চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে
আমরা ভেবে করবো কি।
ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম।
তাকে তোমরা বল কি।
ছয় মাসের এক কন্যা ছিল
নয় মাসে তার গর্ভ হল
এগার মাসে তিনটি সস্তান
কোনটা করবে ফকিরি৷
ঘর আছে তার দুয়ার নাই
মানব আছে তার কথা নাই
কেবা তাহার আহার জোগায়।
কে দেয় সন্ধ্যাবাতি৷
লালন সাঁই ফকিরে বলে
মাকে ছুঁলে ছেলে মরে
এই তিন কথার অর্থ নইলে
তার হবে না ফকিরি।।
————
লালন-সঙ্গীত, পৃ. ৯৫
গানটি কলার গাছ, কবর ও লবণ সংক্রান্ত বাংলা ধাঁধা ও প্রবাদের উপর ভিত্তি করে রচিত। বাউলমতের তত্ত্ব ব্যাখ্যায় ধাঁধা ও প্রবাদের এরূপ ব্যবহারে লালনের ভাষা-জ্ঞান ও প্রকাশ-ভঙ্গির অসাধারণ দক্ষতা প্রকাশিত হয়েছে। লোকগীতি-স্বরলিপি (১ম খণ্ড) গ্রন্থে গানটির স্বরলিপি দেওয়া হয়েছে। এখানে গানের বাণীতে সামান্য পাঠভেদ আছে। আভোগের স্তবকটি নিম্নে দেওয়া হল :
ফকির লালন ভেবে বলে
ছেলে মরে মাকে ছুঁলে (হায় হায়)
আবার এই কয় কথার অর্থ নইলে
তার হবে না ফকিরি।– পৃ. ১০৬
২য় চরণের “ছেলে মরে মাকে ছুঁলে” পাঠ অন্ত্যমিলের বিচারে শুদ্ধ। পাঠটি গ্রহণ করা যায়। অতিরিক্ত ‘হায় হায়’ সুরে খাতিরে যুক্ত হয়েছে।
গঙ্গা ধর সরকার
গানটি লালন ফকিরের রচনা। লালন ফকিরের গুরু সিরাজ সাঁই এর নির্বিকল্প সমাধি হলে সেই অবস্থা দেখে এবং পরবর্তীতে সিরাজ সাঁই এর বর্ণনা শুনে লালন ফকির এই গানটি রচনা করেছিলেন।
এখানে চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে অর্থাৎ পরমাত্মার সাথে জীবাত্মার মিলন হয়েছে- নির্বিকল্প সমাধিতে পরমাত্মা-জীবাত্মা ঐক্য বোধ হয়। ঐ অবস্থা জীব বাইরে থেকে বুঝতে পারে না।
“ঝিয়ের পেটে মায়ের জন্ম/ তারে তোমরা বলবে কি?”
অর্থাৎ জীবই ঈশ্বর হয়ে উঠেছে। অসীম অনন্ত সীমার মধ্যে অবতীর্ণ হয়েছে আর সীমার মধ্যে অসীমের উল্লাস প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ মানুষের মধ্যে সেই পরম চৈতন্যের প্রকাশ হয়। সেটাকে কোনো বাক্য বা বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা যাবে না।
এর পরের লাইনে সাধন রহস্য উদঘাটন করেছেন,
“6 মাসের এক কন্যা ছিল, 9 মাসে তার গর্ভ হলো। 11 মাসে 3 সন্তান।” অর্থাৎ ষড়রিপু- কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মাৎসর্য্য, অহংকার- এগুলো যখন সাধক/সাধিকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। তখন তাঁর নবদ্বার ( দুই চোখ, দুই কান, দুই নাসিকা রন্ধ্র, মুখ, পায়ু ও উপস্থ) রুদ্ধ অর্থাৎ বন্ধ হয়ে যায়। খুলে যায় 10 ম দ্বার আজ্ঞাচক্র। তারপর একাদশ দ্বার ব্রহ্মরন্ধ্র অর্থাৎ সহস্রার চক্র। তখন তিনি সিদ্ধি লাভ করেন। এই সিদ্ধি স্বরূপ তার মধ্যে করলাম,জ্ঞান ও প্রেমরূপ তিন সন্তানের জন্ম হয়।
এর পরে ঐ নির্বিকল্প সমাধির বর্ণনা করেছেন।
” ঘর আছে তার দুয়ার নেই/ লোক আছে তার বাক্য নেই।কে বা জোগায় আহার/কে বা জ্বালায় সন্ধ্যাবাতি?”
অর্থাৎ দেহরূপ ঘর আছে কিন্তু নবদ্বার রুদ্ধ থাকায় তাতে বর্হিজগতের কোনো কিছুর প্রভাব নেই। মানুষটি বেঁচে আছেন অথচ তিনি চুপ হয়ে গেছেন মৌনতার গভীরে বোধের জগতে। তাঁর ভিতরে প্রাণের কোনো লক্ষণ নেই – শ্বাস প্রশ্বাস, খাওয়া দাওয়া বা বাহ্যক্রিয়া, হৃৎস্পন্দন এইসব কিছুই নেই। অথচ তিনি বেঁচে আছেন।
” ফকির লালন ভেবে বলে ছেলে মরে মাকে ছুঁলে/আবার এই কয় কথার অর্থ না জানলে হবেনা ফকিরি?”
অর্থাৎ জীবাত্মা যখন পরমাত্মায় মিলিত হয় তখন জীবত্মের নাশ হয় , তাঁর ভিতরে তখন শিবত্ব বা ঈশ্বরত্বের প্রকাশ হয়। তাই লালন ফকির বলছেন এই গানের অর্থ ও ভাব না জানলে তিনি ফকির অর্থাৎ বৈরাগী হতে পারবেন না।
গানটির কথা ও ভাবার্থ গুরু পরম্পরায় প্রাপ্ত।
– সংগৃহীত
তবে অনুরোধ করব গানটি বারংবার শুনে নিজের মত অর্থ খুঁজে নেওয়ার।চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে•••√•√
সঞ্জয় মালাকার
অশেষ ধন্যবাদ সহ অপার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।এতো সুন্দর করে গানটার ভাবার্থ তুলে ধরার জন্যে।
ইউসুফ
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।