দুই বছরেরও বেশি আগে ২৫ মে ২০০৯ সালে সাতসকালে ঘুম থেকে জেগে টিপটিপ বৃষ্টিকে তোয়াক্কা না করে আমরা রওনা দিয়েছিলাম নেত্রকোনার কেন্দুয়ার উদ্দেশে। আমরা মানে, প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা, তাঁর দুই ছাত্র তুষার-হিমেল ও আমি। বৃষ্টিভেজা পথ অতিক্রম করে আমরা যখন কেন্দুয়া বাজারে পৌঁছালাম, তখনো অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। আর সেই অঝোর বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমাদের স্বাগত জানাতে দীঘলকুর্শা গ্রাম থেকে ছুটে এলেন আবদুল হেলিম বয়াতি। এবার তাঁর সঙ্গে এই বৃষ্টি, এই রোদ প্রকৃতির এমনই দুরন্ত খেয়ালের মধ্যে দুস্তর পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পাঁচহার গ্রামে পৌঁছালাম। সেখানে জারির গীতি-নৃত্যের আসরের জন্য একটি শামিয়ানা টানানো হয়েছে এবং শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে গ্রামের সব বয়সী নারী-পুরুষের সমাগম ঘটেছে। তখন প্রকৃতি তাঁর অশেষ কৃপায় আমাদের আসর উপভোগের ব্যবস্থা করে দিল, অর্থাৎ বৃষ্টি-রোদের লুকোচুরি খেলা ভেঙে আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেল। সেই সঙ্গে খুব দ্রুতই জারিগানের সাজ-পোশাক হিসেবে সাদা রঙের ধুতি, সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, মাথায় লাল ফেটি, বুকে-পিঠে গুণচিহ্নের মতো লাল রঙের বেল্ট ও দুই পায়ে ঘুঙুর পরে নিলেন দোহার-খেলোয়াড়েরা। দ্রুতই নৃত্য-পরিচালক ও সহকারী গায়কেরা নির্দেশমতো আসরে প্রবেশের জন্য সার বেঁধে দাঁড়ালেন এবং সহকারী গায়ক বা ডাইনার ‘অত্ অত্’ ধ্বনির সঙ্গে সেনাসদস্যদের কুচকাওয়াজের ভঙ্গিতে আসরে প্রবেশে একটি বৃত্ত রচনা করেন। তার ঠিক পরপরই শুরু হলো দুই বয়াতির প্রতিযোগিতামূলক জারিগানের আসর।
আসরে শুরুতে আসর-বন্দনা পরিবেশন করেন আবদুল হেলিম বয়াতি। তাঁর আসর-বন্দনার মধ্যে দোহার-খেলোয়াড়েরা বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে একই সঙ্গে দিশা গীত ও নৃত্য পরিবেশন করতে থাকেন। এতে জারিগানের পুরো আসরটি হয়ে ওঠে দারুণ উপভোগ্য ও বৈচিত্র্যময়, যা দেখে-শুনে অনেকটা যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে আসরে উপস্থিত সব বয়সী দর্শক-শ্রোতা। এবারে আবদুল হেলিম বয়াতি পরিবেশিত আসর-বন্দনার কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যেতে পারে। আসর-বন্দনার শুরুতেই হেলিম বয়াতি টানা সুর-ছন্দ রচনা করে এভাবেই গেয়ে ওঠেন, ‘নবী নামে মালা পর গলেতে/ তরবে যদি ভবসিন্ধুতে।’ আর তাঁর এ ধরনের আসর-বন্দনার সুর-বাণীর ফাঁকে ফাঁকে ডাইনা তাল সংযুক্ত করেন এভাবে, ‘এ তি এ তি’। সঙ্গে সঙ্গে ডাইনার এই তাল সংযুক্তিমূলক কথার পিঠে দোহার-খেলোয়াড়েরা সমস্বরে তালে গতি আরোপ করেন, ‘হে’ বা ‘হেই’ বলে। পরক্ষণে বয়াতি পুনরায় তাঁর সুর-বাণীকে পুনরাবৃত্তি করেন, ‘নবী নামে মালা পর গলেতে/ তরবে যদি ভবসিন্ধুতে।’ এ পর্যায়ে ডাইনা বলেন, ‘এই যে আমার পয়লা ডাক’, দোহার-খেলোয়াড়েরা বলেন, ‘আল্লা-নবী স্মরণ রাখ’। ডাইনা বলেন, ‘হাসান কী হোসেন কী।’ দোহার-খেলোয়াড় বলেন, ‘আচ্ছা বেশ’ এবার বয়াতি সুরে টান দেন, ‘আল্লাহ গো…’ বলে এবং একে একে বন্দনা গাইতে থাকেন, ‘প্রথমে বন্দিনু প্রভু তুমি নিরাঞ্জন/ যাহারি কুদরিতে বৃদ্ধি হলো এই ভুবন/ মৃত্তিকা গগনে নাই যাহার সমতুল/ পূজিবার যোগ্য তিনি সকলেরই মূল/ রহমত নাজিল করল আল্লাহু পাকও পরওয়ার।’
ডাইনা, ‘হাসান কী হোসেন কী।’ দোহার-খেলোয়াড়, ‘আচ্ছা বেশ’
বয়াতি, ‘দ্বিতীয় বন্দনা করি নবী মোস্তফায়/ মা আমেনার গর্ভে জন্ম শুনেন বন্ধুভাই/ এর পরে বন্দিনু আমি ফেরেস্তা সকল/ জিব্রাইল মিকাইল বন্দি আসরে দাঁড়াইয়া।’
দোহার, ‘হায় হায় আসরে দাঁড়াইয়া।’
বয়াতি, ‘আজরাইল ইসরাফিল সব সেলামও করিয়া রে…।
আল্লা গো…/ মা ফাতেমার চরণ বন্দি শুনেন বন্ধুগণ/ এসো মা ফাতেমা মাতা গো তোমার গুণ গাই।
ডাইনা, ‘লক্ষ্মী লক্ষ্মী।’ দোহার, ‘জয় হোক।’
বয়াতি, ‘তুমি যদি ছাড়িয়া দাও মা আমি ছাড়ব না/ খেলুয়ারে কেন্দে মা গো রেখে রাঙ্গা পাও/ হেলিম বয়াতি কণ্ঠে বিষাদও গাও/ তুমি যদি ছাড় মাগো আমি ছাড়ব নাই\/ রেখে গেলাম মা ফাতেমা ওই আল্লাহরই দুহাইও রে…
আল্লা গো …/ এর পরে বন্দিনু আমার উস্তাদের চরণ/ বলি আমি দীনহীনে শুনেন বন্ধুগণ/ উস্তাদ আমার মধু সরকার জাউলা ছিল ভারি/ দাদা উস্তাদ শ্যাম রায় ব্রাহ্মণ মুনি/ উস্তাদ আমার সোবহান মিয়া তারাকান্দিয়া গেরাম/ দাদা উস্তাদ জহুর উদ্দীন সবাইরে জানাইলাম/ পীর হুজুর গাউসে আউলায় করিয়া স্মরণ/ মা জননীর চরণ বন্দি আসরে জগতে…
দোহার, ‘তরবে যদি ভব সিন্ধুতে।’
বয়াতি, ‘আল্লা গো…
বিষাদ অর্থ দুঃখ আর সিন্ধু সাগর
বিষাদ-সিন্ধু হইল কিন্তু কান্নারই লহর
একষট্টিডা প্রবাহ দিয়া বিষাদও গড়া
ছাব্বিশটা মহরম প্রবাহ সভাতে ধরা
ত্রিশটা উদ্ধার প্রবাহ সভাতে জানাই
পাঁচটি মাত্র এজিদবধ গুনে দেখেন ভাই
এগারো হাজার আসেটাশ আশি বাক্য দিয়া
মীর মশাররফ হোসেন গেছেন বিষাদও লিখিয়া রে\’
বয়াতির মুখে মীর মশাররফ হোসেন রচিত অমর উপন্যাস বিষাদ-সিন্ধুর এমন ব্যাখ্যা এবং সংক্ষিপ্ত পরিচিতি শুনে চমকিত হয়ে উঠি। আগে দুই-একবার শুনেছিলাম যে মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু জারিগানের আসরে উপস্থাপিত হয়ে থাকে। কিন্তু তা কোনো দিন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা হয়ে ওঠেনি। এবার নেত্রকোনার জারিগানের আসরে এসে তা যে এমনভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারব, এ ধরনের ভাবনা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। কারণ, আমরা মূলত নেত্রকোনা অঞ্চলের জারিগানে অন্তর্ভুক্ত নৃত্যরীতি প্রত্যক্ষ করতে এবার এসেছি। আর সে আসরে এসে বয়াতির মুখের কথায় জানতে পারলাম, ‘আল্লা গো…/ বাজে কথা বারণ রেখে জারিগান গাই/ বলি আমি শুনেন হেথা সকলকেই জানাই/ হোসেনের যুদ্ধটাই আজকে গাইব কিছুক্ষণ/ আর একজন প্রতিযোগী সরকার আসতেছে যখন/ প্রশ্ন-উত্তর গাইব জারি আসরে দাঁড়াইয়া/ বৃদ্ধ বয়সে ঘোর বিপদে গেলামও পড়িয়া রে…।’ এভাবেই জারিগানের মধ্যে প্রতিযোগিতার বিষয়টি উল্লেখ করে হেলিম বয়াতি তাঁর প্রতিপক্ষের বয়াতিকে বিষাদ-সিন্ধু থেকে প্রশ্ন রেখে যান। পরের বয়াতি এসে তার উত্তর দিয়ে নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেন। আর এভাবেই মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু আশ্রিত ‘বিষাদ-জারি’র আসর এগিয়ে যেতে থাকে। এখানে সে আসরের বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়ার সুযোগ নেই। তবে, আসর শেষে আবদুল হেলিম বয়াতির কাছ থেকে জানতে পারি—নেত্রকোনা অঞ্চলে আগে ‘জঙ্গনামা’ ও ‘শহীদে কারবালা’র পুঁথিকে আশ্রয় করেই জারিগান প্রচলিত ছিল। তিনি বলেন, ‘আগে এ অঞ্চলের জহুরুদ্দিন সরকার, ইসরাইল বয়াতি, খাগুরিয়ার নবী, বনেরগাতির ইমান আলী, খাবাসাতের কিতাব আলী, এঁরা সবাই জঙ্গনামা অবলম্বনে জারিগান পরিবেশন করতেন। পরে শিক্ষার প্রসারে আমরা নাইনটিন সিক্সটি ফোর বা ফাইভে সকলে একসঙ্গে চিন্তাভাবনা কইরা মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু বইটার থাইকা জারিগান শুরু করলাম। আমরা বিষাদ-সিন্ধুকে অনুবাদ কইরা নিয়া জারিগান গাইছি। এটাকে আমরা ছন্দোবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ করছি, মানে গদ্যটাকে পদ্য করছি নিজের মুখে মুখে। এখন আমরা এই পদ্যরূপেই গাই। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধুর গদ্যকে ছন্দোবদ্ধ করার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের কাছে শ্রুতিমধুর করতে গেলে তো গান করতে হবে। গান যেহেতু করতে হবে আমাদের এখান থেকে কিছু কারচুপি করতে হবে। কিছু দিতে হবে, নিতে হবে। লেখক মীর মশাররফ হোসেন কোনো সুর রাগিণী দেয়নি। সুরটা আমাদের দেয়া। আমরা পাঁচ প্রকার, সাত প্রকার, আট প্রকার, দশ প্রকার, বিশ প্রকার, পনের প্রকার সুর দিই।’
প্রশ্ন: জারিগানের দিশাগুলো কাদের তৈরি?
উত্তর: জারিগানের দিশাগুলো আমাদের তৈরি। একসময় যখন জারিগান ‘জঙ্গনামা’, ‘শহীদে কারবালা’ থেকে গাইত তখনো ছিল দিশাগুলো, এখন আমরা আরও কিছু দিশা বাড়াইছি, যেমন আমরা একটা দোহার গাই, যখন এমাম হোসেনের দুগ্ধপোষ্য সন্তান কারবালা থেকে নিয়ে আসে তখন আমরা দিশা গাই—
দেখে যা রে চন্দ্র সূর্য নক্ষত্রে মিলিয়া
কান্দে গো মায়ে মরা পুত্র লইয়া\
এটা আমাদের তৈরি দিশা। এই দিশার গেয়ে দিশাটি দোহারদের মুখে তুলে দিয়ে বয়াতি জারির মূল গীত করে থাকেন।
যেমন মনে করেন হোসেন পরিবার রে যখন বান্ধিয়ে নেয় বা হোসেনের দুই সন্তানরে বান্ধিয়ে নেয় তখন একটা দোহার দিলাম—
বান্ধের চোটে ছাত্তি ফাটে/ পানি দেও রে খাই
হাতের বন্ধন খুলে দাও/ জননীর কুলে যাই।
রে কাফেরের দল/ তোদের বুঝি দয়া মায়া নাই\
মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ অনুসরণে জারিগানের উদ্ধারপর্ব প্রথম প্রবাহ থেকে বলছি এসব কথা। এমাম হোসেনের সন্তান পরিবার জয়নাল আবেদীনসহ বাইন্ধে যখন এজিদ জেলখানায় নেয় এই জায়গায় প্রযোজ্য। এমন একটা জায়গা লাগে ব্যথিত। এটা জয়নাল আবেদীনের সংলাপ। উনার কান্নাকাটি বর্ণনা করা হয়। এভাবেই আমরা চরিত্রের সংলাপগুলোর সাথে সুরগুলো মিলায়ে দিই।
প্রশ্ন: মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’কে ছন্দোবদ্ধ করার ক্ষেত্রে আপনারা কোনো সূত্র মেনে চলেন?
উত্তর: সূত্র একটা মেনে চলতে হয়। আমাদের ভাষায় কবিত্ব বলে একটা কথা আছে। যেমন, আমরা বলি—
হয় ময় রয় যয় নয় চয় রয় সয় পয়
যাহার মিল রয় তাহাকেই কবিত্ব কয়।
এককথায়, মিত্রাক্ষরে যাদের কথার শেষ কথাটায় মিল রবে তাকেই কবি বলে।
এরপর আসর থেকে এ পদ্ধতিতে রূপান্তরিত বিষাদ-সিন্ধুর ৬১টি প্রবাহ, তথা মহরম পর্বের ২৬টি প্রবাহ, উদ্ধার পর্বের ৩০টি প্রবাহ এবং এজিদবধ পর্বের পাঁচটি প্রবাহ মিলে মোট ৬১টি প্রবাহে বিভক্ত ‘বিষাদ-জারি’ সংগ্রহ করি।
আমাদের দেশে একটি ধারণা প্রচলিত আছে যে গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে লিখিত সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু মীর মশাররফ হোসেন রচিত লিখিত সাহিত্য বিষাদ-সিন্ধুর পরিবেশনা নেত্রকোনা অঞ্চলের জারিগানের আসরে প্রত্যক্ষ করে আমাদের সেই ধারণা মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে যায় এবং গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত জারিগানের বয়াতি-দোহার-নৃত্যশিল্পীদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সৃজনশীলতা, সর্বোপরি বাংলাদেশের ফোকলোর নিয়ে আমাদের নতুন একটি পর্যবেক্ষণ তৈরি হয়, যা নিয়ে সুবিস্তৃত গবেষণার পথ খুলে যায়। সে পথের সূত্র ধরে এরই মধ্যে কবি-গবেষক নাজমীন মর্তুজার সঙ্গে যৌথভাবে রচনা করেছি ফোকলোর ও লিখিত সাহিত্য: জারিগানের আসরে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ আত্তীকরণ ও পরিবেশন-পদ্ধতি শীর্ষক একটি গ্রন্থ, যা অচিরেই বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হবে।
ছবিঃ জারিগান পরিবেশন করছেন আবদুল হেলিম বয়াতি ও তাঁর দল
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১১
Leave a Reply