কাজী নজরুল ইসলাম (জন্ম: ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬, মৃত্যু: ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ ) তিন যুগ ছিলেন মানসিকভাবে অসাড়, অক্রিয়। ৯ জুলাই ১৯৪২-এ ইতি ঘটে ২২-২৩ বছরের সাহিত্য জীবন। নেমে আসে বিষণ্ন অপরাহ্ন। এ কী জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি কবির বিতৃষ্ণা, বিরাগ; নাকি, ‘আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধূর ধূপ।’ ২৯ আগস্ট কবির মৃত্যু দিন স্মরণে আমাদের মূল রচনা।
কলকাতা বেতারকেন্দ্রে শিশুদের আসরে কবিতাপাঠ শেষ করতে পারেননি, হঠাৎ কণ্ঠ রুদ্ধ হলো, তারিখটি হলো ৯ জুলাই ১৯৪২। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পার হয়েছে মাত্র। এক বছরের ব্যবধানে বাংলার দুই মহাকবির একজনের জীবনের সমাপ্তি ঘটল, অন্যজন রয়ে গেলেন আরও তিন যুগ শরীরীভাবে, কিন্তু মানসিকভাবে অসাড়, অক্রিয়। তাঁর সৃষ্টিশীলতার মৃত্যু ঘটেছিল ওই দিনই।
তারপর ব্যাধির ক্রমাগত প্রসার, জটিলতা বৃদ্ধি এবং শেষ পর্যন্ত তা দুরারোগ্যতাকেও ছাড়িয়ে গেল। শরীর বর্তমান, কিন্তু মস্তিষ্ক ভাবনা-চিন্তা-বোধহীন, পুরোপুরি বিকল। ২২-২৩ বছরের সাহিত্যজীবনের ইতি ঘটল মধ্য বয়সে। আরও ৩৪টি বছর বেঁচে রইলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলার অগুনতি মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, গর্ব, উৎসাহ, আবেগ, ঔৎসুক্য, আগ্রহ এবং পরম দুঃখ, ব্যথা ও বেদনা নিয়ে।
এখনকার জাতীয় কবির লোকদেখানো দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, একসময় বাংলার মানুষ নজরুলকে নিয়ে সত্যি সত্যি মেতেছিলেন তাঁর প্রমত্ত তারুণ্য দুরন্ত যৌবন, প্রবল মুক্তি উদ্বেলতা, প্রচণ্ড রুদ্রতা, অমিত সাহসপূর্ণ স্বাধীন-চিত্ততা, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, বিপুল হইচই ও উল্লাসপ্রিয়তার জন্য। ‘উন্নত মম শির’ নজরুলের এটিই প্রধান পরিচয়। মানেননি তিনি দেশের পরাধীনতা, উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, ধনিকের দৌরাত্ম্য, সামাজিক বৈষম্য, মিথ্যাচার, ধর্মীয় ভণ্ডামি, অমানবিকতা, বিদেশি শাসকের গণবিরোধী আইনি ফরমান—কোনো কিছুই। বিদ্রোহী কবিতাতে তো লিখেছিলেনই, ‘আমি মানি না কোনো আইন’। স্বদেশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা হলো নিরঙ্কুশ, নিঃশর্ত, একমাত্র ধ্যানজ্ঞান—
যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামি ভাই করব সেথাই বিদ্রোহ।
ধামা-ধরা। জামা-ধরা। মরণ-ভীতু চুপ রহো।
আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ।
এই দুলালুম বিজয়-নিশান, মরতে আছি—মরব শেষ।
(বিদ্রোহী বাণী, বিষের বাঁশী)
ওই সোজা কথাই বললেন ধূমকেতুর সম্পাদকীয় রচনায় রবীন্দ্রনাথের আদলে শিরোনাম করে—মোরা সবাই স্বাধীন, মোরা সবাই রাজা। স্বরাজ অর্থাৎ নিজের স্বাধীন দেশ, নিজেদের শাসন বুঝিয়েছেন তিনি, ‘আমি কারুর অধীন নই, আমরা কারুর সিংহাসন বা পতাকাতলে আসীন নই।’ স্পষ্ট ভাষায় ধূমকেতুর পথের ঠিকানা নির্দেশও করে দিয়েছিলেন—
পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে। সকল কিছু নিয়ম-কানুন-বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।
আর এই বিদ্রোহ করতে হলে সকলের আগে আপনাকে চিনতে হবে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে—
‘আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ।’ বলতে হবে—
যে যায় যাক সে, আমার হয়নি লয়।
কোনো সন্দেহ নেই যে, সম্পূর্ণ আত্মপ্রত্যয়ভরা নজরুল বাংলা সাহিত্যে ব্রিটিশ শাসন-বিরোধিতার পয়লা নম্বর কবি। এ জন্য তাঁকে নির্যাতন ও পীড়ন সইতে হয়েছিল প্রচুর, কারাবাস করতে হয়েছিল পুরো একটি বছর, তাঁর অনেকগুলো বই নিষিদ্ধ হলো। কিন্তু নজরুল কিছুতেই মাথা নোয়ালেন না। তাঁর বিদ্রোহ-বাণী উচ্চারণ করে করে চললেন। অত্যাচার ও ত্রাসকে কোনো রকম তোয়াক্কাই করলেন না।
এমন নজরুলকে আমরা পাই তাঁর সাহিত্যজীবনের অনেকটা সময় ব্যেপে। তারপর একসময় নজরুলের বিদ্রোহী ও প্রতিবাদী সত্তার বজ্রনির্ঘোষ অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়ল। অগ্নিগিরির নির্বাপণ পুরোপুরি ঘটেনি বটে, কিন্তু নজরুল শান্ত হয়ে পড়লেন। গানের কলিতে এই শ্রান্তির কথাই বললেন তিনি, ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’। দেশের স্বাধীনতা তখনো আসেনি, অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণও উদ্ধত উলঙ্গই রইল, কিন্তু বিদ্রোহী কবির মধ্যে ক্লান্তি এসে ভর করল, তিনি সত্যি সত্যি রণক্লান্ত হয়ে পড়লেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য যে কবির এত তূর্যনিনাদ, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে এত প্রচণ্ড নির্ঘোষ, সর্বপ্রকার অমানবিকতার বিরুদ্ধে এত প্রতিবাদ, ধর্মান্ধতার প্রতি এত ব্যঙ্গোক্তি, সাম্প্রদায়িকতার প্রতি এত ঘৃণা, অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এত সংক্ষুব্ধতা—সেসব কোথায় গেল! প্রবল প্রেরণা ও উদ্দীপনায় যিনি লিখলেন অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয়োল্লাস, যুগবাণী, রুদ্রমঙ্গল, রাজবন্দীর জবানবন্দী, সাম্যবাদী, সর্বহারা; যিনি লাথি মেরে কারার লৌহকপাট ভেঙে ফেলতে চাইলেন, যিনি চাইলেন বক্ষ বিদীর্ণ করে দুঃশাসনের রক্ত পান করতে, যিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের বাংলা রূপ দিলেন; যাঁর মধ্যে এত তারুণ্যের দীপ্তি ও যৌবন-জল-তরঙ্গ, উজ্জীবনা, উদ্দীপনা ও সরবতা, সেই কবি কোলাহলের জগৎ থেকে ক্রমশ দূরে সরে গেলেন এবং বললেনও, ‘কোলাহল করি কারও ধ্যান ভাঙিব না’।
নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেলেন মহাবিদ্রোহী কবি। এ কি জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি কবির বিতৃষ্ণা বিরাগ! ওই যে বললেন, ‘আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ’—সে কী তীব্র অভিমান!
পুড়েছেন নজরুল জীবনের আগুনে, ধূপের মতো একাকী। জীবন মেলাতে পারেননি, সংসার গোছাতে পারেননি, অর্থকষ্টে ভুগেছেন; দারিদ্র্যকে মহান বলেছেন, কিন্তু তা যে কী মর্মান্তিক জীবন-যন্ত্রণা, তা কেবল কবিই অনুভব করেছেন, অন্য কেউ নন।
সাহিত্যজীবনের শেষ পর্যায়ে নজরুল প্রধানত গান ও সুর নিয়ে ব্যস্ত রইলেন। আগেও গান লিখেছেন, এবার গানের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দিলেন। জীবনের সচ্ছলতা বাড়ানোর জন্য গ্রামোফোন কোম্পানিতে যোগ দিলেন। নাটকে ও সিনেমাতে গান লিখলেন, সুর দিলেন, নিজেও অভিনয় করলেন।
নানা শ্রেণীর গান—আধুনিক, প্রেমসংগীত, ঋতুসংগীত, ভক্তিগীতি, ইসলামি গান, কীর্তন, ভজন, শ্যামাসংগীত ইত্যাদি। গানে নজরুলের সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য পরিলক্ষিত। বাংলা গানের তিনি এক শীর্ষ মহারথী। তাঁর অনেক গানেই বিষাদখিন্নতা ও বিরহের অতলান্ত বেদনার সুর বেজে ওঠে, আর থাকে নিবেদন, ভক্তি ও প্রীতি। গান রচনার মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের দিনগুলো অবসিত হয়ে গেল।
তবু সমাজ-সংসার কবিকে একাকী ও ধ্যানাবিষ্ট থাকতে দেয় না। তরুণেরা ডাক দেয়, অনুরাগীজন টেনে আনে বাইরের জগতে, সাহিত্য সভায় পৌরোহিত্য করেন কবি, ভাষণ দেন, গানও গান। একসময় রাজনীতিও করেছিলেন, রাজনীতির ময়দানের লোকেরাও আসে, সাংবাদিক ছিলেন একসময়, নতুন করে সংবাদপত্র সম্পাদনার দায়িত্ব এসে পড়ে। কিন্তু কবি তখন অবসাদখিন্ন, নিজের অসুস্থতা, স্ত্রীর পক্ষাঘাতগ্রস্ততা, সাংসারিক দুর্ভোগ—সব মিলিয়ে মধ্য বয়সেই কবি টালমাটাল, দিশেহারা। নজরুলকে ব্যবহার করেছে অনেক মানুষ, অনেক সংস্থা, অনেক কোম্পানি। তাঁর দ্যুতিময় প্রতিভা ও ধীশক্তির রস নিংড়ে নিয়েছিলেন স্বার্থপর মানুষেরা। কবিও অনুভব করছিলেন, তাঁর সৃষ্টিশীলতার আয়ু বোধহয় ফুরিয়ে এল। ঠিক মৃত্যুচিন্তা নয়, আর কিছু করার শক্তি তাঁর আর নেই, অসহায়ত্বের এ রকম একটি বিষণ্ন অনুভূতি এবং বোধ। জীবনের শেষ ভাষণে (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির রজতজয়ন্তী উৎসবের সভাপতি হিসেবে, ১৯৪১ সালের ৫ ও ৬ জুলাই) কবির ধ্যাননিমগ্ন বিষণ্নতার কথাই অভিব্যক্ত হলো, কবি যেন অন্য এক পরম লোকে চলে গেছেন।
১. অসুন্দরের সাধনা আমার নয়, আমার আল্লাহ পরম সুন্দর। তিনি আমার কাছে নিত্য প্রিয়ঘন সুন্দর, প্রেমঘন সুন্দর, রসঘন সুন্দর, আনন্দঘন সুন্দর। আপনাদের আহ্বানে যখন কর্মজগতের ভিড়ে নেমে আসি, তখন আমার পরম সুন্দরের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হই, আমার অন্তরে বাহিরে দুলে ওঠে অসীম রোদন। আমি তাঁর বিরহ এক মুহূর্তের জন্যও সইতে পারি না।
২. আনন্দ-রস-ঘন স্বর্ণবর্ণের এক না-জানা আকাশ থেকে যে শক্তি আমার রস সরবরাহ করতেন…তিনি মহাশ্বেতা-রূপে মাঝে মাঝে হয়ে যান সমাধিস্থা। তখন আমিও হয়ে যাই নীরব, আমার বাঁশি আর বাজে না, রসস্রোত হয়ে যায় তুষারভূত, আমার আনন্দময় তনু হয়ে যায় পাষাণ-বিগ্রহ। এ মৃত্যু নয়, কিন্তু মৃত্যুর চেয়েও নিরানন্দময়।
৩. যদি আর বাঁশি না বাজে—আমি কবি বলে বলছিনে—আমি আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছিলাম সেই অধিকারে বলছি—আমায় ক্ষমা করবেন—আমায় ভুলে যাবেন। বিশ্বাস করুন আমি কবি হতে আসিনি, আমি নেতা হতে আসিনি—আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম—সে প্রেম পেলাম না বলে আমি প্রেমহীন এই নীরস পৃথিবী থেকে নীরব অভিমানে চিরদিনের জন্য বিদায় নিলাম।
(যদি আর বাঁশি না বাজে)
বিদ্রোহ, বিপ্লব আর প্রতিবাদে যে কবি পৃথিবীকে নবযুগের আহ্বানধ্বনি শুনিয়েছিলেন, যে কবি স্বাধীনতার মন্ত্রবারিতে দেশকে সরস করতে চেয়েছিলেন, যে কবি মানবপ্রেমের জয়গানে সকলকে আত্মমর্যাদার ভরসা দিয়েছিলেন; তিনি মধ্য বয়সেই পৃথিবীকে প্রেমহীন ও নীরস ভেবে চিরবিদায় নিতে চান। এ তো অভিমান নয়, জীবনযন্ত্রণাবিদ্ধ কবির ব্যর্থতার গ্লানিবোধ। সাহিত্যজীবনের শেষ পর্যায়ে নজরুল চলমান সময়ের কোলাহল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। সে জন্য তাঁর শেষের কবিতা ও রচনাগুলোতে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংসার কিছুই আর আসেনি। নজরুল প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর কবি, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অনেকটা সময় তিনি দেখেছেন; কিন্তু ওই যুদ্ধ নিয়ে কিছুই তিনি লেখেননি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখন তুঙ্গে, এ নিয়েও নজরুল তেমন কিছু আর লেখেননি। ভারত-বিভক্তির অব্যবহিত পূর্ববর্তী বছরগুলোতে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল সময় চলছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরপরই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ পরাশক্তি বুঝে নিয়েছিল কলোনিগুলো আর ধরে রাখা যাবে না। ঔপনিবেশিক শাসন তুলে নিতেই হবে। সচল সক্রিয় নজরুলের প্রয়োজন এ সময়ে যে আরও বেশি ছিল, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা তিনিই তো উপনিবেশ-বিরোধিতার প্রধান কবি। কিন্তু নজরুলের সে সৌভাগ্য হলো না, জীবনের বিধাতা তাঁকে তার আগেই স্তব্ধ ও মূক করে দিলেন। নিশ্চুপ নিশ্চলতার দিকেই নজরুলের যাত্রা। মৃত্যু নয়, তবে তা মৃত্যুর অধিক। হয়তো প্রশান্তি, কিন্তু বিষণ্নতার গান, ‘বিদায়ের বেলা মোর ঘনায়ে আসে’।
দিনের চিতা জ্বলে অস্ত-আকাশে\
দিন শেষে শুভদিন এলো বুঝি মম
মরণের রূপে এলে মোর প্রিয়তম
গোধূলির রঙে তাই দশ দিশি হাসে\
দিন গুনে নিরাশার পথ-চাওয়া ফুরালো
শ্রান্ত ও জীবনের জ্বালা আজি মুড়ালো।
ওপার হতে কে আসে তরী বাহি
হেরিলাম সুন্দরে, আর ভয় নাহি
আঁধারের পায়ে তার চাঁদ-মুখ ভাসে\
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ২৬, ২০১১
Leave a Reply