শিবনাথ শাস্ত্রী (৩১-১-১৮৪৭ — ৩০-৯-১৯১৯) মজিলপুর–চব্বিশ পরগনা। হরানন্দ ভট্টাচার্য। চাংড়িপোতা গ্রামে মাতুলালয়ে জন্ম। সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল ও সংস্কৃত কলেজে শিক্ষা। ১৮৭২ খ্ৰী সংস্কৃতে এম.এ. পাশ করে শাস্ত্রী উপাধি পান। ছাত্রাবস্থায় সামাজিক সংস্কারমূলক আন্দোলন ও ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তাঁর পাঠ্যজীবন বাধাপ্ৰাপ্ত হয়। অবশ্য পিতার বিরাগভাজন হলেও মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণের বিশেষ স্নেহভাজন ছিলেন। ১৮৭৩ – ৭৪ খ্রী. মাতুলের বিখ্যাত ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকা সম্পাদনা করতেন এবং হরিনাভির স্কুলটিও তিনিই দেখতেন। এসময়ে স্বাস্থ্যের কারণে দ্বারকানাথ কাশীতে বাস করতেন। ১৮৭৪ খ্রী. তিনি ভবানীপুরের সাউথ সুবার্বন স্কুলে হেডমাস্টার পদে যোগ দেন। ১৮৭৬ খ্রী. হেয়ার স্কুলে সংস্কৃত শিক্ষকরূপে আসেন, কিন্তু সরকারী চাকরির প্রতি বিরাগবশত ও ব্রাহ্মসমাজের কাজের জন্য ১৮৭৮ খ্ৰী. পদত্যাগ করেন। তাঁর প্রধান পরিচয় সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা-নেতারূপে। গোঁড়া হিন্দু ব্ৰাহ্মণ পরিবারে জন্ম হলেও হিন্দুদের মধ্যে সেকালে প্রচলিত কুসংস্কার ও অর্থহীন আচার-আচরণের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা জন্মায়। ১৮৬৫ খ্রী. থেকেই ভবানীপুর ব্ৰাহ্মসমাজ মন্দিরে যাতায়াত করতেন এবং সমাজসংস্কারমূলক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে এবং বিধবাবিবাহের পক্ষে মত প্ৰকাশ করেন। তাঁর ‘আত্মচরিত’ পুস্তকে ১৮৬৮ খ্রী. তাঁরই উৎসাহে সম্পাদিত বিপত্নীক যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ ও বিধবা মহালক্ষ্মীর বিবাহের বিষয় বর্ণিত আছে। এই বিবাহের প্ৰায় সব খরচ বিদ্যাসাগর মহাশয় বহন করেন। এই উপলক্ষে পিতার ক্ৰোধ সত্ত্বেও সমাজে নবদম্পতিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তিনি বহু দুর্যোগ মাথা পেতে নেন এবং উপেন দাসের সঙ্গে নবকৃষ্ণ বসুর বিধবা কন্যার বিবাহেও সাহায্য করেন। ২২-৮-১৮৬৯ খ্রী. আনন্দমোহন বসু প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে ব্ৰাহ্মসমাজে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করেন। তখন কেশবচন্দ্ৰ সেন ছিলেন তাঁদের নেতা। উপবীত ও মূর্তিপূজার সঙ্গে এখানেই তাঁর ইতি ঘটে। ফলে পিতা কর্তৃক বিতাড়িত হন। কেশবচন্দ্রের নেতৃত্বে ‘Indian Reforms Association-এ যোগ দেন। এ সভার বহুবিধ কর্মতালিকা ছিল, যথা : মদ্যপান নিবারণ এবং শিক্ষা, সুলভ সাহিত্য ও কারিগরী বিদ্যার প্রচার। তিনি ‘মদ না গরল’ নামে মাসিক পত্রিকা প্রচার করেন। নারী-মুক্তি আন্দোলনেও তিনি কেশবচন্দ্রের সহযোগী ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাদের বলিষ্ঠ আন্দোলনের ফলেই ১৮৭২ খ্রী. আইনে মেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স-সীমা চোদ্দ বছর নির্ধারিত হয়। ক্ৰমে মহিলাদের উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে যে আন্দোলন শুরু করেন তাতেই কেশবচন্দ্রের বিরোধিতার জন্য তাদের মধ্যে দ্বিমত শুরু হয়। শিবনাথ প্রমুখেরা কেশবচন্দ্ৰকে অগ্রাহ্য করে হিন্দু মহিলা বিদ্যালয় বা বঙ্গ-মহিলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি স্বীয় কন্যা হেমলতাকে এখানে ভর্তি করান। ১৮৭৭ খ্রী. ব্ৰাহ্মসমাজের কয়েকজন তরুণকে নিয়ে একটি বৈপ্লবিক সমিতি গঠন করেন। সমিতির কাৰ্যসূচীতে জাতীয়তামূলক ও সমাজ-সংস্কারমূলক শিক্ষা এবং রাষ্ট্ৰীয় স্বাধীনতার পরিকল্পনা ছিল। তাঁর গুপ্ত সমিতিতে আনন্দমোহন বসু ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর রচিত ‘যুগান্তর’ নামে সামাজিক উপন্যাস থেকে ‘যুগান্তর’ পত্রিকার (১৯০৭) নামকরণ হয়। তাদের অন্যান্য অঙ্গীকার ছিল-জাতিভেদ অস্বীকার, সরকারী চাকরি অস্বীকার, সমাজে নারী-পুরুষের সমানাধিকার স্বীকার ইত্যাদি। অশ্বারোহণ ও বন্দুক-চালনা শিক্ষা তাদের কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই কর্মসূচীর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি হেয়ার স্কুলের শিক্ষকতা ত্যাগ করেন। ১৮৭৮ খ্রী. কেশবচন্দ্রের অপ্ৰাপ্তবয়স্ক কন্যার বিবাহ উপলক্ষে ব্ৰাহ্মসমাজে ভাঙ্গন ধরে এবং তাঁর নেতৃত্বে সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা হয়। এখন থেকে তিনি সমাজ-সংস্কারে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। তিনি ধর্মপ্রচার ছাড়াও সারা ভারতে সামাজিক ও রাজনৈতিক সংহতি এবং সাম্যের কথাও প্রচার করেন। মাদ্রাজ ভ্রমণের সময়ে সেদেশের জাতিভেদ ও ছুঁৎমাৰ্গকে তীব্রভাবে আক্রমণ করেন। শিক্ষাপ্রসারের জন্য আনন্দমোহন বসু ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একযোগে সিটি স্কুল (১৮৭৯) স্থাপন করেন। এই বছরেই ‘স্টুডেন্টস সোসাইটি’ নামে একটি গণতান্ত্রিক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন একটি জমিদার-কবলিত প্ৰতিষ্ঠান ব’লে ২৬-৭-১৮৭৬ খ্রী. ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন নামে মুখ্যত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্মক্ষেত্র প্ৰতিষ্ঠায় তিনি উদ্যোগী ছিলেন। সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজের পক্ষ থেকে ‘সখা’ নামে কিশোরদের জন্য ভারতের প্রথম মাসিক পত্রিকা তাঁর উৎসাহে প্ৰকাশিত হয় (১৮৮৩)। ১৮৯৫ খ্ৰী. প্রকাশিত ‘মুকুল পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৮৮৮ খ্রী. তিনি ছয় মাসের জন্য বিলাত ভ্ৰমণে যান। ইংরেজ চরিত্রের নিয়মানুবর্তিতা প্রভৃতি সদগুণ লক্ষ্য করে স্বপ্রতিষ্ঠিত ‘সাধনাশ্রমে’ সেই নিয়ম প্রবর্তন করেন। কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকরূপে তাঁর রচনার সংখ্যা অনেক। ‘আত্মচরিত’ এবং ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’ আজও গবেষকদের কাছে অতি মূল্যবান তথ্যমূলক পুস্তক। বাংলা প্ৰবন্ধকাররূপে তাঁর খ্যাতি সর্বাধিক। রচিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘নির্বাসিতের বিলাপ, ‘নয়নতারা’, ‘বিধবার ছেলে’, ‘রামমোহন রায়’, ‘হিমাদ্রিকুসুম’ (কাব্য), ‘ধৰ্মজীবন’, ‘History of the Brahmo Samaj, ‘Men I have seen’ প্রভৃতি। তাঁর ‘মেজ বৌ’ উপন্যাসটির ইংরেজী অনুবাদ ইংল্যান্ডের Indian National Journal-এ প্রকাশিত হয়েছিল (১৮৮২)।
পূর্ববর্তী:
« শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
« শিবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
পরবর্তী:
শিবনাথ সাহা »
শিবনাথ সাহা »
Leave a Reply