ইব্রাহিম আল-কোনি তর্কসাপেক্ষে বিশ্বের সর্বাধিক পরিচিত লিবীয় লেখক। সাধারণত প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলেও সুসানা শ্যান্ডার সঙ্গে আলাপচারিতায় লিবীয় গণবিক্ষোভ সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন তিনি।
জনাব আল-কোনি, লিবিয়ার সংবাদ শোনার পর আপনার মনে কী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল?
আল-কোনি: বেসামরিক জনগণের ওপর শাসকগোষ্ঠীর বর্বরোচিত সহিংসতায় আমি অত্যন্ত মর্মাহত। গাদ্দাফির বাহিনী তাদের জনগণের বিরুদ্ধেই অস্ত্র তুলে নিচ্ছে, ঠিক যুদ্ধের মতো। এটা পাগলামি। অন্যদিকে আমি আবার খুশি এ জন্য যে এই যুদ্ধ মুক্তির পথে চালিত করছে। ইচ্ছাশক্তিরই জয় হবে ভীতির বিরুদ্ধে।
নিজ দেশে সবে দুই মাস কাটিয়ে এসেছেন আপনি। ওখানে কী দেখলেন?
আল-কোনি: অসুস্থ ভাইকে দেখতে ডিসেম্বরে বিমানে করে লিবিয়া গিয়েছিলাম। ক্যান্সার হয়েছে ওর। আমার সমসাময়িক অনেকেরই ক্যান্সার রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, নিপীড়ক গাদ্দাফির শাসনের অধীনে চিরন্তন চাপেরই পরিণতি এটা। ওখান থেকে মিসর ও তিউনিসিয়ার গণ-আন্দোলনের অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করেছি আমি। লিবিয়াও নিজস্ব বিপ্লবের জন্য তৈরি বলেই মনে হয়েছে, ওখানেও স্ফুলিঙ্গ গিয়ে পড়তে পারে। হাজার হোক, লিবিয়ার পরিস্থিতি দীর্ঘকাল ধরেই বিপর্যয়কর হয়ে আছে।
স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসার মতো সাহস কোথায় পাচ্ছে তরুণসমাজ?
আল-কোনি: মূলত লিবীয় জনগণ অত্যন্ত শক্তিশালী, সহিষ্ণু ও ধৈর্যশীল। কিন্তু ৪২ বছরের স্বৈরাচারের চাপ যারপরনাই বেশি হয়ে গেছে, কোনো একপর্যায়ে বিস্ফোরণ ছিল অনিবার্য। তবে এই মুক্তি এসেছে অনেক মূল্যের বিনিময়ে। তিউনিসীয় ও মিসরীয়দের তুলনায় লিবীয়রা ঢের বেশি মূল্য দিচ্ছে। লিবিয়ার জনসংখ্যা মাত্র পাঁচ মিলিয়ন, মাত্র অল্পদিনের ব্যবধানেই হাজার হাজার লোককে হত্যা করা হয়েছে।
আপনি সব সময়ই লিবিয়া সফর করেন। ওখানে কি বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ আর সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে উন্মুক্ত বিতর্কের অবকাশ ছিল?
আল-কোনি: হ্যাঁ, সব সময়ই তা ছিল, তবে গোপন। সমন্বিত আন্দোলনের বদলে বরং বিক্ষিপ্ত বুদ্ধিবৃত্তিক বলয় ছিল। বহুকাল ধরেই মনোভাব গাদ্দাফির বিরুদ্ধে ছিল। কারণ ১৯৬৯ সালে তিনি ক্ষমতা গ্রহণের সময় যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেখান থেকে ভিন্ন কিছু প্রত্যাশা করেছিলাম আমরা। ১৯৭০ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যাই আমি, কারণ স্বদেশে নিজেকে আর নিরাপদ ভাবতে পারছিলাম না।
পরবর্তী সময় কি আপনি নিরাপদে লিবিয়া সফর করতে পেরেছেন?
আল-কোনি: বেশ। ইতিমধ্যেই আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লেখকে পরিণত হয়েছিলাম এবং সেটাই এই শাসকগোষ্ঠীর খেয়ালখুশি থেকে কিছুটা রক্ষা দিয়েছে। কিন্তু যখনই লিবিয়ায় গেছি, গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিতে ছিলাম আমি।
আপনি কি সুইজারল্যান্ড থেকে মাতৃভূমির সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে পেরেছেন?
আল-কোনি: বিপদ সত্ত্বেও আমি সব সময়ই লিবিয়ায় যাওয়ার চেষ্টা করেছি। হাজার হোক, ওরা আমারই জাতি। গ্রেপ্তার ও কারাগারে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছি বটে, কিন্তু সুইজারল্যান্ডে বাস করলেও এটাই আমার স্বদেশভূমি। এর সঙ্গে আমি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আমি ওখানে ক্রমাগতভাবে পরিবর্তন আনার জন্য চেষ্টা করে গেছি। এমনকি লিবিয়ায় প্রগতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গেও যুদ্ধ করেছি আমি, বিতর্কে নেমেছি।
গাদ্দাফি-পুত্র সাইফ আল-ইসলামের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতিশ্রুত সংস্কারের কোনো তাৎপর্য বা বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে কি?
আল-কোনি: সাইফ আল-ইসলামের লক্ষ্য সমাজকে আধুনিকীকরণ। তিনি জানেন, জনগণের এটা প্রয়োজন, জনগণও তাঁকে বিশ্বাস করে। জনগণ দীর্ঘকাল ধরেই স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় ক্লান্ত বোধ করে আসছে। তারা এখন পুরোপুরি মরিয়া। মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরোধিতার কারণেই সংস্কার-প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। এটা ছিল বাবা ও ছেলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। গাদ্দাফি নতুন করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূমিকালাভের সুযোগ ও পাশ্চাত্যের সমর্থনলাভের পর মনে করেছিলেন যে সংস্কার শুরুর আর প্রয়োজন নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই স্বৈরাচারকে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় রাখার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করেছে।
জনগণ সংস্কার কর্মসূূচির ব্যর্থতায় কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে?
আল-কোনি: সংস্কার, ইতিবাচক পরিবর্তন ও প্রচারমাধ্যমের বৃহত্তর স্বাধীনতার ঘোষণা ফাঁপা প্রতিশ্রুতিতে পর্যবসিত হওয়ার পর লিবীয়রা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। হতাশা যখন প্রবলভাবে অনুভূত হয় আর নিরাশায় পর্যবসিত হয় জীবন, জনগণ তখন সব ধরনের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত হয়ে যায়, ঠিক লিবিয়ার রাজপথে যে কাজটি তারা করছে। আপনি সেই পর্যায়ে পৌঁছে গেলে নিজের জীবনের ঝুঁকি নেবেনই।
গাদ্দাফিবিহীন জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা—কেমন মনে হয়?
আল-কোনি: লিবিয়া যখন রাজতন্ত্র ছিল—পরে গাদ্দাফির শাসন এসেছে—তখনো লিবিয়াকে প্রত্যক্ষ করেছি—সম্ভাব্য নানা দৃশ্যপট রয়েছে। লিবিয়া মুক্ত, গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হতে পারে। তবে আমি যেটা জানি না সেটা হলো দেখার জন্য বেঁচে থাকব কি না, তবে অতিসাম্প্রতিককালেও লিবিয়া যেমন ছিল তা এখন অতীতের বিষয়। জাতি স্পষ্টতই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, এখন আর পিছু ফেরার পথ নেই। লিবিয়ায় ফের চরম ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার স্বপ্ন দেখার উপায় নেই কারও। তিউনিসিয়া আর মিসরের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে।
আপনার দ্য পাপেট উপন্যাস স্বৈরাচারকে ধ্বংসাত্মক ক্যান্সার হিসেবে তুলে ধরেছে। একে সত্যিই লিবীয় স্বৈরাচারকে উপমা হিসেবে তুলে ধরার ইচ্ছা ছিল?
আল-কোনি: উপন্যাসটি ক্ষমতাবান এক ব্যক্তির বিভ্রম ও রোগের মিথোজীবিতা তুলে ধরেছে। একদিন তার আলখেল্লা ত্বকের সঙ্গে মিলে গেলে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার পক্ষে আর জোব্বা খুলে ফেলা সম্ভব ছিল না, তাহলে সে মারা যাবে। কেবল লিবিয়া বা আরবীয় দেশগুলোরই নয়, উপন্যাসটি বরং সব ধরনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দলিল। আমি রাজনীতিক নই, আমি দার্শনিক সাহিত্যের একজন লেখক। ক্ষমতার জন্য লালায়িত মানুষই সব সময় আমার কাজের উপজীব্য, সেটা রাজনৈতিক, নৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতা, যা-ই হোক না কেন। আমি এ বিষয়ে বুঁদ হয়ে থাকি।
আরব বিশ্বের চলমান উত্তাল অবস্থা কি আপনাকে নতুন কোনো উপন্যাস রচনায় অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে?
আল-কোনি: তিউনিসিয়ায় বিপ্লবকে উস্কে দেওয়া সিদি বাউজিদে ১৭ ডিসেম্বর, ২০১০-এ তিউনিসীয় ফেরিওয়ালা মোহাম্মদ বাউয়াজিজি আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছেন। তাঁর কাজ স্ফুলিঙ্গকে জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তা গোটা আরব বিশ্বকে বদলে দিয়েছে। আমাকে আরব বিশ্বের এসব বিপ্লব, আন্দোলন নিয়ে লিখতে হলে তাঁদের শেকড়, সূচনা নিয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। সাহিত্য সব সময়ই শেকড়সন্ধানী।
মোহাম্মদ বাউয়াজিজি কি একজন আরব বীর?
আল-কোনি: আমি এই ভদ্রলোককে সাধু হিসেবে তুলে ধরতে চাইব। গোটা আরব বিশ্বেরই উচিত তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা। তিনি আমাদের কালের যিশু, তিনি আপন ক্রুশে পরিণত হয়ে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আশার এক প্রতীক। সমগ্র আরব বিশ্বকে বর্তমানে চুরমার করে দেওয়া ভূমিকম্প সূচিত হয়েছে তাঁর হাত দিয়েই। তাঁকে নিয়ে লিখতে হলে তিনি যত কিছুর সূচনা ঘটিয়েছেন সেসব নিয়েও লিখতে হবে বৈকি। সেটাই সাহিত্য, বিশ্বকে তা পরোক্ষ, উপমাগতভাবে তুলে ধরে। এসব ঘটনা নিয়ে লেখার ধারণাটা আমাকে কোনো রোগের মতোই আক্রান্ত করেছে। কোনো লেখকের পক্ষে এটা দারুণ রকম ফলপ্রসূ, গভীর, বিশাল অনুপ্রেরণা।
১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন ইব্রাহিম আল-কোনি, লিবীয় মরুভূমিতে তুরেগ গোত্রের সদস্য হিসেবে বেড়ে উঠেছেন। ১৯৭০ সালে তিনি মস্কো চলে যান। এখানে গোর্কি লিটারেচার ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেছেন। ১৯৯৩ সালে সুইজারল্যান্ডে অভিবাসনের আগে মস্কো ও ওয়ারসে সাংবাদিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে এখানেই বাস করছেন। তিনি অন্যতম মহান আরব সাহিত্যিক। তাঁর উপন্যাসগুলো বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
অনুবাদ: শওকত হোসেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১১
Leave a Reply