শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৪০ — ১৫-১২-১৯২৫) বরাহনগর–চব্বিশ পরগনা। রাজকুমার। পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য স্কুলে প্রবেশ করে সর্বোচ্চ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। সে যুগের তুলনায় একটু বেশী বয়সে (২০ বছর) বিনা পণে বিবাহ করেন। বিবাহের পর স্ত্রীর শিক্ষার জন্য সচেষ্ট হন। এজন্য প্ৰথমে পারিবারিক বাধা এসেছিল। ১০ বছর পর বিলাত যাবার আগেই ব্ৰাহ্মধর্ম গ্রহণের জন্য তাঁকে পৈতৃক নিবাস ত্যাগ করতে হয়। স্বগ্রামে সামাজিক ও নৈতিক উন্নতির জন্য সংগঠন গড়ে তোলেন। সরকারী ডাকবিভাগে তিনি উচ্চপদ পান। নিজ গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কায় পরে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটের পদ পেয়েও তিনি তা গ্ৰহণ করেন নি। গ্রামের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ১৮৮১ খ্রী. সরকারী কর্ম ত্যাগ করেন। নিজ পরিবারের মহিলাদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে ১৮৬৫ খ্রী. বরাহনগরে একটি মহিলা বিদ্যালয় খোলেন। ১৮৮৬ খ্রী. ঐ বিদ্যালয় আবাসিক ও ট্রেনিং বিভাগে বধিত হয়। ভারতে মহিলাদের কর্মসংস্থান-উপযোগী শিক্ষণ ও আবাসিক কেন্দ্ৰ এটিই প্রথম। স্ত্রীশিক্ষা ছাড়াও প্রসূতি ও শিশুমৃত্যু রোধের জন্য আপ্ৰাণ চেষ্টা করেন। ১৮৬৭ খ্রী. তিনি তাঁর নিজস্ব লাইব্রেরী সামাজিক উন্নতি বিধায়িনী সভার কাছে দান করেন। তাঁরই দেওয়া জমিতে ও অর্থ সাহায্যে ২-১-১৮৭৬ খ্রী. বরাহনগর পাবলিক লাইব্রেরী গঠিত হয়। ১৮৭১ খ্রী. মেরী কার্পেন্টারের আহ্বানে সস্ত্রীক বিলাত যান। এখানে তারা ইংরেজ-সমাজের বিভিন্ন স্তরে (লর্ড থেকে শ্রমিক) আলোচনা ও অভিজ্ঞতা আদান-প্ৰদান করেন। তিনি প্ৰধানত মদ্যপান-বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতাদি দেন। বিভিন্ন সংবাদপত্রের রিপোর্টে দেখা যায়–এই সময় শশীপদ নানাভাবে প্ৰশংসাভাজন হন। তাঁর স্ত্রীই প্রথম ভারতীয় কুলীন ব্ৰাহ্মণ মহিলা যিনি সাগর পার হয়ে স্বেচ্ছায় বিলাত যান। বিলাতেই তাদের চতুর্থ সন্তান অ্যালবিয়ানের জন্ম হয়। ১৮৭২ খ্রী. দেশে ফিরে লব্ধ অভিজ্ঞতা স্ত্রীশিক্ষার কাজে নিয়োজিত করেন। ১৮৭৬ খ্রী. স্ত্রী রাজকুমারীর মৃত্যুর পর একজন হিন্দু বিধবাকে বিবাহ করেন। বরাহনগরে শিক্ষায়তন প্ৰতিষ্ঠা ছাড়াও তিনি সমাজোন্নতি সমিতি, সাধারণ পাঠাগার, মহিলা পাঠাগার, শ্রমিক শিক্ষার নোইশ বিদ্যালয়, মুসলমান শিশুদের শিক্ষাকেন্দ্ৰ, সেভিংস ব্যাঙ্ক, কিন্ডারগার্টেন-পদ্ধতির শিশু-বিদ্যালয় প্রভৃতি বহু সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শ্রমিক শিক্ষণ-কেন্দ্র ‘শ্রমজীবী সমিতি’ প্ৰতিষ্ঠা (১৮৭০) ও ‘ভারত শ্রমজীবি’ নামে এক পয়সা দামের এক সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্ৰকাশ করেন (১৮৭৪)। এই পত্রিকার প্ৰথম সংখ্যাতে শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘শ্রমজীবী’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। অনুন্নত হিন্দু সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ও সক্রিয় প্রচেষ্টাও প্রধানত তাঁরই উদ্যোগে ভারতে প্রথম শুরু হয়। অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের জন্য নিজে তাদের খাদ্যগ্রহণ ও স্বগৃহে তাদের নিমন্ত্রণ করে পথ নির্দেশ করেন। শ্রমিক-শিশুদের বাধ্যতামূলক শিক্ষার জন্যও তিনি মালিক পক্ষকে প্রথম উদ্ধৃদ্ধ করেন। ১৮৭৩ খ্ৰী. ‘অন্তঃপুর’ নামে মহিলা পত্রিকা প্ৰকাশ করেছিলেন। পত্রিকাটিতে দুনীতিগ্ৰস্ত মানুষের চরিত্র্যোদঘাটনের জন্য তাঁর ৩ মাস কারাদণ্ড হয়। তাঁর গৃহ হিন্দু-বিধবাদের আশ্রয়স্থল ছিল। তিনি ৩৫ জন বিধবার বিবাহ দেন। নিজের স্বল্প বিত্ত থেকে তাদের ভরণপোষণ ও শিক্ষার ব্যয় বহন করতেন। ১৮৭৩ খ্রী. (১৮৯৩ খ্রী. শিকাগো ধৰ্মসভার ২০ বছর আগে) তিনি সাধারণ ধর্মসভা নামে এক সম্মেলন করেন। জাতীয় উন্নতি ও ধর্মভিত্তিক শিক্ষার প্রসারের জন্য ১৯০৮ খ্ৰী. খ্ৰীষ্টান, হিন্দু, মুসলমান ও অন্য সম্প্রদায়কে তাদের সকলের ধর্মবিষয়ক সৎশিক্ষার জন্য ‘দেবালয়’ স্থাপন করেন। সারাজীবন অর্থকৃচ্ছতা ভোগ করেছেন। নবদ্বীপের পণ্ডিতগণ কর্তৃক তিনি ‘সেবাব্রত’ উপাধি-ভূষিত হয়েছিলেন।
পূর্ববর্তী:
« শশীন্দ্রচন্দ্র সিংহ
« শশীন্দ্রচন্দ্র সিংহ
পরবর্তী:
শশীবালা দাসী »
শশীবালা দাসী »
Leave a Reply