শিশিরকুমার ভাদুড়ী, নাট্যাচাৰ্য (২-১০-১৮৮৯ –- ৩০-৬-১৯৫৯)। পৈতৃক নিবাস রামরাজাতলা-হাওড়া। হরিদাস। খ্যাতনামা অভিনেতা ও নাট্যাচাৰ্য। ১৯০৫ খ্রী. বঙ্গবাসী স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৯১০ খ্ৰী. স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বি.এ. ও ১৯১৩ খ্রী. এম.এ. পাশ করেন। সারা জীবন প্রচুর পড়াশুনা করেছেন। মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশনের সুবেশ ও সুকণ্ঠ অধ্যাপক তাঁর শিক্ষাদানের নিষ্ঠায় ছাত্রমহলে বিশেষ প্রিয় ছিলেন। শৌখিন অভিনেতারূপে ছাত্র ও অধ্যাপক জীবনে ইংরেজী ও বাংলা বহু নাটকে অংশগ্রহণ করেছেন। সাধারণত ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট মঞ্চে অভিনয় করতেন। ১৯১২ খ্রী. এখানে রবীন্দ্রনাথের ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকে কেদারের ভূমিকায় তাঁকে দেখে কবি বলেন, ‘কেদার আমার ঈর্ষার পাত্র। একদা ঐ পার্টে আমার যশ ছিল।’ ১৯২১ খ্রী. শৌখীন অভিনেতারূপে শেষ অভিনয় করেন। অভিনয় বৃত্তিকে পেশারূপে গ্ৰহণ করে ১০-১২-১৯২১ খ্রী. আলমগীর নাটকে নাম-ভূমিকায় ম্যাডান কোম্পানীর রঙ্গালয়ে আবির্ভূত হন। ক্রমে চাণক্য ও রঘুবীর চরিত্রে অভিনয় করে অনন্যসাধারণ প্ৰতিভার স্বাক্ষর রাখেন। মতের অমিল হওয়ায় ম্যাডান কোম্পানী ত্যাগ করেন। শিক্ষিত সংস্কৃতিবান শিশিরকুমারের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে আরও কয়েকজন তরুণ প্রতিভাধর নট মঞ্চে আসেন। পরের যুগে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চকে তাঁরাই পূর্ণতা দিয়েছিলেন। ১৯২৩ খ্রী. ইডেন গার্ডেন একজিবিশনে তিনি একটি নাট্যগোষ্ঠী গড়ে তুলে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘সীতা’ নাটক মঞ্চস্থ করেন এবং তিনি রামচন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করে নাট্যজগতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেন। ‘সীতা’ জনপ্রিয় হওয়ায় অ্যালফ্রেড থিয়েটার (বর্তমান গ্রেস সিনেমা) ভাড়া নিয়ে অভিনয়ের আয়োজন করলেও কোন কারণে সম্ভব না। হওয়ায় ‘বসন্তলীলা’ গীতিমালা অভিনয় করেন। এতে পুরানো গানের সঙ্গে হেমেন্দ্ৰকুমার রায় ও মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়-রচিত কয়েকটি গান মণিলাল ও প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর গ্রন্থনায় কৃষ্ণচন্দ্ৰ দে’র নেতৃত্বে গাওয়া হয়। নৃত্যে ছিলেন নৃপেন্দ্ৰচন্দ্ৰ। মনোমোহন থিয়েটার ইজারা নিয়ে যোগেশ চৌধুরী রচিত ‘সীতা’ নাটক অভিনয়ের প্রথম রাত্রি ৬-৮-১৯২৪ খ্রীঃ। থিয়েটারের নাম নাট্যমন্দির। এটি ঐতিহাসিক প্রযোজনা। এই রাত্রে, রসরাজ অমৃতলাল মঞ্চে দাড়িয়ে ঘোষণা করেন, ‘শিশিরকুমারই থিয়েটারে নবযুগের প্রবর্তক’। ‘সীতা’র সর্বত্র নতুনত্ব। বিলাতী ভাবধারা সম্পূর্ণ বর্জন করে-কনসার্টের বদলে রোশন’চৌকি, আসন-ব্যবস্থায় বাংলা অক্ষর, প্রবেশ-পথে আলপনা ও পূৰ্ণকলস, প্রেক্ষাগৃহে চন্দন-অগরু-ধূপের গন্ধ। আর ছিল পাদপ্রদীপের বদলে আলোক-সম্পাত। সীনের পরিবর্তে বকস সেট। ‘সীতার সঙ্গীতাচার্য ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্ৰ দে ও গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়। গীতরচনা, নৃত্য, দৃশ্যপট ও সাজসজ্জা পরিকল্পনায় ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও চারুচন্দ্র রায়। ইতিহাস অভিজ্ঞতায় সাহায্য করেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। ‘সীতা’য় প্রথম জনতার দৃশ্যে ১০০ জন অভিনেতা ও অভিনেত্রী অংশগ্রহণ করেন। ‘সীতা’ দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘শিশির ভাদুড়ীর প্রয়োগ-নৈপুণ্যে আমার বিশেষ শ্রদ্ধা আছে’। এই নাটকে সীতার ভূমিকায় প্রভা ও রামের ভূমিকায় শিশিরকুমার কিংবদন্তীতে পরিণত হন। ১৯২৫ খ্রী. থেকে তাঁর বিপরীত ভূমিকায় তারাসুন্দরী অভিনয় করেন। নাটক— ‘জনা’, ‘চন্দ্ৰগুপ্ত’, ‘পুণ্ডরীক’, ‘আলমগীর’। সে সময় নাট্যমন্দির সাফল্যের চুড়ায়। মূলধন ৫ লক্ষ টাকা। ডিরেক্টর তুলসীচরণ গোস্বামী, নির্মলচন্দ্ৰ চন্দ্র ও শিশিরকুমার। নূতন কোম্পানী মঞ্চ বেছে নিলেন কর্নওয়ালিস থিয়েটার (বর্তমান শ্ৰী সিনেমা)। ‘সীতা’ নাটক দিয়ে উদ্বোধন হলেও পরবর্তী অভিনয়, ‘বিসর্জন’ নাটক (২৬-৬-১৯২৬)। এতে তিনি ‘রঘুপতি’র ভূমিকায় ও পরে দশম অভিনয়ে ‘জয়সিংহে’র ভূমিকায় অভিনয় করেন। ১৯২৭ খ্রী. মাঝামাঝি ‘প্ৰফুল্ল’ নাটকে যোগেশের ভূমিকায় তাঁর প্রথম সামাজিক নাটকে অভিনয়। ৬-৮-১৯২৭ খ্রী. ‘ষোড়শী’তে জীবানন্দ। বোধহয় এই নাটকেই কঙ্কাবতী প্ৰথম অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘শেষরক্ষা’ নাটক অভিনয়ের তারিখ ৭-৯-১৯২৭ খ্রীঃ। এই নাটকে তিনি প্ৰযোজনাক্ষেত্রে ‘মেইয়ার হোল্ড’ ও ‘রাইনহার্টে’র পদ্ধতিতে দর্শকদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা বর্ধনের চেষ্টায় দর্শক ও অভিনেতার দূরত্ব ঘুচিয়ে শেষ দৃশ্যে সবাইকে মিশিয়ে দেন। ১৯২৮ খ্ৰী. নূতন ভূমিকা ‘দিগ্বিজয়ী’তে নাদির শাহ ও ‘সধবার একাদশী’তে নিমচাঁদ। ১৯২৯ খ্রী. ‘চিরকুমার সভা’—ভূমিকা চন্দ্ৰবাবু। ১৯৩০ খ্রী. উল্লেখ্য অভিনয় ‘তপতী’ নাটকে। এ বছর অর্থাভাবে নিজস্ব মঞ্চ নাট্যমন্দির ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং সদলে অভাবনীয়ভাবে প্ৰতিদ্বন্দ্বী আর্ট থিয়েটারে অর্থাৎ ষ্টার-এ যোগ দেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা-সদলবলে আমেরিকা যাত্রা। আমেরিকায় অভিনয়ের ব্যাপারে। পরস্পর-বিরুদ্ধ নানা খবর পাওয়া যায়। বহু বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করে ২৩ জন অভিনেতা-অভিনেত্রীসহ দল নিয়ে দুই ভাগে যাত্রা করেন। ড্রেস রিহার্সাল দেখে প্রযোজক মিস মার্বারী অর্থ বিনিয়োগে ভয় পান। এসময় কলিকাতা থিয়েটারের বিখ্যাত আলোকশিল্পী সন্তু সেনের সাহায্যে আমেরিকার ভ্যান্ডারবিল্ট থিয়েটারে ‘সীতা’ প্ৰযোজিত হয়। (১২-১-১৯৩১)। প্ৰশংসা পেলেও অর্থলাভ হয়নি। আড়াই হাজার টাকা লোকসান হয়। সতু সেন এ ঋণভার গ্ৰহণ করেন। এরপর দীর্ঘকাল অভিনয় করলেও একটানা প্ৰশংসার বদলে তাকে মাঝে মাঝে তীব্র সমালোচনারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা নরেন্দ্র দেব রচিত ছোটদের নাটক ‘ফুলের আয়না’। এটি বাঙলার প্রথম কিশোর নাটক। প্ৰথম অভিনয় ১৯-১-১৯৩৪ খ্রী.। রীতিমত নাটক’-এর প্রথম অভিনয় ১১-১২-১৯৩৫ খ্রী.। রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের নাট্যাভিনয় ২৪-১২-১৯৩৬ খ্রী। মোট ৭ টি রবীন্দ্র-নাটক তিনি প্ৰযোজনা করেন। সর্বশেষ অভিনয় শ্ৰীরঙ্গমে। এখানে কয়েকটি নূতন নাটক অভিনয় করেন। এরমধ্যে ‘মাইকেল’ নাটকে নাম-ভূমিকায় তাঁর অভিনয় অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। উল্লেখযোগ্য প্ৰযোজনা : ‘বিপ্রদাস’, ‘তখৎ-এ-তাউস’, ‘বিন্দুর ছেলে’ ও ‘দুঃখীর ইমান’। ১৪ বছর পর ১৯৫৬ খ্রী. অর্থাভাবে শ্ৰীরঙ্গম বন্ধ হয়ে যায়। এটিই বর্তমান বিশ্বরূপা থিয়েটার। এরপর নাট্যাচাৰ্য আর স্থায়ী মঞ্চ পান নি। ‘পোষ্যপুত্র’, ‘টকী অফ টকীজ’ প্রভৃতি নামে কয়েকটি চলচ্চিত্রে অবতীর্ণ হলেও বিশেষ কোন ছাপ রাখতে পারেননি। ১৯৫৯ খ্রী. ভারত সরকার তীকে ‘পদ্মভূষণ’ উপাধি দিতে চাইলে–সবিনয়ে তিনি তা প্ৰত্যাখ্যান করেন। আক্ষেপ ছিল–খেতাবের বদলে একটি জাতীয় নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হলে শেষজীবনে শান্তি পেতেন। মঞ্চ ও অভিনয় থেকে অনেকদূরে প্রায় অবজ্ঞাত অবস্থায় জীবিতকালেই কিংবদন্তী হয়ে ওঠার দুর্লভ গৌরবের অধিকারী হয়েছিলেন। বহু নাটক ও ছায়াছবির অভিনেতা, বিশ্বনাথ তাঁর অনুজ।
পূর্ববর্তী:
« শিশিরকুমার বসু
« শিশিরকুমার বসু
পরবর্তী:
শিশিরকুমার মিত্র »
শিশিরকুমার মিত্র »
Leave a Reply