লাল চেয়ারে মাদাম সেজান নিউইয়র্কের গোগেনহাইম মিউজিয়ামের কাঠের ঢালু র্যাম্প দিয়ে বয়সের ভারে জরাজীর্ণ মিসেস শারলট রসম্যানের হুইলচেয়ারটি ঠেলতে ঠেলতে ব্যালান্সের জন্য রেলিংয়ে হাত দিতে গেলে দেখি, ওখানে সার দিয়ে বসে আছে পশমি সোয়েটার পরা কাচের সব গিরগিটি, তাদের টুকটুকে লাল জিহ্বার নিচে রাখা একটি করে থার্মোমিটার। শিল্পশোভন কায়দার হাতল ভেবে তাদের ছুঁতে গেলে খানে দজ্জালের মতো কানা এক প্রহরী অ্যায়সা তেড়ে আসেন, যেন গিরগিটিদের কালোয়াতি অভিব্যক্তি অনুধাবন করতে না পারলে তিনি ঘেটি ধরে আমাদের ভাসিয়ে দেবেন দজলা নদীতে। বিষয়টি খেয়াল হতেই মিসেস রসম্যান ভ্রুকুটি করে বলেন, ‘ইউ আর অ্যা স্ট্রং জুলু ফ্রম আফ্রিকা, দিস ইজ মিউজিয়াম, ডোন্ট টাচ্ অ্যানিথিং বয়, জাস্ট পুশ।’
শারলট রসম্যানের বয়স আশির ওপরে। একসময় নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটিতে তিনি ফাইন আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশনের কোর্স পড়াতেন। শোনা যায়, ফরাসি দেশের চিত্রশিল্পী সেজানের ওপর তাঁর স্পেশিয়ালিটি আছে। তেরো বছর ধরে তিনি ভুগছেন আলঝেইমার ব্যাধিতে। আমি ভলান্টিয়ার হিসেবে তাঁর জন্মদিনে তাঁকে জাদুঘরে সেজানের চিত্র প্রদর্শনী দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি। হুইলচেয়ারে সওয়ার হওয়ার সময় আমি তাঁকে বলেছি, আমার সাকিন বাংলাদেশ, খেশ কুটুমরা ওখানেই থাকেন। তার পরও তিনি আমাকে জুলু মনে করায় ইচ্ছা হয় নিউইয়র্ক ছেড়ে হুনুলুলুতে চলে যাই। হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে আমার প্রতিক্রিয়া জানাতে তিনি বয়সের তারজাল আঁকা কুঁচকানো মুখে হেসে বলেন, ‘ও ইয়েস, আই রিমেম্বার, তোমাদের দেশের রাজধানী…ফাইন সিটি ইস্তাম্বুল’—আমার জিহ্বা চুলবুল করে ওঠে বুড়িকে জোরসে ধাতানি দেওয়ার জন্য, তবে মুরব্বি মানুষের সঙ্গে বেয়াদবি করলে আল্লাহ বেজার হবেন ভেবে খামোশ থাকি।
প্রদর্শনীতে ঢোকার মুখে টাঙানো খোদ সেজানের আঁকা বিশাল প্রতিকৃতি। তার কাছে যেতেই বৃদ্ধা বলে ওঠেন, ‘কনসার্টের তো দেরি আছে, আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যাও, এক পাত্র মার্টিনি হলে সিম্ফনি শুনতে বেশ হবে। ইস্তাম্বুলে তোমরা তো রাখি খাও। আই নো অল অ্যাবাউট ইট।’ আমি ইস্তাম্বুল প্রসঙ্গে বেফজুল কিছু না বলে তাঁকে ইয়াদ করিয়ে দিই, ‘মেম, আজকে কোনো কনসার্ট হচ্ছে না। আমরা সেজানের প্রদর্শনী দেখতে যাচ্ছি।’ তিনি চটে উঠে বলেন, ‘আফ্রিকায় তো জুলুরা গুহাগাত্রে ছবি আঁকে, সেজানের পেইন্টিংয়ের তুমি কি জানো? টেল মি দ্য ট্রুথ।’
‘আরে মেমসাহেব, তাঁর সম্পর্কে জানার জন্য তো কাজবাজ ছেড়ে আজ আপনার সাথে এসেছি। কাইন্ডলি একটু বয়ান করলে শুধু উপকৃত নয়, রীতিমতো সরফরাজ হই।’ শারলট রসম্যান বাকতাল্লা শুরু করলে, তিনি বিশেষজ্ঞ কি না, তাই আমি ছোট্ট টেপে তাঁর বক্তব্য রেকর্ড করি। যার সারাৎসার হচ্ছে:
‘যে সময় প্যারিসে তাঁর জানি দোস্ত পিসারো ও রেনেয়ার ইমপ্রেশনিস্ট সব পেইন্টিং এঁকে সমঝদারদের মাতোয়ারা করে দিচ্ছেন, সেজান তখন কাজ করতেন নিভৃতে। মাঝেমধ্যে যিশুখ্রিষ্ট যে রকম ভারী ক্রুশ বহন করছিলেন, সে রকম ক্যানভাসের বোঝা কাঁধে করে ন্যুব্জ পিঠে এসে দাঁড়াতেন কনসের সব জাত দেখনেওয়ালার সামনে। আর্টক্রিটিকরা তাঁর চিত্রকে অ্যায়সা বিলা করতেন যে তিনি চাকু দিয়ে তাবৎ ক্যানভাস ছিঁড়েখুঁড়ে চলে আসতেন ল্যুভর মিউজিয়ামে। আততায়ীর হাতে ধরা চাক্কুর মতো পেইন্ট ব্রাশ খামচে ধরে ঘুরে বেড়াতেন জাদুঘরের ঝাড়বাতিতে সমুজ্জ্বল সব অলিন্দে। স্কেচবুকে নকল করতেন ধ্রুপদি তৈলচিত্রের অনুকৃতি। সনাতনী প্রকরণের সিলসিলা বোঝার চেয়েও অনেক বেশি অবসেসড ছিলেন ট্র্যাডিশনাল ফর্ম ভেঙেচুরে তছনছ করে দেওয়ার দিকে। এভাবেই তিনি খোলনলচেসহ পরিবর্তন করেন পরবর্তী জমানার শিল্প-দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি চাইতেন, তাঁর রং থেকে যেন ঝরে তাজা খুন। একবার কবি জোয়াসিম গাসকেটকে বলেছিলেন, ক্ল্যাসিক্যাল যুগের ওস্তাদেরা এঁকেছেন নারীর উষ্ণ শরীর, তাঁদের কারও কারও সবুজ পত্রালিতে ছাওয়া বৃন্ত থেকে বেরিয়ে আসত তরল কস। তবে হ্যাঁ, আমার চিত্রে ধারণ করতে চাই আদিগন্ত মাঠ থেকে উত্থিত সবুজ গন্ধ, আর সেইন্ট ভিক্টরে পর্বতের মর্মর অবয়ব থেকে উড়ে আসা পাথরের সৌরভ। জেনে রাখো, আমি কিন্তু প্যারিসের সমঝদারদের জিগরে নাড়া দেব একটি মাত্র আপেলের স্থিরচিত্র এঁকে।’
বয়ান সমাপ্ত করে মিসেস শারলট রসম্যান ‘নাও, ইউ নো হোয়াট সেজান ওয়াজ আফটার। তুমি কিন্তু এই প্রদর্শনী খুব এনজয় করবে, ইউ আর অ্যা ফাইন জুলু’ বলে কুলুকুলু করে খামোখা ফোকলা মুখে হাসেন। সেজানের প্রতিকৃতির সামনে এসে দাঁড়ান চার্লি চ্যাপলিনের নির্বাক যুগের বায়স্কোপের চরিত্রের মতো ফ্রক-কোট পরা ছড়ি হাতে এক সমঝদার। তিনি ট্রলিতে করে ঠেলে আনছেন গোটা পঁচিশেক জিল করা বই-পুস্তক আর গিটার। ফাইন আর্টস বোঝার জন্য বুঝদারদের বইপত্র পড়তে হয় বটে, কিন্তু তা ট্রলিতে করে ঠেলে প্রদর্শনীতে নিয়ে আসার তো কোনো রসুম নেই। খানে দজ্জালের মতো কানা প্রহরী তাঁকে বাধা দিলে তিনি দস্তানা পরা হাতে ধস্তাধস্তির উদ্যোগ নেন। এই মওকায় আমি বইগুলো চিত্রশিল্পের কি না, তা দেখতে গিয়ে বুঝতে পারি, এগুলো অকাল্ট সায়েন্স, কিরোর হস্তরেখা ও নিউমারোলজির কিতাব। প্রহরী ট্রলি আটকালে তিনি পকেট থেকে হাতের রেখার ছাপওয়ালা কাগজ বের করে সেজানের প্রতিকৃতির সামনে মনোকলজাতীয় চশমা দিয়ে তা দেখতে শুরু করেন। বিড়বিড় করে হস্তরেখার ছাপ খোদ সেজানের বলে দাবি করলে তাঁর আচরণে প্রতিকৃতি থেকে সেজানের বোধ করি বাজান বলে আর্তনাদ করতে ইচ্ছা হয়।
প্রদর্শনীর হলকক্ষে এসে ‘হাউস অব বেলভিউ’ ও ‘পপলার’ বলে দুটি নামজাদা চিত্রের পাশ দিয়ে হুইলচেয়ার ঠেলে চলে আসি আপেলের স্থিরচিত্রের সামনে। মিসেস রসম্যান এবার অস্থির হাতে কী কারণে জানি তাঁর পার্স খুলিবিলি করে বলেন, ‘ডু ইউ নো দ্য নেম অব এমিলি জোলা? বিখ্যাত ফরাসি লেখক, তিনি সেজানকে পাঠিয়েছিলেন এক ঝুড়ি আপেল। জোলা সেজানকে চরিত্র করে উপন্যাসও রচেছিলেন। না, জোলার পোর্ট্রেট তিনি আঁকতে পারেননি। এঁকে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন। তবে তাঁর পাঠানো আপেল, জাস্ট লুক অ্যাট ইট, কী রকম অমর হয়ে আছে।’ আপেলের চিত্র আড়াল করে দাঁড়িয়ে শুভ্র ব্রাইডাল গাউন পরা এক যুবতী। এ ধরনের পোশাক পরে মেয়েরা যায় চার্চে বিয়ের কনে সেজে। তাঁর গণ্ডদেশে লেপ্টানো লিপস্টিকের লোহিতাভা। অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে স্থিরচিত্রটি ভালো করে দেখার জন্য হুইলচেয়ার ঘোরাতেই শুভ্রবসনা নারী একটি আংটা থেকে ফুঁ দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেন সব বুদ্বুদ। মুহূর্তে সাবানের স্বচ্ছ গোলকে প্রতিবিম্বিত হয় ঝাড়ের রংধনু আলো। চিত্রদর্শনের তরিবতের সাথে ফুৎকারে বুদ্বুদ ছড়ানো অসামঞ্জস্যপূর্ণ, তাই তাকে সামাল দিতে ছুটে আসেন কানা প্রহরী। তাঁর দিকে তাকিয়ে নৃত্যের ভঙ্গিতে ঘুরে শুভ্র গাউনের ফ্রিলকে ছত্রের আকৃতি দিয়ে নারীটি গেয়ে ওঠেন, ‘লাস্ট নাইট…লুবি লুবি লি লি, আই মেইড লাভ ইন সিসিলি।’ তাঁর গানের কলি অনুযায়ী তিনি গত রাতে রতিক্রিয়ায় লিপ্ত ছিলেন ইতালির সিসিলি দ্বীপে। তা বেশ, নিশ্চয়ই চিত্র দেখতে সকালের ফ্লাইটে তিনি নিউইয়র্কে এসেছেন! কানা প্রহরী থতমত খেয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে এক চক্ষু বস্ফািরিত করে লো নেকলাইনের সিথ্রু গাউনের ভেতর দিয়ে যেন যমজ চন্দ্র দেখেন। মিসেস রসম্যান আবার পার্স খুলিবিলি করে বলেন, ‘বয়, আমার হিয়ারিং এইডটা খুঁজে দাও তো। মেয়ে গাইছে কি, কিছু যে ঠিকমতো শুনতে পাচ্ছি না?’
মাদাম সেজানের পোর্ট্রেটটি দেখার আগ্রহ আছে আমার, তবে ওদিকে যেতে চাইলে পরীক্ষার পড়া ধরার ভঙ্গিতে বৃদ্ধা বলেন, ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট সম্পর্কে তুমি কী জানো? টেল মি বয়।’ আমাকে জবাবের কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনি আবার বলেন, ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট বা বিমূর্ত শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলনের কোনো জরুরত নেই। মূর্ত থেকে বিমূর্তে চলে যাওয়ায় মূল মাজেজা হচ্ছে, এখানে শিল্পী প্রকরণ ও রং দিয়ে এমন এক কম্পোজিশন তৈরি করেন, যা মূলত হয়ে ওঠে ভিজুয়াল ল্যাংগুয়েজ।’ এ পর্যন্ত বলে তিনি দম ধরে আবার মন্তব্য করেন, ‘বয়, ইফ ইউ ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য বেসিকস অব অ্যাবস্ট্রাক্ট ভিজুয়াল ল্যাংগুয়েজ…’ বলে তিনি এমন এক মুখভঙ্গি করেন, তাতে মনে হয় তাঁর বক্তব্য হচ্ছে, ‘বাছা, ভিজুয়াল ল্যাংগুয়েজ না বুঝলে তোমার তো সেজানের চিত্র না দেখে বরং ইস্তাম্বুলের বাজারে দাঁড়িয়ে খেজুরের গুড় বিক্রি করা উচিত।’ আর্ট সম্পর্কে আমার নলেজের সংকট থাকলেও আত্মসম্মান নিয়ে কোনো অনটন নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে করা যায় কী? বিস্মৃতিপ্রবণ বুড়ির ত্রিসংসারে কেউ নেই দেখে তাঁর জন্মদিনে কিঞ্চিৎ আনন্দ দেওয়ার জন্য আমি তাঁকে সাহায্য করছি। এই স্বেচ্ছাসেবায় আখেরে সওয়াব হাসিল হলেও এই মুহূর্তে তাঁর সহবৎ গোর-আজাবের শামিল মনে হয়।
অবশেষে আমরা মাদাম সেজানের চিত্রের সামনে এসে দাঁড়াই। এই ছবি নিয়ে মিসেস রসম্যানের লেখা একটি প্রবন্ধও আছে। সুতরাং, তাঁর কথা ধারণ করার জন্য আমি আবার টেপ অন করি। বৃদ্ধা ঠোঁট উল্টিয়ে বলেন, ‘লিসেন বয়, দ্য ট্রুথ ইজ…নারী সান্নিধ্যে সেজান ছিলেন রীতিমতো আতঙ্কিত, জানতেনও না তাদের সঙ্গে কী ধরনের সুলুক করতে হবে? একবার তাঁর স্টুডিওতে এক নারী মডেল, বেচারি কেবল বিবস্ত্র হতে শুরু করেছে, তিনি ঘাবড়ে গিয়ে প্রায় নগ্নিকা মেয়েটিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেন। তবে ১৮৬৯ সালের দিকে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় হরটেনসে ফিফেটের। সে-ও আরেক মডেল, তাঁদের সম্পর্ক ছিল দীর্ঘ ৩৭ বছর। তাঁদের একটি ছেলেসন্তানের জন্ম হলেও তাঁরা একত্রে বাস করেছেন খুবই অল্প। লুক অ্যাট হার, হরটেনসে এখানে কী রকম তেতো-বিরক্ত হয়ে পোজ দিচ্ছে। চিত্র সম্পর্কে এই মেয়ের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না। নাউ টু টেল ইউ অ্যা সিক্রেট, তাম্রবর্ণা চুলের এই দীর্ঘাঙ্গীকে লাল চেয়ারে বসিয়ে তাঁর ছবি না এঁকে তাঁর সঙ্গে নিয়মিত সহবাস করলে সেজান উপকৃত হতেন সবচেয়ে বেশি।’ তাঁর বক্তব্যের শেষাংশ নিয়ে আমি ফলোআপ প্রশ্ন করি। কিন্তু তিনি প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বলেন, ‘জার্মান কবি রাইনে মারিয়া রিলকে কিন্তু এই ছবি নিয়ে দারুণ রিমার্ক করেছেন। তাঁর মতে, লাল চেয়ারে বসা মাদাম সেজান কোনো বিষয় নয়, এখানে চিত্রের কম্পোজিশন এমনভাবে তৈরি যে, মনে হয় তাঁর বর্ণাঢ্য অভ্যন্তর মৃদু মৃদু কাঁপছে আর রঙের ভাইব্রেশন ভেঙে পড়ছে ঊর্মিমালায়।’
আরও অনেক চিত্র দেখার বাকি আছে, তাই আবার হুইলচেয়ার ঠেলতে শুরু করলে মিসেস রসম্যান বলেন, ‘ছবিটি সিয়াটলের বোয়িং কোম্পানির মালিকের পার্সোনাল কালেকশনে ছিল অনেক দিন। আমার ভাশুর অ্যারোপ্লেনের মেকানিক হিসেবে বোয়িংয়ে কাজ করতেন। টু টেল ইউ অ্যা সিক্রেট…ভাশুর মশাই চিত্রটি চুরি করার পরিকল্পনা করেছিলেন। পরে আমি ওনার সঙ্গে প্যারিসে ডেট করি। তারপর আমাদের বিয়ে হয় সিয়াটলের এক চার্চে।’ বক্তব্য শুনে মনে হয়, বৃদ্ধা এবার ভাশুর আর ভাতারে ভজঘট করে ফেলছেন। সুতরাং, তাঁর আবজাব বকোয়াস রেকর্ড করার কোনো জরুরত নেই। তাই আমি টেপ অফ করি।
হলকক্ষের ঠিক মাঝামাঝি টাঙানো ‘মাউন্ট সেইন্ট ভিক্টরে উইথ লার্জ পাইন’ নামের চিত্রটি। এর সামনে দাঁড়ালে হালকা নীলাভে শুভ্র সবুজ হরিতের ঈষৎ প্রলেপ দৃষ্টিতে তন্ময়তা ছড়ায়। পাহাড় এখানে উপস্থাপিত হয়েছে আকাশের প্রেক্ষাপটে, হাওয়ার ঝিলিমিলি সঞ্চালনে যেন বর্ণের এক স্থাপত্য হিসেবে। এ চিত্রপটের প্রগাঢ় নির্জনতার দিকে তাকিয়ে মিসেস রসম্যান বলেন, ‘রোদ পোহানো কুমিরের মতো এই পর্বতের সামনে সেজান বসে থাকতেন গতিরহিত। আর অলস চেখে বারবার পর্যবেক্ষণ করতেন ভাসমান মেঘের ছায়ায় পত্রালির সঞ্চালনে প্রকম্পিত পাথরের পর্বত। এই চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে কবি রাইনে মারিয়া রিলকে বলেছিলেন, হজরত মুসা (দ.) যেমন সর্বশক্তিমানের তেজস্ক্রিয় বিভায় অবলোকন করেছিলেন সিনাই পাহাড়ের রূপ, তারপর বুঝি আর কেউ সেজানের মতো কোনো পাহাড়কে এভাবে পর্যবেক্ষণ করেননি।’
আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পাহাড়ের এই ছবিটি আমার দেখার ইচ্ছা হয়, তবে মিসেস রসম্যান অস্থির হয়ে পার্স থেকে ছোট্ট নিড়ানির মতো কিছু বের করে তা দিয়ে দুই হাত চুলকাতে থাকেন। তাঁর হাতির দাঁতের মতো শ্বেতকায় হাতে ধূসর ছাতাধরা নীলচে সব চাকা ফুটে বেরোচ্ছে। তিনি চুলকাতে চুলকাতে জানতে চান, ‘হোয়ার ইজ মাই অ্যালার্জি মেডিসিন, বয়?’ তাঁর ওষুধপত্রের কোনো সুলুকসন্ধান আমার জানা নেই বলে তাড়াতাড়ি মিউজিয়াম থেকে বেরোতে যাই, যাতে তাঁকে বয়স্ক মানুষের জন্য নির্দিষ্ট নার্সিং হোমে পৌঁছে দিতে পারি। কাঠের র্যাম্প ধরে নেমে আসার সময় তিনি বিড়বিড় করে বলেন, ‘এই পাহাড়কে আরও নিবিড়ভাবে স্টাডি করার জন্য সেজান ১৯০৬ সালের ১৫ অক্টোবর আবার পেঁচিয়ে ওঠা সড়ক ধরে বৃষ্টি-বাদলের মধ্যে উঠে যান ওপরে। ঝোড়ো হাওয়ায় বজ্রপাত হলে এক অচেনা পথচারী সংজ্ঞাহীন শিল্পীকে ধোপার গাড়িতে করে ফিরিয়ে আনে তাঁর স্টুডিওতে। জ্ঞান ফিরে এলে তিনি পথচারীকে বলেছিলেন, ছবি আঁকতে আঁকতে মৃত্যু হলে কিন্তু খুব ভালো হতো। ছয় দিন পর সেজানের মৃত্যু হয় নিউমোনিয়ায়।’
র্যাম্প থেকে নেমে আসার সময় দেখি, পাশের এক বেঞ্চে বসে ছড়ি হাতে হস্তরেখাবিদ সমঝদার গিটার বাজাচ্ছেন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাইডাল গাউন পরা যুবতী দুই চোখ মুদে গাইছেন, ‘লাস্ট নাইট আই ডাইড ইন ইয়োর আর্মস।’ এই গানের তর্জমা হচ্ছে, ‘গেল রাতে তোমার বাহুডোরে আমার মৃত্যু হয়েছে।’ এই কলিটি হাছা হলে মেঘের মতো শুভ্র বসনে আচ্ছাদিত এই নারীর শরীর, যা এই মুহূর্তে ভাস্কর্যে বসে থাকা একঝাঁক সফেদ কবুতরের মতো দেখাচ্ছে, তা কি তবে অশরীরী? কানা প্রহরী কাচের গিরগিটিদের পাহারা দিতে দিতে এক চোখে সমঝদারের সঙ্গে শ্বেতবসনাকে দেখেন, তবে তাঁরা বর্তমানে তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে তেমন কিছু করতে পারেন না।
মিসেস রসম্যান বলেন, ‘বয়, সিয়াটলের যেখানে আমি থাকি, সাবওয়ের আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন ছাড়া ওখানে পৌঁছানো কঠিন।’ আমি জবাবে বলি, ‘মেম, আমরা এখন নিউইয়র্কে আছি। আমি আপনাকে ট্যাক্সিতে করে নার্সিং হোমে পৌঁছে দিচ্ছি।’ তিনি প্রতিবাদ করে বলেন, ‘লিসেন বয়, আই লিভ ইন সিয়াটল, আমার ওষুধপত্র সব ওখানে, আমাকে সাবওয়ে স্টেশনে পৌঁছে দাও প্লিজ! এনাফ অব সেজান টুডে!’
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ২৬, ২০১১
Leave a Reply