অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার
‘ভায়োলেন্স আমি নিতে পারি না’
তারেক মাসুদ [৬ ডিসেম্বর ১৯৫৭—১৩ আগষ্ট ২০১১]
একাধিক বৈঠকিতে তারেক মাসুদের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে। সেখানে নানা বিষয়ের ওপর তিনি খোলামেলা কথাবার্তা বলেছিলেন। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে সেই সাক্ষাৎকারটির অংশবিশেষ ছাপা হচ্ছে এখানে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তৈমুর রেজা
প্রশ্ন: বাংলা চলচ্চিত্রের বয়স অনেক দিন তো হয়ে গেল। এত দিনকার বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসের মধ্য দিয়ে কি ছবির কোনো নতুন ভাষার আদল তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে? আপনি কী মনে করেন?
তারেক মাসুদ: দেখো, এখানে একটা প্যারাডক্স আছে। আমাদের দেশে চলচ্চিত্র মাধ্যমটা প্রযুক্তির দিক দিয়ে বাইরে থেকে এসেছে। বলতে গেলে পুরোটাই। এর প্রাথমিক বিকাশ যেহেতু পশ্চিমেই হয়েছে, এর কারিগরি দিকটির বাইরেও শিল্পমাধ্যম হিসেবে এর যে সৃজনশীল চরিত্র, সেটাও কিন্তু নির্ধারিত হয়েছে পশ্চিমের ধরন-ধারণ দিয়ে। এ অঞ্চলে চলচ্চিত্রের যে প্রবাহ দেখতে পাই, গোড়া থেকেই সেখানে আসলে প্রযুক্তির পাশাপাশি ছবির স্বভাব কী হবে, সেটাও ওখান থেকে ধার করা হয়েছে। এই যে কনটেইনারের সঙ্গে কনটেন্ট চলে আসা, সেটা বেশ বড় রকমের ঝামেলা তৈরি করেছে। গানের ব্যাপারটা দেখো। আমরা জানি, মিউজিক্যাল যে ব্যাপারটা আমাদের এখানে প্রভাব ফেলছে, সেটা হলিউডি ব্যাপার। বলিউডে যে মিউজিক্যাল কাঠামো এখন হরদম চলছে, সেটা কিন্তু স্থানীয় উদ্ভাবন নয়। সেটা হলিউড থেকে এসেছে। এর ইন্সপিরেশনটা স্থানিক নয়। হলিউডে চল্লিশ দশক পর্যন্ত চলচ্চিত্র মানেই গান থাকত। বলিউড ওই জায়গাতেই আটকে গেছে। যেখানে হলিউডে আর একটা গানও থাকে না।
অনায়াসে চলচ্চিত্র মাধ্যমকে আমরা বিভিন্ন লোকশিল্পের অনুপ্রেরণায় গড়ে তুলে একটি নিজস্ব স্থানিক ভাষারীতি দাঁড় করাতে পারতাম। সেদিকে আমরা যেতে পারিনি।
প্রশ্ন: মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের সঙ্গে ফোকলোরের কি বিশেষ কোনো সম্পর্ক আছে?
তারেক: আমি মনে করি আছে। সেটা এই অর্থে যে, চলচ্চিত্র একটি জনগ্রাহ্য মাধ্যম। ইট ইজ নট অ্যা হাই আর্ট বাই নেচার। চিত্রকলা বা সংগীত যেমন একটা হাই আর্ট লেবেলে চলে গেছে—এলিট আর্ট। চলচ্চিত্রের সঙ্গে লো আর্ট…
প্রশ্ন: মাস আর্ট আমরা যাকে বলি।
তারেক: পপুলার আর্ট, মাস আর্টের একটা সম্পর্ক আছে। এই শিল্পের একটা লোকভিত্তি আছে এবং লোকগ্রাহ্যতা আছে। এটা শুদ্ধতাবাদী হাই আর্টিস্ট এলিটদের ধার ধারে না। এই আর্ট—গভীর অর্থে—একধরনের ভালগার আর্ট। ভালগার শব্দটির উৎস হচ্ছে ভালগাস, এর মানে হচ্ছে পিপল। জনগণ এবং অ্যানিথিং, অর্ডিনারি পিপলের রুচিসংক্রান্ত, তাকে পুরাকালে রোমান সভ্যতার সময়ে ভালগার বলা হতো। দিস ইজ পিপলস টেস্ট। সংস্কৃত ভাষায় একটা কথা আছে না, মিষ্টান্নমিতরেজনাঃ। ইতরজনকে মিষ্টি দিয়ে বিদায় করো। ওই রকম আরকি।
প্রশ্ন: আমাদের দেশে চলচ্চিত্র আন্দোলনে বিকল্পধারা কথাটা নানাভাবে এসেছে। আপনারও একটি পরিচিতি দাঁড়িয়েছে বিকল্পধারার চলচ্চিত্রকার বলে। বিকল্পধারা বলতে আসলে কী বুঝতে হবে?
তারেক: আসলে এই ধারাটা যখন সত্যিই বিকল্প ছিল তখন এটাকে আমরা ‘স্বল্পদৈর্ঘ্য’ নামে ডাকাডাকি করেছি। আসলে সব অর্থে বিকল্পধারা ছিল তখন। অর্থাৎ বিকল্পভাবে ফরম্যাট, ১৬ মিলিমিটারে তৈরি হচ্ছিল। বিকল্প নির্মাণ হচ্ছে। এর কাছ থেকে টাকা ছিনতাই করে, ওর কাছ থেকে টাকা ধার করে, নিজের জমি বিক্রি করে—প্রযোজনাও বিকল্প। প্রদর্শন হচ্ছে বিকল্প অডিটরিয়ামে, বিকল্প প্রজেকশন-ব্যবস্থায়। ঘাড়ে করে প্রজেক্টর নিয়ে, নিজেরা টিকিট বিক্রি করছি। নিজেরা পোস্টার ছাপাচ্ছি এবং ওভাবে মানুষ দেখছে। দ্যাট ওয়াজ বিকল্প। এবং বিষয়ের ক্ষেত্রেও বিকল্প হতে হবে। এইটটি টু থেকেই যখন কাগজে-কলমে বইপত্রে টেলিভিশনে অন্য মাধ্যমে কোথাও মুক্তিযুদ্ধ নেই, তখন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে প্রতিটি ছবির বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। এখন সেটা ক্লিশে। তখন কিন্তু আমি বলব বিকল্প। কারণ মেইনস্ট্রিম বিষয় হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রে সেভেনটি ফোরের পর থেকে আর বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ নেই। নির্মিতের ক্ষেত্রে কতটা অলটারনেটিভ আই অ্যাম নট শিওর। তার পরও কিছু এক্সপেরিমেন্ট আছে।
প্রশ্ন: এই অলটারনেটিভ ছবির পাশাপাশি আরেকটা ধারা হচ্ছে মেইনস্ট্রিম, এফডিসির চলচ্চিত্র। ওখানে ফর্মুলা অনুসারে অমেধাবী লোকেরা ছবি বানাচ্ছে। তার পরও দেখি, এই ছবিই মূলত, যে অর্থে চলচ্চিত্র মাস আর্ট, মাস পিপলের কাছে পৌঁছাতে পারছে। অন্যদিকে অলটারনেটিভ ছবির মূল আবেদনটা আমরা কিন্তু দেখি মধ্যবিত্ত ইনটেলেকচুয়াল অডিয়েন্সের কাছে। আসলে এ ব্যাপারটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
তারেক: মঞ্চনাটক তো একটা আর্ট ফর্ম। কিন্তু ঢাকায় দেখো, মঞ্চনাটকের পরিচিতি কিন্তু বেইলি রোড, শিল্পকলা একাডেমী ডিঙাতে পারছে না। ঢাকার কিছু শিক্ষিত লোকের বাইরে এটা নেই। শিল্প-সাহিত্যে জনসম্পৃক্তির এই প্যারাডক্সটা আছে। চিত্রকলা বা সংগীতেও তা-ই। সিনেমার ক্ষেত্রে কেন আমরা অন্য কিছু আশা করি? কিন্তু চলচ্চিত্রের পপুলার আর্ট হিসেবে একটা আলাদা মাত্রা রয়েছে। এটা একটা ইন্ডাস্ট্রিও বটে। কারণ, এর সঙ্গে ভোক্তার একটা ব্যাপার আছে।
চলচ্চিত্রে, ফর্মুলা ছবির মধ্যেও, সৃজনশীলতা আছে। ফর্মুলার যেমন ছক আছে। এটা ননক্রিয়েটিভ। এভাবে এভাবে শট নিতে হয়, এভাবে গল্প লিখতে হবে, এভাবে চিত্রায়ণ হবে, এ রকম সংলাপ, এ রকম কাঠামো। আর্ট ফিল্মেরও কিন্তু একটা ছক আছে। শর্টগুলো এ রকম কুঁতে কুঁতে, আস্তে আস্তে স্লো হয়ে যাবে। মুখটা আস্তে এ রকম করে (নিজে মুখ ঘুরিয়ে দেখিয়ে) ঘুরাবে। এই যে ফলসনেসটা, এটা কিন্তু আর্ট ফিল্মে ক্লিশে আর্ট ফিল্মের ছক। ফর্মুলা আমরা শুধু চাপিয়ে দিই যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ছবিতেই ফর্মুলা আছে। কোন চলচ্চিত্রটা আসলে যেটা বলছ, জনগ্রাহ্য? এফডিসির কোন ছবিটা আসলে হিট করে? যেটা সৃজনশীল। ওই ফর্মুলার থেকেও বেরিয়ে আসা। এই যে আমরা বলি যে বেদের মেয়ে জোছনা। এটা স্টাডি করতে হবে। তোজাম্মেল হোসেন কোনো দিন কারও অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন না। এইটা শাপেবর হয়েছে। কুশিক্ষা উনি পাননি। ফলে তিনি অনেক নতুন জিনিস করতে পেরেছেন। তিনি জীবন থেকে নিয়েছেন। এই ছবিতে দেখব যে আগের সিনে নায়িকার সঙ্গে গান করছে নায়ক। পরের দৃশ্য হচ্ছে জেলে, সে গান গাইছে। এতক্ষণ সে নায়িকার সঙ্গে গান করছে, তুমি ছাড়া বাঁচব না। কিন্তু জেলে যাওয়ার পর গানের কথা হচ্ছে ‘মা, মা, মা। মা আমারে একটা রুটি দেয় দিনে রাতে মশার জন্য ঘুমাইতে পারি না কম্বল নাই’। এই সমস্যা। বাস্তব জীবনে কিন্তু জেলে যাওয়ার পর নায়িকার কথা মনে হয় না, মায়ের কথা মনে হয়। দিস রিয়েল লাইফ হ্যাজ সংক্রমিত করেছে ছবিটাকে। ইউ ক্যান ইজিলি কানেকটেড দ্যাট। এখানেই সৃজনশীলতার পরিচয়।
প্রশ্ন: তাহলে আপনি বলছেন, আর্ট ফিল্ম হোক বা ইন্ডাস্ট্রির ছবি হোক, ছবি শিল্প হতে হলে তাকে আসতে হবে জীবন থেকে?
তারেক: নিশ্চয়ই। আমরা একটা ছবির কাজ করেছিলাম ইন দ্য নেম অব সেফটি, নিরাপত্তার নামে। হিউম্যান রাইটসের। এই ছবিতে ভিকটিম যে ভাষায় কথা বলে সেই বাক্যবিন্যাসের কোনো মানে হয় না। মহিলাকে রেপ করা হয়েছে। তারপর পুলিশ আবার তাকে টর্চার করেছে। নিরাপত্তার নামে নিয়ে ওখানেও তাকে টর্চার করেছে। যখন জ্ঞান ফিরে আসছে সেই বর্ণনাগুলো দিচ্ছে সে। মোস্ট সুররিয়েল পোয়েটিক বর্ণনা। সে কিন্তু ইন্টারভিউ দিচ্ছে। এই যে গ্লানি, রেপড হওয়ার গ্লানি সে বর্ণনা করছে যে, উঠে আসছে হাসপাতালে একটা সাদা কাপড়, তার জানালাগুলোতে সাদা কাপড়, মফস্বলের হাসপাতালগুলোতে যেমন হয়। সে বর্ণনা দিচ্ছে, ‘জাইগা উইঠ্যা দেখি সে আবার সেই পুলিশ আর পুলিশ।’ সে যেভাবে পুলিশের বর্ণনা দিচ্ছে, তাতে কোনো বাক্য হয় না। কিন্তু ইমেজ পাচ্ছি। আর ‘সাদা, চারদিকে সাদা আমি কুতায় আইলাম, মনে হইল এই সাদার মধ্যে যদি আমি ডুইবা যাইতি পারতাম। আমি সাদা দুধে গোসল কইরা এখন পবিত্র হইয়া যাইতে পারতাম।’ এত শুদ্ধ বাংলাও কিন্তু না, আরও জটিল।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে আর্ট ফিল্মে জীবন যেভাবে হাজির হয় তাকে কেউ কেউ কৃত্রিম বলেন। আপনার কী মত?
তারেক: আমার সঙ্গে একবার ঢাকাই ছবির অন্যতম পরিচালক কাজী হায়াতের আলাপ হচ্ছিল। মাটির ময়না ছবিটা দেখে উনি বলেছিলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের সিনেমায় চরিত্রগুলো যেভাবে আচরণ করে, সেটা কিন্তু পশ্চিমের মানুষের আচরণকে অনুসরণ করে করা।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী রকম? উনি বললেন, ‘দেখেন আমাদের দেশে যদি আপনজন কেউ মারা যায়, মেয়ে মারা গেল বা বোন মারা গেল, তখন আঞ্চলিক ভাষায় বলে যে একেবারে কেঁদেকেটে ছরদো হয়ে যায়। আপনার সিনেমায় দেখেন, মেয়েটা মারা গেল, বাপেও কান্দে না, মায়েও কান্দে না, ভাইটা, হ্যায়ও কান্দে না। এইটা আসলে পশ্চিমাদের অনুকরণ করেন।’ আমি তখন বললাম, আপনি যেটাকে দেশীয় আচরণ বলছেন, মানুষ এভাবে কাঁদে, হাসে, নানা সময়ে যেভাবে সে আচরণ করে, এই আচরণবিধিগুলো পুরোপুরি কি সে জীবন থেকে আহরণ করে? তার মধ্যে এসব আচরণের অনেক প্যাটার্নই কিন্তু গেঁথে যায় চলচ্চিত্র দিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ যে আচরণ করছে, রি-অ্যাক্ট করছে নানা ঘটনায়, এই আচরণগুলো আপনি কি মনে করেন না যে আপনার বানানো চলচ্চিত্র দিয়ে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত? প্রেমে ব্যর্থ হয়ে মানুষ কীভাবে কাঁদবে তার মানস গঠন আপনি তৈরি করে দিচ্ছেন। উনি খুব অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আরে, আমি তো এভাবে ভাবিনি।’ মানুষের আবেগে তো পার্থক্য থাকে। হাইব্রিডের মতো সব একাকার করে দিলে তো হবে না। বৈচিত্র্য থাকতে হবে। আমার বাবাকে দেখেছি, উনি জীবনে কোনো দিন কান্নাকাটি তো দূরের কথা, কথা বলার সময় একটা স্বাভাবিক স্কেল থাকে না উত্তেজিত হলে, যেটা ছাড়িয়ে যায়, ইমোশনাল হয়ে গেলে… আমার বাবা চিরদিন একই স্কেলে কথা বলেছেন। আমার পরিবারে আমার বোন যখন মারা গেছে তখন আমার বাবা কাঁদেনি। পাথর হয়ে গেছিল। সেই জিনিসটা তো একটা সিনেমাটিক ট্রিটমেন্টের মধ্যে আসবে। আমি যদি এখন এটা, কাজী হায়াতের ছবির মতো আমার মা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাঁদতে বসে, তাহলেই কেবল সেটা সত্যি হবে তা তো না।
প্রশ্ন: আপনার ছবিতে রিচুয়াল, মিথ, ফেস্টিভিটি এগুলো অনেক গুরুত্ব নিয়ে আসে, আবেদন নিয়ে আসে। আপনি কি রিচুয়ালকে নিছক রিচুয়ালস হিসেবেই দেখেন? নাকি এর মধ্যে অন্য কিছুর খোঁজ করেন?
তারেক: মাটির ময়নায় দেখো, যখন পুঁথিতে শোনা যাচ্ছে, ইব্রাহিম তার ছেলেকে কোরবানি দেবে ইত্যাদি ইত্যাদি, এই গল্প যখন বলা হচ্ছে পুঁথির মধ্যে, দর্শক শুনছে, আর কে শুনছে? আনু শুনছে। আনু যখন শুনছে আনুর কি নিজের কথা মনে হচ্ছে না? আমি যখন শৈশবে এই পুঁথি শুনেছি তখন আমি আমাকে আবিষ্কার করেছি। আমার বাবা যেন ইব্রাহিম। আমাকে মাদ্রাসায় যে দান করেছে, আমাকে স্যাক্রিফাইস করেছে ধর্মের কারণে। ধর্মের জন্য আমাকে বলি দিয়েছে। আনুও কি এই পুঁথিতে নিজেকে আবিষ্কার করছে না? এখন দর্শক যদি আনুর মধ্যে সেই অনুরণনটা খুঁজে না পায় তো সেটা আমার হয়তো ব্যর্থতা। এটা যদি আমি জারিত করতে না পারি এই রিচুয়াল শুধু রিচুয়ালের জন্য না, ইটস নট রিচুয়াল ফর রিচুয়ালস সেক। এই যে ইব্রাহিমের আর্কিটাইপ, এই মিথ তো আমার আজকের জীবনেও যে কতটা জারি আছে, কতটা প্রাসঙ্গিক। সো, মিথ কি আসলেই মিথ্যা? মিথকে কনটেক্সুয়ালাইজ করা গেলে সত্যিটা এই সময়ের মধ্যেও পাওয়া যায়।
প্রশ্ন: আরেকটা প্রশ্ন। মানুষের কিছু ফ্যাকাল্টিকে আমরা বলি ভালো, কিছু মন্দ। ভায়োলেন্স, ক্রুয়েলটি, বীভৎসতা এগুলো নেতিবাচক ব্যাপার। যেমন অমিয়ভূষণ মজুমদার, তার ফিকশনে সেভাবে ইভিল ক্যারেক্টার আসতে পারে না। ফিল্মে যেমন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। সত্যজিৎ রায়ের শুধু অশনি সংকেত বাদ দিলে তার কাজের মধ্যে দৃষ্টিকে পীড়া দেয় এমন কিছু আসে না। আপনার ছবিতেও খুব ভায়োলেন্ট কোনো দৃশ্য, যা আমাকে পীড়া দেয় বা ইভিল কোনো ক্যারেক্টার আমরা দেখি না। এটা আসলে কী?
তারেক: ভালো-মন্দ দুটো দিকই খুব কড়াভাবে আসে ফর্মুলা সিনেমায়। আর আমরা যারা সৃজনশীল ছবি বানাতে চেষ্টা করি তাদের ফিল্মে ভায়োলেন্স যে আসে না, তা না, কিন্তু তার ট্রিটমেন্ট হয় ভিন্ন। যেমন যদি আমি আমার ছবি মাটির ময়নার কথা বলি। পুরো ছবিটা বেসিক্যালি ভায়োলেন্স নিয়ে। ছবির বিষয়বস্তুই যদি দেখি, নানাভাবে ভায়োলেন্স আছে, ওয়ার ইজ দ্য ব্যাকড্রপ। ছবির মধ্যে নানাভাবে ব্রুটালিটি আছে। একটা ব্যাপার আছে নন্দনতাত্ত্বিক, যেটা তুমি বললে, একজন নির্মাতা হয়তো ভায়োলেন্স না দেখিয়ে ভায়োলেন্ট একটা অ্যামবিয়েন্ট তৈরি করছে। এটা তার কাছে অনেক বেশি অর্থবহ যে গ্রাফিক ওয়েতে ভায়োলেন্স দেখাব না, কিন্তু আমি ক্রিয়েট এ সেন্স অব ভায়োলেন্স। মাটির ময়না ছবিতে ভায়োলেন্স মোর অ্যাসথেটিক্যালি এসেছে। এসথেটিক এ অর্থে যে, ইটস মাচ মোর ক্রিয়েটিভলি চ্যালেঞ্জিং টু শো ভায়োলেন্স উইদাউট শোয়িং ভায়োলেন্স। ইনডিপেনডেন্ট সিনেমার ক্ষেত্রে ফর্মুলা ট্রিটমেন্টের জায়গায় ইনডিভিজুয়াল টেম্পারমেন্ট কাজ করে। এখন ব্যক্তিগত জীবনে আমার আদর্শিক জায়গার থেকে বড় জায়গা হচ্ছে যে, আমি আসলে ভায়োলেন্স জিনিসটা ব্যক্তি জীবনে নিতে পারি না। আই হ্যাভ মাই ওন হিস্ট্রি আছে। সে কারণে আমি ভায়োলেন্স নিতে পারি না। অ্যাজ এ ফিল্মমেকার আমি জানি যে, যখন আমি ভায়োলেন্স দেখছি এটা আসলে ফলস, এই রক্তটা আসলে কৃত্রিম রক্ত, পুরো জিনিসটা তৈরি করা, তার পরও আমি তাকাতে পারি না। আই অ্যাম সো মাচ অ্যাফেক্টেড বাই ভায়োলেন্ট সিন। একটা ভার্চুয়াল ভায়োলেন্স, যেটা আসলে অ্যাকচুয়াল ভায়োলেন্স না, তাও আমি নিতে পারি না। অনেক সময় এমন হয়েছে, কোনো একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, কারও ব্লিডিং হচ্ছে, আমি সেখান থেকে পালিয়ে চলে গেছি। এই যে আমার ব্যক্তিগত জিনিসটা রয়েছে, সেটাও এখানে রিলেটেড। মাটির ময়না ছবিতে অনেক ভায়োলেন্ট দৃশ্যের সুযোগ ছিল, যখন গরু জবাই দেওয়া হচ্ছে, প্রাসঙ্গিকভাবেই ওখানে স্লটারিংটা দেখানো যেতে পারত, কিন্তু ওখানে শুধু পোস্ট-স্লটারিং রক্তভেজা ছুরিটা দেখা যাচ্ছে। চড়ক খুবই ভায়োলেন্ট ব্যাপার, আমাদের ক্লোজআপ ছিল, বিশাল বড়শি দিয়ে গাঁথা চামড়া, সেটা কিন্তু আমার টেম্পারমেন্টের কারণে ওই ভায়োলেন্ট সিন আমি ব্যবহার করব না।
প্রশ্ন: এখন শিল্পীর অ্যাসথেটিকস আর টেম্পারমেন্ট—এই দুটোর বোঝাপড়া আসলে কীভাবে হয়? কারণ শিল্পী তো আসলে জীবনের কাছেই পৌঁছাতে চান, যাকে তিনি ভয় করেন, যার প্রতি তিনি অবসেসড এসব কিছু তিনি ধরতে চান। কিন্তু টেম্পারমেন্ট কিছু বিষয়কে খারিজ করতে চায়। এই বোঝাপড়াটা কী করে হয়?
তারেক: এখন অ্যাসথেটিকসটা যদি কনট্রাইভড হয়, আনফরচুনেটলি কনস্ট্রাকটেড অ্যাসথেটিকসের সংখ্যাও কম নয়। তথাকথিত আর্ট সিনেমার মধ্যে আহরিত বা আয়োজিত বা ইমপোজড অ্যাসথেটিকস বা জিনিস কিন্তু অনেক বেশি। সে রকম সিনেমার থেকে ফর্মুলা সিনেমা আমি মনে করি অনেক বেশি স্পনটিনিয়াস। এর মধ্যে ফিল্টারিং কম। কিন্তু আমরা যে কৃত্রিম বিষয়গুলো… আমি যদি দেখি এটা তার পার্সোনালিটিকে রিফ্লেক্ট করছে না, বা তার টেম্পারমেন্ট বা অভিজ্ঞতাকে রিফ্লেক্ট করছে না, বরং তার একটা নোশন অব আর্ট সিনেমা থেকে ওই রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সে ধারণ করছে ছবির মধ্যে। সে, আমি যদি বলি, এখন ব্রেসোর সিনেমা। আমি বিশ্বাস করতে চাই আমি মনে করি যে, ব্রেসোর টেম্পারমেন্টের কারণেই তার ছবির সমস্ত চরিত্রের ধরন পাথরের মতো। তার চরিত্রগুলোর যেন কোনো গ্রাফ নেই, কোনো ইনটনেশন নেই। কথার মধ্যে নেই বা আচরণের মধ্যেও নেই। যখন মুশেট-এর মধ্যে একটা অসাধারণ সিচুয়েশন হচ্ছে, রেপড হয়েছে মেয়েটা, এরপর বাড়িতে এসেছে, মা অসুস্থ, তার শিশু বোনটা কাঁদছে, মা অসুস্থ বলে দুধ খাওয়াতে পারছে না। তখন এই রেপড হয়ে ফেরা টিনএজ মেয়েটি চুলা জ্বালাতে চেষ্টা করে, সে দেখে কোনো দেশলাই নেই, সে আগুনে দুধটা গরম করতে পারছে না, তখন সে নিজের দুটো স্তনের মাঝখানে দুধের বোতলটা রেখে ওয়ার্ম করে তারপর তার ছোট্ট বোনটাকে খাওয়াচ্ছে। এই পুরো ঘটনাটা এমন ব্যানাল, এত ক্যাজুয়াল, এত ফ্ল্যাটভাবে ঘটতে থাকে, তার আগে-পরের ঘটনাগুলো, যা ঠিক বাস্তবে ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু এটা হতে পারে। কিন্তু এটা ব্রেসোর এক্সপেরিয়েন্স, তার স্টেট অব মাইন্ডকে রিফ্লেক্ট করে। তার অ্যাসথেটিকসকে রিফ্লেক্ট করে। কিন্তু আমি যদি এটা এখন বাংলাদেশে এই একই জিনিস রিপ্রডিউস করার চেষ্টা করি তাহলে যে ফলসনেসটা হবে, তখন দেখা যাবে কৃত্রিমভাবে একটা মাথা ডান থেকে বাঁয়ে দশ মিনিট ধরে ঘুরে যাচ্ছে, এরপর তার পিওভি থেকে পাঁচ মিনিট ধরে একটা ল্যান্ডস্কেপ দেখছি। এই ফলসনেসটা আর্ট ফিল্মেও ঘটতে পারে, কারণ ব্রেসোকে আমি ধারণ করছি না, ধার করছি। আর্টের সঙ্গে কৃত্রিমতার একটা বিরাট সম্পর্ক আছে এবং এই কৃত্রিমতাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করাই হচ্ছে আর্টের কাজ।
প্রশ্ন: ফিল্মের ইতিহাসে দেখা গেছে, যুদ্ধ ও যৌনতা ফিল্মে অনেক বেশি আসছে। এটার কারণ হয়তো ফিল্মে সেক্স অনেক সেনসুয়াল, যুদ্ধ অনেক গ্রাফিক। এই বাড়তি সুবিধার কারণেই ফিল্ম অনেক সময় যুদ্ধ ও যৌনতাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আপনার নিজের যে নন্দনতাত্ত্বিক দুনিয়া সেখানে সেক্স কতখানি জুড়ে আছে, কীভাবে আছে? আর সেটা আপনি কীভাবে ফিল্মে রিপ্রেজেন্ট করার কথা ভাবেন?
তারেক: সিনেমায় যুদ্ধ ও যৌনতার মতো জিনিস দুভাবে এসেছে। পুঁজি হিসেবে আর উপজীব্য হিসেবে। পুঁজি হিসেবেই বেশি দেখি আমরা। সিনেমা তো শুধু আর্ট নয়, এটা একটা ইন্ডাস্ট্রি, বিপণনযোগ্য জিনিস। এটাকে প্রথমে স্বীকার করে নিতে হবে। আরেকটা দিক, যেটা তুমি বললে, এর একটা মাধ্যমগত অ্যাডভান্টেজ আছে, বিকজ বোথ আর ভিজুয়ালি এক্সপ্লয়টেবল, পজিটিভ সেন্সেই বলছি, ভীষণ এক্সপ্লয়টেবল এলিমেন্টস অব লাইফ। এই দুটোই আমাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ একটা ট্রমা হিসেবে ইট হন্টস এভরি নেশন। ওয়ার ইজ অ্যান ইনসটিংকট, যদি ফ্রয়েডের কথা নিই, দ্যাট ইজ রিলেটেড টু ডেথ অ্যান্ড কিলিং। হোমিসাইড অ্যান্ড সুইসাইড। তারই একটা উল্টো পিঠ হচ্ছে জীবন, কারণ ইট ইজ ইমপসিবল টু থিংক অ্যাবাউট লাইফ উইদাউট ডেথ। শুধু বিশ্বসাহিত্যেই নয়, বাস্তবেও দেখা যাবে যে বেস্ট লাভ স্টোরিজ আর বেজড অন ওয়ারটাইম। ভালোবাসা এবং সেক্স। সেক্স জিনিসটা যখন মেয়ার গ্রাফিক রিপ্রেজেন্টেশন হয়ে ওঠে তখন সেটা পর্নোগ্রাফি, আর যখন সেটা পার্ট অব লাইফ হিসেবে আসতে পারে তখন সেটা আর্ট।
আরেকটা ব্যাপার বলি। আমার নিজের মধ্যে নিজের একটা বিরাট তোলপাড় দীর্ঘদিন ধরে চলছে। জীবনের একটা বিশাল অংশ এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো যৌনতা। সেটা আমার ছবিতে প্রায় শতভাগ অনুপস্থিত। এটা একধরনের অসম্ভব সীমাবদ্ধতা, অসম্পূর্ণতা এবং অক্ষমতা নির্মাতা হিসেবে মনে করি। বিকল্প ছবি বানাতে হলে শুধু বিকল্প প্রদর্শনী হলে হবে না, বিকল্প বিষয়বস্তু নিয়ে আসতে হবে। যৌনতা শুধু ব্যক্তিগত নয়, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রিক জীবনেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমি নিজেই আত্মসমালোচনা করব। আমাদের এ ব্যাপারে সাহসী হতে হবে এবং আরও বেশি সচেতন হতে হবে। যুদ্ধের মধ্যে যেমন রাজনীতি থাকে, যৌনতাও তেমনি একটি বিরাট রাজনীতির অংশ। একজন শিল্পী হিসেবে, নির্মাতা হিসেবে আমি বলব সেক্সুয়ালিটি অলমোস্ট অ্যামাউন্ট টু দ্য ইমপরট্যান্স অব ওয়ার বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন সোশ্যাল ইনজাস্টিস, পারসিকিউটেড প্রান্তিক জনগোষ্ঠী—এগুলো যদি সিনেমার জরুরি বিষয় হয়, তবে যৌনতাও খুব জরুরি বিষয়।
প্রশ্ন: ইরানি ছবির সঙ্গে তো আপনার খুব ভালো পরিচয় আছে। ইরানি ছবিতে আমরা যেটা দেখেছি যে এসব বিষয় ডিল করার জন্য দে হ্যাভ ইনভেন্টেড এ লাঙ্গুয়েজ…
তারেক: এটা একটা অন্য প্রসঙ্গ, বলতে গেলে অনেক সময় লেগে যাবে। আমি শুধু এটুকু বলি, সিনেমার একটা নিজস্ব ভাষা বিভিন্ন সাপ্রেশন থেকে তৈরি হয়। এর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হচ্ছে আমাদের সান্ধ্যভাষা।
প্রশ্ন: বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা যে ভাষাটা চর্যাপদে ব্যবহার করেছেন।
তারেক: হ্যাঁ, চর্যাপদের ভাষা। তারপর বাউলদের ভাষা। বাউলরা যে গুহ্য ভাষায় কথা বলে, এই ধরনের ভাষা আসলে যখন সমাজ বা রাষ্ট্র পারমিট করছে না বা সিস্টেম যাকে অনুমোদন করে না তেমন কথা বলতে গিয়ে তৈরি হয়, মাইনরিটির স্বর হিসেবে খুব পরোক্ষভাবে আসে। এই পরোক্ষ প্রকাশ করতে গিয়ে আমরা একটা নতুন ভাষার জন্ম দিয়ে ফেলি।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৯, ২০১১
Leave a Reply