জানের মাছ উঠছে খলখলিয়ে। বেশির ভাগ পুঁটি, খলশে, ডারকা, চেংটি, ছোট শোল, চ্যাং এবং দু-একটি ব্যাঙও। জান তৈরির বাঁশের মাচা একটু হলেই ছুঁয়ে যাবে জলাভূমির পানি। সারা দিন অশ্রান্ত বৃষ্টি, আকাশ কালো, মাঝে মাঝে ফরসা, আবার কালো হয়। কালো হলে শিরশির বাতাস বইতে থাকে আর পঙ্গপালের মতো মাছগুলো এসে চারিদিকে ঘুরতে থাকে। জালটা উঠলেই শত শত মাছ। টিনের বালতিতে মাছগুলো জড়ো হচ্ছে। এর মধ্যে কয়েক বালতি ভর্তি।
মামা বলে, ‘হারে কাবুরুদ্দি, ঠান্ডা নাইগছে?’ কাবুরুদ্দি বলে, ‘বাড়ি যাইম, মামু।’ মামা বলে, ‘ক্যানেরে, প্যাট অ্যালাও কামড়ায়?’ মামা বুঝেছে, আমাশয় রোগাক্রান্ত ভাগনেটিকে কোথায় পাঠাতে হবে। বলল, ‘আর খানেক শয়া থাক। বাড়ি গেলে উড়কি ধানের মলা খোয়াইম।’ কাবুরুদ্দি অসহায়ের মতো জালের দিকে তাকিয়ে দেখে, এবার উঠেছে বাইম। বাইম সাপের মতোই, তবে ফণা নেই, বিষ নেই, খেতে গোশতের মতো। মামা খুশি। বাইম তার পছন্দের মাছ।
‘তোর মামি ফাইক করি ছাঁচি তেল দিয়া আজ রাইতত আন্দিবে।’ বলল মামা। ভাগ্নে ভাবে, বাইম মাছ ও তার মামা একই প্রজাতির, দুজনই পিছলিয়ে যায়। সন্ধের আগ পর্যন্ত তার বাসায় যাওয়া হবে না। কড়কড় করে বাজ ছুটছে, নামছে ঝমঝমানো বৃষ্টি। কাবুরুদ্দি ভাবে, তার মামা এতগুলো মাছ দিয়ে কী করবে, বাসায় নেবে না। তাহলে যাবে কোথায়? অনেক পরে জানতে পেরেছে, এগুলো যাবে বড় দেওয়ানীর বাড়ি। সেখানে কেন যাবে এত সুন্দর সুন্দর মাছের বালতিগুলো তা তার বোধগম্য নয়। কেন আবার, পয়সার জন্য। মামা ধনী হতে চায়।
শাওন মাস এলে কাবুরুদ্দির পেট খারাপ হয়। এ অঞ্চলে সব ছেলেমেয়ের বুঝি হয়। অথচ এর কথা কেউ কাউকে বলতে পারে না। পানির মধ্যেই বিষ। চুয়ার পানি সে বিষের আধার, এর চেয়ে কালো পানি আর কেউ দেখেনি। চুয়া অর্থাৎ কুয়া। মান্ধাতার আমলের। পরিষ্কার করেনি কেউ, করার কথা কারও মনে হয়নি। সাদা চোখেই পোকা সরিয়ে পানি পান করে কাবুরুদ্দি। পোকার ওষুধ কিনে আনে মামা। তখন তাতে এতই গন্ধ যে নাক বন্ধ করে পানি খেতে হয়। কাবুরুদ্দি ভাবে, পানির দেশে পানির এত কষ্ট ক্যানে।
টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ হলে কাবুরুদ্দির ঘুম আসে ফড়িংয়ের মতো। ফড়িং যেমন ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে, তার মনটাও টাপ্পাস কি টুপ্পুস শব্দের আবহে বৃষ্টির সঙ্গে ভেসে বেড়ায় ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে। গানের সুরের টাপ্পাস কি টুপ্পুস স্মৃতি অধিকার করেছে। ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুরটুপুর’ শুনে তা মনে হয় না। কেন তা সে জানে না। ঝমঝমেয়া পড়ে শব্দটিও যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসে। জ্যৈষ্ঠে টিনের চালে আম পড়ার শব্দ হলে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে আমগুলো রাতারাতি বস্তায় পুরতে।
মামি রাতে উঠতে দেন না। বলেন, ‘অ্যালাও আইত বাকি, চণ্ডী আসি মারি ফেলাইবে। আইতোত চণ্ডী বাইর হয়, জানিস না, ছোট ছাওয়া পাইলে বাড়ি নিয়া যায়।’
কাবুরুদ্দি ভাবে, চণ্ডীর দেখা পেলে তার সঙ্গেই চলে যাবে। চণ্ডী খারাপ কিসে? হলোই না হয় হিন্দুদের দেবতা, তা-ও সে মামির চেয়ে ভালো হবে। মামি ভালোবাসার ভান করে, ভালোবাসে না। ছোট হলেও ভালোবাসা চিনে ফেলেছে কাবুরুদ্দি।
বাড়ি থেকে জানের মাছের দূরত্ব কম নয়, তিন-চার ক্রোশ হবে। সকালবেলা অতটুকু পথ হেঁটেই এসেছে মামা-ভাগ্নে। কাদায় মাখানো পুরো পথটা। কাদায় গরুগাড়ির গরুগুলো কী কষ্টে পথ করে নেয়। একটি গরুর পেছনে দশ-বারোটি জোঁক। জানের পানির নিচে কাবুরুদ্দি জোঁক দেখতে পায়। তার জানা আছে জোঁকের শাস্তি কী। নুন অথবা চুন। মুহূর্তে জোঁকের রক্তাক্ত দেহ খসে পড়ে গরুর পা বেয়ে। গরু জানে, কাবুরুদ্দি তাকে সাহায্য করার জন্য জোঁকগুলো সরিয়ে দিচ্ছে। গরু কথা বলতে পারে না, অথচ কাবুরুদ্দির ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারে অনায়াসেই, যখন চুপ করে কাবুরুদ্দিকে সহায়তা দেয় গরু।
বালতিতে রাখা আহত বাইম মাছটি পালানোর সুযোগ খুঁজছে। কাবুরুদ্দি জানে, এ মাছের ভাগ সে পাবে না। তার চার-পাঁচজন মামাতো ভাইদের হিস্যা মিটিয়ে তার পাত পর্যন্ত পৌঁছাবে না মাছটির অংশ। মাছটিকে পালানোর সুযোগ করে দেয়। খানিক পরে হুঁক্কায় টান দেওয়ার শেষে মামা এসে দেখে বাইম মাছটি নেই।
বলে, ‘কাবুরুদ্দি, বাইম মাছটা কোটে গেইল?’ কাবুরুদ্দি হেলায় জবাব দেয়, ‘মুই জানো না।’
বড় বাজ পড়ল কোথাও। মামা উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, ‘ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্নাইলাইহে রাজিউন।’
বর্ডারের ওপাশেই ঝিল, বড় বড় মাছ ওখানেই। মামা রাতের বেলা অদৃশ্য হন। কোথা থেকে ধরে নিয়ে আসেন মৃগেল, রুই, কালবাউস। কাবুরুদ্দিন কোনো দিন খায়নি। জেনেছে, ওগুলো বাজারে বিক্রি হলে মামার অনেক লাভ হবে। জাল নিয়ে ওদিক থেকেও মাছুয়ারা এ পাশে আসে। রাতের বেলা পুকুর সাবাড়। তবে ওরা কোনো দিন পুকুরে বিষ ছেড়ে যায়নি। অথচ সাটুরিয়ায় পরপর তিনটি পুকুরে বিষ ছেড়েছে স্থানীয়রা। ছোট বিরোধ।
মামা ব্যবসায়ী লোক। তবু মা-মরা ভাগনেটির হাত ধরে থাকতে তার ভালো লাগে। স্লেট ভেঙে গেলে নতুন স্লেট কিনে দিতে বিলম্ব হয় না। সাদা চক নিয়ে আসে, আলিফ বে তে ছে লিখে দেয়, সন্ধেবেলা দেখে, লেখাগুলো ঠিক হলো কি না। মামি তার জন্য পুরোনো কাপড়গুলোতেই সুঁই-সুতো লাগিয়ে ঝালিয়ে দেয়। সকালবেলা যেদিন হিমালয়ের পাহাড় থেকে হরিণ নেমে এল, সে হরিণের মাংসের টুকরো কাবুরুদ্দি পায়নি। খেয়ে শেষ করেছে সবাই। শুনেছে, হরিণের গোশত খেতে সুস্বাদু নয়। ভালো হলদিবাড়ির চিতল মাছ। মামার শখ চিতল মাছের পেটি।
মামার সঙ্গে বাজারেও গেছে। মামা নিজে বসেনি। এক আদিয়ার প্রজা মাছগুলো বিক্রি করছে, আর উনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেওয়ানিগিরি করছেন। তার মাছের খাঁচাগুলো বিক্রি হয়ে যায় বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে। কারণ একটাই, তাঁর মাছ টাটকা। বেশি দামের জন্য নেই তাঁর প্রতীক্ষা। যতটুকু তাঁর বরাতে, তাতেই সন্তুষ্ট। যখন যেখানে প্রয়োজন ছুটে গেছে তাঁর গরুর গাড়ি, এক হাট থেকে আরেক হাটে সওদা।
বর্ডারে ব্যবসা চাল-ডাল-নুন-তেলের। যখন যেখানে সস্তা, চাহিদা, সেখানে। অভাবীদের অভাব মেটে না। লুকিয়ে শাড়ি, লুঙ্গি, সাবান নিয়ে চলেছে যারা, দেখলেই চেনা যায় তাদের। এইটুকু পারাপার করলেই দিনের অভাব মিটবে। দিনের অভাব অর্থাৎ ভাতের ক্ষুধা। সবাই জানে, কিছু বলে না। এক দেশের মাল অন্য দেশে চালান করা।
কাবুরুদ্দির সঙ্গে ঘুমায় পাঁচজন, মামাতো ভাইয়েরা, পড়াশোনায় লবডঙ্গা। স্কুলে যাওয়ার ঢংটি আছে, একটু বৃষ্টি হলেই স্কুল কামাই। সারা দিন হিন্দি সিনেমা দেখা। পড়াশোনার সঙ্গে নেই সংযোগ। বর্ডারের ওধার থেকে বোতলে কি যেন মজাদার পানীয় এসেছে। গ্রামের ছেলেরা চেখে দেখেছে। কেউ কেউ বলেছে, এর চেয়ে মজাদার আর কোনো পানীয় নেই।
ভরা বর্ষায় মামার সন্ধান নতুন ব্যবসার। বিরাট বর্ডারের কোথায় ফোকর তা জানে শুধু মামার মতো কয়েকজন। পাহারাদারেরা জানবে না, কত ধানে কত চাল। কাবুরুদ্দি আঁচ করতে পারে, জানের মাছ ছেড়ে এখন কোন মাছ তার মামার জালের আগায়। এই ব্যবসার ছোবলে নির্ঘাত আঘাত পাবে নিজ সন্তানেরাই। হলদিবাড়ির চিতল মাছ নয়, হলুদ রঙের ‘ডাইলের’ বোতল। যে ব্যবসায় রাতারাতি বাড়ি, গাড়ি। কাবুরুদ্দি ছোট, তার জানতে বাকি নেই, হলুদ রঙের শিশি বর্ষার পানির মতো নিয়ে আসবে অন্ধকার রাত্রিতে চোখের পানি।
টিনের চালে বেজে ওঠে বর্ষার গান:
‘আঁধার ঘরোৎ পড়ি থাকঙ
পড়ে চৌখের পানি
আবো টাপ্পাস কি টুপ্পুস করিয়া’
মুস্তাফা জামান আব্বাসী: সাহিত্য-সংগীত ব্যক্তিত্ব
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১২, ২০১১
Leave a Reply