মাহফুজ এবং স্মৃতির নির্মমতা
এডওয়ার্ড সাইদ অনুবাদ: আহসান হাবীব
নাগিব মাহফুজ নাগিব মাহফুজ নোবেল পুরস্কার পান ১৯৮৮ সালে। তারও আগে থেকে তিনি আরব বিশ্বের বাইরে আরব অথবা মধ্যপ্রাচ্য অধ্যয়ন শাস্ত্রের শিক্ষার্থীদের কাছে এক সুপরিচিত নাম। কায়রোর নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের চিত্ররূপময় কাহিনি রচয়িতা হিসেবেই মূলত খ্যাতিমান ছিলেন। ১৯৮০ সালে আমি নিউইয়র্কের এক প্রকাশককে তাঁর লেখালেখির ব্যাপারে আগ্রহী করার চেষ্টা করেছিলাম। সেসময় প্রকাশক মশায় ‘তৃতীয় বিশ্বের’ বই প্রকাশ করতে চাচ্ছিলেন। তাঁকে নাগিব মাহফুজের কিছু লেখার অনুবাদ ছাপতে বলেছিলাম। কিছু ভাবনাচিন্তার পর তিনি আর আগাননি। কেন এমন সিদ্ধান্ত খোঁজ নিতে গেলে আমাকে বলা হলো (কোনো কূটাভাস ছাড়াই), আরবি ভাষাটি বিতর্কিত।
এর কয়েক বছর পর মাহফুজের ব্যাপারে জেকুলিন ওনাসিসের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং আমার তরফ থেকে উৎসাহব্যঞ্জক যোগাযোগ ঘটে। তাঁর লেখা নেবেন কি না ভেবে দেখলেন জেকুলিন। পরে যাঁদের কারণে মাহফুজ ডাবলডেতে জায়গা করে নেন, জেকুলিন তাঁদের অন্যতম। তাঁর লেখাগুলোর ইংরেজি অনুবাদের স্বত্ব প্রকাশনা সংস্থা আমেরিকান ইউনিভার্সিটি ইন কায়রো প্রেসের হাতে। হতভাগা মাহফুজ! স্বত্ব বিক্রির সময় হয়তো আশাও করেননি, কোনো একসময় তিনি লেখক হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করবেন। সাহিত্যসংশ্লিষ্ট নয়—মূলত বাণিজ্যিক উদ্যোগ—এমন ব্যাপারে তাঁর বলার নেই কিছুই।
আরব পাঠকের কাছে মাহফুজের স্বর স্বতন্ত্র। ভাষার ওপর অসাধারণ দখল। এখানে আমি এটুকুই বলতে চেষ্টা করব, নিজের দেশের ব্যাপারে সন্দেহাতীতভাবে তাঁর অবিমিশ্র ও এক অর্থে উদ্ধত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। আর রাজা যেমন তাঁর রাজ্য জরিপ করেন, তেমনি তিনি তাঁর দেশের দীর্ঘ ইতিহাস এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন, সবচেয়ে মনোরম ও লোভনীয় হিসেবে তাঁর দেশের যে অবস্থান, তার সারসংকলন, বিচার ও রূপায়ণের সামর্থ্য তাঁর আছে বলে উপলব্ধি করেন।
তা ছাড়া একেবারে নিজস্ব ভঙ্গিতে এসব প্রকাশের বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাহিত্যিক কলাকৌশল তাঁর আয়ত্তাধীন। তাঁর প্রকাশভঙ্গি বলিষ্ঠ, প্রত্যক্ষ ও কুশলী। তাঁর সৃষ্ট নানা চরিত্রের মতোই (কোনো চরিত্র হাজির হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে দেন) মাহফুজ সোজা পাঠকের ওপর এসে পড়েন, ঠাসবুননের আখ্যানপ্রবাহে পাঠককে মগ্ন করেন। তারপর তাতে অবগাহন করতে দেন। আর এ সময়ের পুরোটাই তিনি তাঁর চরিত্রগুলোর জীবনের স্রোত ও তরঙ্গ ইচ্ছামতো পরিচালনা করতে থাকেন। এখানে বাস্তববাদ আছে, তবে সঙ্গে আছে স্বপ্নও—সর্বব্যাপ্ত দৃষ্টির বাসনা। এক দিক থেকে দান্তেরই মতো। দান্তে যেভাবে পার্থিব বাস্তবতার সঙ্গে শাশ্বতের (খ্রিষ্টধর্মকে বাদ দিয়ে) জোড় বাঁধেন তেমনি করে।
১৯১১ সালে জন্ম নেওয়া মাহফুজ ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে তিনটি উপন্যাস প্রকাশ করেন। প্রাচীন মিসরের উপর এসব উপন্যাস লেখার সময় তিনি চাকরি করছেন আওকাফ (ধর্মীয় অর্থ সরবরাহ) মন্ত্রণালয়ে। এগুলো আজও অনূদিত হয়নি। ১৯৪৫ সালে প্রকাশ করেন খান আল-খালিলি উপন্যাস। এটা আধুনিক কায়রোর উপাখ্যান। ঔপন্যাসিক জীবনের এই পর্যায় তুঙ্গে পৌঁছে ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে কায়রো ট্রিলজি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এসব অনবদ্য উপন্যাস আসলে বিশ শতকের প্রথম ভাগের আধুনিক মিসরীয় জীবনযাপনের এক প্রকার সংক্ষিপ্তসার।
কায়রো ট্রিলজি কুলপতি এল-সায়েদ আহমেদ আবদেল-গাওয়াদ ও তাঁর পরিবারের তিন প্রজন্মের ইতিহাস। উপন্যাসগুলোতে বিপুল পরিমাণে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিস্তারিত বর্ণনা আছে। পাশাপাশি এগুলো নারী-পুরুষের অন্তরঙ্গ সম্পর্কের পাঠও। আবার আবদেল-গাওয়াদের কনিষ্ঠ পুত্র কামালের জন্য অল্প বয়সের ও স্বল্পস্থায়ী ইসলামপ্রেম অতিক্রমের পর বিশ্বাসের অনুসন্ধানও বটে।
১৯৫২ সালের মিসরীয় বিপ্লবের পরের পাঁচ বছর নাগিব মাহফুজ প্রায় নীরবে কাটিয়ে দেন। এর পর তাঁর গদ্য রচনা অবিরাম ধারায় বেরোতে শুরু করে। উপন্যাস, ছোট গল্প, রোজনামচা, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ ও নাটক—সবই। সাহিত্যিক জীবনের শুরুতে প্রাচীন দুনিয়া নিয়ে কাজ করার সময় থেকেই মাহফুজ অসাধারণ উৎপাদনশীল লেখক। তাঁর প্রগাঢ় বন্ধন নিজের যুগ-ইতিহাসের সঙ্গে। তবু তিনি আবারও প্রাচীন মিসরে ফিরতে বাধ্য। কেননা, প্রাচীন ইতিহাস থেকে তিনি সমকালীন নানা পরিপ্রেক্ষিত খুঁজে নিতে পারছিলেন। সেগুলো সামান্য অদলবদল ও পাতন করে নিজের দুরূহ সৃষ্টিকর্মের চাহিদা মেটাতে পারতেন।
সত্যে অধিষ্ঠাতা (১৯৮৫) উপন্যাসে মনে হয় এ কথা খাটে। এটি ইংরেজিতে অনূদিত হয় ১৯৯৮ সালে, আখেনাতেন, ডুয়েলার ইন ট্রুথ নামে। এই উপন্যাসটিতে ক্ষমতা, গোড়া ধর্মীয় ও ব্যক্তিগত সত্যের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এবং কখনো কখনো অবর্ণনীয় ও রহস্যময় চরিত্র-উদ্ভূত অদ্ভুত সুসংগত অথচ অত্যন্ত বিপরীত পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে বিভিন্ন সুরের মিলনের ব্যাপারে মাহফুজের বিশেষ চিন্তা অমায়িকভাবে ফুটে উঠেছে।
আর মাহফুজের রচনাশৈলী স্বচ্ছ হওয়া সত্ত্বেও তিনি অত্যন্ত পরিশীলিত; শুধু আরবি ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেই নয়, সামাজিক প্রক্রিয়া ও জ্ঞানকাণ্ডের উদ্যমী ছাত্র হিসেবেও। নিজের অঞ্চলে তো বটেই, হয়তো সারা দুনিয়ায় এ ব্যাপারে তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। বাস্তববাদী উপন্যাসগুলোর জন্য তাঁর সুখ্যাতি আছে। এসব উপন্যাস আধুনিক মিসরের কেবল নিষ্ঠাবান সমাজতাত্ত্বিক দর্পণ নয়, ক্ষমতা আসলে কীভাবে বিরাজ করে সেই অত্যন্ত বাস্তব ভাব উন্মোচনের দুঃসাহসী প্রয়াসও বটে। এই ক্ষমতার উৎস হতে পারে স্বর্গীয়—যেমন ১৯৫৯ সালের আওলাদ হারিতনা (গেবেলাবির সন্তান) রূপকধর্মী উপন্যাসে দেখা যায়, বিশাল ভূস্বামী গেবেলাবি এক দেবতুল্য চরিত্র, যিনি তাঁর সন্তানদের স্বর্গ অথবা সিংহাসন থেকে, পরিবার, গোষ্ঠী কিংবা রাজনৈতিক দল, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি আমলাতন্ত্র ইত্যাদি সাধারণের ক্ষেত্র থেকে নির্বাসিত করেন। আমি কিন্তু বলছি না যে মাহফুজের উপন্যাস কতগুলো বিমূর্ত আদর্শ দ্বারা চালিত কিংবা এদেরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। যদি তেমনই হতো, তাহলে তাঁর সৃষ্টিকর্মের শক্তি অনেক কম হতো; তাঁর অগণন আরব আর আজকের বিপুল আন্তর্জাতিক পাঠক তাঁর লেখায় এতো আনন্দ পেত না।
আমার ধারণা, নিজের সৃষ্ট চরিত্রগুলো ও এদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে মাহফুজ চিন্তাকে এত পূর্ণরূপে ধারণ করতে চেয়েছেন যে তাঁর লেখায় তত্ত্বীয় কোনো কিছুই প্রকট থাকেনি। তবে, তিনি সর্বদা বিমোহিত হন পরমসত্তা যেভাবে আবশ্যিকভাবে একই সঙ্গে বস্তুগত ও অপ্রতিবিধেয় হয়ে যান সে ব্যাপারে। যেমন গেবেলাবি তাঁর সন্তানদেরকে ঘর ছাড়ার হুকুম দেওয়ার পর তারা নির্বাসিত হয়ে চির তরে তাঁর আওতার বাইরে চলে যায়। এমনকি গেবেলাবি তাঁর নিজের দুর্গে—বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পরও। অথচ সন্তানদের নতুন বসতি এলাকা থেকে তাঁর বাড়ি সব সময় দৃষ্টিসীমার ভেতরই। অনুভূতি আর যাপনের অভিজ্ঞতা স্পষ্টভাবে দেখানো, মূর্ত করা; অথচ মাহফুজের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যক্ত অসাধারণ গদ্যে তা সঙ্গে সঙ্গে ধরা যায় না।
গেবেলাবির সন্তান-এর এই আখ্যানবস্তু প্রলম্বিত হয়েছে এবং আরও গভীরতা পেয়েছে মালহামাত আল-হারাফিশ (১৯৭৭) (হারাফিশের মহাকাব্য)-এ। ভাষার কুশলী ব্যবহারের মাধ্যমে পরমসত্তাকে তিনি ইতিহাস, চরিত্র, ঘটনা, কালিক পরম্পরা ও স্থানে রূপায়িত করতে সক্ষম। আর একই সময়ে, পরমসত্তা যেহেতু বস্তুর গোড়ার কথা তাই তার অপূর্ব, মৌলিক এবং কখনো যন্ত্রণাদায়ক উদাসীনতা রহস্যজনকভাবে বজায় থাকে। আখেনাতেন-এ সূর্যদেবতা অকালিন একেশ্বরবাদী তরুণ রাজাকে চিরতরে বদলে দেন। কিন্তু নিজে দেখা দেন না, ঠিক যেমন আখেনাতেনকে দেখা যায় দূরের এক কিনারায়, তাঁর শত্রু, মিত্র ও স্ত্রীর বহু আখ্যানে। এরা তাঁর গল্প বলে, কিন্তু তাঁকে নিয়ে রহস্যের কুলকিনারা করতে পারে না।
অথচ মাহফুজের আরেকটি দিক আছে। সেটি ভয়ংকর নিগূঢ়তাবিরোধী। মাহফুজের এই দিকটি এক অধরা বৃহৎ শক্তির স্মৃতি, এমনকি উপলব্ধির দ্বারা দ্বিখণ্ডিত। অথচ এই শক্তিই মনে হয় তাঁকে যন্ত্রণার্ত করে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আখেনাতেনের গল্পে অন্তত ১৪ জন কথকের দরকার হয়েছে। তবুও তাঁর শাসনামল নিয়ে বিরোধাত্মক ব্যাখ্যার মীমাংসায় ব্যর্থ হয়েছে তারা। মাহফুজের যেসব রচনার সঙ্গে আমি পরিচিত, সেসবের প্রতিটিতেই ক্ষমতার এই ধরনের কেন্দ্রীয় অথচ দূরবর্তী রূপায়ণ আছে। সবচেয়ে স্মরণীয় এমন চরিত্র হলো কায়রো ট্রিলজির জাহাঁবাজ বয়োজ্যেষ্ঠ চরিত্র এল-সায়েদ আহমেদ আবদেল-গাওয়াদ। পুরো ট্রিলজিজুড়ে তাঁর কর্তৃত্বপূর্ণ উপস্থিতি সব কার্যকলাপের ওপর ছায়া ফেলে।
ট্রিলজিতে তাঁর প্রাধান্য ধীরে ধীরে কমতে থাকা শুধুই দৃষ্টির অগোচরে ঘটে না, এ রূপান্তর ও অবমূল্যায়নও ঘটেছে কতগুলো জাগতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে: যেমন আবদেল-গাওয়াদের বিয়ে, তাঁর লাম্পট্য, তাঁর সন্তানসন্ততি এবং পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। পার্থিব বিষয়াদি মাহফুজকে বিহ্বল করে। আর হয়তো তাঁকে একই সময়ে বাধ্য ও বিমোহিত করে। বিশেষত, এল-সায়েদ আবদেল-গাওয়াদের ক্ষয়িষ্ণু উত্তরাধিকার কীভাবে ১৯১৯ সালের বিপ্লব, সাদ জগলুলের উদারনৈতিক যুগ, ব্রিটিশ দখলদারি এবং দুই যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে ফুয়াদের শাসনের পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত তিন প্রজন্মকে এক সাথে ধরে রাখতে সক্ষম হয় সেই বর্ণনায় এটা পরিষ্কার।
এর ফলটা দাঁড়ায়, পাঠক যখন মাহফুজের কোনো উপন্যাসের শেষ প্রান্তে চলে আসে, যখন তার মনে একই সঙ্গে উদয় হয় চরিত্রগুলোর অধোমুখি দীর্ঘ যাত্রা শেষে কী হলো তা নিয়ে আক্ষেপ আর হালকা অস্পষ্ট আশাবাদ যে, কাহিনির শুরুতে ফিরে গিয়ে পাঠক হয়তো এসব মানুষের ঋজুতা উপলব্ধি করতে পারবে। প্রক্রিয়াটি যে কতটা প্রভাববিস্তারী, তার ইঙ্গিত আছে ঔপন্যাসিকের আন্তজীবনী থেকে প্রতিধ্বনির (১৯৯৪) ‘বাণী’ খ্যাত অংশে: ‘বিস্মরণ প্রবণতায় যা অদৃশ্য হয়, তা স্মরণের মধ্যে স্মৃতির নির্মমতা প্রকাশ পায়।’ মাহফুজ সময়ের বিচারে প্রবৃত্ত হন। কিন্তু ইতিহাসের অনিবার্য ফল হিসেবে মুক্তির কোনো কথা তাঁর সাহিত্যকর্মে জোর করে নিয়ে আসেন না।
মাহফুজ এক নিরহংকার কাহিনিকার। তিনি কায়রোর ক্যাফেতে ক্যাফেতে বিচরণ করেন, তাঁর অখ্যাত কোণে নীরবে কাজ সারেন। অর্ধশতাব্দী ধরে যে অনমনীয়তা ও আড়ম্বরসহকারে তিনি তাঁর সাহিত্যকর্মে দৃঢ়তা বজায় রেখে গেছেন, গতানুগতিক দুর্বলতার খপ্পরে পড়তে দেননি—এটা লেখক হিসেবে তাঁর কীর্তির মর্মবস্তু। নিত্যতা ও সময় যেভাবে অন্তরঙ্গ বন্ধনে জড়িয়ে থাকে সে দৃষ্টিভঙ্গি বিস্ময়করভাবে ধরে রাখা সম্ভবপর হয়েছে মূলত তাঁর দেশ মিসরের জন্য। মাহফুজের কাছে মিসর ভৌগোলিক স্থান ও ইতিহাস হিসেবে সারা দুনিয়ার অতুলনীয়। ইতিহাসের চেয়েও প্রাচীন। ভৌগোলিকভাবে স্বতন্ত্র, নীল নদ, নদবিধৌত উর্বর ভূমিখণ্ডের কারণে। মাহফুজের মিসর ইতিহাসের এক অপার পুঁজি, যার বিস্তারকাল কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত। সরকার. শাসন, ধর্ম ও বর্ণের বিস্ময়কর বৈচিত্র্য সত্ত্বেও মিসর তার সুসংগত পরিচয় ধরে রেখেছে। তা ছাড়া, নানা দেশের মধ্যে মিসরের অবস্থান অনন্য। দ্বিগ্বিজয়ী, পরিব্রাজক, চিত্রকর, লেখক, বিজ্ঞানী ও পর্যটকদের আকর্ষণের বস্তু এই দেশটি মানবেতিহাসে যে স্থানে অধিষ্ঠিত আর যে দৃশ্যত কালাতীত নিদর্শন জারি রাখছে তার তুলনীয় কোনো দেশ নেই।
মাহফুজের সাহিত্যকর্মের প্রধান অর্জন ইতিহাসকে শুধু গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়াই নয়, আক্ষরিক অর্থেও নেওয়া। আর টলস্টয় কিংবা সোলঝেনিৎসিনে যেমন, তেমনি মাহফুজেও তাঁর সাহিত্যিক ব্যক্তিত্বের পরিমাপ জানা যায় তাঁর নিছক দুঃসাহস, এমনকি তাঁর পরিসরের স্পর্ধার উচ্চতায়। মিসরের ইতিহাসের বিরাট বিরাট অংশকে সেই ইতিহাসের তরফে গ্রন্থিবন্ধ করা এবং নাগরিকদের নিরীক্ষার জন্য তাদেরই একজন হয়ে উপস্থাপন করার মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষা সমকালীন লেখকদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া বিরল।
মাহফুজের মিসর তেজোদীপ্ত। নিখুঁত ও রসাত্মক ঢংয়ে তিনি দেশের অদ্ভুত প্রাণবন্ত চিত্র আঁকেন। তাঁর মিসর মহান নায়কদের দ্বারা পুরোপুরি আচ্ছন্ন নয়, আবার সর্বাত্মক সংগতির কিছু না থাকলেও চলবে না, যেমন সংগতি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন আখেনাতেন, কিন্তু টেকাতে পারেননি। শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রবিহীন মিসর সহজেই হয়ে উঠতে পারে নৈরাজ্যিক কিংবা অদ্ভুত এক অকারণ স্বৈরশাসন আসন গাড়তে পারে, যার ভিত্তি হয়তো হতে পারে ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা কোনো ব্যক্তিনির্ভর স্বৈরতন্ত্র।
মাহফুজের ব্যাপারে একই সঙ্গে লক্ষণীয় ও গ্লানিকর বিষয় হলো, তাঁর কল্পনাশক্তি ও সৃষ্টিকর্মের যে বিশালতা তা সত্ত্বেও কেমন করে তিনি এক শোভন, মানবিক সমাজের মিসরের প্রতি তাঁর উনিশ শতকীয় উদার বিশ্বাসকে এখনো পাহারা দিয়ে যাচ্ছেন। যদিও যেসব সাক্ষ্য-প্রমাণের গভীরে তিনি খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছেন আর সমকালীন জীবন ও ইতিহাস নিয়ে যে লেখালেখি করছেন, সেগুলো তাঁর বিশ্বাসকে খণ্ডন করে। তবু নাগরিক হিসেবে মাহফুজ তাঁর সাহিত্যকর্মে দেখান সংঘর্ষ ও ঐতিহাসিক অধঃপতনের (আমার পঠিত সব লেখকের চেয়ে তাঁর লেখায় এই অধঃপতনের চিত্র সবচেয়ে জোরালো) দৌর্বল্যকর প্রক্রিয়াকে হয়তো অতিক্রম করে যাবে ভদ্রতা ও বহুজাতিগত, চিরন্তন, মিসরীয় ব্যক্তিত্বের ধারাবাহিকতা।
রচনাকাল, ১৫ ডিসেম্বর ২০০১
নাগিব মাহফুজ—মিশরীয় কথাসাহিত্যিক (জন্ম: ১১ ডিসেম্বর ১৯১১—মৃত্যু: ৩০ আগস্ট ২০০৬) । ১৯৮৮ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ২০১১ সালে তাঁর জন্ম শতবর্ষ পূর্ণ হলো।
এডওয়ার্ড সাইদ— (জন্ম: ১ নভেম্বর ১৯৩৫—মৃত্যু: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৩) ফিলিস্তিন বুদ্ধিজীবী। পোস্ট কলোনিয়ালিজম মতবাদের প্রবক্তাদের অন্যতম।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ০২, ২০১১
Leave a Reply