লক্ষ্মীশ্বর সিংহ (১-৬-১৯০৫ — ২৪-৪-১৯৭৮) রাঢ়ীশাল–শ্ৰীহট্ট। বাণেশ্বর। বাল্যকাল থেকেই কাঠের কাজে ও দারুশিল্প সম্পর্কে তাঁর ঝোঁক ছিল। গ্রামের শিল্পীদের কাছে হাতেখড়ি হয়। পরে সরকারী বিদ্যালয়ে শিক্ষা পান। অসহযোগ আন্দোলনের জোয়ারে সরকারী বিদ্যালয় ছেড়ে জাতীয় বিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯২২ খ্ৰী. এলমহার্স্টের চেষ্টায় শ্ৰীনিকেতন প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি এই নূতন কর্মযজ্ঞে যোগ দেন। গ্রামের লোকদের কাঠের কাজ শেখাতেন; গ্রাম-সংগঠনের কাজও করতেন। শ্ৰীনিকেতনে জাপানী কারুদক্ষ কাসাহারা এলে তিনি তাঁর কাছে শিল্প ও সাহিত্যের তালিম নিতে থাকেন। তাঁর ‘কাঠের কাজ’ গ্ৰন্থটিতে রবীন্দ্রনাথ ভূমিকা লেখেন। শান্তিনিকেতনে তিন বছর কাটিয়ে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে ১৯২৮ খ্রী. সুইডেনে যান। সেখানে ন্যাসশ্লয়েড ট্রেনিং কলেজ থেকে ডিপ্লোমা নিয়ে তিন বছর পরে দেশে ফিরে শান্তিনিকেতনে ১৯৩২ খ্রী. পর্যন্ত কারুশিল্পের শিক্ষক নিযুক্ত থাকেন। আরিয়াম ও আশা দেবী তাঁর দুজন উৎসাহী শিষ্য ছিলেন। বিশ্বভারতীতে তখন অর্থসঙ্কটের জন্য তাঁর বিদ্যার রূপায়ণে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার কয়েক মাস পরেই কবির অনুমতি নিয়ে অর্থসংগ্রহ ও উপযুক্ত শিক্ষকের সন্ধানে সুইডেনে যান। তাঁর চেষ্টায় শ্লয়েড কলেজ থেকে দুজন শিক্ষিকা মিস জিয়ানসন ও সেডার ব্লম শান্তিনিকেতনে আসেন। তাছাড়া অর্থসংগ্রহ করে বয়নশিল্প ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম কিনে তা দেশে পাঠান। ১৯৩৭ খ্রী. দেশে ফিরে আবার কাজে যোগ দেন। আশা ছিল শ্ৰীনিকেতনে নিখিল ভারত শ্লয়েড (Sloid) শিক্ষাগার গড়ে উঠবে; তা সফল হয়নি। কংগ্রেস তখন বিভিন্ন প্রদেশে সরকার গঠন করেছে। গান্ধীজী পরিকল্পিত শিক্ষাদর্শ অনুসারে বেসিক ন্যাশনাল এড়ুকেশনের প্রবর্তন-পর্ব চলছে। এর পাঠক্রম রচনায় জাকীর হোসেনের নেতৃত্বে যে কমিটি গঠিত হয় তাতে তিনি কাঠের কাজ, কার্ডবোর্ড ও ধাতুশিল্প-সম্পর্কিত বিষয় সংযোজন করেন। ওয়ার্ধায় একটি শিল্প বিদ্যালয় স্থাপিত হলে তিনি তার সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়ে সেখানে যান। ১৯৩৮ খ্ৰী. গান্ধীজীর আমন্ত্রণে সেবাগ্রামের বি.টি. কলেজের অধ্যাপক হিসাবেও কাজ করেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে কারুশিল্পকে উন্নীত করার কাজে আত্ননিয়োগ করেন। সাহিত্য-ব্যাপারেও তাঁর খুব আগ্রহ ছিল। ১৯২৮–৩১, ১৯৩৩–৩৬ খ্রী বিদেশে অবস্থানকালে এসপেরান্তো আন্দোলন খ্যাত বিখ্যাত সেলমা লাগেরলফের সান্নিধ্যে আসেন এবং বিশ্বভাষা এসপেরান্তো শিখে সেই ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্ৰহণ করেন। ১৯৩৬ খ্রী. ভারতে ফিরে এবং স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৪৮ খ্রী. এদেশে এসপেরান্তো ভাষার প্রচার ও প্রসারকল্পে দিল্লী ও কলিকাতায় কেন্দ্ৰ স্থাপনের ব্যবস্থা করেছিলেন। শান্তিনিকেতনে ছাত্র ও শিক্ষকদের নিজ চেষ্টায় শেখাতেন। বাংলায় ‘এসপেরান্তো সহজপাঠ’ রচনা করেন। তাঁর এসপেরান্তো রচনা ‘Maisata Stono (রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ-এর অনুবাদ), Jaroj sun Tero (আত্মজীবনী) প্রভৃতি। সেলমা লাগেরলফের দুটি বিখ্যাত উপন্যাসের বাংলা অনুবাদ মূল এসপেরান্তো ভাষা থেকে প্রকাশ করেন। ‘তরাই-এর তরুণী’ নামক কাহিনীটি সাধুভাষায় ১৯৪৩ খ্ৰী. প্রবাসীতে ধারাবাহিকরূপে বার হয়। পরে চিত্তরঞ্জন দেবের সহযোগিতায় চলতি ভাষায় পরিবর্তিত হয়ে ‘বিনয় ভবন’ থেকে গ্ৰন্থাকারে ১৯৬২ খ্ৰী. প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখা অন্যান্য গ্ৰন্থ : ‘এসপেরান্তো আন্দোলন’ (১৯৬৩), ‘ল্যাপল্যান্ড’, ‘Swedish Flora and Fauna’, ‘Lapland and iceland Travel’, ‘Shibaji’, ‘Sloyd Handicraft’ (কাঠের কাজের স্কুলপাঠ্য), ‘শিক্ষাশিল্প ও কার্পাস বিজ্ঞান’ প্রভৃতি। UNO ফেলোশিপ উপলক্ষে ‘Child care and Mother Training’ প্রোগ্রামে ডেনমার্কে ভ্ৰমণকালে সেখানের কৃষি ও পশুপালন সম্বন্ধে নানা মূল্যবান প্রবন্ধ রচনা করেন। এছাড়া শিক্ষা সম্বন্ধেও তাঁর অনেক রচনা আছে।
পূর্ববর্তী:
« লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
« লক্ষ্মীনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
পরবর্তী:
লজ্জাবতী বসু »
লজ্জাবতী বসু »
Leave a Reply