ভূমিকার প্রয়োজন ছিল না
আখতার হুসেন
নির্বাচিত গল্প : ওয়াসি আহমেদ \ প্রকাশক: শুদ্ধস্বর, ঢাকা \ প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১১ \
প্রচ্ছদ: তৌহিন হাসান \ মূল্য: ৪০০ টাকা
কথাশিল্পী ওয়াসি আহমেদ নিজের থেকে যদি না বলতেন, ‘চারপাশের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা ইন্দ্রিয়াতীত জগতের প্রতীকমাত্র—প্রতিচ্ছবি নয়, সিমবল’, তাহলেও তাঁর ছোটগল্পের পাঠপ্রতিক্রিয়া অন্তে আমাদেরও একই মতো উচ্চারণ করতে হতো। কেননা, নিগূঢ় সত্যের স্বরূপ যেমন একরোখা ও এক রঙা নয়, বাহ্যিক সত্যের স্বরূপ তো নয়ই, তেমনি ইন্দ্রিয়পরবশ মানুষ ও তার পরিপার্শ্বের স্বরূপও বহুভঙ্গিল, বহুবর্ণিল, রহস্য-জটিল ও ঐন্দ্রজালিকতায় আকীর্ণ। ফলে একজন অতিসংবেদনশীল সাহিত্যশিল্পীর, বিশেষত কথাশিল্পীর চোখে তাঁর পরিপার্শ্ব, চলমান ঘটনা, ছোট আর বড়, সর্বোপরি তাঁর পর্যবেক্ষণের বৃত্তে ধরা পড়া মানুষের চেহারা ও চরিত্র এবং তাদের মনস্তত্ত্বের অস্বাভাবিকতা অতি স্বাভাবিকরূপে প্রতিভাত হতেই পারে। মনে হতে পারে, ঘোর লাগা অস্বাভাবিকতার মধ্যে সবকিছু যেন স্বাভাবিক, অতি স্বাভাবিকতার মধ্যে সবকিছুই যেন ঐন্দ্রজালিকতার আলো-ছায়ার বৃত্তে আবদ্ধ। বৈচারিক এই পটপ্রেক্ষায় যদি ওয়াসি আহমেদের নির্বাচিত গল্প-এর ২৩টি গল্প বিচার করতে বসি, তাহলে তাঁকে ভুল বোঝার অবকাশ কম থাকবে বলেই মনে করা যেতে পারে। বিশ্বের চলতি ও জনপ্রিয় কোনো সাহিত্যিক-প্রবণতা কিংবা বহু ব্যবহারে দীর্ণ, ম্লান কোনো সাহিত্যিক অভিধায় ফেলে যাঁরা তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু, তাঁর বয়নরীতি ও চরিত্রগুলোর পরিণামের বিচারে বসবেন, তাঁদের কাছে বিনীত অনুরোধ, তাঁরা সে কাজটি করা থেকে বিরত থাকুন। কেননা, ছোটগল্পের প্রকরণ নিজেই যেখানে পাশ্চাত্য থেকে আগত এবং তাকে আশ্রয় করে বাংলা সাহিত্যের ওয়াসির পূর্বসূরির পূর্বসূরিরা যেখানে সর্বোচ্চ বিশ্বমানের সংখ্যাহীন ছোটগল্পের জন্ম দিয়েছেন এবং এখনো দিয়ে চলেছেন, সেখানে ওয়াসির সাহিত্যশৈলী, প্রকরণ ও বিষয়গত বিশেষ প্রবণতা নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলবেন, তাঁদের একটু কৃপার চোখেই দেখা যেতে পারে। বরং আমরা দেখি ওয়াসির সাহিত্যিক শক্তিসত্তার জগৎটিকে, অন্তত আমাদের আলোচ্য গ্রন্থের সুবাদে।
এ গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘ডলফিন গলির কুকুরবাহিনী’ দিয়েই আলোচনার সূত্রপাত করা যাক। ‘রাত ঘন হওয়া মাত্র’ যে গলি ‘কুকুরের দখলে চলে যেত’, চলত তাদের হাঁকডাকের ‘জোটবাঁধা সন্ত্রাস’, হারাম হয়ে যেত গলিটির প্রায় প্রত্যেকের চোখের ঘুম, সেই বেওয়ারিশ কুকুরগুলোকে যখন সিটি করপোরেশনের কুকুর ধরা ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী ‘ধরে ধরে ঝটপট ট্রাকে তুলে নিয়ে বিদায় হলো’, উল্লিখিত গল্পের শুরুটা যেন ঠিক তার পর থেকেই। কুকুরবিহীন ‘প্রথম প্রথম কয়েকটা রাত’ ‘রোমাঞ্চকর’ ও ‘আনকোরা’, শোরগোলহীন, বুক ধড়াস করা হাঁকডাক ছাড়া হলেও, কোথায় যেন একটা শূন্যতার সৃষ্টি হয়, ‘নিঝুম রাতগুলো নির্ভেজাল রাত’ মাত্র হয়ে ওঠে। ‘কুকুরবিহীন বিরান গলি’র বাসিন্দাদের ‘রাতের পর রাত পার হয়ে গেলেও ঘুম কিংবা মুক্তি কারও কাছেই ধরা’ দেয় না। মনে হতে থাকে কেবলই ‘কী যেন ছিল, কী নেই!’ শুরু হয় তাদের মনের কন্দরে কন্দরে নতুন করে উসখুসানি। ‘তাবিজ মাদুলির মতো’, ‘অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মতো’ সেসব বেওয়ারিশ কুকুরের বিচিত্র মুখগুলো, দেহাবয়বগুলো ভেসে উঠতে লাগল কেবলই তাদের চোখ ও মনের ক্যামেরায়। এক অসাধারণ মনস্তত্ত্বের গল্প ‘ডলফিন গলির কুকুরবাহিনী’।
ঠিক একইভাবে অপার আনন্দের সঙ্গী করে এ গ্রন্থের ‘খাঁচা ও অচিন পাখি’, ‘শেরশাহ ও তাঁর অমোঘ পরিণতি’, ‘অপুর ধর্মটিচার’, ‘স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা এলেমানের লেজ’, ‘তেপান্তরের সাঁকো’, ‘ছোঁয়া’, ‘মধ্যদিনের গান’, ‘শিঙা বাজাবে ইসরাফিল’, ‘শীত-পিপাসার দেও-দানব’, ‘ভারহীন দৃষ্টিহীন’, ‘ত্রিসীমানা’, ‘দীপার দুপুর’, ‘হোয়াইট ম্যাজিক’ ও ‘উদ্ধার পুনরুদ্ধার’ শিরোনামের গল্পগুলোর পাঠ। উদ্ধৃতি চিহ্নবিহীন অন্য গল্পগুলোকেও বিন্দুমাত্র আকর্ষণহীন ভাবার অবকাশ নেই। বস্তুত এ গ্রন্থের প্রথম থেকে শেষ গল্পটি পর্যন্ত ওয়াসির একটা ক্রম-পরিণতি সহজেই লক্ষ করার মতো। সৌকর্যে কি ভাবে-ভাবনায় তাঁর কোনো গল্প গৌণ নয় কোনোভাবেই। গল্প বুনে তোলার ভাষাগত কারুকাজ এবং সাধারণ একটি ঘটনাকে বহুমাত্রিকতায় পর্যবসিত করার ক্ষেত্রে তাঁর যে ক্ষমতা, সেটাও রীতিমতো সমীহ-জাগানিয়া। এ গ্রন্থের প্রতিটি গল্পে তারই অমোচনীয় স্বাক্ষর বিধৃত। তাঁকে সবিশেষ অনুরোধ, প্রায় বিরলপ্রজ লেখকদের পঙিক্তভুক্ত তিনি যেন না হন।
এ বইয়ের ভূমিকার দরকার ছিল না। ওয়াসি আহমেদের গল্পগুলোই তাঁর সবচেয়ে বড় ভূমিকা, তাঁর ক্ষমতার পরিচয়বাহী সম্পদ।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৯, ২০১১
Leave a Reply