মুর্তজা বশীর [জন্ম: ১৭ আগস্ট ১৯৩২]
‘কেন ছবি আঁকেন?
কবে থেকে আঁকেন?
কী বোঝাতে চান?
…আমি এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর আর দিতে চাই না। একই কথা কতবার বলব?’
না, ১৭ আগস্ট ৮০তে পা রাখতে যাওয়া শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তেমন আলোচনা হলো না। বরং আলোচনার বিষয় হয়ে এল অমরত্ব। মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকা।
প্রায় ৩০ বছর আগের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, নামকরা ইতিহাসবিদ এ বি এম হাবিবুল্লাহ মারা গেলেন। যত দূর মনে পড়ে, অবজারভার-এর ভেতরের পাতায় তার ছোট্ট একটা খবর বের হলো। আর কোনো কাগজে খবরটা খুঁজে পেলাম না। খুবই মর্মাহত হলাম। খ্যাতিমান একজন পণ্ডিত চলে গেলেন, অথচ কোনো খবর নেই! আমি তখন চট্টগ্রামে থাকি। কয়েকটি খবরের কাগজের অফিসে গিয়ে আমার পরিচিতদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমি মারা গেলে নিউজটা কোথায় দেবেন?’
‘এসব কী বলেন, বশীর ভাই।’
‘না, না, বলেন না। আমার জানাটা জরুরি।’
কেউ বলল, ভেতরের পাতায়। কেউ বলল শেষ পাতায়। সম্ভবত দৈনিক বাংলা বলল, তারা প্রথম পাতায় সিঙ্গেল কলাম দেবে। ওই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন আমার বন্ধু কবি শামসুর রাহমান। তাই হয়তো তাঁরা ওইটুকু দেওয়ার কথা বলেছেন।
মূল শিরোনামের দিকে ইঙ্গিত করে আমি বললাম, ‘এইখানে দেবেন না?’
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী যে বলেন, বশীর ভাই।’
আমি তখন বলেছিলাম, ‘আমাকে তাহলে তত দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে হবে, যত দিন না আমি মারা গেলে লিড নিউজ হই। আমাকে সেভাবেই প্রস্তুত হতে হবে।’
কথাগুলো বলছিলেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। ১৭ আগস্ট যিনি আশি বছরে পা রাখছেন। নিজেকে যিনি বরাবর ৩০ বছরের যুবক বলে ভাবেন। প্রৌঢ়ত্ব বা বার্ধক্য যাঁকে স্পর্শ করে না। যিনি কাজের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে চান। চান অমরত্ব। তাঁর কাছে জানতে চাই, আপনার সেই প্রস্তুতি কত দূর এগোল?
ফার্স্ট লিড হওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। আমার বাবা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আমার বন্ধু কবি শামসুর রাহমান তাঁদের মৃত্যুর পর ফার্স্ট লিড হয়েছিলেন। তাঁদের যোগ্যতাবলেই। আমি তো আমার প্রতিভার বাইরে যেতে পারব না। চার-পাঁচ বছর আগের কথা। এ দেশের একজন নামকরা শিল্পী আমাকে বললেন, ‘আপনার ছবি তো কিছু হয় না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার মনে হয় আমার কাজে তাড়াহুড়া আছে? নিষ্ঠার অভাব আছে?’
সেই শিল্পী বললেন, ‘না, আপনার নিষ্ঠা ও সততা শতভাগ।’
‘তাহলে? আমি তো আমাকে উজাড় করে দিচ্ছি। স্টান্টবাজি করছি না। আমার যতটুকু প্রতিভা তার বেশি তো আমি যেতে পারব না।’
একটু দম নিয়ে বলেন মুর্তজা বশীর, ‘তবে একটা কথা বলি, আমি একজন বিতর্কিত শিল্পী।’
—নিজেই বলছেন?
—হ্যাঁ। কারণ আছে, আমি সময়ের আগে চলেছি। আমি যখন ট্রান্সপারেন্সি বা স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করেছি, তখন সেটা লোকে বোঝেনি। আমি যখন ‘দেয়াল সিরিজ’ নিয়ে কাজ করলাম, তখনো প্রশ্নবিদ্ধ হলাম। স্বাধীনতার পরে যখন ‘এপিটাফ ফর মার্টিয়ার্স’ করলাম আমাকে শুনতে হয়েছে, বশীর অ্যানাটমির বই থেকে আঁকছে। সে সময় আমি শিল্পকলা একাডেমীর পুরস্কার পেয়েছিলাম বলে অনেকে ছবি নামিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আজকে সেসব ছবি কি আমার কাছে আছে? না, একটাও নেই। লোকে খোঁজে, আপনার ‘দেয়াল’ বা ‘এপিটাফ’ সিরিজের কাজ আছে? আমি কখনোই ক্রেতার মুখের দিকে তাকিয়ে ছবি আঁকি না। সে কারণে আমি জনপ্রিয় শিল্পী নই। যখন যেটা মনে হয়েছে, এঁকেছি। কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ তো ছবি আগেও বোঝেনি, এখনো বোঝে না। সেটা কোনো দোষের বিষয় না। যেমন আমি লাহোরে লরেন্স গার্ডেনে গিয়ে রওশন আরার উচ্চাঙ্গসংগীত কিছুক্ষণ শুনে উঠে এসেছিলাম। কারণ, উচ্চাঙ্গসংগীত বোঝার জন্য, তার রস নেওয়ার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
—আমাদের আলোচনা আজ ‘অমরত্ব’ নিয়ে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র সন্তান মুর্তজা বশীর তাঁর মা-বাবার ১০০তম বিবাহবার্ষিকী উদ্যাপন করে প্রদর্শনী করেছেন। এত বছর পরেও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বেঁচে আছেন। এই অমরত্ব নিয়ে আপনার অনুভূতিটা জানতে চাই।
—ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ কিন্তু তাঁর সন্তান আর বংশধরদের জন্য বেঁচে নেই। তাঁর সন্তান আর বংশধরদের আকর্ষণ ছিল তাঁর সম্পদের প্রতি।
—এটা কি লেখা যাবে?
—কেন যাবে না? শহীদুল্লাহ মারা যাওয়ার পর আমি মুর্তজা বশীর মামলা করেছি সম্পত্তির জন্য। কারণ, আমাকে তো কেউ দিচ্ছিল না। শুধু ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ নন, বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আমাকে বলেছিলেন, হামিদুল হক চৌধুরীর মৃত্যুর পরও সন্তানদের মধ্যে মামলা-মোকদ্দমা হয়। এটা দুঃখজনক। যে পিতা সন্তান জন্মের আগে থেকে সন্তানের মুখ দেখার স্বপ্নে বিভোর থাকেন, তাকে বড় করেন ও শিক্ষাদান করেন, তাঁর মৃত্যুর পরপর সন্তানেরা কীভাবে জমির মালিকানার জন্য পিতার নাম কেটে ওয়ারিশ হিসেবে নিজেদের নাম বসাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দুঃখজনক। হ্যাঁ, আমিও ন্যায্য হিস্যার জন্য মামলা করেছি। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহেক তাঁর সন্তানেরা অমর করে রাখেনি। শহীদুল্লাহ্র কাজ শহীদুল্লাহেক অমর করে রেখেছে। যদিও মনঃকষ্ট নিয়ে জিজ্ঞেস করছি, আসলে তাঁর জন্য আমরা কী করেছি? আগে পাঠ্যপুস্তকে ছেলেমেয়েরা তাঁর জীবনী পড়ত, এখন সেটা নেই। তরুণ প্রজন্মকে আমরা জানাতে পারছি না। বাংলা একাডেমীতে তাঁর স্মরণসভায় কতজন লোক হয়? একটা মজার কথা বলি, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মৃত্যুর কিছুদিন আগে সাংবাদিক হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ তাঁর একটা সাক্ষাৎকার ছেপেছিলেন দৈনিক পাকিস্তান-এ। যে লোক সারা জীবন বাংলা ভাষার জন্য কাজ করেছেন, রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে শান্তিনিকেতনে ভারতের সাধন ভাষা নিয়ে কথা বলেছেন, তিনি পরিষ্কার ইংরেজিতে বলে গিয়েছিলেন, ‘আই উইল বি ফরগটেন ভেরি সুন’।
ঢাকায় শহীদুল্লাহ্র নামে নামকাওয়াস্তে একটা রাস্তা আছে। কিন্তু হোল্ডিংয়ে কোথাও নাম নেই। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বারাসাতে একটি পুরো রাস্তা, পিয়ারা গ্রামে ঢোকার মুখে চন্দ্রকেতু গড়ে কলেজ, ইছামতী নদী পারাপার করা একটি ফেরি জাহাজ তাঁর নামে। একটি সেতুও শহীদুল্লাহ্র নামে করা হয়েছে। মানুষ যেমন তাঁর কাজ দিয়ে বেঁচে থাকে, তেমনি মানুষকে সম্মান করতেও জানতে হয়।
—আপনি কাজ দিয়ে বেঁচে থাকতে চান। কাজ দিয়ে বাঁচেন যাঁরা, তাঁরা সাধারণ নন, বিখ্যাত মানুষ। তো, আপনি বিখ্যাত হতে চাইলেন কেন?
—আমার বাবা তখন বগুড়ার আযিযুল হক কলেজের প্রিন্সিপাল। আমি ভীষণ দুর্বিনীত ছিলাম। বাবার কাছে অভিযোগ আসত শুধু। বাবা একদিন আমাকে ডেকে বললেন, হয় ফেমাস হও, নয় নটোরিয়াস; মিডিওকার হয়ো না। আমি ঠিক করলাম, ফেমাস হব। তত দিনে আমার কাছে জানা হয়ে গেছে ফেমাস কারা। আমি যখন ক্লাস টেনের ছাত্র, বাবার রেমিংটন বন্ড কাগজের প্যাডের পাতায় পোরট্রেট এঁকে জওহরলাল নেহরুকে পাঠিয়েছিলাম। লিখেছিলাম, আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র, আপনার পোরট্রেট এঁকে পাঠালাম, বিনিময়ে আপনার স্বাক্ষর চাই। তিনি পাঠালেন, স্বাক্ষরের নিচে তারিখ: সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮। এখনো আছে। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন নিয়ে বই পড়েছি। জেনেছি, সূর্য সেনের সঙ্গী অম্বিকা চক্রবর্তীর কথা। তাঁর স্বাক্ষর, ছবিও আমার কাছে আছে। কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন আমায় লিখে দিলেন, শিল্পীর দায়িত্ব কী। সাইকেলে করে বিশ্বভ্রমণ করা প্রথম বাঙালি রামনাথ বিশ্বাস কিংবা দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনকেও আমি চিনতাম। যে বয়সে যে মানুষগুলোর কথা আমি পড়েছি, জেনেছি বা সংস্পর্শে এসেছি, সে বয়সে এঁদের নামও অনেকে জানত না। আমি যখন প্যারিসে ছিলাম, মমার্তে বসে জাঁ পল সার্ত্র নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়তাম। অস্তিত্ববাদ তখন আমার অস্তিত্বজুড়ে। কিন্তু আমার ভিনদেশী সহপাঠী ততটা উত্তেজিত নন। আমায় বলেছিলেন, সময় এখন সার্ত্রের চেয়েও এগিয়ে। পিকাসো যেদিন মারা গেলেন, আমি ভাবলাম, আজ বুঝি সব বন্ধ থাকবে। পয়সা নেই, এই সুযোগে আমি উইন্ডোশপিং করব। দেখি, কারও কোনো বিকার নাই। সব ঠিকঠাক চলছে। আমার এক সহপাঠিনী শুধু মজা করে বলেছিলেন, তোমার গ্র্যান্ডপা মারা গেছেন। তো, আমি তো জানি বিখ্যাত মানে কী?
৩ আগস্ট দুপুর ১২টায় ঢাকার মণিপুরিপাড়ায় মুর্তজা বশীরের বাড়িতে গিয়ে দেখি, তাঁর ঘরে বইয়ের স্তূপের ওপরে স্ট্যাম্পের খাতা। রাশিয়ার কয়েকটি দুর্লভ স্ট্যাম্প নিয়ে পড়াশোনা করছেন। সম্প্রতি ভুটান থেকে আনা দুটি কয়েন তাঁকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুর মতো হাসি। ‘আমার সংগ্রহে ভুটানের কাগজের নোট আছে, কিন্তু কয়েন ছিল না।’ জিজ্ঞেস করলাম, স্ট্যাম্প আর কয়েন সংগ্রহ নিয়ে আপনি এখনো বিভোর। শিকারির মতো খুঁজে বেড়ান। অটোগ্রাফ নেওয়া বন্ধ করলেন কবে?
অটোগ্রাফের খাতা উল্টে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, কাশ্মীরের নেতা শেখ আবদুল্লাহসহ নানাজনের দুর্লভ অটোগ্রাফ দেখাতে দেখাতে বললেন, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক গিয়েছিলেন বগুড়ায়। আমি অটোগ্রাফ নিলাম। বললাম, কিছু লিখে দিলেন না? তিনি লিখলেন, ‘বি ট্রুথফুল।’ সেদিন থেকে অটোগ্রাফ নেওয়ার প্রতি আমার আগ্রহ কমে গেল। সারা জীবন এত অসত্য বলে আমাকে লিখলেন, সত্যবাদী হতে? একাকিত্ব উপভোগ করেন মুর্তজা বশীর। খুব একটা ভিড়ভাট্টা, হইচই, বিয়েবাড়ি পছন্দ নয় তাঁর। ঘরের পাশে এক চিলতে বারান্দায় বসে নারকেলগাছ, গাছের পাতা নড়া, কাঠঠোকরার ঠোকর দেখতে দেখতে কেটে যায় বেলা। যখন চট্টগ্রামে ছিলেন, বউ-ছেলেমেয়েরা ঢাকায় এলে ডাইনিং টেবিলে নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে একা সময় কাটাতে বরং ভালোই লাগত তাঁর। বললাম, এখন ভীষণ নিয়মতান্ত্রিক, হিসেব করা জীবন আপনার। কিন্তু একটা সময় নিয়ম ভাঙাটাই আপনার নিয়ম ছিল। কেন?
—যখন নিয়ম ভেঙেছি, তখন আসলে সংস্কার ভেঙেছি। এখন আমার স্থিত হয়ে বসার সময়। তবে ছোটবেলা থেকে আমার মনে হতো পরিবারে কেউ আমায় ভালোবাসে না, কেউ আমায় চায় না।
—কিন্তু আপনার মা তো অমানুষিক কষ্ট করেছেন আপনার জন্ম দিতে গিয়ে?
—তা ঠিক। মা সব সময় বলতেনও, ‘তুই জন্মের আগেও জ্বালিয়েছিস, এখনো জ্বালাচ্ছিস।’ আমার বাবাকে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন এতগুলো সন্তান জন্মদানের বিষয়ে। তিনি বলেছেন, শেষেরটা যে জিনিয়াস হবে না, কে জানে? অন্নদাশঙ্করের একটা লেখায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র বিষয়েও এর উল্লেখ আছে। আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাড়ি থেকে একবার পালিয়ে গেলাম। আবার দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় লখনৌ চলে গেলাম। পরে বাড়ির জন্য মন খারাপ হলো, তাই চলে এলাম। আমার ভীষণ অহংবোধও ছিল। আমরা অনেক ভাইবোন। মা সবার জন্য ফিরনি রেঁধে টেবিলে বাটিতে বাটিতে হয়তো রেখেছেন। আমি গুনে দেখি, একটা কম। আমার মনে হতো আমারটাই নাই। এটা হয়তো মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। কিন্তু আমার মনে হতো কেউ আমাকে চায় না। শৈশব থেকেই তাই আমি একাকিত্ব ভালোবাসি। তবে এখন আমি সত্যিই একা। আমার চার ঘনিষ্ঠ বন্ধু—কবি শামসুর রাহমান, নাট্যকার সাইদ আহমেদ, শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তী আর সবশেষে শিল্পী আমিনুল ইসলাম। সবাই একে একে চলে গেল। আমার আর কথা বলারও কেউ নেই। আমি এখন সত্যিই একা।
—আপনি আপনার অনুজ শিল্পীদের পরামর্শ দেন খ্যাতি-যশে হারিয়ে না যেতে। বলেন, খ্যাতি আর যশ যেন শ্যাওলাধরা পিচ্ছিল পথ, পায়ে রবারের স্যান্ডেল। অসাবধান হলেই পা পিছলে যায়। কথাটা কেন বলেন?
—কথাটা আমাকে বলেছিলেন প্রয়াত ফজলে লোহানী। আমার অহংবোধ দেখেই বলেছিলেন। সেই শিক্ষাটা পরবর্তী প্রজন্মকে দিই। সেই শিক্ষা থেকে আমি মোহমুক্ত থাকতে শিখেছি। জীবনের ধাপে ধাপে নানা জনের কাছ থেকে নানা শিক্ষা নিয়ে নিজেকে পরিবর্তন করেছি। ১৯৬১ সালে লাহোরে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে বলেছিলাম, ফয়েজ ভাই, আমার নাম হয় না কেন? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, বশীর, তুমি নামের পিছনে ছুটো না, নাম তোমার পেছনে ছুটবে। এটাও আমার একটা শিক্ষা।
ঘরের দেয়ালে তরুণ মুর্তজা বশীরের সঙ্গে জয়নুল আবেদিনের একটা আলোকচিত্র। জয়নুল আবেদিন মারা যাওয়ার ২০ দিন আগে হাসপাতালে তোলা ছবিটি। তুলেছিলেন শিল্পী কামরুল হাসান। ছবিটি দেখতে দেখতে মুর্তজা বশীর বললেন, আমার অহংবোধে আমি জয়নুল আবেদিনকেও আঘাত করেছিলাম। তবে জয়নুল আবেদিন আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি ভালো কাজ করো, কিন্তু তুমি একাই ভালো কাজ করো না। আমরাও আঁকি।’ বলেছিলেন এমনভাবে নিজেকে তৈরি করো, যাতে অন্যের প্রশংসা শুনে হাসবে। অন্যের সমালোচনাতেও শুধু হাসবে। ওই অহংবোধের উত্তরেই এত কিছু বলা। কথাগুলো হূদয়ে নিতে আমার ১০ বছর লেগেছিল। এখন আমি প্রশংসাতেও হাসি, সমালোচনাতেও হাসি।
—আমাদের আলোচনার শুরুটা ছিল অমরত্ব নিয়ে। শেষটাও করতে চাই অমরত্ব নিয়ে। কিছু বলবেন?
—আমার অমরত্বের বাসনাটা হলো ক্লাস টেনে। আমি তখন বগুড়া করনেশন ইনস্টিটিউটে পড়তাম। সকালবেলা আমার এক বন্ধুর বাড়ি গেলাম দেখা করতে। দেখি, গামছা কাঁধে বের হচ্ছে। সে প্রশ্ন করল, কিরে, কোথায় যাস?
আধা ঘণ্টা অপেক্ষা কর, আমি নদীতে ডুব দিয়ে আসি।
আমি আধা ঘণ্টা ঘুরে এসে দেখি, ওদের উঠানে অনেক মানুষ। ভিড় ঠেলে তাকিয়ে দেখি, বন্ধু আমার মাটিতে শুয়ে।
—কী হলো?
শুনলাম, করতোয়া নদীতে ডুবে মারা গেছে।
বিরাট একটা ধাক্কা খেলাম। ছোটবেলা থেকে পড়তাম, মানুষ মরণশীল। কিন্তু সেদিন মনে হলো ম্যান ইজ ইমমরটাল। আমাকে ইমমরটাল হতে হবে। এমন কিছু কাজ করতে হবে, যেন আমি মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকি, কিন্তু কীভাবে? সেই থেকেই ছবি আঁকা, লেখালেখি। সৃজনশীল কাজ দিয়ে মৃত্যুর পর বেঁচে থাকতে চাই। কখনো মনে হয় ছবি নয়, হয়তো বাংলার হাবসি সুলতান কিংবা পশ্চিমবঙ্গের মন্দিরের টেরাকোটা নিয়ে আমার গবেষণাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কে জানে? শুধু সময় বলে দেবে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি উপন্যাসে বলেছিলেন, মানুষ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, কিন্তু কখনোই হারবে না। কিন্তু আমি ঠিক এর উল্টোটাই বিশ্বাস করি, মানুষ হারতে পারে, কিন্তু ধ্বংস হবে না।
মুর্তজা বশীরের অটোগ্রাফের খাতা থেকে
জওহরলাল নেহরুর অটোগ্রাফ: মুর্তজা বশীর যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র, তখন নেহরুকে একটি পোর্ট্রেট এঁকে পাঠালে বিনিময়ে তিনি ওপরের অটোগ্রাফটি পাঠান। সময়কাল সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক: তিনি গিয়েছিলেন বগুড়ায়। মুর্তজা বশীর অটোগ্রাফ চেয়ে বললেন, কিছু লিখে দিলেন না? তিনি লিখলেন, ‘বি ট্রুথফুল’.।
কমিউনিস্ট নেতা ভবানী সেন: অটোগ্রাফে ভবানী সেন আমায় লিখে দিলেন, শিল্পীর দায়িত্ব কী।
সুমনা শারমীন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১২, ২০১১
Leave a Reply