হাসান আজিজুল হক—(জন্ম: ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯, পশ্চিমবঙ্গ) ছোটগল্পকার, কথাসাহিত্যিক।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: মাসউদ আহমাদ
লেখার ব্যাপারটা সব সময়ই আমার কাছে একটা দায়ের মতো। যখনই কোনো লেখা মাথায় আসে তখনই মনে হয়, একটা দায় এসে ঘাড়ে চাপল। এই দায় থেকে নিজেকে উদ্ধার করতে হবে। তার কারণটা হচ্ছে এই, লেখাটাতে আমি আমার নিজের সবটাকে দিয়ে দিতে চাই। এই একটি মাত্র জায়গা, যেখানে আমি কোনো রকমেই কোনো আপস করি না, করতে পারি না। নানা জায়গায় হয়তো আমি আপস করতে পারি। ছোটখাটো আপস করতে পারি। অপরের দিকে তাকিয়ে আমি নিমরাজি হতে পারি। কারও মুখের দিকে তাকিয়ে একটা সম্মতি দিতে পারি। কিন্তু লেখার জায়গাটাতে কোনোমতেই কোনো আপস করা সম্ভব নয়। আর যখনই লেখার কিছুটা মাথায় আসে, তখন মনে হয় মাথায় বাজ পড়ল—এখনই আমাকে লেখাটা লিখে ফেলতে হবে। লেখার অনুরোধ সব সময়ই আমার কাছে একটা বিপত্তির মতো আসে; একটা কিছু লিখতে হবে। তারপর কেউ যদি বলে, গল্প লিখতে হবে—তাহলে সেটা হয় মহা বিপত্তি। যখন যেটার প্রতি নিবিষ্ট থাকি, তার বাইরে আমি যেতে পারি না। আমি সব সময়ই আমার মনোযোগটাকে ব্র্যাকেট করে ফেলি আরকি। মনোযোগের বাইরে ব্যাপক-হালকা মনোযোগের বিষয় আছে। আর যে হালকা মনোযোগের ভেতরে একটা জায়গা নিবিষ্ট করার জন্য, সেখানে ব্র্যাকেট করা আছে। এভাবেই আমি করি। আমার প্রতিটি লেখাই এভাবে তৈরি হয়। সে জন্য লেখাটা আমার কাছে দায়ের মতো, আনন্দের বিষয় নয়।
আবার লিখব বলে আনন্দ পাচ্ছি এমনো নয়। তবে এটা ঘটে—আমি যখন লিখতে শুরু করলাম, যে লেখাটা শুরু করা আমার জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল, লিখতে শুরু করতে গিয়ে আমি দেখছি যে, একটি বা দুটি বাক্য লেখার পর তরতর করে এগোচ্ছে। এরপর লেখাটা যত চলতে থাকে, ততই আমার মনোযোগটা নিবিষ্ট হয়। ফলে আমার লেখার অক্ষরগুলো ক্রমেই ছোট হয়ে আসতে থাকে। বড় বড় অক্ষর হলেই মনে হয়, আমার মনোযোগটা চুরি হয়ে গেল। কিন্তু যখন অক্ষর ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে এবং আর অক্ষর হচ্ছে না যেগুলো, তখনই বোঝা যায়, আমার মনটা সত্যিকার অর্থে ওই লেখাটার মধ্যে ঢুকেছে। তখন সেই লেখাটির মধ্যে আমি অদ্ভুত ধরনের একটা শান্তি ও তৃপ্তি অনুভব করি। আনন্দ হয়। এটাকে ঠিক আনন্দ বলা যাবে না—তৃপ্তি লাভ হয়। তারপর লেখাটা ছেড়ে দিই। সাধারণত আমি লেখাটা ছাড়ি তখনই, যখন লেখাটা ভালো চলছিল। লিখতে লিখতে অনেক সময় আটকে যায়, যখন আটকে যায়, সেই সময় লেখাটা ছেড়ে দিলে পরে এসে তা আবার শুরু করাটা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু লেখাটা যখন বেশ ভালো চলছিল, আমার নিজের হিসাব মতো, সেই সময় যদি আমি লেখার লোভটা ছেড়ে দিই যে এখন আর লিখব না, তার পরের দিন বসলে মুহূর্তের মধ্যে লেখার ওই জায়গাটাতে আমি পৌঁছাতে পারি আরকি। কাজেই আমার একটা অভ্যাসই হচ্ছে এই, লেখাটা যখন ভালো চলছে তখনই লেখাটা ছেড়ে দেওয়া। এর ফলে হয় কি—পরের দিন যখন আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছে সেই জায়গাটা লিখতে, আমি জানি যে একটা জায়গায় আমি ছেড়েছি, বসলেই তো আবার লিখতে পারব; কিন্তু বসাতেই যে আমার চাপ। কাজেই এই দায়, কিছুতেই আমি মন থেকে এই দায়কে তাড়াতে পারি না। তবু হয়তো লিখতে বসলাম, দুটো অভিজ্ঞতা হলো—কখনো দেখছি, খুব ভালোভাবেই ছেড়েছিলাম, শুরু করতে গিয়ে দেখছি আর হলো না সে রকম। গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক মিলছে না লেখাটা। আবার কখনো এ রকম হয়, যেমন চলছিল লেখাটা শুরু করলাম আর তেমনি করেই চলতে থাকল।
আর লেখার ব্যাপারটা কী—আমি তো সেই অর্থে বিষয়বস্তু নিয়ে ভাবি না, একটা জীবনযাপন চলছে আমার চারপাশে, বিশালভাবে। সেই বিশাল জীবনযাপনের আয়তন চিন্তা হয়—সেটা শুধু আমার চারপাশে নয়, আমার এই বাংলাদেশ বা ভারতবর্ষজুড়ে নয়; একটা মানুষের যে জীবনযাপন, সেটা পৃথিবীজুড়েই চলছে। এখান থেকে কতটুকুই বা তোলা যায়। কত নুড়ি পাথর, সোনাদানা বা হীরা-মানিকের কণা তোলা যায়, সে জন্য এটা একটা ভীষণ ব্যাপার। সমুদ্রের ডুবুরির মতো, খুঁজে বেড়ানোর মতো কাজ। আমি সে কারণে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট করে একটা গল্প লিখব, তা হয় না। আমাকে বহুলোক মাঝেমধ্যে বলে, জানেন, এ রকম মজার ঘটনা ঘটেছে। আপনি এটা নিয়ে একটা গল্প লিখতে পারেন। অনেকে বলেছে। অজস্র। এ রকম বলা গল্প আমি একটাও লিখেছি কি না, সন্দেহ আছে। আর লেখার সময় আমি যেটা করতে চাই, সেটা একটা গোপন কথাই বটে। যেমন—ক্যামেরাওয়ালা ছবি তুলে থাকে, কী আপনি বলতে চান? এই নেন আমার ছবি। আমি ঠিক তেমন করে আমার কলমটাকে ক্যামেরায় রূপান্তরিত করতে চাই। তাতে আমি ছবি তুলি, লেখার মাধ্যমে। ফলে যখন কেউ বলে, আপনার লেখা পড়ে বুঝতে তো অসুবিধা হয়; তখন একদিক থেকে আমার আশ্চর্যই লাগে। মন দিয়ে পড়লে তো আমার লেখা ছবির মতোই, আমি তো ছবির বিকল্প হিসেবেই লিখেছি। যে মানুষগুলোকে নিয়ে লিখেছি, সে মানুষগুলোকে তো চোখের সামনে দেখতে পাওয়ার কথা। আর সেই ছবিগুলো কিন্তু আলাদা নয়। চারপাশের যে পরিবেশ, আবহ—সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। কারণ, আমি পুরো পরিবেশসহ ছবিটা আঁকি। সে জন্য আমার গল্পে বর্ণনা একটু বেশি। এই বর্ণনা দিয়ে আমার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, ওই পরিবেশটা আমি যখন তুলছি, আমি যেমন অনুভব করেছিলাম সেই পরিবেশে, সেই অনুভবটা ওটার সঙ্গে মিশিয়ে ফেলা। এটা না হলে আমি গল্প লিখতে পারি না। আমার গল্পে প্রকৃতির অনেক বর্ণনা আছে, কিন্তু প্রকৃতি আমার গল্পের বিষয় নয়। আমার গল্পের চালচিত্রে আছে প্রকৃতি, মূল বিষয় হচ্ছে প্রধানত মানুষ। মানুষের জীবনের বিরাট বিরাট ঘটনা, যেগুলো সাধারণত গল্পের বিষয় হয়, চমকপ্রদ ঘটনা—এগুলো নিয়ে কিন্তু আমি লিখিনি। ফলে আমি গল্প বানিয়ে লিখতে পারি না। লেখার চেষ্টাও করি না। আমার গল্প নির্মাণ বলে কোনো বস্তু নেই। গল্প নির্মাণে বেশ কাঁচা আমি। গল্পের উদ্ভাবনটা আমি ওইভাবে করি না। করতে পারি না। ঘটনার পরম্পরা একদম হিসাব করে নেব, এটা হয় না। এ কারণে হয়তো আমি কোনো দিন ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখতে পারব না। আমার ধারণা আরকি। অনেকে হয়তো পারে। কিন্তু আমার ভেতর এই জিনিস নেই। আমার যেটা হয়, কোনোভাবে একটা উপলক্ষ পেয়ে গেলাম, সেটাই তখন বিস্তারিত হতে শুরু করে। আমার অধিকাংশ ছোটগল্পই কিন্তু সে রকম। বিশেষভাবে নির্দেশ করা একটি গল্প, এটা আমার গল্পে কখনো আনতে চাই না আরকি। ছড়ানো জীবনটাকে দেখা—আসল ব্যাপারটা হচ্ছে জীবনের ভেতরটাতে ঢুকে দেখা; বাইরে থেকে যেটা দেখা যায়, সেটা নয়। সে জন্য তথাকথিত জীবনঘনিষ্ঠ ইত্যাদি কথা যখন বলে মানুষ আমার গল্প সম্পর্কে, আমার বিরক্তিই লাগে। জীবনঘনিষ্ঠ আবার কী? গরিব মানুষ বলেই বা কী? দুটোই তো সমান। হতে পারে সে একজন শ্রমজীবী বা খুব সাধারণ মহিলা; যেমন, মা-মেয়ের সংসার বা বাড়ির চাকরানিকে নিয়ে লেখা গল্প। মা-মেয়ের সংসার—সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকার পটভূমিতে লেখা। এ রকম অনেক গল্প আছে, যেমন ‘মন তার শঙ্খিনী’। একটি মেয়েকে নিয়ে লেখা গল্প। এগুলো আবার বিখ্যাতও হয়ে গেছে।
কেমন করে হয়েছে, তা জানি না। কিন্তু কোনো রকমে সামনে নিয়ে এলাম আরকি। তারপর লিখতে লিখতে হয় দু-একটি নতুন নতুন ঘটনা উদ্ভাবিত হলো। লেখার ভেতর দিয়েই সেটা এসে গেল। সেটা যদি সম্পূর্ণ মিশে না যায়, ওপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে কোনো গল্প লিখতে চাই না আমি।
একটা বিষয় আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। গল্পের শুরু, তার মাঝখান, ভালো করে ওপরে উঠে যাওয়া, তারপর ঝপ করে শেষ করে দেওয়া—ছোটগল্প সম্পর্কে প্রচলিত ব্যাপারগুলোর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি কখনো এমন করে চেষ্টা করিনি। গল্পটা কী করে শেষ হবে, লিখতে লিখতেই আমাকে বলে দেয়—আর লিখো না। এখানেই শেষ করো। এটা আমি আগে থেকে ঠিক করি না। দু-একবার ঠিক করেছি, কিন্তু পরে দেখেছি, সেভাবে হয় না। তার আগেই শেষ হয়ে যায়। অথবা সেটুকু লেখার পর আরও খানিকটা লিখেছি।
আমাকে একবার খুব ইমপ্রেস করা হলো—বিলডাকাতিয়া বলে একটা জায়গা আছে। যশোর থেকে শুরু করে প্রায় সাতক্ষীরা পর্যন্ত, বিশাল বিল ছিল সেটা। আমি ওই দেশ থেকে এসে এখানে মাইগ্রেট করেছিলাম, যেটা আমাদের নিজেদের বাড়ি, এখনো সেটা আছে। আমার অনেকগুলো গল্পের পটভূমি সেই বাড়িটা, যেমন: ‘বিষণ্ন রাত্রী’, ‘প্রথম প্রহর’, ‘আত্মজা’ ও ‘একটি করবীগাছ’, ‘সারা দুপুর’, ‘আমৃত্যু আজীবন’। ওই জায়গাটা ভারি সজল, ছায়াময় ও সুন্দর। নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরও এখনো তেমনই আছে। ওইখানে নদী আছে—ওখানকার নদী তো আর ফাঁকা নদী নয়, ওখানে যেহেতু জোয়ার-ভাটা বয়, কাজেই ছয় ঘণ্টা পরপর নদীগুলো পূর্ণ দেখতে পাওয়া যায়। নদী দেখার যে আনন্দ, সেটা পাওয়া যাবে নিঃসন্দেহে। গাছপালা সব মিলে, আশপাশে যে গ্রামগুলো আছে, সেগুলো পার হলেই বিলডাকাতিয়া চর। তার মানে আমাদের ওই গ্রাম থেকে পশ্চিম দিকে যে বিলডাকাতিয়া—উত্তর-দক্ষিণে প্রসারিত, বিশাল। ওখানে হাজার গ্রাম বলে একটা জায়গা আছে। বিলের মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম আছে। মূলত সেগুলো হিন্দুদের গ্রাম। এক হাজারটি গ্রাম আছে। সেই বিল যখন শুকনো, তখন আমি তা পার হয়েছি, ওপারের গ্রামে গিয়েছি। গ্রামে গিয়ে মনে হয়েছে, আর পাঁচটা গ্রামে ঢুকি। এভাবে অনেকগুলো গ্রাম দেখেছি। এই গ্রামগুলোই, যখন নদীর স্রোতে পানা ভাসে, বিলডাকাতিয়া যখন পরিপূর্ণ হয়ে যায়, তখন দেখে মনে হয় গ্রামগুলোই যেন পানার মতো ভাসছে, মানে গ্রামগুলোকে এমন অদ্ভুত ধরনের ডুবন্ত লাগে আরকি। একসময় আমার মনে হলো, এই গ্রামগুলো, বিল একদিক থেকে তো জীবনের প্রতীক। এটাই তো সোর্স—কেন্দ্র, উৎস। এই বিলকে ঘিরে চারপাশে যে অজস্র গ্রাম এবং লাখ লাখ মানুষের জীবনযাপনটা চলছে, তাদের প্রাণকেন্দ্র এই বিল। এখান থেকেই তারা জীবিকা সংগ্রহ করে। তখন মনে হলো, এই পটভূমিতে কী গল্প লেখা যায়? গল্প বলতে এটাই। এই পটভূমি ব্যবহার করা যায় নিশ্চয়ই। তাহলে এই পটভূমিকে ধরতে গেলে কী ধরব—একটা জীবনযাপন ধরি। কোনো একজন চাষির বাড়িতে যাই। সেই চাষি নিজের জমি চাষ করে, নাকি অন্যের জমি; হালচাষ করে যে গরু দিয়ে, সেই গরু সে কীভাবে কিনেছে, দেখি। হঠাৎ যদি তার একটা গরু চুরি হয়ে যায়, তাহলে সে কী করবে? গরু তো খোয়া যেতেই পারে—সাপের কামড়ে মারা যেতে পারে, অনেক রোগ আছে তাতে আক্রান্ত হতে পারে। ঠিক তখনই ‘আমৃত্যু আজীবন’ গল্পের ভাবনাটা মাথায় আসে। লিখতে শুরু করলাম, ‘আকাশে হাওয়া ছিল তখন। করম আলী ছেলেকে ডেকে বলল, “বাজান, আর দেরি করিসনে। এক্ষুনি চল, বৃষ্টি নামবে।”’ তারপর গল্পে তার মায়ের বর্ণনা, বুড়িমা, স্ত্রীর বর্ণনা, তার ছেলের জীবনযাপন, অপ্রত্যাশিত জীবনযুদ্ধ, ঘর-সংসার গড়া—তারপর লেখাটা আসতে থাকে একটার পর একটা। তখন আর অসুবিধা হয় না। যেটা বলছিলাম প্রথমে, ছেড়ে দিলেই মনে হয় কী কঠিন কাজে আমি হাত দিয়েছি, কী করে শেষ করব এটা? কিন্তু সাধারণত আমি ছেড়ে দিই না। এমন অনেক লেখা আছে, খুব কঠিন মনে করে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু অনেক সময় ছাড়ি না, ছাড়ি না বলেই ‘শোনিত সেতু’-এর মতো অতিশয় দীর্ঘ গল্প, জীবন ঘসে আগুন-এর মতো গল্পগ্রন্থই তো বলা যায়, ‘আমৃত্যু আজীবন’-এর মতো গল্প—আমার অনেক সমালোচক বলে থাকেন, আমি অতটা বুঝি না, মহাকাব্যিক ছোটগল্প ইত্যাদি; এই গল্পগুলো আমি সেই সময় লিখেছি।
লেখার জন্য একটা চাপ, এটা এখনকার মতো তখনো ছিল। এখন যেমন চাপ, তখন তো অত সাহিত্য পত্রিকা ছিল না। খুব কম ছিল। এর মধ্যে পূর্বমেঘ বের হতো রাজশাহী থেকে। সেটির সম্পাদক দুজন; জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী স্যার এবং মুস্তাফা নূরউল ইসলাম। আমাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন—গল্প পাঠাও। আমার অসংখ্য গল্প ওখানেই বেরিয়েছে। ‘আমৃত্যু আজীবন’ ওখানেই বেরিয়েছে। শামুক নামের একটা উপন্যাস পূর্বমেঘে বেরিয়েছিল। ওটা পরে আর কিছু করিনি। অনেকে বলে, বের করে ফেলো। আমাকে একজন সংগ্রহ করে দিয়েছে। সেটা একটা আলাদা স্টোরি। বই আকারে বেরোয়নি। কারণ, আমি দেখছি যে সেটা অসম্ভব কাঁচা। সেটা বের করা ঠিক হবে না।
সাম্প্রতিক কিছু লেখা নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি। রবীন্দ্রনাথের ওপর ছোট ছোট কিছু লেখা লিখে ফেলেছি। এ রকম করে, হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথের বিশেষ কোনো গান উপভোগ কিংবা গল্প, প্রবন্ধ বা বক্তব্য—যে রবীন্দ্রনাথকে আমি নিত্যদিন ব্যবহার করছি আরকি, তাঁর সম্পর্কে কিছু লেখা আমি লিখতে চাই। গোটা তিনেক লিখে ফেলেছি। আর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আন্তর্জাতিক সেমিনার যেটা হয়ে গেল, তার জন্য একটা প্রবন্ধ লেখার কথা ছিল আমার—১৫০ বছর পরের রবীন্দ্রনাথ। সেমিনারে আমার প্রবন্ধ তারা পছন্দও করেছে। তারা অনুরোধ করেছে, এটা নিয়ে আরেকটু যেন লিখি। আর আমার যেটা হয়, লিখতে গেলে তো ফাঁকি দিতে পারি না। যা-ই হোক, আর তিন-চার দিন লিখলে লেখাটা শেষ হয়ে যাবে। এই একটা কাজ। আর ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে করতে চেয়েছিলাম ভাষা নিয়ে একটা কাজ, বাংলা ভাষা নিয়ে। বাংলা ভাষায় আর্টের যে ব্যাপারটা, সেটা দেখানোর চেষ্টা করা। সেটার নাম দিয়েছিলাম, ‘ভাষা, ভাষাদর্শন, ভাষাতত্ত্ব, বাংলাদেশে বাংলা ভাষার রূপান্তর’। এটার একটা অংশ লেখা হয়েছে। বাকিটা শুরু করতে হবে। আর স্মৃতিকথার তৃতীয় অংশটার সূত্রপাত করে রেখেছি। ওই লেখাটা আছে। নাম এখনো ঠিক করিনি। আমি তো নাম লেখার শেষে ঠিক করি। তার মানে এখন একদম নিরিবিলি হতে পারলে ঢাকা ইউনিভার্সিটির কাজটা করব। এরপর আত্মজীবনীমূলক স্মৃতিকহনটা চলবে। আর একটা উপন্যাসের কথা ভেবেছি, মাঝারি সাইজের। লিখতে শুরু করব। গল্প নিয়ে আপাত ভাবছি না। সময় পাচ্ছি না। চিন্তা করারও তো ফাঁক পেতে হবে। কিন্তু ফুরসত পাচ্ছি না। গল্প আমার চিরকালের প্রেমের জিনিস। গল্প তো লিখবই। আর এক বইয়ের গল্প আরেক বইয়ের সঙ্গে মেলাতে চাই না। সবাই হয়তো সেটা খেয়াল করেছে। কিছু না কিছুভাবে পার্থক্য থাকে, যাতে আগের বইটার সঙ্গে পার্থক্যটা পরিষ্কার বোঝা যায়। আমারই লেখা, কিন্তু নতুন পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা।
আমার যেটা মনে হয়, একেবারে সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে, এই মুহূর্তের বাংলাদেশ নিয়ে আমার লেখা খুবই কম। আমি মিডল ক্লাসদের নিয়ে লিখেছিও কম। আজকের এই ভীষণ প্রযুক্তির উন্নয়নের যে বাংলাদেশ, তা নিয়ে লিখেছি অনেক কম। আমার লিখতে ইচ্ছা করে না, কিন্তু আমার মনে হয় চুপ করে থাকলে তো চলবে না। আর ভাসাভাসা জিনিস নিয়ে তো আমি লিখব না, একেবারে যদি ভেতরে ঢুকতে না পারি। বাংলাদেশে যেভাবে ব্যবসা হয়, গার্মেন্টশিল্প, পরিবহন ব্যবসা হয়, নানান বিষয়ে মানুষ পুঁজি বিনিয়োগ করছে, বর্জ্য পদার্থ দিয়ে সর্বনাশ করে দেওয়া হচ্ছে। কী বিশ্রী একটা জায়গায় গিয়ে আমরা পৌঁছেছি আরকি। এসবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে নানান কিছু যুক্ত হয়ে পড়েছে। আমাদের স্বাধীনতার ব্যাপারগুলোকে আর একটু ভাবার দরকার আছে, কাকে স্বাধীন বলে। একটা দেশকে কোন সময় বলা যায় যে এটি একটি স্বাধীন দেশ। এসব যদি একদম ভেতর থেকে বলতে পারি, তবেই আমার লেখাটা আসে। এ জন্য পরিশ্রমেরও দরকার ছিল। এখন মনে হয়, সেই সঙ্গে আমার একটা যানবাহনের দরকার ছিল। সহজে যেখানে খুশি, যখন খুশি যাতে চলে যেতে পারতাম। তাহলে আমি দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছিঁড়ে-খুঁড়ে দেখতে পারতাম। ঢাকা শহরটাকে একদম ভেতর থেকে দেখতাম। গজেন্দ্র মিত্রের তিন খণ্ডের উপকণ্ঠে কলকাতা শহরের শুরু থেকে বৃদ্ধি তুলে ধরা হয়েছে। কলকাতার মতো ঢাকাও তো অনেক পুরোনো শহর। কত ঐতিহ্য আছে ঢাকার! ৪০০ বছর পূর্ণ হয়ে গেছে ঢাকা শহরের। এটা নিয়ে একটা সৃজনশীল উপন্যাস হবে না? অন্তত ৫০ বছর সামনে নিয়েও একটা কাজ করা যায়। ঢাকা শহরের এ সমস্ত জমি, যেগুলো তোমরা দেখছ, সেখানে কারা বাস করত? তাদের কী হলো? কোন সামাজিক প্রক্রিয়ায় তারা দূর হয়ে গেল? কেউ বলতে পারে, টাকা দিয়ে তাদের কাছ থেকে জমিগুলো কিনে নেওয়া হয়েছে। এটা তো কোনো কথা হলো না। এমন একটা প্রেশার তৈরি করা হয়েছে, সেটার মানে একটাই—কেউ নিজের জায়গায় থাকতে পারবে না।
এখন যে প্রয়োজনটা দেখা দিয়েছে, সেদিক থেকে বলতে গেলে কী বিশাল ডাকাতি এবং জোরজুলুমটা আমরা করেছি। সবাই এতসব ঢাকা ঢাকা করে, কিন্তু ঢাকা শহরটাকে নিয়ে কেউ লিখল না। ঢাকায় না থাকলেই বলে, হ্যাঁ, গ্রাম্য। কিছুই জানে না। কিন্তু কেউ কোনো দিন বিবেচনাও করল না যে ঢাকার ট্রান্সফরমেশনটা হলো? কাকে বঞ্চিত করে কার উপকার করে, কীভাবে এটা দাঁড়াল? এসব জানতে হলে তাকে রাজউক দেখতে হবে, পেপার দেখতে হবে, স্যাটেলমেন্ট অফিসে যেতে হবে; কেমন করে ল্যান্ড ট্রান্সফার হয়েছে, ল্যান্ডগুলো কী রকম ছিল, কীভাবে তা ব্যবহূত হয়েছে? কী নষ্ট করে, কী তৈরি হয়েছে? করাপশন! করাপশন! এসব বলি আরকি। এসব উদ্ধার করতে পারলে দেখতে পাবে কত শকুন কীভাবে নেমেছে ঢাকাতে। কিচ্ছু কেউ করবে না, শুধু মুখে মাতব্বরি করবে, এই হচ্ছে আমাদের স্বভাব। মুশকিলটা তো হচ্ছে এখানেই। আমার দ্বারা আর এটা হবে না, আমার সেই বয়স নেই। তবে কাজটা করতে পারলে বড় কাজ হতো, আন্তর্জাতিক মানের উপন্যাস হবে। শওকত আলীর মধ্যে এই চেষ্টাটা কিছুটা ছিল। ওয়ারিশ, প্রদোষে প্রাকৃতজন-এ সে এসবের স্বাক্ষর রেখেছে। আমরা তা হারিয়ে ফেলেছি। সর্বনাশটা হয়েছে কি—এসব রোমান্টিক জায়গা থেকে দেখে সর্বনাশ হয়েছে। প্রাচীন জিনিস মানেই রোমান্টিক জায়গা থেকে দেখা—হায়, কী দিন হারালাম! তা নয়, আজকের যে কঠিন নিষ্ঠুরতা, প্রাচীন বাংলাতেও তা-ই ছিল। এর চেয়ে সহজ ছিল না। কাজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া আরকি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০১১
Leave a Reply