জাফা : কমলালেবুর দেশ
গাসান কানাফানি
অনুবাদ মশিউল আলম
গাসান কানাফানি সূত্র: অল্টারনেটিভ ইনফরমেশন সেন্টার, প্যালেস্টাইন ডেভিড বেন-গুরিয়ন, ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ১৯৪৮ সালে এক বিবৃতিতে বলেন:‘ লিটানি নদীর দক্ষিণ সীমান্তে (লেবাননের ভেতরে) একটি খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমরা তাদের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুলব। আরব ঐক্য বিনষ্টের পর বোমা মারা হবে আম্মানে, জর্ডানকে গুড়িয়ে দেওয়া হবে, পতন হবে সিরিয়ার। এর পরও মিসরের লড়াইয়ে সাহস থাকলে বোমা ফেলব বন্দর সাইদে, আলেকজান্দ্রিয়ায়, কায়রোতে… এভাবেই শেষ করা হবে অ্যাসিরীয় এবং আরামদের সঙ্গে আমাদের পূর্বপুরুষের অসমাপ্ত লড়াই।’ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তি ও ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন স্মরণে ফিলিস্তিন লেখক গাসান কানাফানির রচনাটি অন্যান্য ফিলিস্তিন লেখকের সঙ্গে মিসরীয় পত্রিকা সাপ্তাহিক আল আহরামে প্রকাশিত হয়েছিল।
যখন আমাদের জাফা ছেড়ে আক্রি শহরে চলে যেতে হয়েছিল, তখন আমার মধ্যে কোনো দুঃখবোধ ছিল না। আমার মনে হচ্ছিল, অন্য এক শহরে বেড়াতে যাচ্ছি, যেখানে বেশ খাওয়া-দাওয়া হবে। আক্রিতে আমাদের দিনগুলো অস্বাভাবিক মনে হয়নি। বোধ হয় এ জন্য যে তখন আমি ছোট ছিলাম। আমার বরং আনন্দই হচ্ছিল যে স্কুল থেকে মুক্তি পেয়েছি…। কিন্তু যে রাতে আক্রি শহরের ওপর বিরাট আক্রমণ হলো, তখন পরিস্থিতিটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠতে শুরু করল। সেটা ছিল নিষ্ঠুর এক রাত, পুরুষদের গম্ভীর নীরবতা আর মহিলাদের দোয়া-দরুদ পাঠের মধ্য দিয়ে কেটেছিল সেই রাত। আমার বন্ধুরা, তোমরা এবং আমি তখন এতই ছোট ছিলাম যে কী ঘটছিল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তবু সেই রাতেই আসল ব্যাপারটার কিছু দিক পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। ইহুদিরা আতঙ্ক ছড়ানো আর কামান দাগানো থামালে সকালবেলা আমাদের দরজার সামনে দেখা গেল বিরাট এক ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। খুব তড়িঘড়ি করে, পাগলের মতো লোকজন সেই ট্রাকে তুলছিল হালকা জিনিসপত্তর, বেশির ভাগই ঘুমানোর সরঞ্জাম।
প্রাচীন বাড়িটার দেয়ালে হেলান দিয়ে আমি দেখছিলাম, মা ট্রাকে উঠলেন, তারপর উঠলেন আমার ফুপু, তারপর ছোটরা, তারপর আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, বাবা সেই কোনা থেকে আমাকে টেনে নিয়ে নিজের মাথায় তুললেন, বসিয়ে দিলেন চালকের কেবিনের ওপরে ব্যাগ-বোঁচকা রাখার জন্য খাঁচার মতো ধাতব কুঠুরিটার মধ্যে। আমি দেখলাম সেখানে চুপচাপ বসে আছে আমার ভাই রিয়াদ। আমি জুত হয়ে বসার আগেই গাড়িটা ছেড়ে দিল। আক্রি একটু একটু করে হারিয়ে যাচ্ছিল রাস এল-নাকুরার (লেবাননে) চলে যাওয়া পর্বতমুখী সড়কটা বাঁকে বাঁকে।
দিনটা খানিক মেঘলা ছিল, আমার শরীরে একটু একটু করে ঢুকে পড়ছিল শীতের শিরশিরে অনুভূতি। ব্যাগ-বোঁচকায় হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে একদম চুপচাপ বসে ছিল রিয়াদ। দুই হাঁটুর মাঝখানে গাল রেখে দুই হাতে হাঁটু দুটি বেড় দিয়ে নীরবে বসে ছিলাম আমিও। একটার পর একটা কমলাবাগান পার হয়ে যাচ্ছিল, আমাদের গাড়িটি ভোঁস ভোঁস বিকট শব্দ করতে করতে উঠে যাচ্ছিল ওপরের দিকে…দূর থেকে গুলির শব্দ ভেসে আসছিল যেন আমাদের বিদায় জানানো হচ্ছে।
দিগন্তে নীল ধোঁয়াশায় মুড়ে ছিল রাস এল-নাকুরা; গাড়িটা থেমে গেল হঠাৎ। তল্পিতল্পার ভেতর থেকে বেরিয়ে নেমে গেলেন মহিলারা, এগিয়ে গেলেন রাস্তার ধারে এক কমলালেবু বিক্রেতার কাছে। কমলালেবু নিয়ে যখন তাঁরা ফিরে এলেন, তাঁদের কান্নার শব্দ আমাদের কানে পৌঁছাল। আমার কাছে তখনই কেবল মনে হলো, কমলালেবু কত প্রিয়, কত মূল্যবান; মনে হলো পরিচ্ছন্ন, বড় ফলগুলোর প্রতিটি যেন যক্ষের ধন। আমার বাবা চালকের পাশ থেকে উঠে একটি কমলালেবু হাতে নিলেন, নীরবে তাকালেন ফলটির দিকে, তারপর কাঁদতে শুরু করলেন অসহায় শিশুর মতো।
রাস এল-নাকুরায় পৌঁছে আমাদের গাড়িটা দাঁড়াল একই রকমের অনেকগুলো গাড়ির পাশে। পুরুষেরা নিজ নিজ হাতের অস্ত্র তুলে দিতে লাগলেন পুলিশদের হাতে, যারা অস্ত্রগুলো নেওয়ার জন্য সেখানে ছিল। তারপর এল আমাদের পালা। আমি দেখলাম, পিস্তল আর মেশিনগান ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে বিরাট এক টেবিলের ওপর। দেখলাম, কমলালেবুর দেশ অনেক পেছনে ফেলে আঁকাবাঁকা সড়ক ধরে বিশাল বিশাল গাড়ির এক দীর্ঘ সারি আসছে লেবাননের দিকে। তখন আমিও ভীষণ কাঁদলাম।
আমাদের মা তখনো নীরবে তাকিয়ে ছিলেন কমলালেবুগুলোর দিকে, বাবা যেসব কমলাগাছ ইহুদিদের কাছে ছেড়ে দিয়ে এসেছেন, সবগুলো যেন মায়ের চোখে ঝলমল করছিল…ঝকঝকে পরিষ্কার গাছগুলো, যেগুলো একটা একটা করে কিনেছিলেন বাবা, সবগুলো যেন তাঁর মুখের ছবিতে প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল। তাঁর চোখে অশ্রু, পুলিশ অফিসারের সামনে তিনি তা লুকোতে পারছিলেন না, চকচক করছিল তাঁর চোখভরা জল।
বিকেলে আমরা যখন সিডন পৌঁছালাম, ততক্ষণে আমাদের পরিচয় দাঁড়িয়ে গেছে শরণার্থী।
গাসান কানাফানি
জন্ম: এপ্রিল, ১৯৩৬, আক্রিতে (১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি দখল কায়েম হয়, এটি হাইফা উপকূলের প্রাচীনতম একটি শহর)। কানাফানির ছেলেবেলা কাটে জাফায়। ওখানেই ফরাসী মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা। ১৯৪৮ সালে জাফা ছেঢ়ে এসে আশ্রয় নেন লেবানন, সিরিয়া ও কুয়েতে। ১৯৬১ সালে বৈরুতে ফিরে এসে গল্প, উপন্যাস, চিত্রনাট্য, রাজনৈতিক প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেন। ১৯৭০ সালে পপুলার ফ্রন্ট অব প্যালেস্টাইনের মুখপাত্র হিসেবে কাজ শুরু করেন। জুলাই, ১৯৭২ সালে গাড়িতে পেতে রাখা ইসরায়েলি বোমায় নিহত হন তিনি।
(ইংরেজি থেকে অনুবাদ)
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১২, ২০১১
Leave a Reply