২২ শ্রাবণ কবিগুরু রবান্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুবার্ষিকী। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে ভিনদেশি দুই লেখক উইলিয়াম রাদিচে ও সের্গেই সেরেব্রিয়ানি রবীন্দ্রনাথকে নতুনভাবে আবিষ্কারের প্রয়াশ পেয়েছেন। তাঁদের রচনার বাংলা অনুবাদে রবীন্দ্র-মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের বিশেষ আয়োজন।
২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের সার্ধশততম বার্ষিকী উপলক্ষে নানা উৎসব-আয়োজন চলছে; কয়েকটি অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছি এবং কয়েকটিতে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছি; এসবের মধ্যে আমি সেই পুরোনো প্রশ্নের নতুন এক উত্তর পেয়ে যাই। প্রশ্নটি হলো, আজকের দিনে একজন লেখকের প্রাসঙ্গিকতা কী বা কীভাবে একজন লেখক আজকের দিনে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন?
এই প্রশ্নে আমি প্রায়ই বিরক্তি বোধ করতাম। কারণ আমার মনে হয়, যাঁরা প্রশ্নটি তোলেন, এর উত্তর তাঁদের জানাই আছে। তাঁরা আমাকে দিয়ে এ কথা বলাতে চান যে অন্যায়-অবিচারে ভরা, সংঘাতময় আমাদের এই পৃথিবীতে রবীন্দ্রনাথের সর্বজনীনতা প্রাসঙ্গিক; শিক্ষা, ধর্ম, জাতীয়তা, উন্নয়ন ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর ধারণার মধ্যে আমাদের সমকালীন অনেক সমস্যা-সংকটের সমাধানের দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। তাঁরা যখন চান আমি এই কথাগুলো বলি, তখন আমার বিরক্তি বোধ হয়। আমি বলি, ‘হ্যাঁ, এই সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কোনো বিষয়ের ভাবনা বা ধারণার জন্য আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ওইসব ভাবনা ইতিমধ্যে অনেক মানুষেরই আছে। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শিল্পী: বিরাট, সীমাহীনভাবে বৈচিত্র্যময় ও জটিল সৃজনশীল শিল্পী। কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, চিত্রকলা—তাঁর কোনো কাজই কেবল ভাবনা বা আদর্শের বাহন ছিল না। সত্যিকারের সব বড় শিল্পীর মতো তাঁর সব কাজই একসঙ্গে অনেক কিছু বলে। সেগুলোর মধ্যে নানা কূটাভাস ও পাল্টা স্রোত থাকে। কাজগুলো বড় এ কারণে যে প্রতিটি প্রজন্মের মানুষ সেগুলোর মধ্যে নতুন নতুন জিনিসের দেখা পায়; বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পী ও অভিনেতারা সেগুলো ব্যবহার করতে পারেন, সেগুলোর সম্ভাবনা অফুরান। বৈশ্বিক প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিতে এশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো যখন ইউরোপীয় ও আমেরিকান ঐতিহ্যগুলোর কাছাকাছি চলে আসে, তখন আমরা দেখতে পাই, রবীন্দ্রনাথের কাজগুলো পৃথিবীজুড়েই আরও বেশি বেশি করে ব্যবহূত হচ্ছে।’
১৯১২ সালে গীতাঞ্জলির মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে আন্তর্জাতিক সত্তার সূচনা ঘটে, তার পর থেকে চিন্তাবিদ রবীন্দ্রনাথকে শিল্পী রবীন্দ্রনাথের ওপরে স্থান দেওয়া হয়। ফলে তাঁর সৃজনশীল অর্জন সম্পর্কে পরিপূর্ণ উপলব্ধির ক্ষেত্রে একধরনের বাধা সৃষ্টি হয়। ১৯১৩ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাঁর সাহিত্যের জন্য (যদিও বাংলা ভাষায় তাঁর লেখালেখির জন্য নয়), কিন্তু বিভিন্ন দেশে ভ্রমণের সময় তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্য যেসব মানুষ ভিড় করতেন, তাঁরা যতটা না তাঁর কবিতা শুনতে যেতেন, তার চেয়ে বেশি যেতেন তাঁর বক্তব্য শুনতে। তাঁরা যা চাইতেন, তিনি তাঁদের তা-ই দিতেন; এবং দীর্ঘ শ্মশ্রু আর ‘সর্ব-এশীয়’ কেতায় অনন্য পোশাক-পরিচ্ছদের কারণে তিনি পেয়ে যান এক সন্তর ভূমিকা। কিন্তু এই ভূমিকায় তিনি প্রায়ই সংকীর্ণ, সংকুচিত বোধ করতেন। ১৯৩০ সালে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু উইলিয়াম রোদেনস্টাইনকে লেখেন:
‘আমি যখন ইউরোপে যাই, অবকাশের অফুরান বিলাস আমার জন্য নয়—আমাকে সর্বদাই থাকতে হয় সুশীল আর আদর্শবান। আমার ভেতরের শিল্পীটি সব সময় হতে চায় দুষ্টু আর স্বাভাবিক—কিন্তু আমি সত্যিই যা, তা হওয়ার জন্য প্রয়োজন বিরাট সাহসের। কিন্তু আবার এও সত্য যে আমি আদতে নিজেকে জানি না, নিজের স্বভাবের সঙ্গে ছলচাতুরি করার সাহসও আমার নেই। তাই অকর্মণ্য শিল্পীটির অবশ্যই প্রয়োজন হয় একজন সঙ্গীর, যার সৎ উদ্দেশ্যের সীমা নেই।’
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠানের আয়োজকেরা এই কথাগুলো স্মরণে রাখলে ভালো করবেন!
রবীন্দ্র উৎসব
কিন্তু এ সপ্তাহে ডেভোনের ডার্লিংটন হলের রবীন্দ্র উৎসবে আমার যেসব অভিজ্ঞতা হলো, তাতে মনে হয় তাঁর ‘প্রাসঙ্গিকতা’র প্রশ্নে আমাকে কথা বলতে হবে নমনীয়ভাবে, সহনশীলতার সঙ্গে। একজন লেখক তখনই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন, যখন তাঁর যেকোনো লেখা, যেকোনো কাজ পাঠককে ভাবিত করে, নাড়া দেয়—যেকোনো কারণে: নান্দনিক, আবেগ-অনুভূতি, আধ্যাত্মিক, আদর্শিক বা রাজনৈতিক। এ কথাটি খুব সাধারণ মনে হতে পারে। প্রাসঙ্গিকতার কারণেই একজন লেখক প্রাসঙ্গিক হন, আলোড়িত করেন আলোড়ন-ক্ষমতাসম্পন্ন হয়েই। কিন্তু এই প্রশস্তির উত্তর হলো, একজন চিন্তাবিদ ও একজন শিল্পী হিসেবে রবীন্দ্রনাথের আবেদনকে একত্রে আনার একটি উপায়।
এক ব্যক্তির মধ্যে ভাবাদর্শ, শিল্প ও পাণ্ডিত্যের এমন শক্তিময় সম্মিলন ঘটেছে, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন আর একটি দৃষ্টান্ত কি কেউ দেখাতে পারেন? ডার্লিংটন উৎসবের পরিকল্পনা করেন গান্ধীবাদী সতীশ কুমার, ডার্লিংটনের শুম্যাকার কলেজ ও দি স্মল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং রিসার্জেন্স ম্যাগাজিনের সম্পাদক। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর প্রবল আগ্রহ প্রধানত আদর্শিক এবং অনুষ্ঠানে তিনি যেসব বিখ্যাত বক্তাকে সমবেত করেছিলেন, তাঁরা সবাই শান্তি, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রগতিশীল শিক্ষার প্রতি রবীন্দ্রনাথের অঙ্গীকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। দুই দিনে সেখানে যাঁদের বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ডেম জেন গুডঅল (প্রকৃতিবিজ্ঞানী, প্রকৃতি সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতা এবং জাতিসংঘের শান্তিদূত, যিনি ৭৭ বছর বয়সে বছরে ৩০০ দিন ব্যয় করেন ভ্রমণ আর বক্তৃতার পেছনে), মস্তিষ্ক বিজ্ঞানী ইয়ান ম্যাকগিলক্রিস্ট ও শিক্ষাবিদ অ্যান্টনি শেলডন। আমার মনে হয়, সেখানকার শ্রোতাদের ৯০ শতাংশই এসব আদর্শ ও মূল্যবোধের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করেন। আর একজন ট্যাক্সিচালক আমাকে একবার যেমনটি বলেছিলেন, ‘ডার্লিংটনের স্থানীয় শহর টটনেস হচ্ছে ইংল্যান্ডের নতুন যুগের রাজধানী।’
তবে উৎসবটির অত্যন্ত আকর্ষণীয় একটা দিক ছিল এই যে চিত্রশিল্পী, সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী—যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, অথবা আমার মতো রবীন্দ্রসাহিত্যের একজন অনুবাদক যে সুযোগ সেখানে পেয়েছেন। সার্ধশতবর্ষ উৎসবের এই বছরজুড়ে অনেক প্রবন্ধে ও বক্তৃতায় আমি গুরুত্বের সঙ্গে বলে চলেছি রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মগুলোর রূপান্তরযোগ্যতা সম্পর্কে। অপেরায়, থিয়েটারে ও চলচ্চিত্রে সংগীত রচয়িতা, সংগীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পীদের দ্বারা রবীন্দ্রসৃষ্টির সুপ্রচুর ও প্রায়শ বিস্ময়কর ব্যবহারের কথা গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছি। সেসব রূপান্তরের অনেকগুলোই রবীন্দ্রনাথকে নানা দিকে নিয়ে যায়, যা তিনি নিজেও হয়তো কল্পনা করতে পারতেন না: হোক সেটি আলেকজান্ডার জেমলিনস্কির ১৯২২ সালে করা বিপুলাকার লিরিশ সিমফোনি (যেখানে দ্য গার্ডেনার থেকে নেওয়া হয়েছে সাতটি কবিতা), বা পরম বীরের বহুল প্রশংসিত ও ব্যাপকভাবে প্রদর্শিত অপেরা স্ন্যাচড বাই দি গড, যেখানে রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার অনুবাদের ওপর ভিত্তি করে আমার রচিত একটি লিব্রেটো ব্যবহার করা হয়েছে, অথবা ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে ১৭ মে জ্যাজ সংগীতকার জো এবং ইদ্রিস রহমানের সঙ্গে আমার করা একটি অনুষ্ঠানে (ফ্লায়িং ম্যান/ পক্ষীমানব: একুশ শতকের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা, পরিচালনা: মুকুল আহমেদ), অথবা ভ্যালেরি ডুলটনের চমৎকার নতুন প্রযোজনায় ডাকঘর, যার প্রিমিয়ার প্রদর্শনী হয় ৪ মে লন্ডনের নেহরু সেন্টারে বা রবীন্দ্রনাথের গানের ওপর ভিত্তি করে নতুন করে প্রযোজিত নৃত্য, লন্ডনে যার আয়োজন করেছে আকাদেমি (নৃত্য পরিচালনা: অ্যাশ মুখার্জি)। কিন্তু এ রকমই হওয়া উচিত, এভাবেই তিনি বিরাট ও মহান হয়ে ওঠেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সোনার তরীতে করে আসে, তাঁর কর্মসম্ভার নিয়ে যায়, নতুনভাবে সৃজন করে। সেগুলোর সৃজনশীল ব্যবহার গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে নদীতীরে ফেলে রেখে চলে যায়।
উইলিয়াম রাদিচে: কবি, লেখক এবং রবীন্দ্র অনুবাদক
অনুবাদ: মশিউল আলম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৫, ২০১১
Leave a Reply