রাশিয়া সফরে মস্কোয় রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালের আগে রাশিয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম বলতে গেলে কারোরই জানা ছিল না। এটা বিদিত যে ১৯১০ সালে পরলোকগত লেভ তলস্তয় কোনো দিনও ঠাকুরের নাম শোনেননি। কিন্তু ১৯১৩ সালে বাঙালি এই কবির নোবেল পুরস্কার পাওয়াতেই অবস্থা যারপরনাই পাল্টে যায়। প্রায় রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ঠাকুর। ১৯১৩ সালেই গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদ রুশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে গিয়েছিল। ১৯১৭ সালের আগেই মস্কোয় রুশ অনুবাদে তাঁর দুটি রচনার সংকলন (একটি ছয় খণ্ডে ও অন্যটি নয় খণ্ডে) প্রকাশিত হয়। প্রথম সংকলনটির দ্বিতীয় সংস্করণ বাজারে আসে ১৯১৬ সালে, কিন্তু স্পষ্টতই ১৯১৭ সালের ঘটনাপ্রবাহের কারণে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯২০ সালের আগে ইংরেজিতে সব অনুবাদের কাজ হয়েছিল, তার কারণ স্রেফ বাংলা কেউ জানতেন না।
এসব অনুবাদে বেশ কজন সাহিত্য ব্যক্তিত্ব অংশ নিয়েছিলেন। এভাবে গীতাঞ্জলির বেশ কয়েকটি ভাষান্তরের একটি সম্পাদিত হয়েছিল ইউরোপীয় বিভিন্ন মাস্টারপিসের প্রথিতযশা অনুবাদক নিকোলাই পুশেচনিকভের (১৮৮২-১৯৩৯) হাতে। অন্যদিক থেকে তিনি ছিলেন সাহিত্যে প্রথম রাশিয়ান নোবেল বিজয়ী আইভান বুনিনের (১৮৭০-১৯৫৩) ভাতিজা। বুনিন স্বয়ং তাঁর ভাতিজার গীতাঞ্জলির অনুবাদ সম্পাদনা করেছিলেন। ১৯১৪ সালে বের হয়েছিল এর প্রথম সংস্করণ, ১৯১৮ সালে চতুর্থ সংস্করণ। এই অনুবাদটিই ফের ১৯৬০-এর দশকে ঠাকুরের সোভিয়েত রচনা সংগ্রহতে প্রকাশিত হয়। গীতাঞ্জলির অপর একটি অনুবাদ (১৯১৪ সালে প্রকাশিত এবং ১৯১৫ ও ১৯১৬ সালে পুনর্মুদ্রিত) সম্পাদনা করেছিলেন সুপরিচিত রুশ-লিথুয়ানীয় সিম্বলিস্ট কবি য়ুর্গিস বালত্রুসাইতিস (১৮৭৩-১৯৪৪)। এই কবি প্রথমে রুশ ভাষায় কবিতা লিখে নাম কেনেন এবং পরে লিথুয়ানীয় ভাষায় কবিতা রচনা করেছিলেন। ১৯১৫ সালে একটি সুগভীর ভূমিকাসহ বিশিষ্ট বিদুষী এবং এক মহান ও বিখ্যাত সাহিত্যিক পরিবারের সদস্য জিনাইদা ভেনগেরোভার হাতে রুশ তরজমায় ঠাকুরের নাটক রাজা প্রকাশিত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য, ১৯১৪ সালে একটি জার্নালে বিশিষ্ট রুশ-পোলিশ ভাষাবিদ বোদুয়েন দে কোর্তেনের (১৮৪৫-১৯২৯) গীতাঞ্জলির অনুবাদের সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে লেখক কোনস্তাান্তিন পাউস্তোভস্কি এ সময়ের স্মৃতিচারণায় যেমন লিখেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের চেতনায় প্রাধান্য বিস্তার করেছেন।’
১৯১৭ থেকে ১৯২৭—এই দশকেও রুশ পাঠকদের কাছে ঠাকুরের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি, বরং সম্ভবত আরও বেড়ে উঠেছিল। ১৯২০-এর দশকের শেষ দিক অবধি কবির বহু রচনা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিম ইউরোপের বহু অভিবাসী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত হয়। কোনো কোনো রচনা একাধিকবারও অনূদিত হয়। এভাবে ১৯২০-এর দশকে ঘরে-বাইরে উপন্যাসটির অন্তত তিনটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল (সবই ইংরেজি থেকে); এর একটা বের হয় বার্লিন থেকে। এসব অনুবাদের ভূমিকায় রুশ লেখকেরা উপন্যাসে বর্ণিত ভারতীয় ঘটনাপ্রবাহ ও চরিত্র (স্বদেশি আন্দোলনের) এবং রুশ সাহিত্য ও রুশ বিপ্লবের সাদৃশ্য উল্লেখ করেছেন। আসলে এখন প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, ঘরে-বাইরের রচয়িতা ঠাকুর হয়তো দস্তয়েভস্কির দ্য পোসেজড (বা দ্য ডেভিলস) পড়ে থাকতে পারেন এবং এই উপন্যাসটিই হয়তো কোনোভাবে ঘরে-বাইরে উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৯২০-এর দশকে সরকারি মতাদর্শের নিয়ন্ত্রণ-পরবর্তী সময়ে যেমন কঠোর হয়ে উঠেছিল, তেমন কড়া ছিল না। ‘কমিউনিস্ট’ ধরনের কোনো কোনো সমালোচক ঠাকুরকে ‘মরমি’ ও ‘আদর্শবাদী’ হিসেবে তুলে ধরলেও প্রকাশকদের (সেগুলোর কোনো কোনোটা তখনো ব্যক্তিমালিকানাধীন বা ‘সমবায় সংগঠন’ ছিল) ঠাকুরের রচনাবলি প্রকাশে বাধা দেননি। ফলে বহু পাঠকের ঠাকুরের কবিতা ও গদ্য উপভোগ করার পথে বাধা পড়েনি। এভাবে আমার পিতামহের ছোট ভাই (১৯০০ সালে জন্ম) আমাকে বলেছিলেন, হবু স্ত্রীকে ভোলাতে (নিশ্চয়ই ১৯২০-এর দশকে হবে) গীতাঞ্জলি থেকে কবিতা আবৃত্তি করতেন তিনি। সুপরিচিত পণ্ডিত ফিওদর শেরবাতস্কির (১৮৬৬-১৯৪২) ছাত্র মিখাইল তুবিয়ানস্কি (১৮৯৩-১৯৩৭) ছিলেন ঠাকুরের রচনা বাংলা থেকে রুশ ভাষায় সরাসরি তরজমাকারীদের প্রথম। গীতাঞ্জলির মূল থেকে অনুবাদের প্রয়াস পেলেও তেমন একটা সফল হতে পারেননি। কারণ, তিনি কবি ছিলেন না। আসলে রাশিয়ায় এখনো এমন কাউকে পাওয়া যায়নি, যিনি সরাসরি বাংলা থেকে রুশ ভাষায় কাব্যিক অনুবাদ করতে পারেন। তবে ঠাকুরের গদ্যের অনুবাদক হিসেবে এম তুবিয়ানস্কি বেশ সফল। অন্যান্যের ভেতর জীবনস্মৃতি অনুবাদ করেন তিনি। এই অনুবাদকর্মটি এখনো মানসম্পন্ন অনুবাদ হিসেবে টিকে আছে। এম তুবিয়ানস্কি দার্শনিক আই কালুবোভস্কির সঙ্গে ঠাকুরের ‘ন্যাশনালিজম’ অনুবাদ করেন (১৯২২ সালে এই অনুবাদটি প্রকাশিত হয়। তারপর আর বের হয়নি)। এম তুবিয়ানস্কি অন্যদের করা ঠাকুরের রচনার অনুবাদের বেশ কিছু ভূমিকা লিখেছেন। এসব ভূমিকা আজও মূল্য ধরে রেখেছে। তবে ১৯২৭ সালে বুদ্ধ মতবাদের ওপর পড়াশোনা করতে মঙ্গোলিয়ায় চলে যান তিনি। ১৯৩০-এর দশকে ফিরে আসেন এক ভিন্ন দেশে। ১৯৩৭ সালে স্তালিনের ত্রাসের তুঙ্গ সময়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। ১৯২৭ সালে রুশ ভাষায় ঠাকুরের রচনা প্রকাশের তুঙ্গ মুহূর্ত ছিল। কিন্তু কার্যত ১৯২৯ সালের দিকে ‘মহাসাফল্যের’ সময় তা রুদ্ধ হয়ে পড়ে। স্তালিন তখন জোরেশোরে ‘তৃতীয় বিপ্লব’ সূচনা করেছিলেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত কার্যত সোভিয়েত ইউনিয়নে ঠাকুরের কোনো রচনাই বের হয়নি।
১৯২০-এর দশকে একাধিকবার সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরের নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন ঠাকুর, কিন্তু কোনো না কোনো কারণে ১৯৩০ সালের আগে বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। অবশেষে ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বরে যখন মস্কোয় আসেন, তখন বেশ দেরি হয়ে গেছে। তাঁর জনপ্রিয়তার তুঙ্গ অবস্থার অবসান ঘটেছে। শাসকগোষ্ঠী স্পষ্টতই ভারতীয় এই সাধুর ব্যাপারে সন্দিহান ছিল। সংবর্ধনা মোটামুটি নিয়ন্ত্রিতই ছিল। সেই সফরের পুরো কাহিনি আজও প্রকাশিত হয়নি। সম্ভবত ইতিহাসবিদদের জন্য সোভিয়েত সিক্রেট পুলিশের আর্কাইভ উন্মুক্ত করে দিলেই জানা যাবে।
ঠাকুরের রাশিয়ার চিঠির কাহিনি খুবই করুণ। দেশে ফেরার পরপরই তিনি বাংলায় রাশিয়ার চিঠি প্রকাশ করেছিলেন। এসব চিঠির ইংরেজি তরজমা প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে, স্পষ্টতই ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে সেন্সর করা ভাষ্যে। তাতে বেশ কিছু ‘বিপজ্জনক’ অনুচ্ছেদ বাদ দেওয়া হয়েছিল। প্রথম রুশ অনুবাদ বের হয়েছিল সিপিএসইউর ২০তম কংগ্রেসের বছর, ১৯৫৬ সালে। কিন্তু রুশ এই অনুবাদও আদর্শগত কারণে সংক্ষিপ্ত ছিল। স্পষ্টতই তাতে নিচের অনুচ্ছেদ থাকাতেই ১৩ নম্বর চিঠিখানা (অপয়া সংখ্যা!) বাদ দেওয়া হয়েছিল:
‘তা সত্ত্বেও, আমি বিশ্বাস করি না যে তারা ব্যক্তি ও সমাজের ভেতর সঠিক সীমারেখা টানতে পেরেছে। এদিক থেকে ওরা ফ্যাসিস্টদের চেয়ে ভিন্ন নয় [ঠাকুর খুব সম্ভব ইতালীয় ফ্যাসিস্টদের কথা বুঝিয়েছেন।] এই কারণে তারা রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের নামে ব্যক্তির উপর নিপীড়নের বিষয়টি স্বীকার করতে ঘৃণা করে। তারা ভুলে গেছে, ব্যক্তিকে দুর্বল করার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র শক্তিশালী হতে পারে না। ব্যক্তি শৃঙ্খলবন্দী থাকলে সমাজ স্বাধীন হতে পারে না। এখানে চলছে লৌহমানবের স্বৈরশাসন। অনেকের উপর একজনের শাসন স্বল্প সময়ের জন্যে ভালো ফল বয়ে আনতে পারে হয়তো, কিন্তু চিরকালের জন্যে নয়। উপর্যুপরি যোগ্য নেতা পাওয়া অসম্ভব।’
এসব চিঠির উপসংহার রুশ ভাষায় কোনো দিনও প্রকাশিত হয়নি। আমার ধারণা, নিচের এই অনুচ্ছেদটিই সবচেয়ে খারাপ:
‘এটা হয়তো অসম্ভব নয় যে, এই সময়ে বলশেভিনিজমই চিকিৎসা, কিন্তু ডাক্তারি চিকিৎসা চিরস্থায়ী হতে পারে না; প্রকৃতপক্ষেই যেদিন ডাক্তারের আমলের অবসান ঘটবে সেটাই হবে রোগীর লাল চিহ্নিত দিন।’
বলাবাহুল্য, দেশের কমিউনিস্ট নেতারা সম্ভবত এ ধরনের পরামর্শ সহ্য করতে পারেননি, কারণ তাঁরা ভেবেছিলেন, চিরজীবন শাসন করবেন।
১৯৩০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মস্কো ত্যাগের আগে ইজভেস্তিয়া (খবর) নামের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্রের এক সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকার দেন ঠাকুর। অন্যান্য বিষয়ের ভেতর তিনি বলেন, ‘যেখানে মন উন্মুক্ত, সেখানে মতভিন্নতা থাকতে পারে। শক্তি প্রয়োগ করে আমাদের সবার চিন্তাধারাকে এক রকম করে ফেললে সেটা যান্ত্রিক নিয়মতন্ত্রের কেবল কৌতূহলহীনই নয়, বরং বন্ধ্যা জগতে পরিণত হবে। আপনাদের যদি গোটা মানবজাতিকে নিয়ে কোনো মিশন থাকে, সেই জীবিত মানবজাতির স্বার্থেই মতের ভিন্নতার অস্তিত্ব মেনে নিতে হবে। মতামত সারাক্ষণ বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির অবাধ প্রবাহ ও নৈতিক তাগিদের মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। সহিংসতা শুধু সহিংসতা ও অন্ধ নির্বুদ্ধিতারই জন্ম দেয়। সত্যকে স্বাগত জানাতেই মনের স্বাধীনতা প্রয়োজন; ত্রাস তাকে অসহায়ের মতো হত্যা করে।’
১৯৩০-এর দশক নাগাদ স্তালিনের নামের সমার্থক হয়ে ওঠা সন্ত্রাস ঘাতক শক্তির পূর্ণ শক্তি প্রকাশ করেনি। কিন্তু মস্কোয় মেজবানের উদ্দেশে ঠাকুর যেসব কথা উচ্চারণের সাহস করেছিলেন, সেগুলো ইতিমধ্যেই রাষ্ট্রদ্রোহমূলক বিবেচিত হচ্ছিল। এই বিদায়ী সাক্ষাৎকার ১৯৮৮ সালে গর্বাচেভের অধীনে বর্তমান রচনার রচয়িতার উদ্যোগে রুশ ভাষায় একই পত্রিকা ইজভেস্তিয়ায় প্রকাশিত হয়েছিল।
অবশ্য ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি ক্রুশ্চেভ ভারতকে ‘পুনর্বাসিত’ করলে রাশিয়ায় আবার সুযোগ পান ঠাকুর। ১৯৫৫ সাল থেকে নতুন অনুবাদ প্রকাশিত হতে থাকে। ১৯৬১ সালে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়। তাড়াহুড়ো করে আরও দুটি রচনা সংগ্রহ (১৯৫৫-১৯৫৭ সালে আট খণ্ড ও ১৯৬১-১৯৬৫ সালে ১২ খণ্ড) প্রকাশিত হয়। এসব খণ্ডে ১৯১৭ সালের আগের বেশ কটি অনুবাদ (যেমন এন পুশেশনিকভ অনূদিত গীতাঞ্জলি) ও ১৯২০-এর দশকের কিছু অনুবাদ (অর্থাৎ এম তুবিয়ানস্কি অনূদিত জীবনস্মৃতি) অন্তর্ভুক্ত ছিল। বেশ কটি উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ নতুন করে বা প্রথমবারের মতো সরাসরি বাংলা থেকে অনূদিত হয়। তত দিনে বাংলা থেকে রুশ ভাষায় অনুবাদ করার মতো বেশ কিছু লোক আবির্ভূত হয়েছিলেন। ঠাকুরের কবিতার অনুবাদের ক্ষেত্রে অ-রুশ ভাষার কবিতা রুশ ভাষায় অনুবাদে ব্যাপকভাবে প্রযুক্ত কৌশল অনুসরণ করা হয়েছে: বাংলা ভাষা জানেন, এমন একজন ব্যক্তি কবিতার শাব্দিক অনুবাদ তৈরি করবেন। তারপর সেই অনুবাদ একজন ‘পেশাদার’ কবিকে দেওয়া হবে, যিনি এই ‘কাঁচামাল’ একটি চূড়ান্ত কাব্যিক ‘পণ্যে’ পরিণত করবেন। এ কাজের জন্য নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন বিশ শতকের রুশ কবিতাজগতের কয়েকজন মহান ব্যক্তিত্ব, যেমন আনা আখমাতোভা, বরিস পাস্তারনাক এবং একই মাপের অন্য কবিরা। তবে মূলত অর্থের জন্যই এ কাজ করেছেন তাঁরা। প্রাপ্য প্রমাণ মোতাবেক, আখতামোভা বা বরিস পাস্তারনাকের কেউই তাঁদের হাতে ‘কাব্যিক’ তরজমার জন্য তুলে দেওয়া ঠাকুরের কবিতার আক্ষরিক অনুবাদে তেমন একটা অনুপ্রাণিত বোধ করেননি। যদি তা হয়ে থাকে, রচনা সংগ্রহ-এর ঢাউস খণ্ডে প্রকাশিত ঠাকুরের কবিতাগুলোর ভেতর কোনোটাই সেই অর্থে মহৎ রুশ কবিতা হয়ে ওঠেনি (যদিও কিছু কিছু পঙিক্ত মনোহর শোনাতে পারে; আমার অবশ্য ভুল হতে পারে; আগামী প্রজন্ম হয়তো ভিন্নভাবে যাচাই করবে)। এমনও হতে পারে, বেশির ভাগ রুশ পাঠককে এখনো অন্যের মতামতের ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে, যাঁরা তাদের বলে দেবেন যে ঠাকুর একজন মহান কবি। এ অবস্থা অনেকটা আলেকজান্দার পুশকিনের সঙ্গে মিলে যায়। রাশিয়ানদের কাছে তিনি মহান কবি হলেও বিদেশিদের কাছে নন।
তা সত্ত্বেও উল্লেখ করা যেতে পারে, আদেলিনা আদালিসের (১৯০০-১৯৬৯) রুশ তরজমায় ঠাকুরের একটি কবিতাকে সংগীতে রূপ দেওয়া হয়েছে এবং ১৯৭০-এর দশকে একটি সোভিয়েত ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে। ঠাকুর এমনকি, লেনিন ও ব্রেজনেভের সঙ্গে রাশিয়ান কৌতুকের পাত্রেও পরিণত হয়েছিলেন।
১৯৮১-৮২ সালে মস্কো থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা সংগ্রহ-এর চারটি খণ্ড প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ সংস্করণে নতুন কোনো অনুবাদ স্থান পায়নি। ১৯৮৮ সালে গীতবিতান-এর খুবই প্রতিনিধিত্বমূলক একটি নির্বাচিত সংকলন দিনের আলোর দেখা পায়। এটা ছিল অনেকটা বরিস কারপুশকিনের (১৯২৫-১৯৮৭) সোয়ান সং-এর মতো, যিনি রচনা সংগ্রহ ও গীতবিতান-এর জন্য বহু আক্ষরিক অনুবাদের কাজ করেছিলেন। বিশেষ করে, এ সংস্করণের জন্য বেশ ভালো কবিদের হাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কাব্যিক অনুবাদ বের হয়ে এসেছিল। কিন্তু ১৯৮৮ সালের পর আজ পর্যন্ত রুশ ভাষায় ঠাকুরের নতুন কোনো অনুবাদ বের হয়নি। প্রতীকীভাবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাষ্ট্রব্যবস্থার পতনের কয়েক মাস আগে মস্কোয় ঠাকুরের একটি প্রতিমূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভি পি সিংয়ের মস্কো সফরের সঙ্গে এ ঘটনা মিলে গিয়েছিল এবং সম্ভবত এর সঙ্গে কবির পরলোকগমনের ৫০তম বার্ষিকী বা ১৩০তম জন্মবার্ষিকীর কোনো সম্পর্ক থেকে থাকতে পারে। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিক থেকে রুশ ভাষায় ঠাকুরের খুব অল্পসংখ্যক বই প্রকাশিত হয়েছে। কোনো বই বেরোলেও সেটা আগের রচনারই পুনঃপ্রকাশ ছিল। তরুণ প্রজন্মের কাছে ঠাকুর নামের ব্যক্তি ও লেখক সম্পর্কে খুবই কম ধারণা রয়েছে (যদি থেকে থাকে)। কয়েক বছর আগে আমার বিশ্ববিদ্যালয় রাশিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটি ফর দ্য হিউম্যানিটিজের ক্লাস নিচ্ছিলাম। এটা এ দেশে হিউম্যানিটিজে উচ্চশিক্ষার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান। পাশ্চাত্য ভাষা ও সাহিত্যে বিজ্ঞ তৃতীয় বর্ষের ছাত্রদের সঙ্গে ক্লাস ছিল আমার। ওদের কাছে এমনিই জানতে চেয়েছিলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে ওরা কী জানে। অবাক হয়ে জানতে পেরেছিলাম, ওরা কেউ ঠাকুরের নাম পর্যন্ত শোনেনি! তার মানে, আউট অব প্রিন্ট, আউট অব মাইন্ড!
মনে হচ্ছে, কবি ও তাঁর কাজগুলোকে আমার দেশের পাঠকদের কাছে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কিন্তু আজ রাশিয়ায় বাংলা জানা লোকের সংখ্যা তেমন বেশি নেই। তো আমাদের হয়তো আগে পণ্ডিত ও অনুবাদকদের একটি নতুন প্রজন্মকে বাংলা ও এর সাহিত্যের জন্য শিক্ষিত করে তুলতে হবে।
সের্গেই সেরেব্রিয়ানি রাশিয়ান লেখক, যুক্ত আছেন রাশিয়ান স্টেট ইউনিভার্সিটির সঙ্গে
রাশিয়ায় ঠাকুরের কদর
সের্গেই সেরেব্রিয়ানি
অনুবাদ: শওকত হোসেন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ০৫, ২০১১
Leave a Reply