সতীন্দ্রনাথ সেন (১৫-৪-১৮৯৪ – ২৫-৩-১৯৫৫) কোটালিপাড়া-ফরিদপুর। পিতা নবীনচন্দ্ৰ পটুয়াখালির (বরিশাল) মোক্তার ছিলেন। এখানে জুবিলী হাই স্কুলে পড়ার সময় চারণ-কবি মুকুন্দদাসের স্বদেশী গান শুনে তিনি গৃহত্যাগ করে পথনির্দেশের জন্য মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের কাছে হাজির হন। অশ্বিনীকুমার ১০ বছরের এই বালককে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। তখন সহাধ্যায়ী সুধীরকুমার দাশগুপ্তের প্রভাবে বিপ্লবী-জীবনের নিষ্ঠা পালন ও অভ্যাস করতে থাকেন। পরে বরিশালে শঙ্করমঠে প্ৰজ্ঞানানন্দের সংস্পর্শে এসে যুগান্তর বৈপ্লবিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯১২ খ্ৰী ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করে কিছুদিন হাজারীবাগ কলেজে ও পরে কলিকাতা বঙ্গবাসী কলেজে পড়েন। বিপ্লবী কাজের জন্য চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণী থেকে পড়া ছেড়ে দেন। ১৯১৫ খ্রী. কৃষ্ণনগরের নিকটবর্তী শিবপুরে নরেন ঘোষ চৌধুরীর নেতৃত্বে রাজনৈতিক ডাকাতিতে অংশগ্রহণ করেন। এই ডাকাতি মামলায় ৪ বছর কারারুদ্ধ থাকেন। এরপর তিনি অহিংস সংগঠনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন। পটুয়াখালি অঞ্চল তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে (১৯২০) তিনি এখানে একটি যুববাহিনী গড়ে তোলেন এবং বিদেশী দ্রব্যবৰ্জন আন্দোলনে অংশ নেন; ফলে গ্রেপ্তার হয়ে তাঁকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। বরিশাল জেলে। অপমানজনক ব্যবহারের প্রতিবাদে তিনি ৬১ দিন অনশন করেন। ১৯২৩ খ্ৰী. কারামুক্তির পর পটুয়াখালিতে নামমাত্র মূল্যে একখণ্ড জমি কিনে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নিজের এবং সহকর্মীদের কায়িক শ্রমদানে বিদ্যালয়-গৃহটি নির্মিত হয়েছিল। এখানে তিনি শিক্ষকতাও করেন। ১৯২৪ খ্ৰী. পিরোজপুর সম্মেলনে বরিশাল জেলা কংগ্রেসের ভার তাকে দেওয়া হয়। বরিশালে সরকারী চেষ্টায় ও প্ররোচনায় যে সাম্প্রদায়িক কলহের সূত্রপাত হয়, তিনি পদব্ৰজে সারা জেলা পর্যটন করে এই বিরূপ পরিবেশের মোকাবিলা করতে চেষ্টা করেন। ইউনিয়ন বোর্ড করবন্ধ আন্দোলন এবং পটুয়াখালি সত্যাগ্ৰহ আন্দোলন (১৯২৬) তীরই নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এই সকল অহিংস সংগ্রামে তিনি জয়ী হন। ১৯২৯ খ্রী. তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন। এই সময় লাহোর জেলে বিপ্লবী যতীন দাস অনশন করছিলেন। কারারুদ্ধ হয়ে তিনিও অনশন-সত্যাগ্ৰহ আরম্ভ করেন। ১০৮ দিন পর সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে অনশন ভঙ্গ করেন। নেতৃবৃন্দের চেষ্টায় এবং স্বতস্ফুর্তভাবে বরিশালের যুবকগণ দলে দলে সতীন্দ্রনাথের মুক্তির জন্য কারাবরণ আরম্ভ করে। তিন বছর সদভাবে থাকার জামিনে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। বরিশাল কংগ্রেস সংগঠনের ওপর অপরিসীম। প্রভাব থাকায় এসময়ে তিনি সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। কলিকাতায় আইন অমান্য আন্দোলনে ছাত্রদের নেতৃত্ব করে পুনরায় গ্রেপ্তার হন। মার্চ ১৯৩১ খ্ৰী. মুক্তিলাভ করেন কিন্তু বরিশাল থেকে তাঁর বহিষ্কারের আদেশ হয়। ১৯৩২ খ্রী. দ্বিতীয় বারের আইন অমান্য আন্দোলনের পূর্বেই তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৩৭ খ্ৰী পর্যন্ত বন্দীজীবনে দেউলী বন্দী শিবিরে অব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। মুক্তিলাভের পর কিছুদিন কলিকাতার দৈনিকপত্র ‘কেশরী’ পরিচালনা করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ভোলা মহকুমায় ত্রাণকার্যে যান। কিন্তু জেলায় যুদ্ধের জন্য চাদা আদায় যখন সরকারী জবরদস্তিতে পরিণত হয় তখন তিনি তাতে বাধা দেন এবং বেশ কিছু আদায়-করা অর্থ ফিরিয়ে দিতে সরকারকে বাধ্য করেন। ফলে ভারতরক্ষা বিধানে তাঁর তিন মাসের কারাদণ্ড হয়। ১৩ আগস্ট ১৯৪২ খ্রী. আবার কলিকাতায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৪৫ খ্রী. মুক্তি পান। ১৯৪৬ খ্রী. যুক্ত নির্বাচন কেন্দ্র থেকে বিপুল ভোটাধিক্যে যুক্তবঙ্গের বিধান সভায় নির্বাচিত হন। তিনি দেশবিভাগের ঘোর বিরোধী ছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পরেও তিনি নিজ জেলায় থেকে যান এবং পাকিস্তান ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫০ খ্রী. পূর্ববঙ্গে বিধ্বংসী দাঙ্গার সময় জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট তাঁকে ডেকে জেলায় শান্তি বজায় আছে, এই মর্মে এক বিবৃতিতে সহি করতে বলেন। তাতে অস্বীকার করায় গ্রেপ্তার হয়ে আলোবাতাসহীন জেল কুঠরীতে আবদ্ধ থাকেন। পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও তিনি গ্রেপ্তার হন এবং এক বৎসর পর মুক্তি পান। পাকিস্তানের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ১-৭-১৯৫৪ খ্রী. পুনরায় গ্রেপ্তার হন। জেলেই রহস্যজনক ভাবে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
পূর্ববর্তী:
« সতী দেবী
« সতী দেবী
পরবর্তী:
সতীন্দ্রমোহন দেব »
সতীন্দ্রমোহন দেব »
Leave a Reply