৪১.
স্বচ্ছ আকাশ।
মিটি মিটি আলো দিচ্ছে অসংখ্য তারার বাতি।
সেই নরক রাতের আগুন নেই মহানগরীর আকাশে। ধোঁয়াও নেই। তবু মনে হয় মালুর, সে রাতের ভয়ংকর ছায়াটা এখনো ধাওয়া করে চলেছে এই মহানগরীর প্রতিটি মানুষকে। প্রতিটি মানুষের বুকে এখনো সেই নরক রাতের যন্ত্রণা, কাতর আর্তনাদ। মেয়ে কলেজটাকে একাধারে হাসপাতাল আর ইভাকুউ ক্যাম্পে রূপান্তরিত করেছে ওরা।
ঘর, বারান্দা, খোলা চত্বর, কোথাও একটু পা ফেলবার জায়গা নেই। স্টীমারে ডেকের যাত্রীদের মতো নারী পুরুষ এক সাথেই সারি সারি শুয়ে আছে সব। সর্বস্ব খুইয়ে আসা মানুষ, কবে যে আবার নিজেদের আস্তানা গড়ে তুলতে পারবে কে জানে?
দুদিকের ঘুমন্ত মানুষের চাপে দমটা বন্ধ হয়ে আসতে চায় মালুর। ঘামে জবজবে গায়ের জামাটা। ঘুম কিছুতেই আসে না। আর যখন ঘুম আসে না তখুনি যেন রাজ্যের যত চিন্তা এসে ছেঁকে ধরে মালুকে। রাবুর মুখটাই বার বার ভেসে ওঠে ওর বোজা চোখের সুমুখে।
পাস করে তো বেরুচ্ছ রাবু আপা। এবার মেজো ভাইকে নিয়ে ছোট্ট একটি সংসার পাত না কেন? বলেছিল মালু, মাস তিনেক আগে রাবুদের হোস্টেল থেকে কলেজ স্ট্রীটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে।
কাউ ফলের কোয়ার মতো লাল টুকটুকে ঠোঁট জোড়া অকারণেই কামড়ে থেঁতলে একাকার করেছিল রাবু। তারপর বলেছিল, জাহেদ কী নীড় বাঁধবে? ঘরের সাথে তো ওর স্বভাবের বিরোধ। অথচ গতকাল দুপুরে ঠিক উল্টো কথা বলল রাবু। আশ্চর্য। মালু বুঝতে পারে না রাবুর সংশয় নিজেকে অথবা জাহেদকে নিয়ে।
আমার আব্বাকে মনে আছে তোর? কিছুক্ষণ পর শুধিয়েছিল রাবু।
বারে, মনে থাকবে না কেন? মালু যেন প্রতিবাদ করেছিল।
আম্মা তাকে পারেনি সামলে রাখতে।
খোদার পথে যে দেওয়ানা তাকে সামলে রাখবে কে?
দেশের পথে যে দেওয়ানা তাকেই বা সামলাবে কে। মালুর কথাটা শেষ না হতেই বলেছিল রাবু।
কিন্তু, তুমিই যেন বার বার ফিরিয়ে দিচ্ছ মেজো ভাইকে। একটু উত্ত্যক্ত হয়েই যেন বলেছিল মালু।
সেদিন এক টুকরো বিচিত্র হাসি ছড়িয়ে চুপ করে গেছিল রাবু। কেমন বদলে গেছে রাবু। এজমালি সম্পত্তির অর্ধেকের মালিক হয়েও থাকে না পার্ক স্ট্রীটের বাড়িতে। সেটা নাকি তার আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের পথে মস্ত বড় বাধা।
শুধু রাবু কেন, গোটা সৈয়দ বাড়িটাই কেমন যেন হয়ে গেছে। সহজ ঢং, সরল ধাঁচ সবই যেন বদলে গেছে। শহরের আবহাওয়ায় স্বার্থ চিন্তার চক্রজালে সেই ছোট বেলায় দেখা সৈয়দ বাড়ির সহজ গাঁথুনিটা যেন ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে মমতা মাখা শান্ত স্নিগ্ধ পারিবারিক পরিবেশ। তাই জাহেদও আজ সে বাড়িতে খাপছাড়া, অনাদৃত।
এমন কেন হল? বাকুলিয়ার সৈয়দ বাড়িতে কেন আজ মমতার পরশ নেই? কলকাতা শহরটার উপরই রাগ হয় মালুর। এই শহরই কেড়ে নিয়েছে বাকুলিয়ার সৈয়দদের শ্ৰী, সৌষ্ঠব।
মরুগে সৈয়দরা। উঠে পড়ে মালু। পাউরুটিটা বগলে খুঁজে ঘুমন্ত মানুষের ফাঁকে ফাঁকে সাবধানে পা ফেলে নেবে আসে খোলা চত্বরে।
হাসি পেল মালুর। নিজের ভাবনার যার শেষ নেই সে কিনা কোন্ সব মানুষের কথা ভেবে চলেছে। এই কটা দিন তো কোনো রকমে ক্যাম্পেই কেটে গেল। তারপর? নেহাত ক্যাম্পের কিছু কাজকর্ম করে দিচ্ছে বলে রাতটাও কাটাতে পারছে। কিন্তু, এ রকম ফাঁকি দিয়ে আর কদ্দিন কাটাবে? তা ছাড়া খাওয়া? ক্যাম্প থেকে লঙ্গরখানার খাওয়া গত পরশু থেকে তার বন্ধ। অন্য ভলান্টিয়াররা সবাই বাড়ি থেকেই খেয়ে আসে, সে কেন ক্যাম্পের খাওয়া খাবে?
খাবার কথা মনে হতেই পেটটা যেন ক্ষিদের ব্যথায় চিন চিন করে উঠল মালুর। রুটিটাকে নাকের কাছে এনে শুঁকল ও। ইচ্ছে হল এক কামড়ে খেয়ে নিক। তাড়াতাড়ি নাকের কাছ থেকে সরিয়ে আবার বগলে পুরল রুটিটা।
আজ সকালে। কোনো দানশীলা মহিলা এসে রুটি আর জিলিপী বিলিয়ে গেছে দুঃস্থদের। কেমন করে যেন একটা রুটি আর দুখানি জিলিপী পৌঁছে গেছিল মালুর হাতে। অর্ধেকটা রুটি আর জিলিপী দিয়ে বেশ তৃপ্তির সাথেই পেট ভরিয়েছে। মালু। বাকী অর্ধেকটা রেখে দিয়েছে, কাল সকালের জন্য।
আসলে সেই হোটেল ছেড়ে পালিয়ে আসার পর একদিন, মাত্র একটা বেলা মালু তৃপ্তির সাথে পেট পুরে খেতে পেরেছে। সে হল গত পরশু দুপুরে রেস্তোরাঁয়। কথাটা মনে পড়ে জিবে জল আসল মালুর।
একটা ভলান্টিয়ার তাঁবুর খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসল মালু। পা-টা ছড়িয়ে দিয়ে চমকে উঠল ও। শিশির ভেজা ঘাসের নরম স্পর্শে চমকে উঠবারই কথা। সেই কবে গ্রাম ছেড়েছে তারপর ঘাস দুব্বার নরম শরীর মাড়িয়ে পথ চলার যে রোমাঞ্চিত আনন্দ, সে তো এক রকম ভুলেই গেছে মালু।
অতর্কিতে অতীত এসে হানা দেয়। শূন্য গর্ভ আতঙ্কিত ভবিষ্যৎটাও বুঝি। বাকুলিয়ার সেই বয়াতি ছেলেটি, বাইশ বছরের জীবনে কত বিচিত্র পথ পাড়ি দিয়ে এল ও। কত কথা আজ মনে পড়ছে ওর। মেঘ এসে নিভিয়ে দিয়েছে তারার বাতিগুলো। আকাশটা অস্পষ্ট। পাশের তেরপল ছাউনিতে বাচ্চা একটি মেয়ে কেঁদে চলেছে অনেকক্ষণ। বুঝি তার মা, সান্ত্বনা দিয়ে চলেছে, রোতি কেঁউ, আল্লা নে তেরা কিছমত ছিন লিয়া। কিন্তু মেয়েটি শুনবে কেন ও সব কিসমতের ফের। দুধ খেয়েই বরাবর ঘুমোত যায় ও। আজ দুধ পায়নি তাই কান্না জুড়েছে ও। ঘুম তার আসছে না। এটা মাকে কেমন করে বুঝাবে ও, কান্না ছাড়া?
মালুর ইচ্ছে হল রুটিটা দিয়ে আসুক মেয়েটির হাতে। দুধের বদলে রুটিটা পেয়ে হয়ত খুশিই হবে মেয়েটি। কান্না থামিয়ে কচি মুখখানি হেসে উঠবে। ঘুমিয়ে পড়বে।
উঠে পড়ল মালু। দুপা এগিয়েও এল। কী যেন ভাবল। ফিরে এল। মনে মনে আবারও হাসল মালু। শুধু সৈয়দরা কেন, সে নিজেই তো কত বদলে গেছে। বদলে গেছে বলেই আগামী কালকের অনিবার্য উপোসের কথাটা ভাবতে হয় ওকে। রুটিটা বগলে চেপে ফিরে আসতে হয়। এটাই বুঝি মহানগরীর ধর্ম। মন থাকে না এখানে। মন যায় মরে। কেঁদে কেঁদে বুঝি ক্লান্ত হয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে তেরপল ছাউনির মেয়েটি। দোতলার হাসপাতালের ঘরে কোন্ মুমূর্ষ যেন আর্তনাদ করে উঠল। রাস্তার ওপারে পার্কের উঁচু শিরিস শাখায় রাতের পাখিরা হঠাৎ ডানা ঝাপটিয়ে কেঁদে উঠল কী এক অজানা আতঙ্কে। ইচ্ছে হল মালুর, ওই আধখানা রুটি ছুঁড়ে ফেলে দিক নর্দমার জঞ্জালে। যে রুটি ওর একটি কোমল মানবীয় অনুভূতিকে পিষে মারল সে রুটি দিয়ে কেমন করে ক্ষুধা মিটাবে ও? গাটা কেমন ভিজে এসেছে মালুর। কুয়াশা পড়ছে। মনে হল মালুর, মহানগরীর উন্মত্ত দিনের যত উত্তাপ রাতের নিভৃতে স্নেহধারার সিক্ত পরশ হয়ে নেবে আসছে। সেই পরশ ওর সর্বাঙ্গে, ওই খোলা বারান্দার ঘুমন্ত মানুষগুলোর মুখে।
সকালে ঝিকিমিকি রোদটা মুখে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে উঠল মালু। সেই তাঁবুর খুঁটিতে হেলান দিয়ে ও বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছিল। প্রথমেই মনে পড়ল অর্ধেকখানি রুটির কথা। দুপাশে হাতড়াল ও। না, রুটিখানা ওর কোলের উপরই পড়ে রয়েছে।
তাঁবুর পেছনেই কল, মুখ হাত ধুয়ে চিবিয়ে রুটিটা খেল মালু। তারপর কলের মুখে মুখ লাগিয়ে পানি টানল। দিনের মতো ভরিয়ে নিল পেটটা।
ক্যাম্পের অফিস ঘরটার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল মালু।
সবুজ মলমূলের উপর চাঁদতারা আঁকা ভলান্টিয়ারের গোল ব্যাজ বুকে এঁটে ঘর-বারান্দা করছে রাবু। নিজের ময়লা পোশাকের দিকে তাকাল মালু। এ পোশাকে রাবুর সুমুখে পড়লে রক্ষে নেই। অফিস ঘরটি এড়িয়ে পেছনের চওড়া বারান্দাটার দিকে গেল মালু। কিন্তু ততক্ষণ ওকে দেখে ফেলেছে রাবু। ডাক দিয়েছে পেছন থেকে, এই মালু শোন্। যা আশঙ্কা করেছিল মালু তাই হল। ওর ময়লা পোশাক, খোঁচাখোঁচা দাড়ি, অপরিচ্ছন্ন মুখ তেলহীন উস্কোখুস্কো চুল… সবটার উপর একটা শাণিত দৃষ্টি বুলিয়ে নিল রাবু। বলল, কী হয়েছে তোর। মনে হচ্ছে কোনো আস্তাবল থেকে বেরিয়ে এসেছিস?
যারা মানুষ নয় তারা তো আস্তাবলেই থাকে।
কী হল? এমন ঠেস দিয়ে কথা বলছিস যে? একটু অবাকই হল রাবু।
তুমিই বা আমার দারিদ্রকে এমন করে উপহাস করছ কেন? তোমার সামর্থ্য আছে, তুমি রোজ ধোয়া আর ইস্ত্রি করা শাড়ি পরতে পার। আমি পারি না। আমার সামর্থ্য নেই।
মালুর কণ্ঠে ঝাঁঝ। মালুর চোখে ক্ষুব্ধ অনুযোগ।
অবাক হওয়ার ধাক্কাটা সামলে নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে রাবু তাকাল মালুর দিকে, বলতে গেল কিছু। কিন্তু মালু তখনো থামেনি। আসলে তুমি যে সৈয়দ বাড়ির মেয়ে, থাকতে পার ফিটফাট, চলতে পার ছিমছাম, এই আভিজাত্যবোধটা তুমিও ছাড়তে পারনি এখনো।
আর আমি যদি বলি তুই একটা আস্ত অকর্মা। গা আছে, গতর আছে, বুদ্ধিরও কমতি নেই অথচ ভেসে বেড়াচ্ছিস অপদার্থ ভবঘুরের মতো। রাবু প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।
সে জন্য দায়ী আমার জন্ম।
বাজে কথা। তোর জন্ম তোকে বলেনি খেটে খাবি না, রোজগার করবি না।
চুপ করতে হল মালুকে। কেননা ওরা পৌঁছে গেছে দোতলায় ভলান্টিয়ার অফিসে। সেখানে অনেক ভিড়। একটা টেবিলে অনেকগুলো কাগজ ছড়িয়ে রয়েছে। সেখানে চাল, ডাল, আটা, তেল, নুনের হিসেব। কাগজগুলো গুছিয়ে নিয়ে হিসেব করতে বসল রাবু। আমি আসি তাহলে? দরজার দিকে পা বাড়াল মালু।
না বস্। কথা আছে। হিসেব লেখা কাগজের উপর থেকে মুখ না তুলেই বলল রাবু। একটা চেয়ার এগিয়ে দিল মালুর দিকে। চা খাবি? শুধাল রাবু।
পেলে খেতে পারি।
এবার মুখ তুলে মালুর দিকে তাকাল রাবু। হাসল। বলল, এখনো চটে আছিস তুই।
সত্যি চটেছে এবং এখনো চটে আছে মালু। কেননা রাবুর হাসির উত্তরে হাসতে পারল না ও।
একটা মজার জিনিস দেখবি?
কি?
একটা চিঠি। বলেই হাত ব্যাগটা খুলল রাবু। বের করল চিঠিটা।
এগিয়ে দিল মালুর হাতে। চোখ বুলিয়ে গেল মালু :
জানের জান বিবিজান,
দোয়াপর সমাচার এই যে গুজাশতা সালে আপনাকে তিনখানা পত্র লিখিয়াছিলাম। এই সালের শুরুতেও
এক পত্রে দোয়া ফরমাইয়াছিলাম। সেই সমস্ত পত্রে দীন-ই ইসলাম এবং আপনার খসমের প্রতি আপনার
দায়িত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছিলাম। আফসোস আপনার কোনো জবাব পাইলাম না। শুনিলাম আপনি পর্দা কলেজ ছাড়িয়া এখন
সম্পূর্ণ বেপরদা হইয়াছেন এবং বেগানা লোকজনের সঙ্গে হরদম ঘোরাফেরা করিতেছেন (নাউজুবিল্লা…)। আপনি কেন এভাবে নিজের উপর এবং ভবিষ্যতের
আওলাদ ফরজন্দের উপর লানত ডাকিয়া আনিতেছেন আমার আদনা বুদ্ধিতে তাহা বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম
না। আপনি কতবড় নেকবক্ত দরবেশের সাহেবজাদী, কতবড় পীরের জেনানা, এ কথা কী ভুলিয়া গিয়াছেন?
নিশ্চয় আপনার উপর শয়তান ভর করিয়াছে, নচেৎ আপনি কীভাবে এই সব গোনার কাজে লিপ্ত হইতেছেন।
আল্লাহতালা বলেন : কুয়া আনফেসাকুম ওয়া আহলিকুম নারান।
অর্থাৎ তোমরা নিজেকে এবং
পরিজনকে দোযখের ভীষণ অগ্নি হইতে বাঁচাও।
আল্লাহতালার এই সতর্ক বাণী মনে রাখিয়াই আমি আপনাকে
বহুত নসিহত করিয়াছি, চিঠিপত্র মারফত বহুত হেদায়ত করিয়াছি। কিন্তু মনে হইতেছে আল্লাহর
ইচ্ছা ভিন্নরূপ। আপনি সৎপথে ফিরিয়া আসিবেন না এবং মৃত্যুর পর অনন্তকাল দোযখের ভীষণ
অগ্নিতে পুড়িতে থাকিবেন। এই রূপই সাব্যস্ত করিয়াছেন। যাহা হোক স্বামী হিসাবে আমার কর্তব্য
পালনে আমি বিরত হইব না। কেননা বেওকুফ দুরাচারিণী স্ত্রীদের প্রতি স্বামীর কর্তব্য সম্পর্কে
আল্লাহতায়ালাই কোরানে ফরমাইয়াছেন : প্রথমে তাহাকে বুঝাও স্বামী-স্ত্রীর আচার ব্যবহার
ও নারীর আদর্শ ইত্যাদি সম্বন্ধে তাহাকে নসিহত কর, যদি তাহাতেও সে ভালো না হয়, তবে তাহার
বিছানা পৃথক করিয়া দাও, ইহাতেও যদি সে ভালো না হয় তবে তাহাকে শাস্তি দাও।
আপনি যদি আল্লাহ্তালার নির্দেশিত পথে ফিরিয়া না আসেন
তবে অবশ্যই আপনাকে অতি কঠিন শাস্তি পাইতে হইবে। আপনি বিবাহিতা স্ত্রী হইয়াও বৈবাহিক
ধর্ম পালন করিতেছেন না, স্বামীর ডাকে সাড়া দিতেছেন না। উপরন্তু বেগানা মরদদের সহিত
অশোভনভাবে মেলামেশা করিতেছেন।
নিশ্চয় জানিবেন ইহা অতি শক্ত গোনাহ,
এই গোনাহর শাস্তিরূপে দোজখে
হাবিয়ার ভয়ঙ্কর আগুনে আপনাকে চিরকাল জ্বলিয়া খাক হইতে হইবে। হে মূঢ় বালিকা।
ইহাতেও কী তোর
চৈতন্যোদয় হইবে না? এখনও কী তুই স্বামীর মহব্বতে ফিরিয়া আসিবি না? এখনও তুই কী স্বামীর
নির্দেশ অমান্য করিবি? তুই কী আল্লাহতালাকে ভয় করিস না? তুই কী দোজখের আগুনকে ভয় করিস
না?
দিলের দিল জানের জান ছোট বিবিজান।
আপনার সমস্ত অপরাধ আমি অতীতেও ক্ষমা করিয়াছি, এখনও
ক্ষমা করিতে পারি। কেননা আপনার খানদানকে আমি পছন্দ করি, আপনাকে মহব্বত করি। এই কারণেই
আপনাকে আমি শক্ত কোনো বদদোয়া
অথবা কোনো লানত দিতে পারি
না। এই কারণেই, কখনো আল্লার
দরবারে ফরিয়াদের হাত উঠাইলেও আবার সে হাত নামিয়া আসে। আপনি চিরকাল দোজখের আগুনে পুড়িবেন,
এ কথাটা আমি কল্পনা করিতে শিহরিয়া উঠি। আমার দিলে সদমা পয়দা হয়। অতএব পত্র পাওয়া মাত্র চলিয়া আসিবেন। এই পত্রের উত্তর
লিখিবেন। সাতদিনের মধ্যে আপনি না আসিলে অথবা আপনার কোনো চিঠিপত্র না পাইলে আমি স্বয়ং কলিকাতা আগমন করিব।
আর একটি কথাও আপনাকে জানান প্রয়োজন মনে করিতেছি।
আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন আপনার বড় আপা অর্থাৎ আমার বড় বিবি এন্তেকাল ফরমাইয়াছেন। তাহার
অবর্তমানে সংসার ছারেখারে যাইতেছে। কেননা আপনার অন্য আপারা একেবারেই নালায়েক। তাহা
ছাড়া আমারও সেবা শুশ্রূষার
দরকার। আপনি আসিলে সব দিক দিয়াই উত্তম। সর্ব শেষে সর্বশক্তিমান আল্লাহতালা যিনি মালেকুল
মউত গায়েবুল গনি, তাঁহার নিকট দোয়া চাহিতেছি তিনি যেন আপনার নাপাক দিল সাফ করিয়া দেন,
আপনাকে নেকপথে পরিচালিত করেন, শয়তানের কুপ্রভাব হইতে আপনাকে রক্ষা করেন।
ইতি
আলহাজ্জ শাহসুফি গোলাম হায়দার মোহাদ্দেদী।
ছোটবেলার কথা মনে পড়ল মালুর। গোনাহর কথা শুনলে ভয় পেত মালু। দোজখের জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের কাহিনী শুনে শিউরে উঠত। আর রাবু, আরিফাকে গোনার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য কত ব্যাকুল প্রার্থনায় চোখের পানি ফেলত মালু।
মালু দেখল ছোটবেলার অনেক বিশ্বাস, অনেক সংস্কার আর মোহ যেমন ভেঙে গেছে তেমনি ভীতি নামক বস্তুটাও কখন অদৃশ্য হয়েছে মনের কোণ থেকে। মালুর হৃদয়টা আজ দুর্বোধ্য কোনো ভয়ে কেঁপে কেঁপে আড়ষ্ট হল না, মালুর চোখের কোণে আজ প্রার্থনার জল জমল না। মালুর চোখের ক্ষতে আজ ঘৃণার আগুন। অজস্র শিখায় জ্বলে উঠল সে আগুন। রাবু আপা। কেন তুমি বিদ্রোহ কর না? কেন এই অত্যাচার সহ্য করে চলেছ তুমি? এ অন্যায়ের প্রতিবাদ শুনি না কেন তোমার কণ্ঠে?
আশ্চর্য! রাবু হাসছে আর আঙ্গুলের ইশারায় চুপ করতে বলছে মালুকে। রাবুর নিস্পৃহতা অসহ্য। মালু বুঝি কেঁদে ফেলবে! প্রায় কান্নার মতোই শুধাল, কেমন করে তুমি হাসতে পার রাবু আপা। তোমার কী ঘৃণা নেই? বর্বরকে, কুৎসিতকে তুমি ঘৃণা কর না?
ঘৃণা আছে বলেই তো হাসতে পারি। এবারও হাসল রাবু। হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে ক্যাম্প রেজিস্টারটা টেনে নিল।
এই উত্তরের প্রত্যুত্তরে আরও অনেক প্রশ্ন ঠেলে আসে। মালুর ক্রোধ শান্ত হয় না। কিন্তু এক দঙ্গল মেয়ে ভলান্টিয়ার ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতর, শুরু করেছে উড়ো কথার কিচিরমিচির। কে একটা স্লিপ এগিয়ে দিয়েছে রাবুকে, অফিসে ওর তলব পড়েছে।
যাসনে কোথাও। এখুনি আসছি আমি। মালুকে বসতে বলে একতলার সিঁড়ি ধরে নেবে গেল রাবু।
মালুর উপস্থিতি সম্পর্কে এতক্ষণে বুঝি সজাগ হয়েছে মেয়েগুলো। তাই চুপ করে গেছে ওরা। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মালু অবরোধের দেয়াল ভেঙে এই প্রথম ওরা বেরিয়ে এসেছে পৃথিবীর মুক্ত অঙ্গনে। বুঝি তাই ঠোঁটে ওদের কথার খই, মুখে ওদের আলোর দীপ্তি, ওদের চোখে বিস্ময়। নতুন পাওয়া স্বাধীনতার উচ্ছলতা ওদের সর্ব অঙ্গে, ওদের হাসির ফোয়ারায়।
যেমন নেবে গেল সিঁড়ি ধরে তেমনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উঠে এল রাবু। বলল, চল, বাসায় ডাক পড়েছে। জরুরি টেলিফোন।
কে ডেকেছে, কেন ডেকেছে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও রাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল মালু। অস্বাভাবিক গম্ভীর রাবু। সিঁড়ি দিয়ে উঠবার পথে কে যেন ওর মুখের সমস্ত রক্ত টেনে নিয়েছে। ওর মুখটা কাগজের মতো সাদা।
বৈঠকখানায় পা রেখে ওরা চমকে উঠল, থমকে দাঁড়াল।
বৈঠকখানার গালিচার উপর জায়নামায বিছিয়ে বসে আছেন আলহাজ্জ শাহসুফি গোলাম হায়দার মোজাদ্দেদী সাহেব। দুপাশে তাঁর দুই খাদেম। সারা ঘর সৈয়দ বাড়ির ছেলে মেয়েতে ভর্তি। খবর শুনে আরিফাও এসেছে ইঞ্জিনিয়ার স্বামী, দুই ছেলে, তিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। যে যেমনটি পেরেছে কোনোরকম জায়গা করে বসে গেছে ঘরে, কারো মুখে রা নেই। সৈয়দদের মেজ বৌ, সেও আজ দুচোখে বিস্ময় ফুটিয়ে নির্বাক হয়েছে, জড়োসড়ো বসে আছে ভিড়ের ভেতর।
সারা বাড়িতে সৈয়দ সাহেবই একমাত্র চলমান মানুষ, এ ঘর ও ঘর করছেন, কী করবেন কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। অবশেষে পাকঘর থেকে বের করে এনেছেন কালিঝুলিতে একাকার শতজীর্ণ একট তালপাখা। মাথার উপর ঘূর্ণায়মান বিজলী পাখার অস্তিত্ব সত্ত্বেও তাল পাখাটা জামাতাজির খাদেমের হাতে তুলে দিয়ে যেন হাঁপ ছাড়লেন সৈয়দ সাহেব।
ওদিকে সৈয়দগিনী স্বহস্তে শরবত বানাতে গিয়ে দু দুবার গ্লাস ভেঙেছেন। অতঃপর দাসীর হাতে শরবতের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ভাড়ার ঘরে আত্মগোপন করেছেন।
অবাক মানে মালু। সেই দীর্ঘদেহ, উন্নত নাসিকা, গৌরবর্ণ নূরানী চেহারা; মেহেদী রং দাড়ি, মেহেদী রং বাবরি, যেমনটি দেখেছিল এক যুগ আগে ঠিক তেমনটি দেখছে আজো।
সুঠাম দেহটিকে জড়িয়ে সেই অপরূপ অলংকার-ধবধবে চাপকান বুটিদার চোগা। সেই আতরের সুবাস। শুধু কাছে এসে, তীক্ষ্ণ চোখে, একটু খুঁটিয়ে দেখলেই বুঝি ধরা পড়ে যায় মোজাদ্দেদী সাহেবের ফাঁকিটা।
নজরে পড়ে তার চোখের কোলে চিতিপড়া কুঞ্চিত চাম, কপালের কুঞ্চন রেখায় বয়সের ছাপ। কিন্তু সে বয়স কত হবে? পঞ্চাশও হতে পারে সত্তরও হতে পারে। তার চেয়ে বেশিও হতে পারে। অবাক মানে মালু, কেমন করে বয়সকে ফাঁকি দিয়ে চলেছেন মোজাদ্দেদী সাহেব?
ছোটবেলায় সাপের চোখ দেখেছে মালু। তীব্র তীক্ষ্ণ অস্থির সন্দিগ্ধ। সাপের চোখ এক মুহূর্ত কোথাও স্থির থাকে না। ওর মনে হল অনেকদিন পর আবার সাপের চোখ দেখছে ও। কারো মুখের উপর, কোনো কিছুর উপর এক মুহূর্তও স্থির থাকছে না মোজাদ্দেদী সাহেবের চোখ। ঘরের প্রতিটি নরনারীকে, প্রতিটি শিশুকে, প্রতিটি আসবাবকে মুহূর্ত দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় দংশন করে চলেছেন, ঘরময় এক ভীতি বিহ্বল সম্মোহনের কালো পর্দা বিস্তার করে রেখেছেন মোজাদ্দেদী সাহেব। মোজাদ্দেদী সাহেবের চোখে চোখ রাখতে পারে এমন মানুষ বুঝি পৃথিবীতে নেই। কিন্তু মোজাদ্দেদী সাহেবের নূরানী মুখটা আসলে নিস্পৃহ, কোনো নিরাকারের ধ্যানে শান্ত সমাহিত। ক্রোধ নেই, ঘৃণা নেই, খেদ নেই, লোভ নেই, প্রেম নেই সে মুখে। শুধু আছে প্রোজ্জ্বল সেই নূরানী চমক, গৌরবর্ণ চামড়ার গায়ে সুখাদ্য, সুস্বাস্থ্য ও সুখী জীবনের টকটকে আভা।
মোজাদ্দেদী সাহেবের হাতে তসবি। ঠোঁটের মৃদু কম্পন থেকে বোঝা যায় তিনি দরুদ পড়ছেন।
মোজাদ্দেদী সাহেবের সেই সাপের চোখ এক মুহূর্তের জন্য, শুধু এক মুহূর্তের জন্য রাবুকে দেখল। আবার যেমন ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল তেমনি ঘুরে চলল। মোজাদ্দেদী সাহেবের মুখে কী কোনো ভাবান্তর এল?
মনে হল না। শুধু শোনা গেল তিনি বলছেন তারই এক খাদেমকে লক্ষ্য করে তওবা, তওবা, ইয়ে কেয়া জামানা আগিয়া। এতনা বড়া সৈয়দ কামেল আলেম আওর দরবেশকা লাড়কী বেপর্দা ঘুরতা ফিরতা হ্যায়। সেরপর থোড়া কাপড়া ভি নেহী হ্যায়। আওর বেগানা মরদ কা সাথ? তওবা তওবা নাউজুবিল্লাহ্ …।
বেগানা মরদ মালু একবার তাকাল রাবুর দিকে। কী ভাবছে রাবু? হয়ত ওর হৃদয় জুড়ে আজ আগুনের ঝড়, আদিম পৃথিবীর সেই অগ্নিমথিত কান্না। হয়ত ওর হৃদয়টা একেবারেই নিস্তরঙ্গ। কোনো ক্ষোভ নেই, ঘৃণা নেই, আলোড়ন নেই সেখানে, আছে শুধু নিঃসাড় করা জমাট ভয়ংকর এক স্তব্ধতা। হয়ত ভাববার চিন্তার সমস্ত শক্তিই লোপ পেয়েছে ওর।
আশ্চর্য। এর মাঝেও মোজাদ্দেদী সাহেব আর তার দুই খাদেমকে চোখ বুলিয়ে দেখল রাবু। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখল তারপর ভিড় কেটে চলে গেল ভেতরে।
পৃথিবীতে এমন লোক কিছু রয়েছে যে কোনো অঘটনের সময় মাটি খুঁড়ে যারা উঠে আসবেই এবং অঘটনের সাথে জড়িয়ে পড়বেই। অন্তত এই মুহূর্তে জাহেদকে দেখে তাই মনে হল মালুর।
বগলভর্তি ফাইল, হনহনিয়ে এল জাহেদ। বৈঠকখানার ভিড়টা দেখে একবার থমকে দাঁড়াল। তারপর বাড়ির চাকরটাকে উচ্চৈঃস্বরে ডাকতে ডাকতে চলে গেল ভেতরে।
আর একদিনের কথা মনে পড়ল মালুর। সেদিনের মতো ক্রুদ্ধ রাগে জাহেদ কী ফেটে পড়বে না? জামাতাজীকে চ্যাংদোলা করে তুলে দিয়ে আসবে না শিয়ালদ স্টেশনে?
একপা দুপা করে জাহেদের ঘরে এসেই বসল মালু। বিছানায় উপুড় হয়ে কী যেন লিখছে জাহেদ। মালুকে হয় দেখল না নতুবা দেখেও গ্রাহ্য করল না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল মালু। হাই তুলল। বার দুই কাসল তারপর উঠে গিয়ে একটা বই তুলে নিল শেলফ থেকে। বইয়ের পাতা ওল্টাল খস খসিয়ে। কিন্তু অত করেও জাহেদের দৃষ্টিটা আকর্ষণ করা গেল না। অবশেষে মরিয়া হয়েই বলল মালু, এসেছে তো!
জাহেদ তখন লেখাটা শেষ করে কতগুলো সাদা কাগজ টেনে নিয়েছে, সাদা কাগজগুলোর পিঠে পিঠে কার্বন সাজিয়েছে। তারপর কলম ফেলে পেন্সিল টেনে নিয়েছে।
এসেছে তো! আবারও বলল মালু।
দেখলাম তো! বলল এবং একপলক মালুর দিকে চাইল জাহেদ। আবার কপিতে মন দিল।
বিস্মিত হল, ক্ষুব্ধ হল, ক্রুদ্ধ হল মালু। এই দুর্যোগের দিনে কেমন করে নির্লিপ্ত থাকতে পারে জাহেদ?
মেজো ভাই! তুমি কিছুই করবে না? কিছুই বলবে না? চেঁচিয়ে উঠল মালু।
যেন বিরক্ত হয়েছে এমনিভাবে কার্বন আর কাগজগুলো গুটিয়ে ব্যাগে ভরে নিল জাহেদ। বলল সত্যি মালু, তুই এখনো একেবারেই ছেলেমানুষ রয়ে গেছিস। আজ যে আমার কোনো কিছু বলার উপায় নেই, সেটা, দেখতে পাচ্ছিসনে তুই? তুই কী দেখছিস না, এ নৃশংসতার যে বলি তার কণ্ঠে প্রতিবাদ নেই, তার চোখে ঘৃণা নেই?
আশ্চর্য! শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে জাহেদের গলাটা কেঁপে গেল। অবরুদ্ধ অভিমানে অথবা আপন অসহায়তার বেদনায় ও বুঝি এখনি ভেঙে পড়বে। অবাক হল মালু। বক্তৃতার গলা শ্লোগানের গলা জাহেদের। এ গলা মিটিংয়ে মঞ্চে ঝড় তুলেছে, তর্কে বিক্ষোভে আবেগে উচ্ছ্বাসে আগুন ধরা বারুদের মতো বিস্ফোরিত হয়েছে। সেখানে কোথায় লুকিয়েছিল এই করুণকম্পন এই দুর্বলতা? তবু বলল মালু, সেদিনও তো প্রতিবাদ করেনি রাবু আপা।
সেটা ছিল ১৯৩৭ সাল। আজ ১৯৪৬ সাল। সেদিন নিজের ভালো মন্দ বুঝবার মতো বয়স বুদ্ধি কোনোটাই ছিল না ওর। আজ ওর বিবেক ওর কর্তব্যবোধ সব কিছু নিয়ে ওর যে জীবন তার মালিক একমাত্র সে-ই। ও যা করবে তাই তো হবে। আমি কী ওর উপর কিছু চাপিয়ে দিতে পারি? একান্ত যুক্তিসংগত কথা, পরিণত মনের কথা। তবু কথাগুলো বলতে গিয়ে গলাটা আবার কাঁপল জাহেদের! কেন কাঁপল? ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হয়ত তারই উত্তর খুঁজছিল আর কী যেন বলতে যাচ্ছিল মালু। কিন্তু বলা হল না। সমস্ত বারান্দাটা তোলপাড় করে এল রাবু, এসে তছনছ করল জাহেদের আলনাটা।
কী খুঁজছিস? কেমন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল জাহেদ।
তোয়ালে। কী করেছ আমার তোয়ালে?
তোয়ালে? আমি নিয়েছিলাম নাকি? তেমনি ভয়ে ভয়ে বলল জাহেদ।
একশো বার বলেছি নিজের জিনিস নিজে সামলে রেখ। আমার তোয়ালে আমার সাবানে হাত দেবে না। তবু যদি আক্কেল হয় একটু। যতসব অনাসৃষ্টি অভ্যেস। এর তোয়ালে, ওর লুঙ্গি আর একজনের জামা, হাতের কাছে যা পড়ল, বলা নেই কওয়া নেই একটু জিজ্ঞেস করা নেই, অমনি গায়ে জড়িয়ে নিলেন সাহেব। এমন নোংরা অভ্যাসও মানুষের হয়? ছিঃ! রাবু চেঁচায় আর তছনছ করে ঘরের যত জামা-কাপড়। অবশেষে বাথরুমে পাওয়া গেল তোয়ালেটা আর সাবানের কৌটোটাও। জিনিসগুলো নিয়ে যেমন তোলপাড় করে এসেছিল তেমনি ঘরটা তোলপাড় করে চলে গেল রাবু।
কী যেন বলতে এসেছিলেন জাহেদের আব্বা সৈয়দ সাহেব। কিন্তু রাবুর ওই ক্রুদ্ধ মূর্তিটার মুখোমুখি হয়ে কোনো কথা সরল না তাঁর মুখ দিয়ে। শুধু ঘর আর বারান্দার মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে দেখলেন রাবুকে, দেখলেন জাহেদ আর মালুকে। কেন যেন একবার তাকালেন এদিক ওদিক, বুঝি দেখে নিলেন আর কেউ আছে নাকি কাছাকাছি। ইতস্তত করলেন। একটু সাহস সংগ্রহ করলেন। তারপর বিশেষ কাউকে নয়, ওদের তিনজনকে অথবা গোটা বাড়িটাকেই উদ্দেশ্য করে বললেন, এই প্রথম এল জামাইটা। বুজুরগ পরহেজগার আল্লাপরস্ত লোক, তাকে বৈঠকখানাতেই বসিয়ে রাখবে? একবার ভেতরেও আনবে না?
না করছে কে আব্বা? ঘর থেকে শোনা গেল জাহেদের উত্তর।
এক মুহূর্তও আর দাঁড়ালেন না সৈয়দ সাহেব। দ্রুত উঠে গেলেন দোতলায়।
তাঁর নিজের মনের দ্বিধাকে তিনি কেমন করে লুকিয়ে রাখবেন?
রাবু বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে বারান্দায়। এক হাতে ওর ছোট একটা সুটকেস, আর এক হাতে লম্বা ঝোলা। পেছনে চাকরের মাথায় বেডিং।
কোথায় চললে রাবু আপা?
সুটকেসটা ধরতো! প্রশ্নের জবাব দিয়ে ওর হাতে সুটকেসটা তুলে দিল রাবু।
বৈঠকখানার সবগুলো চোখ স্তব্ধ বিস্ময়ে দেখল রাবুকে। দেখল ওর হাতের ব্যাগটা, পেছনে মালু, তার পেছনে বেডিং মাথায় চাকরটাকে মোজাদ্দেদী সাহেবও দেখলেন।
কেউ চোখ ফিরিয়ে দেখল না। মোজাদ্দেদী সাহেবও না।
কারও দিকে, কোনো দিকে তাকাবে না, সোজা বেরিয়ে যাবে, হয়ত তা ভেবেছিল রাবু। কিন্তু মোজাদ্দেদী সাহেবের দৃষ্টিকে বুঝি কেউ কখনও পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনি। রাবুও পারল না। ঘরের মাঝামাঝি এসে থমকে দাঁড়াতে হল ওকে। মোজাদ্দেদী সাহেবের চোখজোড়া সাঁড়াশির মতো গেঁথে নিয়েছে ওকে।
মালু দেখেছে সাপের চোখ, আপন ক্রূরতায় সদা চঞ্চল সদা অস্থির। কিন্তু মালু দেখছে শিকারের মুখোমুখি, ছোবলের পূর্ব মুহূর্তে স্থির, তীরের ফলার মতো তীক্ষ্ণ সে চোখ। সে চোখের মতো ভয়ংকর কিছু নেই পৃথিবীতে। এ ভয়ংকর দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে রাবু বুঝি এগুতে চাইল এক পা।
ঠ্যারো।
রাবুর পা-টা যেমন উঠিয়েছিল বুঝি তেমনি রয়ে গেল।
ঠ্যারো বাত শুনো। ক্রুদ্ধ গর্জনে ফেটে পড়লেন মোজাদ্দেদী সাহেব। কয়েকটি মুহূর্ত সেই গর্জনের প্রতিধ্বনিটা ঘরের মেঝেতে আছড়ে পড়ে বুঝি ভূমিকম্প সৃষ্টি করে গেল।
কোথায় যাচ্ছেন আপনি? সহসা কণ্ঠটাকে স্বাভাবিক করে সাফ বাংলায় শুধালেন মোজাদ্দেদী সাহেব!
পা কাঁপছে রাবুর। হয়ত এখনি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে মাটিতে। হয়ত কিছু বলল ও। কিন্তু-শোনা গেল না কিছু।
এখানে বেগানা মরদ আছে। আমার খাদেমরা আছে। আপনি মাথায় ঘোমটা দিন। এবার একটা আদেশ দিলেন মোজাদ্দেদী সাহেব।
পা এখনও কাঁপছে রাবুর। মুখ রক্তহীন। কপালে ঘাম। এখুনি বুঝি সংজ্ঞা হারাবে রাবু। ওর শক্তি ফুরিয়ে এসেছে।
ঘোমটাটা দিন। আরও উচ্চৈঃস্বর হল মোজাদ্দেদী সাহেবের আদেশ।
আশ্চর্য! ঘামজমা কপালের নিচে রাবুর চোখ দুটো সহসা যেন জ্বলে উঠল এক জোড়া আগুন পাওয়া বারুদের মতো। জ্বলে উঠে স্থির হল সেই সাপের চোখের উপর!
ওর তিক্ত অতীত আর অজানা ভবিষ্যৎ–বুঝি তারই মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে রাবু। মোজাদ্দেদী সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বুঝি ভয়কে জয় করল রাবু।
রাগে ফুলছেন, ক্ষেপছেন মোজাদ্দেদী সাহেব। এবার চেঁচিয়ে উঠলেন মোজাদ্দেদী সাহেব, এখনও খসমের নির্দেশ অমান্য করছেন আপনি? আমি বলছি আপনি মাথায় কাপড় দিন।
না।
না। একটি শব্দ। যেন একটি বজ্রের বিস্ফোরণে কাঁপিয়ে গেল সারা ঘরটা, ঘরের লোকগুলোকে, মোজাদ্দেদী সাহেবকেও।
একমুহূর্তও দেরি করল না রাবু। প্রায় দৌড় নেবে এল রাস্তায়।
৪২.
উঠতি মুসলিম মধ্যবিত্তের এলাকা পার্ক সার্কাস। হিন্দুও ছিল, সংখ্যায় তারা কম। কিছু কাটা পড়ছে দাঙ্গায়। বাকীরা উঠে গেছে বালিগঞ্জ অথবা ভবানীপুর।
পার্ক সার্কাসে নতুন করে পত্তন হয়েছে মন্নুজান হোস্টেলের। হোস্টেলেই ফিরে এসেছে রাবু।
হোস্টেলের জীবনটা ভালো লাগে আমার। পড়ি। কাজ করি। নিজের মতো করে থাকি। আত্মীয়স্বজন কারও তোয়াক্কা রাখিনে।
সাবাস! এই তো যুগের কথা, নতুন যুগের নতুন নারীত্বের কথা। খুশি হয়ে রীতিমতো হাততালি দেয় মালু।
চুপ করতো। দিনে দিনে ফাজিল হয়ে উঠছিস তুই। ধমক ছাড়ল রাবু। রাবু চটেছে। সেদিনও চটেছিল।
মোজাদ্দেদী সাহেবের মুখের উপর অমন একটা না ছুঁড়ে মেরে রাবু যখন নেবে এসেছিল রাস্তায়–মালু মনের খুশিটা ধরে রাখতে পারেনি। বলেছিল এর নাম বিপ্লব। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।
কটমটিয়ে তাকিয়েছিল রাবু। তারপর কিছু দূরে দাঁড়ান ফিটন গাড়িটার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলেছিল, গাড়িটাকে ডাক। মালগুলো তোল। মালুর দুরন্ত কৌতূহল। রাবুর হোস্টেলের সিঁড়িতে মালগুলো নাবিয়েই ও ফিরে এসেছিল পার্ক স্ট্রীটের বাড়িতে।
পার্ক স্ট্রীটের বাড়ির সামনে তখন ট্যাক্সি দাঁড়িয়েছে। সদরে ট্যাক্সিতে উঠবার আগে মোজাদ্দেদী সাহেব ছোটখাট একটা ভিড়ের সৃষ্টি করে ফেলেছেন রাস্তার পাশে। সৈয়দবাড়ির বুড়োবুড়ি ছেলেমেয়েদের চরিত্র ইমান আর ধর্ম সম্পর্কে অত্যন্ত খোলাখুলি ভাবে স্বীয় অভিমত ব্যক্ত করছেন মোজাদ্দেদী সাহেব। রাবু সম্পর্কেও তাঁর আখেরী মতামতটা প্রকাশ করছেন, এই আউরত কসবী হয়ে গেছে, তাকে নিয়ে আপন অন্দরমহলের পবিত্রতা নষ্ট করবেন না মোজাদ্দেদী সাহেব।
বাড়ির ভেতর জাহেদকে খুঁজে পায়নি মালু। রাবুর পিছু পিছুই বেরিয়ে গেছিল ও।
অবাক হয়েছিল মালু। রাস্তার লোক উপভোগ করছিল মোজাদ্দেদী সাহেবের জবান। সৈয়দবাড়ির কেউ প্রতিবাদ করছিল না, দরজায় খিল এঁটে কী এক বিহ্বল আতংক আর ভয়ে জড়োসড়ো বসেছিল সবাই।
ভিড় ভেঙে মালুই এগিয়ে এসেছিল। মোজাদ্দেদী সাহেবকে ঠেলে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছিল।
এরপর ক্যাম্পে রাবুর সাথে দেখা হয়েছিল মালুর। ঘটনাটা বলেনি মালু। আজ বলল।
নিঃশব্দে শুনল রাবু। চুপচাপ পথ চলল। ওরা হাঁটছে ব্রাবোর্ন কলেজের ক্যাম্পের দিকে।
মাস্টার সাহেবকে মনে আছে তোর? হঠাৎ শুধাল রাবু।
বাহ্, কেন মনে থাকবে না?
মাস্টার সাহেব বলতেন, এই তো, এইতো সমাজের চেহারা। এ চেহারাটা পাল্টাতে হবে।
খাঁটি কথা। সায় দেয় মালু।
এখানে সেখানে ব্যক্তিগত প্রতিরোধ তখনই সার্থক যখন সেটা রূপান্তরিত হয় সমষ্টিগত প্রতিবাদে।
মালু পুরোপুরি সায় দিতে পারল না রাবুর কথায়। বলল, সার্থকতার কথা পরে। কিন্তু ছোট ছোট ব্যক্তিগত প্রতিরোধগুলোই তো সমষ্টিকে অনুপ্রাণিত করে। যেমন ত্যাগ, একের ত্যাগ অন্যকে প্রেরণা জোগায়।
রাবুর উত্তরটা শোনা গেল না। ওরা পৌঁছে গেছে কলেজের চত্বরে। সেখানে চত্বর আর বারান্দা জুড়ে রীতিমতো এক জটলা।
ভিড় এড়িয়ে রাবু উঠে গেল উপরে। জটলার ভেতরেই দাঁড়িয়ে পড়ল মালু।
দেখুন, আমি রায়টের বিরুদ্ধে। মানুষের শুভবুদ্ধি কখনো সায় দিতে পারে না এই অমানুষিক হানাহানির পক্ষে। কিন্তু, শুধু নিন্দে করলেই কী দাঙ্গা থেমে যাবে? থামবে না। আপনাকে যেতে হবে গভীরে, খুঁজে বের করতে হবে এ দাঙ্গার অন্তর্নিহিত কারণ। দৃঢ় সংযমে ধীরে ধীরে কথাগুলো বলছেন রাকীব সাহেব। সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্ত, ভেদবুদ্ধি। এটাই তো এ দাঙ্গার অন্তর্নিহিত কারণ। কিন্তু আমরা তো চোখে ঠুলি এঁটেছি। কিছুই দেখব না বলে মনস্থির করেছি। হাত নেড়ে নেড়ে জবাব দিচ্ছে অন্য বক্তা। মালু তাকে চেনে না।
বক্তার কথায় বুঝি অসহিষ্ণুতা, তাই একটু হাসলেন রাকীর সাহেব। বললেন : এই তো মুশকিল তোমাদের নিয়ে। এ্যালজেব্রার ফরমুলায় ফেলে সব সমস্যার সমাধান খোঁজ তোমরা। এই যে মুসলমান জাতটা, খাস বাংলাদেশে, প্রায় দুশটি বছর ধরে এত অবিচার এত অসম্মান কুড়িয়ে আসছে তার সমস্ত দোষ কী ইংরেজের ঘাড়ে চাপিয়েই সন্তুষ্ট থাকবে তোমরা? স্বীকার করি পরাধীনতার যত কুফল সবই আমাদের রোয়ায় রোয়ায়, কিন্তু আসন্ন স্বাধীনতার সনদে আমাদের নিরাপত্তা, আমাদের নিজস্ব বিকাশের গ্যারান্টি যদি না পাই…।
এক্সাক্টলী। পার্কসার্কাসটাকে বালীগঞ্জ বানাও, বেশি বেশি মুসলমানকে ডেপুটি বানাও রাইটার্স বিল্ডিংয়ের বড় বড় চেয়ারে কিছু মুসলমান বসাও, আপনার মতে তা হলেই সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। আমিও হয়ত ওখানে একমত আপনার সাথে; কেননা আপনার আমার মতো মধ্যবিত্তের সমস্যাটা একান্ত চাকরির সমস্যা। কিন্তু রহিমুদ্দী, সলিমুদ্দী অগুনতি খেটে খাওয়া মানুষ, তাদের কী হবে। হিন্দু বা ইংরেজকে হটিয়ে আমি কলিমুল্লা আপনি সলিমুল্লা, ম্যাজিস্ট্রেট হলে ডাণ্ডাটা কী ওদের মাথায় একটু আস্তে মারব? আপনার ভাই আলিমুল্লা যদি কেশোরাম জুট মিলের পাশে আর একটি রহিম জুট মিল বসায় সে কী শ্রমিকগুলোকে কম শোষণ করবে?
দমবার পাত্র নন রাকীব সাহেব। নির্বিচলভাবে আগের কথাটাই শেষ করলেন তিনি। আমরা মুসলমান। নিজেদের আচার রীতি, নিজেদের মানস দিয়ে গড়ে তুলতে চাই নিজেদের জীবনটা। দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় যতদিন আমাদের এই জন্মগত অধিকারে স্বীকৃতি না দেবে ততদিন এই ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা চলতেই থাকবে। এটা কী বুঝছ না তুমি? অপর বক্তার উত্তরটা যেন তৈরিই ছিল। রাকীব সাহেব থামতে না থামতেই বেরিয়ে এল উত্তরটা : আমরা মাথা ফাটাফাটি করে মরি। ওদিকে মজাসে রাজত্ব করুক ইংরেজ, এই তো?
তা নিজেদের ঘর যদি সামলে না উঠতে পারি রাজত্ব ওরা করবেই তো? নিজেদের সমস্যা আর বিরোধগুলো যদি আমরা নিজেরা নিস্পত্তি করতে না পারি তবে বলব আমরা স্বাধীনতার উপযুক্ত হইনি এখনো।
কিন্তু সমস্যার গোড়ায় তো ইংরেজের অনুচরগুলোই ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে রাকীব ভাই। আর আমরা হিন্দু মুসলমান খেলছি তাদের হাতে। আমরা শত্রুকে ভুলে গেছি, ছুরি মারছি ভাইয়ের বুকে। এ তো মহাপাপ, রাকীব ভাই। স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে এর চেয়ে জঘন্যতম কোনো অপরাধ হতে পারে কী? কী জবাব দেব আমরা ভাবী বংশধরদের?
আবেগ উন্মথিত কণ্ঠ ছেলেটির। ক্ষণকাল নিঃশব্দ চমকে ওকে দেখলেন রাকীব সাহেব, কী যেন বলতে গেলেন। কিন্তু অসংখ্য কাকলী গুঞ্জনে চাপা পড়ে যায় তাঁর কথাগুলো।
প্রজাপতির ঝাঁকের মতো এক দঙ্গল মেয়ে এসে ঘিরে ধরেছে রাকীব সাহেবকে।
ভীষণ ফাঁকি দিচ্ছেন, রাকীব ভাই! একদিনও এলেন না রিহার্সালে। গানগুলোর কী হবে বলুন তো?
রাকীব ভাই, আপনি কী ডোবাবেন আমাদের?
আজ কিন্তু ছাড়ছি না আপনাকে।
ওদের সব অভিযোগের জবাবে সরল চোখের মিষ্টি দৃষ্টি দিয়ে হাসেন রাকীব সাহেব। ওই স্মিত হাসিটাই বুঝি ওদের নিরস্ত্র করতে যথেষ্ট।
মেয়েদের ছেড়ে সেই তার্কিক ছেলেটির দিকেই আবার তাকালেন রাকীব সাহেব। উৎফুল্ল কণ্ঠটাকে বেশ উঁচু মাত্রায় তুলে বললেন, দেখ হে, দেখ। দেখে শেখ। মুসলমান মেয়েরা নাটক করছে। ঘরের কোণে জেনানা দর্শকের জন্যে নয়, একেবারে খোলা ময়দানে তোমার আমার সকলের জন্য। সেই যে কোন্ পত্রিকায় না লিখেছে, ক্ষুদে পাকিস্তান জিন্দাবাদ, তার অর্থটা এবার হৃদয়ঙ্গম করতে পারছ তো? নতুন শক্তির বাধন ছিঁড়েছে, তাকে রুখবার শক্তি মোল্লাদেরও নেই, তোমাদেরও নেই। বুঝে নাও কথাটা।
কথাটা শেষ করেই এমন এক কাণ্ড করে বসলেন রাকীব সাহেব যার জন্য প্রস্তুত ছিল না মালু। ভিড়ের এক কোণে একরকম লুকিয়েই ছিল মালু। তবু বুঝি এড়াতে পারেনি রাকীব সাহেবের দৃষ্টি।
ওহে দূরে দূরে কেন, এদিকে এসো। ডাকলেন রাকীব সাহেব। তারপর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন : গায়ক আবদুল মালেক। খাঁটি, যাকে বলে একেবারে কাঁচ্চা সোনা, মানে পিউর গোল্ড। শোননি তো ওর গান? শুনলে আর আমার কাছে আসবে না। রিহার্সালটা ও-ই চালিয়ে নেবে। হেরফের হবে না, একদম পাকা ব্যবস্থা।
আদাব দিল মেয়েরা।
প্রতি অভিবাদনে হাতটা তুলতে গিয়েও বুঝি উঠাতে পারল না মালু। বিচিত্রবর্ণা প্রজাপতির মতো এতগুলো অপরিচিতা মেয়ের উৎসুক সন্ধানী চোখের সুমুখে হাত পা বুঝি ঠাণ্ডা হয়ে আসে মালুর।
ওরা একটা থিয়েটার আর একটা বিচিত্রা করছে দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্যার্থে। বুঝতেই পারছ, সকাজ-উদ্দেশ্য মহৎ। গানগুলো তুমি একটু দেখে দিও। নিজেও গাইবে বইকি? ফরজ কাজ কিন্তু, করতেই হবে। বুঝলে তো? মালুর কাঁধে হাত রেখে বললেন রাকীব সাহেব।
সায় না দিয়ে উপায় কী মালুর!
রাকীব সাহেবকে ছেড়ে এবার বুঝি মালুকেই ছেঁকে ধরে মেয়েরা।…
দি সার্কাস রেঞ্জ। রোজ তিনটের সময় রিহার্সাল শুরু হয় আমাদের। ঠিক সময় আসবেন কিন্তু।…ও… চেনেন না? বেশ, চলুন সঙ্গে, চিনে আসবেন।
ওরা কথার খই ফুটিয়ে চলে। মূক মালু ঘেমে একসা।
উঁহু এখুনি ওকে নিয়ে টানাটানি কর না। আমার সাথে জরুরি কাজ ওর। বললেন রাকীব সাহেব। বেরিয়ে এলেন মেয়েদের ব্যুহ ভেঙে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মালু। রঙিন ডানা উড়িয়ে প্রজাপতির ঝাঁকের মতোই বুঝি উড়ে বেরিয়ে গেল মেয়ের দলটা।
রাকীব ভাই, চিরদিনই আপনি ফাঁকিবাজ। দিব্যি সটকে পড়লেন। যেতে যেতে একেবারে শেষ লাইনের মেয়েটি ঘাড় ফিরিয়ে বলল।
সে কথার ধারেও গেলেন না রাকীব সাহেব। চোখ নাচিয়ে ছুঁড়ে দিলেন একটা টিপ্পনিঃ ভুল করেছিসরে হাসিনা। এমন সকালে ছাই রংটা একটু মানায় না। ওটা অপরাহ্ন বেলার বৈরাগ্য রং।
হাসিনা বুঝি হটবার পাত্রী নয়। চিবুক বেঁকিয়ে গ্রীবা দুলিয়ে জবাব দিল ও। পছন্দ হল না তো? বেশ, কাল থেকে কিন্তু খাঁটি গেরুয়া ধরছি আমি।
মুখ ফিরিয়ে নিলেন রাকীব সাহেব।
মেয়ের দঙ্গলটা দূর থেকেই পাঠিয়ে দিল একটা হাসির হরা। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেল দেয়ালের ওপারে, রাস্তায়।
এই শোন্। একটি মেয়ে ভলান্টিয়ার যাচ্ছিল সুমুখ দিয়ে। ওকে ডাকলেন রাকীব সাহেব।
রিলিফ করতে এসেছিস, না প্রেম করতে এসেছিস?
এমন বেয়াড়া প্রশ্নের জন্য বুঝি প্রস্তুত ছিল না মেয়েটি। লজ্জায় লাল হয়ে যায় ওর শ্যামলাপনা মুখ।
মেয়েটির খোঁপায় একজোড়া সাদা টগর। আচমকা হাত বাড়িয়ে ফুল দুটি তুলে নিলেন রাকীব সাহেব, বললেন, যা। ভাগ। ত্রস্তে পালিয়ে বাঁচল মেয়েটি।
হো হো করে হেসে বাতাস ফাটালেন রাকীব সাহেব। মালুর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার এক প্রিয় ছাত্রী।
নির্দোষ হাসি। হাল্কা কৌতুক। কিন্তু সে কৌতুকে যোগ দিতে পারে না মালু। কোথায় যেন বাধে ওর। অথচ, কেমন সহজ অন্তরঙ্গতায় সকালের এক ঝলক উজ্জ্বল রোদের মতো ওই প্রজাপতির ঝাঁকে আপনাকে ছড়িয়ে দিলেন রাকীব সাহেব। এতটুকু আড়ষ্টতা নেই, সংকোচ নেই। আনন্দ বিতরণ আর গ্রহণের এ বুঝি এক দুর্লভ গুণ। সে গুণ নেই মালুর।
জীবনে এই প্রথম কোনো কিছু নেই বলে দুঃখ হল মালুর। আর যার আছে সেই সৌভাগ্যবানের প্রতি কী এক ঈর্ষার আঁচে দগ্ধ হল।
এ যেন এই মহানগরীর এক নতুন আর অভাবনীয় দিক। এখানেই এই ঈর্ষার জন্ম। কেমন কুৎসিত স্থূল আর অসহ্য তার জ্বালা। হৃৎপিণ্ডের কোনো অচিন গহ্বর থেকে উঠে এল সেই ঈর্ষাবোধ, ঘেন্না ছড়িয়ে দিল ওর সর্বাঙ্গে। ক্ষুদ্রতাবোধ, ঘিনঘিনে এক অস্বস্তি আর লজ্জা। মালুর মনে হল এই মহানগরীর মেলায় ও শুধু অপাংক্তেয় নয়, অশোভন।
আচ্ছা লক্ষ্মীছাড়া ছেলে তো তুই। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে সেই যে উধাও হলি, আর দেখা নেই।
বারে, কোথায় উঠেছেন সেটা জানলে তো দেখা হবে?
রাস্তায় নেবে ফুটপাত ধরে হেঁটে চলে ওরা।
কী কাজ ছিল বলছিলেন? শুধাল মালু।
বাসায় তো চল। তারপর ধীরে সুস্থে শুনবি। বললেন রাকীব সাহেব।
ধীরে সুস্থে শোনার আরামটা তো আপনিই কেড়ে নিলেন। তিনটের সময় যেতে হবে ওই মেয়েদের দঙ্গলে। এই ময়লা পোশাকে যাওয়া যায়?
সত্যি তো। তা হলে কী করা যায়? সহানুভূতির ভান করে গম্ভীর হয়ে যান রাকীব সাহেব।
পার্ক স্ট্রীট যাব। সেখান থেকে মেজো ভায়ের একজোড়া পোশাক নিয়ে নেব। এছাড়া আর উপায় কী?
মালুর দুশ্চিন্তা দেখে হাসি বুঝি চেপে রাখতে পারেন না রাকীব সাহেব।
তা হলে আমি যাই। পার্ক স্ট্রীটের মোড়ে এসে ডানমুখো হল মালু।
খবরটা তা হলে শুনবে না? আপনি বলছেন না যে।
আহা ভালো খবর এত তাড়াতাড়ি বলে ফেললে মজা থাকে নাকি? কী যেন রহস্য রাকীব সাহেবের কথায়।
ভালো খবর? বুঝি ধাঁধায় পড়ল মালু।
তোমার রেডিও কন্ট্রাক্ট তিনদিন ধরে পকেটে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। একটা খোলা খাম মালুর হাতে তুলে দিলেন রাকীব সাহেব।
সত্যি? হাতের আঙ্গুলগুলো বুঝি কাঁপছে মালুর।
শুধু হাত নয় বুকের ভেতরটাও কাঁপছে মালুর।
দুরু দুরু বুকে কম্পিত হাতে খামের ভেতরে কাগজটা বের করে আনল মালু। মেলে ধরল চোখের সুমুখে।
মালুর মনে হল এতদিনের সমস্ত যন্ত্রণা সমস্ত লাঞ্ছনা সার্থক। আজ খুলে গেছে মধুময় আনন্দিত জীবনের দুয়ার।
৪৩.
রহস্য বৈচিত্র্যে অনুপম আশ্চর্য সুন্দর এই পৃথিবী। অদ্ভুত এই পৃথিবীর মায়া। সেই যে দৈত্য বিধ্বস্ত মৃতের নগরী কলকাতা সেও বুঝি কাফন খুলে বেরিয়ে এসেছে জীবনের রাজ্যে। জীবনের রক্ত চলাচল তার ধমনীতে। আবার ট্রাম নেবেছে রাস্তায়। গাড়ি ঘোড়া, যন্ত্র আর মানুষের বিচিত্র ঐকতানে আবার মুখর মহানগরী।
সেই যে উন্মাদ খুন খারাবি–সে ছিল যেন হঠাৎ জ্বরের ঘোরে দুর্বোধ্য বিকার। কেটে যাচ্ছে সে বিকারের ঘোর। ছুরির ডগায় শানিয়ে ওঠা যে ভাষা, তার বদলে সহজ প্রেম আর প্রীতির ভাষাটা যেন ফিরে পাচ্ছে মানুষ। নিজের ভাষায় আবার কথা বলতে শুরু করেছে মহানগরীর নাগরিক। এই বুঝি মহানগরীর ঢং। ক্ষণে ক্ষণে তার নতুন রূপ, অভাবনীয় প্রকাশ। অবাক মানে বাকুলিয়ার সেই খোকা বয়াতি আবদুল মালেক। এতদিন আজব আর অপরিচিত মনে হয়েছিল এই শহরটাকে। অবগুণ্ঠিত ছিল তার মোহিনী রূপ। অনুদ্ঘাটিত ছিল তার বিপুল ঐশ্বর্য। তাই তো সেই নরক রাতের পর থেকে মালু কেবলই অভিসম্পাত দিয়ে চলেছিল এই মহানগরীর উদ্দেশে।
কিন্তু আজ?
বিশাল এই নগরীর স্পন্দন ওর আপন সত্তার গভীরে।
মার্ভেলাস। ইউনিক। শৈলেন বাবুই আনন্দে উচ্ছাসে লাফিয়ে উঠেন।
বার বার পিঠ চাপড়ে দেন মালুর।
পর পর প্রোগ্রাম পেল মালু।
অজেয় গ্যাস্টিন প্লেস খোশ আমাদের দ্বার খুলে দিয়েছে ওর জন্য। ওর সাধনার মুখে খড় কুটোর মতো উড়ে গেছে সব বাধা।
মালুর মনে হয়, এতদিনে বুঝি সার্থক ওর নগর-অভিযান। গানের সুরে দূর বাকুলিয়ার সেই সীমাহীন দিগন্তকে মালু টেনে এনেছে এই মহানগরীর ক্ষুদ্র আকাশে। একটি নতুন উপহার পেয়ে যেন কৃতজ্ঞ মহানগরী। বুঝি প্রতিদানে এই মহানগরী বিপুল তার সম্পদ ভাণ্ডার উজাড় করে ঢেলে দিয়েছে তরুণ শিল্পীর পায়ে।
এও বুঝি মহানগরীর কোনো মহাকৌতুক। অজ্ঞাতকে, অক্ষমকে, শক্তিমানকে সবাইকেই সে টেনে নেবে, কিন্তু গ্রহণ করবে না কাউকে। যার আছে সাধনার ধৈর্য, শক্তির দুঃসাহস, তাকেও অনেক কষ্ট করেই যেন পথ কেটে নিতে হয়। রুদ্ধ কপাট ভেঙে অন্তঃপুরে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিতে হয়।
মালু যেন অল্প আয়াসেই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল সেই অন্তঃপুরে। সেখানে মহানগরীর আপন সুর, বিচিত্র ঐকতান। সেই মহাতানে লীন মালুর অস্তিত্ব।
শহরটাকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে মালু। চমকে উঠবারই কথা। সেই মালু, বাকুলিয়ার মিঞা-সৈয়দরা দেশ ছেড়েছে বলে বিদ্রূপের গান বেঁধেছিল, সে-ই কিনা এই শহরের মায়ায় আটকা পড়ে গেল?
সব কিছুই সুন্দর। সব কিছুই অপরূপ। ওই এ্যাসফাল্টের রাস্তা, ট্রামের ঘর্ঘর শব্দ, বাসের কিউ, মাথার উপরে মাকড়সার সুতোর মতো ছড়ান অজস্র বিজলী তার। টেলিফোনের খাম্বার উপর দাঁড়িয়ে থাকা কাকটাও কৃষ্ণশ্রীতে আজ রূপবান।
যুদ্ধ থেমে গেছে তবু বাফেলওয়ালগুলো ভাঙা হয়নি। বিজলী বাতির চোখে যে কালো ঠুলি পরান হয়েছিল সেগুলো নামান হয়নি। পার্ক সার্কাস ময়দান বা অন্য কোনো পার্কেই হাঁটার উপায় নেই। ট্রেঞ্চে ভর্তি। সেই ট্রেঞ্চগুলো এখনও ভরাট হয়নি। রোজই মেজাজ খারাপ করত মালু, নগর কর্তৃপক্ষ আর ইংরেজের বাচ্চা লাল বাঁদরগুলোর বিরুদ্ধে জিবে শান লাগাত। কিন্তু বাফেলওয়াল, বাতির মুখের কালো বোরখা, পার্ক সার্কাস মাঠের ট্রেঞ্চ, কোনোটাই আর বিসদৃশ মনে হয় না মালুর। মনে হয় এই তো স্বাভাবিক, এই তো কলকাতা, এবড়ো থেবড়ো নানা অমিল আর গরমিলের মহাতান, মহানগরী। আর তার চেয়েও সুন্দর এর মানুষগুলো, উদার আকর্ষণীয়। আর মালু বুঝি এই নগরীর সবারই প্রিয়। রিহার্সালের মেয়েগুলো বিমুগ্ধ চোখে শ্রদ্ধা ঝরায়, দেখা হলে আদাব দিয়ে বাড়িতে দাওয়াত জানায়। গানের মাস্টার হিসেবে বহাল করে।
ছাত্ররা আসে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ নিয়ে।
বুকে জড়িয়ে ধরে জাহেদ। বলে, সাধনার ধন মিছে যায় না কখনো। শুধু সাবধানী দেয় রাবু। বলে, মাথাটা ঠিক রাখিস। তারপর বম্বে ক্রাউনে নিয়ে ব্রেইন কাটলেট খাওয়ায়।
৪৪.
কুয়াশা ঢাকা ভোর। দূরের ট্রামটাকে দেখে মনে হয় বুঝি এক চাক কুয়াশাই ছুটে আসছে। ভিজে রাস্তা। পিছল ফুটপাত।
এসপ্লানেডের মোড়টা পেরিয়ে আচমকা পেছন থেকে একটা ধাক্কা খেল মালু। কে যেন হুড়মুড়ি খেয়ে পড়েছে ওর ঘাড়ে।
আরে অশোকদা?
সেই যে বৌবাজারের মেস থেকে বেরিয়ে এসেছিল মালু আর দেখা হয়নি অশোকের সাথে। আর এখন, এখানেই তো দেখা হওয়া স্বাভাবিক। জায়গাটা হিন্দুরও নয়, মুসলমানেরও নয়। জায়গাটা বিদেশি শাসকদের বিপণি কেন্দ্র। তাই সবাই আসে এখানে, নির্ভয়ে।
কেমন আছেন অশোকদা? খুশি ছড়িয়ে শুধাল মালু।
রানু মারা গেছে। বিনা ভূমিকায় মালুকে এতটুকু প্রস্তুতির অবকাশ না দিয়েই বলে ফেলল অশোক।
মৃত্যুই বোধহয় টেনে এনেছিল ওকে। এখানে বেড়াতে এসেছিল ভাশুর বাড়ি। এখান থেকে যাবে তালতলি। আজ যাই কাল যাই করে যাওয়া হচ্ছিল না।
তারপর? রুদ্ধশ্বাস মালু।
ওর ভাশুরের বাসাটা ছিল বেনে পুকুরে। সেই রাতেই আক্রান্ত হয় ওরা। কোনো রকমে ঠেকিয়ে রেখেছিল রাতটা। সকাল পর্যন্ত পারল না ঠেকাতে। সবাই মারা পড়ল। বেঁচে গেল শুধু রানুর ছোট বাচ্চাটা। লেপ তোশকের গাদির ভেতর পড়েছিল। লক্ষ করেনি কেউ।
মনে পড়ল মালুর। যে সময়টিতে রাবুর শূন্য হোস্টেলটার সুমুখে দাঁড়িয়ে নৃশংস কোনো মৃত্যুর প্রতীক্ষায় চেতনা হারিয়েছিল মালু, ঠিক সেই সময়টিতে নগরীর আর এক প্রান্তে আর একটি মৃত্যু অনেক কিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে এ পৃথিবী থেকে।
কারো মৃত্যু যে অনেক অর্থই কেড়ে নেয় জীবনের, আলোভরা পৃথিবীটাকে ঢেকে দেয় নিকষ আঁধারে, বুঝি এই প্রথম উপলব্ধি করল মালু।
তারপর? তারপর কী, অশোকদা? চেঁচিয়ে শুধায় মালু। আশেপাশের সচকিত লোকগুলের দিকে তাকিয়ে বুঝি হুঁশ হল ওর।
কেন যেন মনে হল মালুর, মৃত্যুর পরও বেঁচে রয়েছে রানুদি। আর সেই রানুদির অনেক খবরই নেবার রয়েছে, অনেক কিছুই জানার রয়েছে।
অশোকদা শুনুন!
অশোক ততক্ষণে চলন্ত একটা ট্রামে লাফিয়ে উঠেছে। সেখান থেকেই মুখ ঘুরিয়ে বলছে : আমার বড় তাড়া। এই শহরে অসহ্য যন্ত্রণা। আজই রওনা দিচ্ছি দ্বারকার পথে। শিগগিরই ফিরে আসছি। দেখা করিস মেসে।
ফড়িংয়ের মতো তেমনি এখানে সেখানে লাফিয়ে ঝাঁপিয়েই বুঝি দিন কাটছে অশোকের। বেন্টিং স্ট্রীটের মোড় কেটে দ্রুত অপসৃয়মাণ ট্রামখানার দিকে কী এক বেদনার দৃষ্টি মেলে চেয়ে থাকে মালু। এসপ্ল্যানেডের চৌমাথা পেরিয়ে আবার ধর্মতলার রাস্তাটা ধরল মালু। আস্তে আস্তে হেঁটে চলল।
মাত্র কয়েকদিন আগে যে সার্থকতার আনন্দে উপচে উঠেছিল ওর মনটা, মহানগরীর বিচিত্র ছন্দতানে নিবিড় আত্মীয়তার অনুভূতিতে আপনাকে বিরাট আর সম্পদময় মনে হয়েছিল ওর–সবই যেন উবে গেল এক লহমায়। রাস্তায় লোক চলছে পাতলা পাতলা। কলকাতার বিশাল জনস্রোত, কাঁধে ঘেঁষাঘেঁষি করে, গায়ে গায়ে হুড়মুড়ি খেয়ে চলা, সেই জনস্রোত যেন অতীতের কোনো কিস্সা কাহিনী।
সজাগ ইন্দ্রিয়, সতর্ক পা, কেমন ছাড়া ছাড়া ভাবে চলছে আজকের নাগরিক। ওদের মুখে মহানগীর আতঙ্ক, ওদের চোখে কী এক সন্দেহ, কী এক অবিশ্বাস। ওরা যেন আপন দেশের মাটিতে হাঁটছে না। প্রাণটাকে হাতে নিয়ে ওরা যেন হাঁটছে কোন শত্ৰুপুরীর অনাত্মীয় পথে। তাই এত ভীত শঙ্কিত পদক্ষেপ ওদের।
গাটা যেন কাঁটা দিয়ে গেল মালুর।
মহানগরীর নাগরিক: ফিরে পেয়েছে তার আপন ভাষা। আপন ভাষায় আবার কথা বলছে সে। তাই তো ভাবছিল মালু। এত বড় মিথ্যাটাকে কেমন করে সত্য বলে ভেবেছিল মালু?
আপন আনন্দের সুরখানা চোখে বুঝি ভুলই দেখেছিল ও। এমনিই বুঝি হয়। বাইরের পৃথিবীতে আমরা শুধু আপন মনের প্রতিবিম্বটাই দেখি, দেখতে চাই। তাই সঠিক দেখাটা কদাচিৎ সম্ভব হয় জীবনে।
মহানগরীর ক্ষত এখনো শুকায়নি। কলঙ্কের চিহ্নগুলো এখনো অদৃশ্য হয়নি। দৃষ্ট ব্যাধির বিষাক্ত জীবাণুরা এখনো কিলবিল করে বেড়ায়, প্রকাশ্যে নয়, নগর দেহের গোপন অন্ত্রে, গিঁঠে গিঁঠে।
কোন্ বন্যায় ভেসে যাবে এত ব্যাধির জীবাণু?
অকস্মাৎ সেই যুদ্ধ কালের বিষাক্ত তালতলির কথাটা মনে পড়ল মালুর। রিক্ততার হাহাকার ভরা দখিন ক্ষেত, বিরানা গ্রাম আর তালতলির তাল সারির মাথায় সে শকুনগুলো।
সেই শকুনির দলটা এখানে বুঝি বিষাক্ত লালা ঝরিয়ে চলেছে। উড়ে উড়ে সর্বত্র ছিটিয়ে দিচ্ছে সে বিষ-লালা। সে বিষ পান করে মানুষ হারিয়েছে তার সত্তা, আত্মাকে করেছে কলুষিত, মনকে করেছে পঙ্গু।
দ্রুত পা চালায় মালু। এত মৃত্যুর বেড়াজাল থেকে বুঝি পালিয়ে বাঁচতে চায় ও।
৪৫.
স্যার।
সেই কখন থেকে বেয়ারা করিম দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করছে। কে যেন মালুর সাথে দেখা করবে বলে অপেক্ষা করে আসছে অনেকক্ষণ। মুখ তোলে না মালু। কাগজের উপর চোখ বুলিয়ে চলেছে ও।
পাঁচ মিনিট পর। কথাটা বলেই আবার কাগজের তাড়ায় ডুব দেয় মালু। সই চালায় খস খস।
উদ্বেল ভক্তি। জানবার বুঝবার সে কী সীমাহীন আকুতি। গভীর মনোযোগের সাথে চিঠিগুলো পড়ে মালু। উত্তর দেয় সব চিঠিরই, নিষ্ঠার সাথে, সময় নিয়ে, সুন্দর করে।
এটা ওর গানেরই অংশ। তাই গানের মতোই একাগ্রতা ঢেলে উত্তরগুলো লেখে মালু। ডাকে ফেলবার আগে পড়ে দেখে আর একবার।
উদ্বেল ভক্তি। জানবার বুঝবার সে কী সীমাহীন আকুতি। গভীর জিজ্ঞাসা। নিবিড় মমতা। চিঠিগুলো পড়ে আর অভিভূত হয় মালু। দূর দূরান্তে ছড়ান কত শ্রোতা মালুর। এই চিঠিগুলো যেন ওদের আত্মার পরিচয়। ওদের প্রশ্ন, ওদের কৌতূহল, ওদের প্রশংসা–সবই যেন শিল্পীর প্রতি উষ্ণ এক প্রীতির ঘোষণা। সে প্রীতির স্পর্শে বল পায়, শক্তি পায় মালু। তাই উত্তর দেয়ার পরও চিঠিগুলো জমিয়ে রাখে মালু। অফিসে আর বাড়িতে পুরনো চিঠির ছোট খাট টিলে বানিয়ে তুলেছে ও।
স্যার, বাজে কাগজ মেলা জমেছে, ফেলে দেব? করিম মিঞা কত দিন অনুমতি চেয়েছে।
না না। ও সবে হাত দিও না তুমি। চেঁচিয়ে উঠেছে মালু। বুঝি সাত রাজার ধন। যক্ষের মতো আগলে থাকে মালু।
“…মুগ্ধ হই, বিস্মিত হই তোমার গান শুনে। কখনো হারিয়ে যাই সুরের বন্যায়। কখনো চমকে উঠি। প্রশ্ন করি নিজেকে : এত সম্পদ এত ঐশ্বর্য আমার। এই ঐশ্বর্যকে চিনে নিতে এত দেরি লাগল কেন। ধিক্কার দেই নিজেকে….
আমার সেই ঐশ্বর্যকে চিনিয়ে দিলে তুমি। আমার অনাবিষ্কৃত
ভাণ্ডার আমারই সুমুখে তুলে ধরলে তুমি। আমার গৌরব ফিরিয়ে দিলে আমাকে। তাই তো তুমি শিল্পী।
তুমি সার্থক। প্রণাম তোমাকে। ইতি–”
রি–।
পড়াটা শেষ করে খামটা উল্টে পাল্টে দেখল মালু। একই খাম, হলদেটে রং দামী বিলেতী কাগজের খাম। একই হস্তাক্ষর, সেই একই জেনারেল পোস্ট অফিসের কালি জড়ান অস্পষ্ট ছাপ। ভালো লাগে মালুর। কী এক রোমাঞ্চিত ছোঁয়ায় সাড়া জাগে প্রাণে। কিন্তু আজ অবধি এই অচেনা রি-র চিঠির উত্তর দিতে পারে না মালু। স্যার আরো দুজন সাহেব এসেছে দেখা করতে। মালুর অন্যমনস্কতার সুযোগে বুঝি একটু সাহস সঞ্চয় করে নিল করিম।
বসতে বল। আগের সাহেবটাকে নিয়ে এসো। চিঠি পত্রের ফাইলটা সরিয়ে রাখে মালু। নোট বইয়ের ফাঁক থেকে মুখ বের করে আসছে দুতা কাগজ। চোখ পড়ায় মালু টেনে নিল কাগজের তা। বিরক্ত রেখার কুঞ্চন জাগে ওর জোড়া ভ্রূর সংগম কেন্দ্রে।
ইস, নজরুল জয়ন্তীর গানগুলোর রিহার্সাল এখনো শুরু হয়নি। বিড় বিড় উচ্চারণ করে মালু। আবার নোট বইয়ের ভেতর চাপা দিয়ে রাখে কাগজগুলো। কী এক অসন্তোষে ছুঁড়ে দেয় নোট বইটা। বক্স ফাঁইলের উপর একটু কাত হয়ে পড়ে থাকে নোট বই। করিম মিঞা তোমাকে আবার বলছি। লোকজন এলে ফওরান বিদায় করে দেবে। দেখছ না, কত কাজ জমেছে। ছড়ান দুটো হাত উল্টিয়ে সেক্রেটারিয়েট টেবিলটার উপর ঘুরিয়ে আনল মালু। ফেলে রাখা কাজের বিপুল পরিমাণটা যেন স্পষ্ট করেই দেখিয়ে দিল করিম মিঞাকে। করিম সবে এসেছে ওঘর থেকে। পুরো কথাটা বোধ হয় কানে যায়নি ওর। তবু অভ্যাস মতোই বলল, জী স্যার।
আবার জী স্যার? না করেছি না স্যার বলতে? খেঁকিয়ে ওঠে মালু।
জী। মুখ নাবিয়ে নেয় করিম।
আর একটা শক্ত কিছু বলতে যাচ্ছিল মালু। সামলে নেয়। করিমের পেছনেই আগন্তুক ভদ্রলোক।
বসুন।
দেখুন, নেহাৎ অপারগ হয়েই আপনাকে বিরক্ত করতে এলাম। আপনি যদি একটু দয়া…
ইনিয়ে বিনিয়ে বলবে লম্বা ভনিতা, সে ভাবেই বুঝি প্রস্তুত হয়ে এসেছিল ভদ্রলোক। কিন্তু শুরুতেই বাদ সাধল মালু! কী বলবার সে কথাটাই বলে ফেলুন না। ভূমিকার কোনো প্রয়োজন আছে?
তেলতেলে চেহারা কেতাদুরস্ত ছেলেটি। মালুর অপ্রত্যাশিত রূঢ়তায় হকচকিয়ে যায়, গুলিয়ে যায় তৈরি করা কথাগুলো। কেমন আমতা আমতা করে বলে : হ্যাঁ, দেখুন, আপনি যদি কিছু মনে না করেন…মানে, আপনার কী সময় হবে?
না। শুধু রুক্ষ নয়, বড় অভদ্র মালুর জবাবটা। অপমান বোধে রাঙ্গিয়ে উঠে মুখ নীচু করে ছেলেটা।
বুঝি কৃপাবোধে নরম হয়ে আসে মালু। আর একটু হলে সশব্দে হেসেই দিচ্ছিল। হয়ত বড় লোকের সুখে পালা অপদার্থ ছেলে। অথবা অক্ষর বর্জিত ছোকরা সহসা পয়সা বানিয়ে ফেলেছে। মনে মনে ভাবল মালু। এবার বলে ফেলুন আপনার কথাটা। আমার মেলা তাড়া। মুচকি হেসে অভয় দিল মালু।
ভড় ভড় করে বলে গেল ছেলেটি : দেখুন! আমার একটি ছোট বোন, খালাত বোন। কলেজে পড়ছিল। পড়া ভালো লাগে না। এখন বাড়িতেই বসে আছে।….
এবং বাড়িতে বসে সকালে চা পান করে। দুপুরে ভাত খায়, রাতে খায় পরোটা। তারপর ঘুমুতে যায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে…বলুন বলুন। বলে চলুন। ছেলেটির কণ্ঠস্বর নকল করে ভেংচিয়ে চলে মালু। অর্থহীন ভনিতায় এবার সত্যিই চটেছে মালু। প্লিজ, মেহেরবানী করে শুনুন আমার কথাটা। বোনটির আমার ভারি শখ, গান শেখে। বেশি না, হপ্তায় দুটো করে বৈঠক নেবেন, মাসে হবে আট কী নয়টি বৈঠক, প্রতি বৈঠকে দশ টাকা করে আশি বা নব্বই। তা আপনাকে শতটা পুরিয়েই দেব। বলুন, আপনি রাজি?
না।
কিন্তু, আপনাকে ছাড়া যে আর কারু কাছে গান শিখবে না আমার বোন।
দুঃখিত। আপনার বোনের শখের গান শেখানোর মতো ফুরসুত হাতে নেই আমার।
দেখুন, একশোয় না হয়, দেড় শো? যা চাইবেন আপনি। তবু দোহাই আপনার…
সাহেবের বুঝি খুব পয়সা আছে?
এমন একটা বেমক্কা আক্রমণে চুপসে যায় ছেলেটা। ফ্যাকাশে মুখে কথা জোটে না ওর।
ইশারা পেয়ে ততক্ষণে অপর দর্শনার্থীদের নিয়ে করিম ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতর। ওদের দিকে মন দেয় মালু।
দেড় শো থেকে দু শোতেও উঠতে পারে ছেলেটা, এই ফাঁকে সে কথাটা জানিয়ে দেয়। সাড়া না পেয়ে বেরিয়ে যায় ক্ষুণ্ণ মুখে।
দুভদ্রলোককে বিদায় দিয়ে আবার কাজে মন দিল মালু।
অনেক কাজ ওর। অনেক দায়িত্ব।
নাজিমুদ্দীন রোডের সেই হলদে বাড়িটা। সেদিন সেটাই ছিল ঢাকার বেতার ভবন।
এবাড়ির একটি নির্দিষ্ট কক্ষকে কেন্দ্র করে মালুর নতুন জীবন। কর্মঠাসা সদা উদ্বিগ্ন ব্যস্ত জীবন।
সাফল্য নাকি নিয়ে আসে দায়িত্বের বোঝা। সে দায়িত্বের ভার বইতে হয় সাফল্যের নতুন নতুন পরীক্ষার সিঁড়ি ডিঙিয়ে। তাই নাকি নিয়ম। সে নিয়মেই কদাচিৎ একটু ফুরসুত মিলে মালুর। গান শেষ হল তো শুরু হল রিহার্সাল। আর সে রিহার্সালের মা বাপ আগা-মাথা কোনো কিছুরই ঠিক নেই। অমুক এল তো তমুক এল না। অমুককে আনতে ছোট। ততক্ষণ হাতপা গুটিয়ে বসে থাক। সব চেয়ে মুশকিল মেয়েগুলোর অভিভাবকদের নিয়ে। দেশটা আজাদ হলেও সমাজ বা পারিবারিক জীবনে আজাদীটা মকসো করতে সায় দেয় না তাঁদের রক্ষণশীল মন। রেডিও থিয়েটার সিনেমা, সবই তাঁদের চোখে সমান, ইতরামি আর নোংরামির আখড়া। অতএব সে সব জায়গায় বাড়ির মেয়েদের নাচতে গাইতে দিতে নারাজ তারা।
অবশ্য, তাঁরা বলেন, মালেক সাহেবকে তাঁরা বিশ্বাস করেন। তিনি অর্থাৎ মালেক সাহেব স্বয়ং নিয়ে যাবেন মেয়েদের, খেয়াল রাখবেন ওদের উপর। অর্থাৎ বদ ছেলেদের পাল্লায় পড়ে ফষ্টিনষ্টির সুযোগ যেন না পায় ওরা। তারপর প্রোগ্রাম শেষে পৌঁছিয়ে দিয়ে যাবেন বাড়ি বাড়ি। তাহলে দুএকজন নেহাৎ মোল্লা কিসিমের অভিভাবক ছাড়া আর সবাই রাজি। উপায় কী! সে দায়িত্বটা পুরোপুরিই নিতে হয়েছে মালুকে।
মেজো ভাই, দেখছো কাণ্ডটা? বাড়ি বাড়ি গিয়ে মেয়েদের কুড়িয়ে আনতে আর ফেরত দিয়ে আসতেই দিনের কতগুলো ঘণ্টা চলে যায় আমার। একটু পড়ব, একটু অনুশীলন করব, সে উপায় নেই। এর উপরেও কত গার্ডিয়ানের যে পায়ে ধরতে হয়। ক্ষুণ্ণ, অভিযোগ ভরা স্বর মালুর। কার উপর রাগ করছিসরে?
এই কমবখৃত অভিভাবকগুলো
হো হো করে হেসে দেয় জাহেদ। স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে স্নেহ ঝরিয়ে বলে : একটু ধৈর্য ধর, একটু সবুর কর। তুই ভুলে যাচ্ছিস, মধ্যযুগীয় পঙ্ককুণ্ড থেকে উঠে আসছি আমরা। পিছিয়ে পড়া জাত, স্বাধীনতার সনদটা পেয়ে গেলাম বলেই রাতারাতি বদলে যাবে দৃষ্টিভঙ্গিটা, ভাবছিস কেন?
চুপ করে শোনে মালু। এ সব যে বোঝে না সে তাও নয়। কিন্তু এত সব ঝামেলা সামলে নিজের জন্য যে একটুও সময় পাচ্ছে না ও। সেখানেই তো ওর যত ক্ষোভ, যত অভিযোগ।
শোন্ মালু। এই দেশের মাটির ধাঁচই আলাদা। এ মাটির মানুষ একবার যেটাকে ধরে, তার শেষ অবধি দেখে একেবারে হেস্ত নেস্ত করেই ছাড়বে। আজ তোর অভিযোগ, উৎসাহিত ছেলে পাচ্ছিস না–কাকে গান শেখাবি, ঘর ছাড়তে নারাজ মেয়েরা। কিন্তু দেখছিস না তুই, শুরু হয়ে গেছে উৎসাহের প্রথম জোয়ার? আরম্ভ হয়েছে ঘর ছাড়ার অভিযান? তোড়ের মুখে এই অভিযান কোথায় গিয়ে শেষ হবে সে আজ কল্পনাও করতে পারবি না তুই। তোর পক্ষেই তখন তাল মিলিয়ে চলা দায় হয়ে পড়বে।
পরিচিত সেই বক্তৃতার ঢংয়ে কী এক উদ্দীপনায় বলে চলে জাহেদ। সেই ছোট বেলার মতো প্রতিটি কথায় প্রশ্নাতীত বিশ্বাসটা হয়ত আসে না মালুর কিন্তু শুনতে ভালো লাগে মালুর। নিজের বুকেও যেন প্রচণ্ড এক প্রেরণার শক্তি পাক খেয়ে যায়।
বাঁধ যখন ভেঙেছে একবার দুর্বার সেই স্রোতের মুখে কোনো সংস্কার, কোনো সনাতনী বাঁধনই আর টিকছে না। এটা মনে রাখিস। শুধু নিজের কাজটা নিষ্ঠার সাথে করে যা। এই দেশকে যে তোর অনেক কিছু দেবার আছে! মালুর কাঁধে সস্নেহ হাতের স্পর্শ বুলিয়ে কথাটা শেষ করে জাহেদ। জাহেদের উৎসাহে ঝামেলা পেরেশানীর ভারটা হয়ত একটু কম মনে হয় মালুর। কিন্তু সময় নিয়ে টানাটানি ওর দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর উপর রয়েছে দৈনিক গড়পড়তা দুটো ট্যুশনি আর একটা গানের স্কুলের এক ঘণ্টার মাস্টারি। এ সব সেরে যখন একটুখানি সময় ছিনিয়ে নেয় মালু তখন হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসে। সঙ্গে থাকে খাতা কলম। নতুন কোনো গানে সুর বাঁধে। পুরনো গানের সুর সাধে। কিন্তু, সে আর কতক্ষণ। ক্লান্তির ঘুমে বুজে আসে চোখের পাতা। শিথিল হয়ে ঢলে পড়ে শ্রান্ত দেহ। এমনি করে ক্ষুদ্র হতে হতে ক্রমশ বিরল হয়ে আসছে ওর অনুশীলনের অবসরটুকু।
এই অতৃপ্তিটা ঢেকে রাখতে পারে না মালু। অসন্তোষের চাপা আগুনটা ধিকি ধিকি পুড়িয়ে যায় ওর বুকের ভেতরটা। এই অসন্তোষের আগুনটাই বুঝি উল্কার আকারে ঝরে পড়ে তাদের উপর যারা আসে অনুগ্রহের প্রত্যাশায়, আসে প্রলোভনের ডালি নিয়ে। আসে দুর্লভ সময়ে অকারণ ভাগ বসাতে।
তাই বলে নিজের সহজ স্বভাবটাকে একেবারেই পাল্টিয়ে দেবে মালু? বুদ্ধি দিয়ে, চিন্তা দিয়ে এই পরিবর্তনটাকে কেমন করে স্বাভাবিক বলে গ্রহণ করবে মালু?
এ যেন ওর নিজে বিরুদ্ধেই কঠিন এক সংগ্রাম। নিজের সাথেই ওর সংঘাত। আপন শিল্পীসত্তার সাথে সামাজিক সত্তার, আপনার অন্তর্নিহিত মানবাত্মাটির বিরুদ্ধে শিল্পী আত্মার দায়িত্বের বোঝাঁটাই যেন অস্থির করে তুলেছে ওকে। সে অস্থিরতার চাঞ্চল্যে নিজেকে যেন ধরে রাখতে পারছে না ও। পারছে না সংযত পরিমার্জিত সামাজিক আচরণের স্পষ্ট একটা সীমারেখা টেনে নিতে। উগ্রতার, হয়ত আত্মম্ভরিতার একটা দূরত্ব আপনার অজানাতেই গড়ে তুলেছে ঘর সংসার করা স্বাভাবিক মানুষগুলোর সাথে। কিন্তু মালু তোত কোনোদিন এমনটি ছিল না? এখানেই, বুঝি স্ববিরোধিতা। বুদ্ধির সাথে আচরণের। বিশ্বাসের সাথে ব্যবহারের। এখানেই বুঝি বিরোধ, শিল্পী মানুষের সাথে সামাজিক মানুষের।
গোলগাল চেহারার সেই কেতাদুরস্ত ছেলেটার প্রতি অহেতুক দুর্ব্যবহারের জন্য অনুতপ্ত হয় মালু।
দেয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে কুঁচকে আসে ওর জ্ব জোড়া। অফিস বন্ধ করার সময় প্রায় হয়ে এল। ওর না বেরুনো পর্যন্ত করিম আর কেরানী ইয়াসীনকেও বসে থাকতে হবে। বুঝি ওদের দিকে চেয়েই ফাঁইলগুলো বন্ধ করে রাখল মালু। কয়েকখানি চিঠি বেছে নিয়ে পুরে নিল হাত ব্যাগে। শোবার আগে উত্তরগুলো লিখে রাখবে।
সেই হলদেটে খামটা একটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় রাখা আছে এক পাশে। দামী কাগজটা রেশমের মতো চক চক করছে। চিঠিখানা তুলে বুক পকেটে রেখে দিল মালু।
এ এক অদ্ভুত মেয়ে। প্রায় হপ্তায় হপ্তায় চিঠি লিখে চলছে। উত্তর চায় না। হয়ত নিজেকে খুশি করার জন্যই লেখে, তাই উত্তরের প্রয়োজন নেই ওর।
কিন্তু মেয়ে কী? খটকা লাগে ওর মনে। কেমন করে এই অনামাকে মেয়ে ধরে নিয়েছে মালু? গোটা গোটা হাতের লেখা দেখে? সে তো পুরুষেরও হতে পারে।
সেই প্রথম থেকেই কেন যেন মনে হয়েছে মালুর, ওই উৎসাহ ভরা পত্রগুলোর উৎস কোনো রহস্যময়ী মেয়ে। ওর গানের অনুরক্তা। ওর শুভার্থিনী। প্রিয় শিল্পীর কাছে বুঝি প্রেরণার অজ্ঞাত ঝরনা হয়েই থাকতে চায় মেয়েটি।
একটুখানি হাসি ঠোঁটের প্রান্ত থেকে উঠে এসে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ে মালুর। ওই বিচিত্র কৌতুকিনীর চিঠিগুলো মালুর জন্য নির্মল এক আনন্দ।
করিম, ইয়াসীন, -চললাম। বেরিয়ে এল মালু।
গেটের সুমুখেই অপেক্ষমাণ রিক্সাটায় চড়ে বসল ও, বলল–টিকাটুলি। ঘরোয়া জলসা বলেই জানা ছিল মালুর। কিন্তু বাড়িটার ভেতরে ঢুকে ওর চক্ষু স্থির। প্রশস্ত আঙ্গিনায় শামিয়ানা টাঙিয়ে চেয়ার পেতে রীতিমতো শানদার জলসার আয়োজন। শামিয়ানা ছাড়িয়ে বারান্দা তক ভরে গেছে লোকে।
অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ মালু। উদ্যোক্তরা পূর্বাহ্নেই সে কথাটা ঘোষণা করে দিয়েছেন। হয়ত তাই এত লোক। সার্থক শিল্পীর গর্ব আর আনন্দের তৃপ্তিতে ভরে যায় মালুর বুকটা। ওর নামে যে কোনো জলসায় ভিড় করে আসে শ্রোতার দল।
প্রধান শিল্পীর মর্যাদা সম্পর্কে সজাগ মালু। মন দিয়ে গাইল ও। গাইল তালতলি বাকুলিয়ার সেই আদিম সুরে। ভূমিষ্ঠ হয়েই যে সুর শুনে আসছে এ দেশের মানুষ। যে সুরে স্বপ্ন রচনা করেছে, অতীতকে দেখেছে, ভবিষ্যৎকে ডেকেছে।
ওরা শুনল ওদের নাড়ির সুর, ওদের মাটির সুর। ওরা চমকিত হল। মালু থামল।
নিস্পন্দ নির্বাক দর্শক। সুরের মূর্ছনায় বুঝি তলিয়ে গেছে ওরা। ওদের চেতনালোক কোনো অতীন্দ্রিয় আবেগে যেন ঘুমিয়ে গেছে। অথবা সুরের পাখায় ভর করে ওরা হারিয়ে গেছে নিজেদেরই কোনো ভাবলোকে, বিলীন হয়েছে স্পর্শে আর দৃষ্টির অতীত সুরেরই কোনো নিজস্ব পৃথিবীতে।
তারপর যেন অকস্মাৎ বিমূঢ় চমকের ঘোর কাটিয়ে ওরা ভেঙে পড়ে প্রচণ্ড হাত তালিতে। সামনে থেকে, পেছনে থেকে, চারিদিক থেকে ওরা ভেঙে পড়ে প্রচণ্ড হাত তালিতে। সামনে থেকে ওঠে চিৎকার–আবার আবার। মালু চোখ ফিরাল সেই মেয়েটির দিকে। প্রথম সারির দক্ষিণ কোণে ছবির মতো বসে আছে যে মেয়েটি। এখনো, চোখ মুদে আছে, যেন স্বপ্ন দেখছে ও। সেই স্বপ্নের আমেজেই বুঝি ঠোঁটের কার্নিশে ফুটে উঠেছে একটি চিকন মৃদু হাসির রেখা, আলো আঁধারের সন্ধিক্ষণের ছায়াটির মতোই অস্পষ্ট কিন্তু অপরূপ। ওর ফর্সা টকটকে মুখখানিতে লাবণ্যের পাতলা ছিলকের মতো লেগে রয়েছে বুঝি অতীন্দ্রিয় সেই সুর-লোকের মায়া। হাত জোড় করে মাফ চাইল মালু, আর গাইতে পারবে না সে।
কিন্তু জ্বলে উঠেছে ওর ভেতরটা, রোমকূপের অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে সে জ্বালাটা পলায়নের পথ খুঁজেও যেন পথ পাচ্ছে না। ব্যর্থ নিরুপায় কোনো কান্নার মতো ওর শরীরটা ফুলে ফুঁসে উঠেছে। সহসা কী এক অপমান এসে বিঁধল ওর শিল্পী সত্তাকে।
চোখ খুলছে না কেন মেয়েটি? এখনো কী ও ডুবে রয়েছে মুর্ছিত সুরের স্বপ্ন মায়ায়? এত লোক…ওরাই বা কেন ঝিমিয়ে পড়ল নির্জীব নিস্তেজ স্বপ্নালুতায়? মালু তো গায়নি কোনো ঘুম পাড়ানি গান! তার চেয়ে রেগে মেগে যদি তেড়েই আসত ওরা, অথবা শিস দিয়ে অঙ্গ দুলিয়ে একটা ইতর হুল্লোড় মুচিয়ে তুলত, তা হলেই যেন খুশি হত মালু, তৃপ্তি পেত। গানের সুরে মানুষের হৃদয়টা নিঙড়ে নিয়ে তার মনের কথা আর ভাষার ফোয়ারাটা যদি খুলেই না দিতে পারল মালু, তবে কী সার্থকতা ওর গানের? আজই প্রথম নয়। বিমুগ্ধ শ্রোতাদের মোহাবিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে আগেও প্রশ্নটি মনে জেগেছে ওর।
চোখ মেলেছে মেয়েটি। মখমলের মতো নরম চোখ। শিশির ফোঁটার মতো টলটলে ওর চোখের তারা। ত্রস্তে মুখ ঘুরিয়ে নিল মালু। মেয়েটিও বুঝি এক খুঁট আঁচল তুলে ঢাকতে চাইল ধরা পড়ার লজ্জাটা।
উদ্যোক্তাদের একজন এসে হাত জোড় করল, স্যার আর একটা গান আপনাকে গাইতে হবে।
বেশ। রাজি হল মালু। পাশে বসা নবীন গায়ক বরকতের দিকে তাকিয়ে বলল ও, বরকত তুমি একটা বাউল ধর! ইতিমধ্যে মেজাজটা একটু দুরস্ত করে নিই আমি।
আজ নিয়ে বার দশেক, কী আরো বেশি, দেখা হল মেয়েটির সাথে। কথা হয়নি একবারও। শুধু চকিত একটি দৃষ্টি বিনিময়। একটু বা চোখের হাসি। একটু রাঙিয়ে ওঠা। তারপর মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া।
একরাশ লজ্জার বোঝায় মিইয়ে গেছে মালু। মেয়েটিও। মেয়েটির অস্তিত্ব সম্পর্কে কেমন করে যেন সজাগ হয়ে উঠেছে মালু।
যে কোনো জলসা অথবা আসরে ও আসবেই, এটা আজকাল এক রকম ধরেই নেয় মালু। মঞ্চে উঠে প্রথমেই মেয়েটিকে খোঁজে ও। পেয়েও যায়। সেই প্রথম সারির কোণের সিটে পটের ছবিটির মতো বসে আছে মেয়েটি। এও এক ধাঁধা।
অচেনা সেই পত্র লেখিকার মতো এও বুঝি এক অদ্ভুত মেয়ে। নীরবতার আড়াল থেকে শুধু দৃষ্টির ভাষায় নিরন্তর উৎসাহ যুগিয়ে চলেছে মালুকে। আপনাকে উন্মোচিত করবার এতটুকু ব্যগ্রতা নেই ওর। ব্যগ্রতা নেই চোখের ভাষাকে মুখের বোলে ফুটিয়ে তুলবার।
কিন্তু মেয়েটির চোখে শুধু কী প্রেরণার ভাষা? কী যেন নিবেদন, সুরে সুরে আপনাকে লীন করার কী এক ব্যাকুলতা, কতদিনের ভীরু চাহনিতে তাই যেন দেখতে পেয়েছে মালু।
সেদিন ছিল টিকেটের ব্যবস্থা। কোনো দাঁতব্য কাজে সঙ্গীত জলসা। প্রথম সারির কোণের চেয়ারে পঞ্চাশ টাকার সিটে বসেছিল মেয়েটি। নিশ্চয় কোনো পয়সাওয়ালার মেয়ে। অথবা বউ? না, বউ নয়। তাই যদি হত তবে একটা সুখী আত্মমগ্ন পুরুষ মুখ মেয়েটির পাশে দেখা যেত নিশ্চয়। মালু তো মেয়েটিকে বারবার একলাই দেখে আসছে।
গায়ক গায়িকাদের মাঝে বসে এমনি সব কথাই ভাবছিল মালু। ভাবতে ভাবতে চোখ গিয়ে পড়েছিল কোণের চেয়ারটিতে। হৃৎপিণ্ডটা কেঁপে উঠেছিল মালুর।
বুঝি অনেক দুঃখ মেয়েটির। দুঃখের ভারে নুয়ে এসেছে ও। এ দুঃখের পীড়ন থেকে কেউ কী মুক্ত করবে না ওকে? মেয়েটির শিশির টলটল চোখের তারায় এ কথাগুলোই যেন লেখা ছিল সেদিন। ওর মুখের উপর থেকে দৃষ্টিটা তুলে নিতে সেদিনের মতো কখনো এত কষ্ট পায়নি মালু। আর একটা দিন ছিল ব্যতিক্রম। মেয়েদের কলেজের কী এক উৎসব। মেয়েটি সেদিন প্রথম সারিতে ছিল না। ছিল দাঁড়িয়ে, মঞ্চের উইংসে। লাল সালুতে মোড়া একটি বাঁশের গায়ে কাঁধের ভারটা ছেড়ে দিয়েছিল ও। হাত দুটো ছিল বুকের উপর, একটি অপরদিকে জড়িয়ে। শাড়ির আঁচলটা ছিল কোমরে প্যাঁচান। উদ্ধত বক্ষের ভারে ওর সরু কোমরটি বুঝি বেঁকে গেছিল। অথবা সে ছিল ওর হেলান দিয়ে দাঁড়াবার ভঙ্গি। অদ্ভুত মনোরম ভঙ্গি। কিন্তু, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে পলকেই মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছিল মালু। কী ছিল মেয়েটির চোখে?
দিগন্তের কিনারে সদ্য ঘুম ভাঙা কোনো মেঘের হাতছানি? তেমনি একটা কিছু যা ব্যক্ত করা যায় না, পুরোপুরি বোঝা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়।
ওর চোখের কোলে যেন জমেছিল ঘন কৃষ্ণ মেঘের সকরুণ স্তব্ধতা। সেখানে। ছিল হারিয়ে যাওয়ার ডাক, কী এক মিনতি আর গভীর আকুতি পরম সমর্পণের। বার বার তাকিয়ে সে চোখের অতগুলো নীরব কথা পড়তে হয়েছিল মালুকে।
আরো আশ্চর্য! সেদিন চোখ ফিরিয়ে নেয়নি মেয়েটি। যেন জিদের বশে বাজি ধরেই তাকিয়ে ছিল মালুর দিকে।
তারপর কয়েকটা গানের শেষে আড়-চাহনিটা আর একবার উইংসের দিকে পাঠিয়েছিল মালু। তখন বিজয়িনীর কৌতুকে নাচছে মেয়েটির চোখ জোড়া। যেন ঠিকরে পড়ছে কী এক বিদ্রূপ! উপেক্ষা করবে? সে শক্তি নেই তোমার। চোখে চোখ না মিলিয়ে পারলে কই উদাসীনতার ভান করতে? যা ইচ্ছে তাই মনে করতে পার তুমি। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব? চোখে চোখ রেখে জবাবটা দিয়ে ফেলছ না কেন?
এ কী প্রশ্ন কথা-না-বলা মেয়েটির?
অজানা এক রোমাঞ্চে দুলতে দুলতে সেদিন বাড়ি ফিরেছিল মালু। নীরব চোখের সেই জিজ্ঞাসাগুলো ছুটে এসেছিল ওর পিছু পিছু। কথা-না-বলা মেয়েটি কী চায় মালুর কাছে? মালু জানে না। মালু শুধু জানে, যখন ও ভাবে মেয়েটির কথা, মধুর এক রোমাঞ্চের আবেগে দোল খায় মালু ঘুমের মাঝে, কাজের ফাঁকে। এ এক অনুভূতি মালুর জীবনে। বুঝি বিচিত্র কৌতুকিনী মেয়ে। মধুর এক প্রচ্ছন্নতায় আপনার আকর্ষণকে দুর্নিবার করে তুলতে চায়। অথবা বড় ভীতু মেয়ে। দারুণ ইচ্ছে মনে কিন্তু সাহস নেই এগিয়ে এসে এক টুকরো হাসি বা দুটো কথার বিনিময় করুক মালুর সাথে।
জলসা শেষে কত লোকই তো ঘিরে ধরে মালুকে। জনপ্রিয় শিল্পীর একটু হাসি অথবা দুটো কথার প্রসাদ পেয়ে কৃতার্থ মনে করে নিজেদের। কিন্তু ওই নাম না-জানা চোখে-চোখে-কথা-বলা মেয়েটি কখনো আসে না মালুর কাছাকাছি। ভিড়ের সাথে মিশে গিয়ে অলক্ষেই বেরিয়ে যায় ও। সেই নবীন গায়ক শেষ করেছে। আবার দাবী উঠেছে মালুর জন্য। চিৎকার করছে দর্শকরা।
মালুর মনে হল চিৎকারটা যেন ধীরে ধীরে ইতর হল্লায় রূপান্তরিত হচ্ছে। ওকে দিয়ে যেন জোর করেই গান গাওয়াবে ওরা।
মেজাজটা আবার বিগড়ে গেল মালুর।
ওরা কী জানে না গাইয়ে বাজিয়ে লিখিয়েদের জোর করে বাগ মানান যায় না? হৃদয় মনের সুকুমার বৃত্তি নিঙড়িয়ে যারা রস আহরণ করে তাদের উপর কী জবরদস্তি চলে? জোর খাটিয়ে কোনোদিন কেউ কী পেয়েছে ওদের কাছ থেকে কাজ হাসিল করতে? কী এক গোঁ চাপল মালুর। অবজ্ঞা আর বিতৃষ্ণায় হাত গুটিয়ে বসে রইল ও। গান সে গাইবে না, দেখা যাক কী করে ওরা। অসাবধানেই বুঝি দৃষ্টিটা ওর ঘুরে গেল সেই কোণের আসনটির দিকে। স্বপ্নঘোর ভেঙে গেছে মেয়েটির। কোমল এক দীপ্তি এসেছে ওর চোখে। অন্যদের হয়ে যেন মাফ চাইছে ও। আর ছোট্ট একটি অনুরোধ এঁকে রেখেছে চোখের কোণে। অনুচ্চারিত সেই আবেদনটা কেমন করে অস্বীকার করবে মালু? তবলচিকে ইশারা দিয়ে গলাটা একটু ঝেড়ে নিল মালু।
একটি পুরনো গানে নতুন সুর যোজনা করল মালু। সুরটিও বোধ হয় পুরনো। কিন্তু নতুন তার ঝংকার। নতুন ঠাট। নতুন ব্যঞ্জনা। ঘুম পাড়ায় না টেনে নেয় না স্বপ্নের অলস পরিমণ্ডলে। মোহের পর্দা আচ্ছন্ন করে না মনকে।
এ এক উদ্দামতার গান। যৌবনের উদ্দামতা। চিরকালের যৌবন যা টগবগিয়ে উপচে পড়ে, ফেনা ছাড়ে। হয়ত ভারি করে তোলে জীবনের বাজে খরচের হিসেব। কিন্তু, সুপ্তি-মুক্তির সেই তো সুর। শুধু আরোহণ অবরোহণের শঙ্কা মুক্ত। হয়ত তাই এ গানের ভাষা মোলায়েম নয়। এর উচ্চারণ অমসৃণ, এর স্বর যেন শিলায় শিলায় প্রচণ্ড ঘর্ষণের রুদ্র নির্ঘোষ। এ কী করছে মালু? ও কী সম্বিত হারাল? রুক্ষতার-ছন্দে এ কোনো ভৈরবী রাগিণীর আরাধনা করছে ও?
হিমশিম খেল তবলচি। হয়রান হল বাজিয়া। ওদের হাত আর চলতে চাইছে না; আঙ্গুল এসেছে অবশ হয়ে। কিন্তু এ যে সুর। সুরের তো অন্য উম্মাদনা। চাঁদের আকর্ষণ যেমন করে টেনে নেয় পৃথিবীর পানি, নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের বুকে তোলে জোয়ারের আলোড়ন, তেমনি অপ্রতিরোধ্য সুরের আকর্ষণ। উন্মাদের মতোই যন্ত্রের বোল তুলে গেল ওরা। যেন আচমকাই থেমে গেল ওরা।
কিন্তু, একি? কোনো প্রতিক্রিয়া নেই দর্শকদের আসনে। যেন থম ধরে গেছে ওরা। অথচ ওরা সজাগ। স্বপ্নালুতার পর্দা নামেনি ওদের চোখের উপর।
ওরা হাত তালি দিল। উত্তাপ নেই সেই তালিতে। নেই ওদের প্রিয় শিল্পীর প্রতি সেই উচ্ছ্বসিত প্রশংসার কলকাকলি। কে ওদের বলে দেবে এই এক পুরুষ আগেও নজরুল নামের কোনো কবির কণ্ঠে এ গান জীবনের প্লাবন ডেকেছিল। এ গানের ভাষা এসেছিল সে কবিরই কলমের সাধনায়। লাল হয়ে এল মালু। যেন লাঞ্ছিত হয়েছে ও। এ রুদ্র রাগিণী গ্রহণ করল না ওর শ্রোতারা।
কত বিশ্বাস, কত আশ্বাস ও দুটো চোখে। যেন বলছে : বুঝেছি আমি বুঝেছি। আজীবন এ গানই গেয়ো তুমি। মালু দেখল মখমল নরম চোখ গলে ঝরে পড়েছে স্নিগ্ধ সহানুভূতি আর অন্তহীন মমতার ধারা। সে ধারা ধুয়ে দিল ওর লাঞ্ছনার গ্লানিটা।
অনুষ্ঠান শেষ হল। কলকলিয়ে বেরিয়ে গেল শ্রোতার দল। জলযোগ আর ধন্যবাদের পালাটা শেষ করে আমন্ত্রিত শিল্পীরাও চলে গেল একে একে।
গেটটার কাছে এসে থমকে পড়ে মালু। মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই নাম না-জানা চোখে-চোখে-কথা-বলা মেয়েটি। মালুকে দেখে এগিয়ে এল ও। একটা চিরকুট মালুর হাতে গুঁজে দিয়ে সরে পড়ল। গেটটা পেরুতে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। যেন বাতাসও শুনতে না পায় তেমনি মৃদুকণ্ঠে বলল : অপেক্ষা করব কিন্তু।
অবাক হবারও বুঝি অবসর পেল না মালু। সেই তখন থেকে দাঁড়িয়ে ছিল মেয়েটি? চিরকুটের ভাঁজটা খুলে ফেলল ও। লেখা আছে : … লারমিনি স্ট্রীট উয়ারী। আগামী কাল বিকেল সাড়ে পাঁচটা। কোনো সই নেই লেখার নিচে।
গেট পেরিয়ে দেখল মালু, একখানি কালো গাড়ি মোড় নিয়েছে বাঁ দিকের রাস্তায়।