সাহসী সূচনা
কাজল রশীদ
ঢাকা নগর জীবনে নারী \ সম্পাদক: সোনিয়া নিশাত আমিন \ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি \ প্রচ্ছদ: নাইমা হক, ফারজানা আহমেদ \ দাম: ৫০০ টাকা \ পৃষ্ঠা: ৩৮৪
বিশ্বে যা- কিছু মহান সৃষ্টি চির- কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
(নারী: কাজী নজরুল ইসলাম)
উপর্যুক্ত পঙিক্ত যতটা শাশ্বত, ততটা অমোঘ। তার পরও স্বীকৃতি মেলে না। উপেক্ষিত হয় প্রায় সর্বত্র। একবিংশ শতাব্দীর এক দশক পেরিয়েও রূঢ় বাস্তবতার অবসান হয়নি। ইতিহাসেও নারীর মর্যাদা দেওয়া হয়নি। পরিবার থেকে রাষ্ট্রের সব স্তরে, প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান থাকলেও; স্বীকৃতি, সম্মান, সুযোগ, সুবিধার ক্ষেত্রে নারীর প্রাপ্তি অশ্বডিম্ব সদৃশ। কস্মিনকালে ভাগ্যের শিকে ছিঁড়লেও তা নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো হওয়ার মতো আপেক্ষিক। দায়সারা স্বীকৃতি, অনন্যোপায় মূল্যায়ন, মুষ্টিবদ্ধ ভালোবাসার অসহনীয় রীতি, সংস্কৃতি, কৃষ্টির ধারাবাহিকতাতেও নারীরা সোনা ফলাতে কার্পণ্য করেনি। প্রবহমান নদীর মতোই তারা সৌন্দর্যের সঙ্গে জীবন সুধা প্রদান ও অমূল্য কীর্তি গড়ার অনন্য এক আধার।
রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছরের ইতিহাসও নারীর ভূমিকায় ঋদ্ধ। ঘরে-বাইরে দ্বিবিধি প্রান্তই নারী ও পুরুষের দ্বিঃসরিত কর্মযজ্ঞে নির্মিত। অথচ নারীর জীবন ও কর্মকে সম্মুখে আনা হয় না। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী কর্মসাধন করেছে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। এদের সাম্প্রতিক সময়ের প্রকাশনা (রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর উপলক্ষে ‘ঢাকা নগর জীবনে নারী’ নারীর মহিমা ও মর্যাদার কথা তুলে ধরেছে। বইটির সম্পাদক সোনিয়া নিশাত আমিন। সঙ্গে রয়েছেন চার সদস্যের (সম্পাদকসহ পাঁচজন) সম্পাদনা পরিষদ: অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ, ড. সৌমিত্র শেখর, ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী।
প্রধান সম্পাদক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ আলোচ্য বইটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘১৬০৮ সালে মুঘল রাজধানী হিসেবে ঢাকার আত্মপ্রকাশ এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করে। ০০০ সৃষ্টির প্রথম থেকেই সত্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে নর ও নারী উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। ঢাকার ইতিহাসও এর কোনো ব্যতিক্রম নয়। অথচ এই ঢাকা শহরে বিগত ৪০০ বছরে নারীর জীবন কেমন ছিল, তা যথার্থ অর্থে বলতে গেলে আমরা কিছুই জানি না। বিষয়টি আমাদের পীড়া দেয় এবং রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর উদ্যাপনের এই সন্ধিক্ষণে আমরা অতীতের এই উদাসীনতা বা শূন্যতা পূরণে আগ্রহী হই। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, আমাদের গ্রন্থে যেসব গ্রন্থ প্রকাশিত হবে তাদের মধ্যে একটি হবে সম্পূর্ণভাবেই নারীবিষয়ক।’
বইটির প্রবন্ধ শিরোনামও লেখক নাম দেখে সহজেই অনুমিত হয় বইটি নারীর মহিমা, মর্যাদা, অবদানকে সমুন্নত ও সমন্বিত করেছেন যথার্থভাবেই। এগুলো হলো: জনবিন্যাস: নারী ও নগর—নজরুল ইসলাম ও মেহেদী হাসান খান; পরিবার: সনাতন থেকে আধুনিক—মাহমুদা ইসলাম ও বিলকিস রহমান; অর্থনীতিতে
নারী: হস্তশিল্প থেকে করপোরেট ব্যবস্থাপনা—সালমা খান; সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে নারী স্বাস্থ্য—হোসনে আরা বেগম ও মৃত্তিকা সহিতা; ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে নারী স্বাস্থ্য—পাপড়ীন নাহার; শিক্ষা ও নারী: অন্দরমহল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—জাহেদা আহমেদ; নারীদের রচিত সাহিত্য: গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ-ভীম্মদেব চৌধুরী; নারী সাহিত্য, উপন্যাস—জুবাইদা গুলশান আরা নারী সাহিত্য: উপন্যাস (১৯৪৮-২০১০)—রফিকউল্লাহ খান; রাজনীতি: অন্দরমহল (সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী)—শিরীন আখতার; রাজনীতি: অন্দরমহল রাজপথ ও সংসদ (ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দী)—মালেকা বেগম; আইনে নারী: নারীর আইন—গোবিন্দ চন্দ্র মণ্ডল; নারীর নৃত্যচর্চা শেখ মেহেদী হাসান; পরিবেশনা শিল্পে নারী: সংগীত—মহসিনা আক্তার খানম (লীনা তাপসী খান); পাশ্চাত্য প্রভাবিত নাট্যচর্চায় নারী—ইসরাফিল শাহীন ও সুদীপ চক্রবর্তী শিল্পকলা চর্চা—নাজমা খান মজলিশ; নারী ও চলচ্চিত্র—অনুপম হায়াৎ; গণমাধ্যম ও নারী: সংবাদপত্র বেতার টেলিভিশন; সভা-সমিতি ও এনজিও—সাদেকা হালিম ও ফারজানা মান্নান বর্ণা; বহিরাগত একলা নারী: আবাসন ও জীবন সমস্যা—রোজি মজিদ আহসান ও হাফিজা খাতুন; কীর্তিমান নারী ব্যক্তিত্ব—নাজমা সিদ্দিকী ও রাশিদা আখতার খানম।
লেখকেরা প্রত্যেকেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রাজ্ঞ, ধীমান, গবেষক ও সুচিন্তিত বিশ্লেষক। বিষয়ভিত্তিক প্রতিটি লেখায় পৃথক বই কিংবা সুবৃহৎ একটি গবেষণা হওয়ার জন্য যথোপযুক্ত। সাগর সেঁচে মুক্তো সংগ্রহের মতো লেখকেরা দীর্ঘ কলেবরের বিষয়কে একটি প্রবন্ধের মধ্যে পরিচিত স্থান দিয়েছেন। ফলে বইয়ে তাই মুক্তোর সমাহার ঘটেছে। যা বইটিকে সব ধরনের পাঠকের পাঠযোগ্য করেছে। যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহী, তাঁরাও পছন্দের রকমফের অনুযায়ী খুঁজে পাবেন উদ্দিষ্ট বিষয়। রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছরের নারীর বিশিষ্টতার বিভিন্ন বিষয়ও কর্মে ঠাসা এই বই সবার নিবিড় পাঠ ও সংগ্রহে রাখার মতো একটি বই।
প্রসঙ্গত, রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে যে বহুমাত্রিক কর্মসূচি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ নিয়েছে, তার একটি ঢাকা-সংক্রান্ত ১৯টি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশনা। এই একাডেমিক কর্মসূচির আওতায় ইতিমধ্যে অধ্যাপক শরীফউদ্দিন আহমেদের সামগ্রিক সম্পাদনায় নয়টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এই সিরিজের নবম গ্রন্থ অধ্যাপক সোনিয়া নিশাত আমিন সম্পাদিত ‘ঢাকা নগর জীবন নারী’।
অকর্ষিত, অচর্চিত, অবহেলিত একটি বিষয়ের তাৎপর্য উপলব্ধিপূর্বক এই বই প্রথম আলোর পরশ দিয়েছে। যাকে বলা যায় সাহসী সূচনা। যার মধ্য দিয়ে নারীর যথাযোগ্য স্বীকৃতি দেওয়ার প্রয়াস ও প্রচেষ্টা রয়েছে। যা নারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্মানিত, গৌরবান্বিত করেছে। যা শুধু কাঙ্ক্ষিত ও প্রত্যাশিত নয়, অপরিহার্য ও অনিবার্যও ছিল।
সাহসী সূচনার এই ধারা অব্যাহত গতিমান হোক, বোধ ও বোধিতে নারী সচেতনতায় বৃক্ষ রোপিত হোক, ঢাকা নগর জীবনে নারী বই পাঠ এই সত্যকেই উচ্চকিত করেছে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ২৬, ২০১১
Leave a Reply