আল আহরাম পত্রিকা থেকে মুয়াম্মার গাদ্দাফির চার দশকের স্বৈরশাসনের অবসান যখন ঘনিয়ে আসছে, লিবিয়ার কবি-লেখক তখন ইন্টারনেটে নিজেদের মধ্যে স্বস্তি আর আনন্দ বিনিময় করছেন; সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁরা আভাস পাচ্ছেন নতুন স্রোতধারার।
ঔপন্যাসিক হিশাম মারাত টুইটারে লিখেছেন, ‘আমরা গাদ্দাফির হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি। আমি কখনো ভাবতেও পারিনি যে কখনো এই বাক্যটি লিখতে পারব।’ ইমতিদাদ নামের ব্লগে ছোটগল্পকার ও কবি গাজী গেবলাবি লিখেছেন, লিবিয়ার মানুষ কীভাবে ভীতি থেকে মুক্তি পাচ্ছে। তিনি লিখেছেন, ‘সেই ভীতি ঢুকে পড়েছিল ভাষার গভীরে। আমার মতো যেসব লিবীয় তাঁর শাসনের বিরোধিতা করেছিল (গোপনে বা প্রকাশ্যে), তাদের হয়ে উঠতে হয়েছিল দুই মানুষ।’ গেবলাবি লিখেছেন, ‘তাঁদের শিখে নিতে হয়েছিল, কীভাবে প্রকাশ্যে সাংকেতিক ভাষায় লিখতে ও কথা বলতে হয়। স্বৈরশাসকের রোষানল থেকে শুধু নিজে বাঁচার জন্য নয়, পরিবারের সদস্য ও বন্ধুবান্ধবকেও বাঁচানোর জন্য সাংকেতিক ভাষায় কথা বলা ও লিখতে পারা ছিল এক বিরাট দক্ষতার ব্যাপার।’
বছরের পর বছর ধরে লিবীয় কথাসাহিত্যের এক বিরাট ভান্ডার নিজের মধ্যে ব্যবহার করেছে এই সাংকেতিক ভাষা।
১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মিসরের কবি-লেখকেরা যখন সামাজিক বাস্তববাদকে আলিঙ্গন করেন, তখন লিবিয়ার অনেক লেখক ওই ধারাটি সলজ্জভাবে এড়িয়ে গেছেন। অবশ্য কিছু কিছু লেখক বাস্তবধর্মী শৈলীতে লিখতেন, যেমন লিখেছেন আবদুল্লাহ আল-গাজাল তাঁর টয়োটা যুদ্ধ উপন্যাসে। কিন্তু অন্য অনেকে নির্ভর করেছেন প্রতীকধর্মী কৌশলের ওপর; পশুপাখিদের রূপকথা থেকে তাঁরা নিয়েছেন রূপক। মিসরে ১৯৯০-এর দশকে সাহিত্যিকদের একটি অংশ সামাজিক বাস্তববাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কিন্তু লিবিয়ায় ‘১৯৯০-এর দশকে সাহিত্যের সৃষ্টি হয়েছে শাস্তির ভীতি থেকে। শাসকের সঙ্গে ঝামেলা এড়াতে সাহিত্যিকদের এটা করতে হয়েছে’—লিখেছেন মোহামেদ মেসরাতি। তিনি বলেন, ২০০৩ সাল নাগাদ কেবল লিবিয়ায় নবীন লেখকদের পুনরাবির্ভাব ঘটে। তিনি আরও বলেন, যেসব লিবীয় লেখক প্রবাসে অবস্থান করেছেন, সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে তাঁরা অনেক বেশি স্বাধীনতা পেয়েছেন।
কিন্তু লিবিয়ার ভেতর যেসব ঔপন্যাসিক ইংরেজিতে লেখালেখি করেছেন, এমনকি তাঁরাও গাদ্দাফি-ভীতি দ্বারা আক্রান্ত ছিলেন। হিশাম মাতারের দ্বিতীয় উপন্যাস অ্যানাটমি অব অ্যা ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স এ বছরের গোড়ার দিকে প্রকাশিত হয়। লিবীয় সরকারের হাতে এক ব্যক্তির অপহরণের পটভূমিতে রচিত একটি ক্ষিপ্রতাময় বাস্তবধর্মী সাহিত্যকর্ম এটি। যেভাবে এই অ্যানাটমি অব অ্যা ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স রচনা করা হয়েছে, তাতেও সবিশেষ সতর্কতা টের পাওয়া যায়। মনে হয় যেন ঘটনার বর্ণনাকারী বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভয় পাচ্ছেন।
দার্শনিক রূপকতা ও প্রাণীদের কাহিনি
লিবিয়ার পুরোনো প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে ইবরাহিম আল-কোনি সবচেয়ে সমাদৃত। গত বছরের ডিসেম্বরে মোবারক-যুগের শেষ লেখক হিসেবে তিনি জয় করেছেন ‘আরবি উপন্যাস পুরস্কার’। কোনির সাহিত্যকর্ম সমকালীন নাগরিক ভুবনকে সযত্নে এড়িয়ে যায়। তাঁর উপন্যাসগুলো হাম্মাদ আল-হামরা মরুভূমির পটভূমিতে লেখা, প্রধানত রূপকধর্মী দার্শনিক ধরনের কাজ। তাঁর সেরা উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে পাথরের রক্তক্ষরণ (ইংরেজি অনুবাদ: ব্লিডিং অব স্টোন—ক্রিস টিংলে ও মায়া জায়ুসি), প্রাণিবাদী ও স্বর্ণচূর্ণ (ইংরেজি অনুবাদ: দি অ্যানিমিস্ট ও গোল্ড ডাস্ট—এলিয়ট কোলা)। এসব উপন্যাসে সমকালীন লিবীয় জনজীবন সম্পর্কে প্রায় কিছুই নেই। কিন্তু এগুলোতে অন্ততপক্ষে পাওয়া যায় মানুষ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, প্রাণী ও মানুষের মধ্যকার বিরোধ এবং মানুষের হাতে প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের প্রাঞ্জল ছবি। কোনির সাহিত্যকর্মের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বন্য ভেড়া, উট ও দুম্বার জন্য তাঁর গভীর সহমর্মিতা; তাঁর উপন্যাসজুড়ে থাকে এসব প্রাণীর বিচরণ। এবং প্রাণিজগতের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট লিবীয় লেখক যে তিনি একাই, তা-ও নয়; এমন আরও অনেকেই আছেন।
প্রকাশনা সংস্থা কোয়াট্রেট এ বছর প্রকাশ করেছে আহমেদ ফাগিহ্র উপন্যাস মরুভূমির ইঁদুর (ইংরেজি অনুবাদ: ডেসার্ট র্যাটস—সোরাইয়া আলম ও ক্রিস টিংলে)। সাপ, পিঁপড়া, গিরগিটি ও মানুষ—সবার প্রতি সমান সহানুভূতি ও সহমর্মিতার প্রকাশ ঘটেছে এই উপন্যাসে। আরব লেখক ইউনিয়নের ‘শীর্ষ ১০৫’ বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে ফাগিহ্র ট্রিলজি গার্ডেনস অব নাইট। এ লেখক তাঁর গল্প ও উপন্যাসে প্রাণীর চরিত্র ব্যবহার করেন প্রচুর। ২০০৯ সালে মিসরের দার আল-শরুক প্রকাশ করেছে ফাগিহ্র ছোটগল্পের একটি বিশেষ সংকলন: ইন ক্রিটিসিজম অব হিউম্যান বিয়িংস অ্যান্ড ইন প্রেইজ অব অ্যানিমেলস অ্যান্ড ইনসেক্টস। অন্যান্য লিবীয় লেখকের মধ্যে ওমর আল-কিদ্দি তাঁর কুকুর রমাদানের চমৎকার ছোট্ট জীবন বইয়ে এবং মোহামেদ আল-আসরাফ তাঁর দ্য হুপোয় পৃথিবীর প্রাণিজগৎ ঘিরে গড়ে তুলেছেন চমৎকার কাল্পনিক ভুবন।
গাদ্দাফির সুদীর্ঘ সাহিত্যিক হাত
গাদ্দাফির দমনমূলক বজ্রমুষ্টির সঙ্গে খাপ খাইয়ে শুধু যে লিবীয়দেরই চলতে হয়েছে, তা নয়। মিসরীয় লেখক ইদ্রিস আলি, যিনি অধিকাংশ গল্প-উপন্যাস লিখেছেন মিসরের লুবিয়ান অঞ্চলের মানুষের দারিদ্র্য ও বিচ্ছিন্নতাকে উপজীব্য করে, তাঁর শেষ বইটি ২০১০ সালে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। নেতা চুল কাটাচ্ছেন শিরোনামের এ উপন্যাসিকাটি মিসরের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবাহিনী জব্দ করে এই মনে করে যে এতে লিবিয়ার স্বৈরশাসককে নিয়ে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। ১৩০ পৃষ্ঠার বইটি আলি নামের এক মিসরীয় নাগরিকের লিবিয়ায় বিদেশি শ্রমিক হিসেবে চার বছরের কাজের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা। এতে বর্ণনা করা হয়েছে, কী কষ্টকর পরিবেশে মিসরীয়রা লিবিয়ায় হাড়ভাঙা খাটুনি খাটছেন। অ্যারাবিক নেটওয়ার্ক ফর হিউম্যান রাইটস ইনফরমেশন নামের একটি মানবাধিকার সংস্থা বইটি সম্পর্কে লিখেছে, এ বইয়ে ‘লিবিয়ার সামাজিক জীবন সম্পর্কে এবং কর্নেল গাদ্দাফির শাসনে সেই জীবন কতটা নিপীড়নের শিকার, সে সম্পর্কে লিবীয় মানুষদের সাক্ষ্য রয়েছে।’
২০১০ সালের আলি মারা গেছেন। তিনি দেখে যেতে পারেননি মিসর ও লিবিয়ায় পরিবর্তনের কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে!
গাদ্দাফি-পরবর্তী সাহিত্যের নতুন সম্ভাবনা
লিবিয়ার সাহিত্যের জন্য পরিবেশ-পরিস্থিতি স্পষ্টই বদলে যাচ্ছে। ১৭ ফেব্রুয়ারির পর থেকে নতুন নতুন সংবাদপত্রের আবির্ভাব ঘটে চলেছে, লেখা হচ্ছে অনেক নতুন কবিতা। কিন্তু মোহামেদ মেসরাতি বলছেন, এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘যে সমাজে কখনো মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিল না, সেখানে গাদ্দাফির পতনের পরও আমাদের অনেক লড়াই করতে হবে মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য। ভয় পরিবারের মধ্যে, পাড়া-মহল্লায়; ভয় সাধারণ পাঠকদের দিক থেকে…। কারণ, উদারপন্থী লেখককে তারা বুঝতে পারবে না। লিবিয়ায় একজন মুক্তমনা উদারপন্থী লেখক অন্য লেখকদেরও ভয় পান, কারণ তাঁরা তাঁর লেখা ঠিকমতো বুঝতে পারবেন না; ভুল বুঝবেন।’
গাদ্দাফি-পরবর্তী সময়ে প্রথম যে লেখাগুলো বেরোচ্ছে, তা হলো বিপ্লবাত্মক কবিতা। তবে গেবলাবির মনে হচ্ছে, এ ধরনের কবিতা অচিরেই ফুরিয়ে যাবে, পথ করে নেবে নতুন ধরনের কবিতা। তাঁর মতে, ‘সেই নতুন ধারার কবিতা হবে বেশি বর্ণনাধর্মী; সেসব কবিতায় থাকবে লিবিয়ার মানুষের দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি বিবরণ; ভাষা ও শৈলীর দিকে মনোযোগ থাকবে কম।’ তিনি আশা করছেন, অনেক লেখক এখন এমন সব লেখা নিয়ে হাজির হবেন, যেগুলো তাঁরা গাদ্দাফির আমলে প্রকাশ করতে পারেননি। গেবলাবি ও মেসরাতি—দুজনই লিবীয় কথাসাহিত্যে নতুন, অধিকতর বাস্তববাদী প্রবণতাকে স্বাগত জানাচ্ছেন। অপেক্ষাকৃত কম বয়সী কবি-লেখকদের মধ্যে ‘বৈরুত ৩৯’ পুরস্কার বিজয়ী নাজওয়া বিনশাতওয়ান এবং ২০১১ সালের ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর অ্যারাবিক ফিকশানের জন্য প্রাথমিক তালিকাভুক্ত রাজান নাইম আল-মাগরাবি সাধারণ নগরজীবনের ওপর ভিত্তি করে লেখা শুরু করেছেন। গেবলাবি মনে করেন, সাধারণ প্রবণতা হবে সংক্ষিপ্ত প্রতীকধর্মিতা থেকে সরে এসে দীর্ঘ কবিতা ও উপন্যাস লেখা। মেসরাতি আশা করছেন, নতুন ও মুক্ত লিবিয়ায় এখন অনেক কিছুই ঘটবে। লুপ্ত হবে গণমাধ্যম ও তথ্যবিষয়ক মন্ত্রণালয়, আবির্ভাব ঘটবে প্রচুর বেসরকারি পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের। তিনি বলেন, ‘ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ সুন্দর নগর ত্রিপোলিতে আমরা লিবীয় শিল্প-সাহিত্যের সৌন্দর্যও দেখতে চাই।’
সূত্র: ইমতিদাদ ও কান্তারা অনলাইন ম্যাগাজিন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১১
Leave a Reply