বাতেন বলল, ‘সবকিছুই আগের মতো করার চেষ্টা করা হয়েছে। পুরোনো দাগ-নকশা-খতিয়ান ধরে ধরে রাস্তাঘাট, পুকুর আর মক্তব। এই যে, এটা হলো বুড়ির পুকুর। ওখানে তো আগে মক্তব ছিল, তাই না? এটা হলো সেই মক্তব। আগের মতোই পুবমুখো।’
‘নানার কবরটা কোথায় রে? ওনাকে তো, শুনেছিলাম, বুড়ির পুকুরের পাড়েই কবর দেওয়া হয়েছিল…!’
‘এই যে, পুকুরের পশ্চিম পাড়ে। এই জায়গাটা…ঠিক এই জায়গাটায় ছিল দাদাজির কবর। কবরস্থানটাও আগের জায়গায় রাখা হয়েছে।’
বুড়ির পুকুরের দক্ষিণ পাড় দিয়েই ছিল ঘাটলাটা। মনে আছে এখনো। তালগাছের গুঁড়ি ফেলে বানানো হয়েছিল তখন। মানুষ গোসল করত, সকালে আরবি পড়তে এসে ছেলেমেয়েরা অজু করত। শ্যাওলা জমে জমে পিচ্ছিল হয়ে যেত তালগাছের ঘাটলা। অনেকে আছাড়টাছাড়ও খেত শুনেছি।
তালগাছের গুঁড়ির ঘাটলা এখন আর নেই। এখন পাকা ঘাটলা। বুড়ির পুকুরে মানুষ এখন পাকা ঘাটলায় গোসল করে। পাকা ঘাটলায় গোসল করা এসব মানুষকে আমি চিনি না। কিংবা কাউকে কাউকে চিনি, মানে চিনতাম। কিন্তু যাদের চিনতাম, তাদের মুখ এখন আগের মতো নেই। তাদের মুখে এখন পঁচিশ বছরের দীর্ঘকাল তার অমোঘ হাতের ছাপ বুলিয়েছে। পঁচিশ বছর আগের যুবক-মুখ এখন পঞ্চাশ বছরের ছায়ায় আচ্ছন্ন, আর কিশোর-মুখে কুটিল প্রৌঢ়ত্ব। নোনা বাতাস আর রোদের রসায়নে শরীরী পরিবর্তনের সঙ্গে পার্থিব টানাপোড়েনের শৃঙ্খলে বাঁধা মানসিক জটিলতা মিলে পঁচিশ বছরের অদেখার মাঝখানে বিশাল এক দেয়াল তুলে দিয়েছে। সে দেয়ালের ওপার থেকে উঁকি মেরে এরাও কি আমার মুখে খুঁজে পাবে তাদের পঁচিশ বছর আগের স্মৃতি?
‘এই যে রাস্তাটা দেখছেন,’ বাতেন পুব দিকে হাত খেলাল, ‘ওটা মুন্সিরহাটে যাওয়ার রাস্তা। জামাল ব্যাপারীপাড়ার মাঝখান দিয়ে চলে গেছে আরও উত্তরে, একেবারে মাওলানা ইদ্রিসের মাদ্রাসার সামনে দিয়ে যোগেন্দ্র পুকুরের পাশে বড় রাস্তার সাথে মিলেছে। কাল বের হলে দেখবেন, সবকিছুই আগের মতো…।’
বাতেন হাসছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ওর হাসির সৌজন্যে আমারও একটু হাসা উচিত। কিন্তু আমি ভাবছি আর বাতেনের চেহারায় পঁচিশ বছর আগের প্রায় শিশুমুখটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। পাচ্ছি না। আমার স্মৃতিতে খোদাই করা ওর সে শিশুমুখে এখন নানা রকম জটিল-কুটিল ভাঁজ, রেখা। ওর পকেটে মুঠোফোন বেজে উঠল। মুঠোফোন বের করে কল রিসিভ করল ও, ‘হ্যা-লো…।’
আমি প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে নিজের মুঠোফোনের অস্তিত্ব অনুভব করলাম। পঁচিশ বছর আগে স্বপ্নেও ভাবিনি, আমার হাতের মুঠোয় এমন একখানা যন্ত্র থাকবে, যা দিয়ে চাইলে সারা পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারব।
আধঘণ্টা আগে বড় জেঠাতো ভাই ফোন করে বলে দিয়েছেন, কাল সকালে যেন যোগেন্দ্র পুকুরের কোনায় হানিফের দোকানে যাই, ওখানে আমিনের সঙ্গে জমি মাপার ব্যাপারে কথা হবে।
আমি যখন কিশোর, তখনই ভেঙে গেছে বাড়িঘর, জমিজিরাত। পুব দিকের বিশাল ধানি জমির মাঠের ওপারে দিগন্তের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বসে থাকার সেই পুকুরপাড় আমার নেই। পুকুরপাড়ে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক তালগাছগুলোও নেই। আমার স্কুল ভেঙে গেছে, স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে বিকেলে খেলতে যাওয়ার সেই মাঠটাঠও। আমার শিক্ষক, সতীর্থ বন্ধু আর খেলার সঙ্গীরা, যারা এখন হারিয়ে গেছে, তাদের কি আর আগের মতো ফিরে পাব? আমি জিজ্ঞাসু চোখ দুটো তুলে বাতেনের দিকে চাইলাম। ওর কাছে কি জানতে চাইব? ও এখনো কথা শেষ করেনি। কার সঙ্গে যেন খুব হাসাহাসি করছে।
ও আমার মামাতো ভাই। আমার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে নানাবাড়িতে। সুতরাং ওর স্মৃতির সঙ্গে আমার স্মৃতির মিল রয়েছে। ওর সঙ্গে এখন একত্রে বুড়ির পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। ও আমাকে আমার নানার কবর দেখাচ্ছে। ও বলছে, সবকিছু আগের মতো করার চেষ্টা করা হয়েছে। তাহলে এই বুড়ির পুকুরপাড়ের সামনের মক্তবের ঈদগাহে নানার সঙ্গে ছোটবেলার সে ‘ইয়া নবী সালামালাইকা’ পড়ার দৃশ্যটাও কি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হবে? আমার নানাও কি আবার ফিরে আসবেন তাঁর সেই দীর্ঘ দেহ, শ্যামলা মুখ আর গোছাদাড়ির লম্বা চিবুক নিয়ে!
এসব কথা বাতেনকে জিজ্ঞেস করা যায় না। কাউকেই জিজ্ঞেস করা যায় না। এমনকি আমি যে এসব ভাবছি, তাতেও নিজের কাছে নিজেকে অদ্ভুত মনে হচ্ছে।
কিন্তু, তবু কেন যে ভাবছি! কেন যে অভিমানে বুকটা দুলে উঠছে! আচ্ছা, নদী কেন ভাঙল? কেন সে আমার ছোটবেলাকে এমন নির্মমভাবে কেড়ে নিল? কেন আমি আমার কৈশোরকে আর খুঁজে পাচ্ছি না পঁচিশ বছর পরে আমার জন্ম-জায়গায় ফিরে এসে? কেন নিজের জন্মভূমিতে নিজেকে আমার অমন বেগানা আর উদ্বাস্তু মনে হচ্ছে? আমার সে মাটি কোথায়, যেখানে আমি প্রথম হাঁটতে গিয়ে ধপাস করে আছাড় খেয়েছিলাম?
পঁচিশ বছর পর জেগে ওঠা চর আবার মানুষের হাতে পড়ে গ্রামের রূপ নিচ্ছে। নকশা মেলে দাগ-খতিয়ান ধরে ধরে মানুষ ফের নিজের জমি বুঝে নিচ্ছে। ঘরবাড়ি তৈরি করছে, পুকুর কাটছে, গাছগাছড়া লাগাচ্ছে। বছর না ঘুরতেই খেতিখোলায় ভরে উঠবে বেলেমাটি। তাজা সবুজ ঘাসে মুখ ডোবাবে গরু-ছাগল, ভেড়া-মহিষ। সেই আগের মতো। আগের সে শতাব্দী-সহস্রাব্দজোড়া অস্তিত্বের টানা ধারাবাহিকতার মতো। মাঝখানের নেই হয়ে যাওয়া পঁচিশ বছরের কথা কারও মনেও থাকবে না।
নিজের জমি বুঝে নেওয়াদের দলে আছি আমিও। শহরের উদ্বাস্তু দৈনন্দিনতার শিকল কেটে পালিয়ে এসেছি শেষ পর্যন্ত নিজের ঠিকানায়। গ্রাম দীর্ঘাপাড়, পোস্টাপিস আমানুল্লাহ…।
শহরে আমাদের নিজের গ্রাম নেই, পোস্টাপিস নেই। যা আছে তা বারোয়ারি। বারো দেশের লোকের ব্যবহারে ব্যবহারে জীর্ণ-দীর্ণ। সেখানে এমনকি অনেক সময় এক ছাদের নিচে বছরের পর বছর ঘুমিয়েও একজনের আরেকজনকে চেনা হয়ে ওঠে না। সেখানে সবাই একে অন্যের সঙ্গে সারা দিন কাটিয়ে এসেও রাতের বেলায় বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে কখনো কখনো নিজের গ্রাম-পোস্টাপিসের কথা ভেবে আনমনা হয়ে যায়। একটু ছুটিটুটি পেলেই ছোটে গ্রামে। বাড়িতে নিজেদের পুকুরপাড়ে বসে কদিন নির্ভার অবসর কাটায়। চারদিকে চেয়ে চেয়ে নিজের শৈশব-কৈশোরকে খোঁজে। শীতের উদোম মাঠে ছোটাছুটি, গ্রীষ্মের ছায়াময় আমগাছের তলায় বসে ঝিমানো কিংবা বর্ষার নতুন পানির বিলে দাপাদাপির স্মৃতি খুঁচিয়ে তোলে। তারপর ফের ফেরার প্রত্যাশা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে শহরের দিকে পা বাড়ায়।
কিন্তু আমার কখনো ফেরার প্রত্যাশা ছিল না। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আমি এখন নিজের গ্রামে। নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছি। আমিন ডেকে এনে মাপজোক করে শরিকদের কাছ থেকে আলাদা করে নিচ্ছি নিজের জমিজমা। আমার সত্তর বছর বয়সী বুড়ো বাবা তাঁর পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া জমি তুলে দিচ্ছেন তাঁর উত্তরপুরুষের হাতে। কিন্তু মাঝের পঁচিশ বছর এই জমি নেই হয়ে গিয়েছিল বিশাল নদীর বুকে। আশ্চর্যের ব্যাপার নয় কি?
আমার বাবার নিষ্প্রভ চোখে একধরনের তৃপ্তি। সেটা হয়তো পূর্বপুরুষের কাছ থেকে পাওয়া জমি তাঁর উত্তরপুরুষের হাতে তুলে দিতে পারার তৃপ্তি। কিন্তু আমার দুই চোখে যদি কেউ এখন তাকায়, তাহলে সে অবাক হয়ে দেখবে, সেখানে লুকিয়ে আছে এক প্রবল শোক। কারণ, পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার হয়ে শত শতাব্দীর আবহমান ধারায় নিজের অস্তিত্বের প্রবাহ অনুভব করার আনন্দে শামিল হতে পারলেও এই বিশাল চরে আমি আমার ছেলেবেলাটা খুঁজে পাচ্ছি না।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৯, ২০১১
Leave a Reply