি, দেশ বাংলা, বঙ্গবাণী, বাংলার কথা, বাংলার বাণী, বাংলার ডাক-১, বাংলার ডাক-২, বাংলার মুখ, বাংলাদেশ-১, বাংলাদেশ-২, বাংলাদেশ-৩, বাংলাদেশ-৪, বাংলাদেশ-৫, বাংলাদেশ-৬, বাংলাদেশ-৭, বাঙলাদেশ, বিপ্লবী বাংলাদেশ, মায়ের ডাক, মুক্ত বাংলা-১, মুক্তি-১, মুক্তি-২, মুক্তি-৩, মুক্তিযুদ্ধ, রণাঙ্গন-১, রণাঙ্গন-২, লড়াই, স্বদেশ, স্বাধীনতা (প্রতিরোধ), স্বাধীন বাংলা-১, স্বাধীন বাংলা-২, স্বাধীন বাংলা-৩, স্বাধীন বাংলা-৪, স্বাধীন বাংলা-৫, স্বাধীন বাংলা-৬, সংগ্রামী বাংলা-১, সংগ্রামী বাংলা-২, সাপ্তাহিক বাংলা, সোনার বাংলা-১, সোনার বাংলা-২ ও সোনার বাংলা-৩।
পত্রিকার বৈশিষ্ট্য আলোচনায় এসেছে এর আকার-আকৃতি ও ধরনবিষয়ক তথ্য। পত্রিকার নামের আশপাশে, নিচে-ওপরের বিভিন্ন ঘোষণা, বাণী, কবিতা, স্ল্লোগান লেখা থাকত। পত্রিকাগুলো সাধারণত এক থেকে চার পাতার হতো।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, প্রকাশিত প্রতিবেদন, সংবাদভাষ্য ও ফিচার বিভিন্ন দেশি-বিদেশি, খ্যাত-অখ্যাত সাংবাদিক, চিত্রগ্রাহক, রাজনৈতিক ভাষ্যকার, কলামিস্ট দিয়ে লেখা। এখানে উল্লেখ করার মতো হলো এই ৪৫টি পত্রিকার মধ্যে সম্পাদনা ও যুগ্ম সম্পাদনায় চারজন নারীর নাম পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন গণমুক্তি (পারভীন খান), মায়ের ডাক (সালেহা বেগম), স্বাধীন বাংলা-৩ (মিসেস জাহানারা কামরুজ্জামান) এবং বাংলাদেশ-২ (সালেহা বেগম)। ইতিহাসের এই বাঁকেও নারীর অসাধারণ অংশগ্রহণের তথ্য নিশ্চিতভাবেই এই প্রথম জানা।
পত্রিকার পরিচিতি অধ্যায়ে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে সেই সময়কার প্রকাশিত ৬৪টি পত্রিকার। এর পরের পর্বেই আছে পত্রিকাগুলোর বিষয়ের ওপর আলোকপাত। এ বিষয়গুলোর মধ্যে যেমন আছে দেশপ্রেম, যুদ্ধজয়, বঙ্গবন্ধুর কথা, মুক্তাঞ্চল কিংবা শরণার্থীদের সংবাদ, তেমনি আছে বিভিন্ন শহীদের হূদয় ভেদ করা চিঠি। যেমন—শহীদ কাশেম লিখে গেছেন, ‘দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত মা-বাবাকে মৃত্যুসংবাদ দিও না’ (পৃ: ১১৮)। আছে দেশের স্বাধীনতার জন্য বিভিন্ন ধরনের শপথ, স্লোগান ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন গ্রামের বর্ণনা। জায়গা করে নিয়েছিল এই মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে বৈশ্বিক রাজনীতি।
বইটির পরিশিষ্ট অধ্যায় অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সেখানে আছে সব পত্রিকার নাম। পত্রিকার পাশে জ্বলজ্বল করছে সেই অমিত সাহসী সম্পাদক ও প্রকাশকদের নাম। পত্রিকার স্ক্যান করা কপি যুক্ত করা হয়েছে। তাতে আরও বেশি অকাট্য দলিল হয়ে উঠেছে বইটি।
বইটি প্রকাশ করেছে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ। পরিবেশক ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১১
Leave a Reply