সিরিয়ার খ্যাতনামা কবি আদোনিসের বিরুদ্ধে সিরীয়বিরোধীদের পক্ষ থেকে এই মর্মে অভিযোগ উঠেছে যে তিনি নিজেকে আসাদ সরকারের কাছ থেকে স্পষ্টত দূরে রাখতে সক্ষম হচ্ছেন না। তবে এই অভিযোগ খণ্ডন করে এক সাক্ষাৎকারে কবি আদোনিস বলেছেন, আমি এক শ ভাগ সিরীয় বিপ্লবের পক্ষে। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত বিবরণ নিচে দেওয়া হলো:
প্রশ্ন: জনাব আদোনিস, সিরিয়ার ঘটনাবলির বিষয়ে আপনার দেওয়া বিবৃতি প্রচুর সমালোচনার ঝড় তুলেছে। আপনার মাপের একজন কবির প্রতিক্রিয়াটা হওয়া উচিত ছিল সমাজের অন্যান্য মানুষের মতোই। যদিও তাদের বুদ্ধিমত্তাকে অস্বীকার করার মানেই তাদের আশাহত করা। যে কেউ বলতে পারে, আপনার ও সিরীয় প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ঠিক তেমনটাই ঘটেছে?
আদোনিস: সিরিয়ার বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদী অবস্থান এই প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে ঘটেনি—এটা আমার ভেতরে সক্রিয় হয়েছে বহু আগে। বর্তমান সরকারের একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে ৫০ বছর ধরে ক্রমাগত সংগ্রামে লিপ্ত আছি। তার মানে, আপনা-আপনিই আমি এর বিরুদ্ধে—কোনো সন্দেহ নেই তাতে।
তবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের পদ্ধতির ক্ষেত্রে মতপার্থক্য আছে। সব রকমের সংঘাতের নিন্দা করি আমি। যদিও যারা এটা প্রয়োগ করে, তারা একে যুক্তিসংগত বলে বিবেচনা করে। আমি কিন্তু সরকার ও বিরোধী কারও বেলাতেই এটা মেনে নিতে পারি না। আমি শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের পক্ষে, মহাত্মা গান্ধী যে রকমটা করেছিলেন।
হতে পারে আমাদের মধ্যে আর বর্তমান বিরোধীদের মধ্যে মতপার্থক্য বিরাজমান, যারা সবকিছু ত্বরিত ও সরাসরি করতে চায়, যেন ওটা রাষ্ট্রের সহিংসতার অন্য আদল। আমি বিশ্বাস করি, বিরোধীদের একটা নতুন ধরনের নীতি ও মূল্যবোধে উজ্জীবিত হতে হবে, যাতে নতুন একটা সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব হয়। এতৎসত্ত্বেও আমি বিপ্লবী আন্দোলনের পক্ষে, এর ফলাফল যা-ই হোক না কেন। এই আন্দোলন জনগণের প্রাণশক্তির প্রতীক আর এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, তারা স্বাধীনতাকামী এবং একটা ব্যতিক্রমী ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চায়।
প্রশ্ন: কিন্তু জনগণ যারা স্বাধীনতার ডাক দিচ্ছে, সিরীয়বিরোধীদের সঙ্গে তাদের দাবির সমন্বয় ঘটায়নি। বিরোধীদের পরিকল্পনা অথবা তাদের ভেতরে স্পষ্টতার অভাবের বিরোধী হতে পারেন আপনি, কিন্তু সাধারণ নাগরিক যারা রাইফেলের বুলেটে বিদ্ধ হচ্ছে, বিরোধীদের মতের জন্য দায়ী নয়।
আদোনিস: আমি বর্তমান আন্দোলনের এক শ ভাগ পক্ষে। আমি তাদের বিরুদ্ধে কিছুই বলিনি বা তাদের কোনো সমালোচনা করিনি। বরং তিউনিশিয়া আর মিসরের ঘটনার সূচনালগ্ন থেকেই তাদের সমর্থন করেছি। আমি সব সময়ই জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম, একেবারে প্রথম থেকে।
প্রশ্ন: বাশার আল আসাদের কাছে লেখা আপনার খোলা চিঠিতে তাঁকে আপনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও কখনোই তিনি নির্বাচিত ছিলেন না। এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁর বাবা ক্ষমতায় আসেন আর বাসার হন তাঁর উত্তরাধিকারী, জনগণের মতামত তিনি গ্রহণ করেন। এ কথা সবারই জানা যে সিরিয়ায় ভোট বা সংসদীয় নির্বাচনের কোনো মানেই আসলে নেই—সেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতাও নেই। এ কারণেই বিরোধীরা আপনার ‘নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট’ কথাটার সমালোচনা করেছে। এই শব্দগুচ্ছ ব্যবহারের মাধ্যমে আপনি কী হাসিলের প্রত্যাশা করেন?
আদোনিস: গোটা আরব বিশ্বে এমন কোনো একটা পার্লামেন্টের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে, যা কিনা অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত হয়েছিল? সিরিয়ায় অন্তত একটা নির্বাচন হয়েছিল আর একটা পার্লামেন্ট গঠন করা হয়েছিল। পার্লামেন্ট নির্বাচিত ছিল, আর সেই পার্লামেন্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করেছিলেন। হ্যাঁ, হতে পারে সেই নির্বাচনে কারচুপি হয়েছিল। অন্তত আমরা এটা বলতে পারি: এই লোকটি নির্বাচিত—তবে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছিল; কিন্তু শব্দ নিয়ে আমরা কেন সময় অপচয় করব?
বাবার মতো বাসার আল আসাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেননি। সত্যিকার অর্থে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত একটা পার্লামেন্ট দ্বারা, পুনরায় আনুষ্ঠানিকভাবে জনগণ কর্তৃক। সেই অর্থেই আমি তাঁকে ‘নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট’ বলে অভিহিত করেছিলাম। কারণ তিনি সামরিক ব্যক্তিত্ব নন। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাসার আল আসাদ ক্ষমতায় আসেননি।
প্রশ্ন: দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কবি হিসেবে স্বদেশবাসীর সঙ্গে থাকার সর্বোত্তম পন্থা কোনটি আপনার দৃষ্টিতে?
আদোনিস: দুটি পথের মধ্যে একটি বেছে নেওয়া: হয় তাকে বাস্তব উপলব্ধিতে অংশগ্রহণ করতে হবে আর রাস্তায় নেমে তাদের সঙ্গে থাকতে হবে অথবা ভাবনা, দৃষ্টিভঙ্গি আর লিখিত বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে জনগণের পক্ষ নিতে হবে। কবিদের বেলায় সাধারণত তাঁরা বাস্তব দিকটাতে থাকেন না। তাঁদের বরং তাত্ত্বিক দিকটাই বেছে নেওয়া উচিত।
অনুবাদ: দিলওয়ার হাসান
সূত্র: কান্তারা অনলাইন ম্যাগাজিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১১
Leave a Reply