রামমোহন রায় (১৭৭২ –- ২৭-৯-১৮৩৩) রাধানগর-হুগলী। রামকান্ত। প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ফুরখশিয়ারের আমলে বাঙলার সুবেদারের আমিন ছিলেন। সেই সূত্রে তাদের ‘রায়’ পদবীর ব্যবহার। আধুনিক ভারতের জনক, আন্তর্জাতিক আদর্শের প্রবক্তা রামমোহন পাটনায় আরবী এবং কাশীতে সংস্কৃত শিক্ষা করেন। স্বগ্রামের নিকটবতী পালপাড়া গ্রামের নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার বা হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কৈশোরেই তাঁর মনে আধ্যাত্মিক চিন্তার বীজ রোপণ করেন। ১৫ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করে কয়েক বছর, তাঁর নিজের ভাষায় ‘পৃথিবীর সুদূর প্রদেশগুলিতে, পার্বত্য ও সমতলভূমিতে’ পৰ্যটন করেন। ১৭৯১ খ্রী. তাঁর পিতা লাঙ্গুলপাড়া গ্রামে এসে বাস করতে থাকেন। এই সময়ে তিনি ও তাঁর ভ্রাতারা পিতারবিস্তৃত জমিদারী দেখাশুনা করতেন। ১৭৯৬ খ্রী। তিনি পৈতৃক ও অন্যান্য সূত্রে কিছু জমি, বাগান ও কলিকাতাস্থ জোড়াসাঁকোর বাড়ির মালিকানা লাভ করেন। বৈষয়িক কাজে তিনি কলিকাতা, বর্ধমান ও লাঙ্গুলপাড়ায় বিভিন্ন সময়ে অবস্থান করতেন। ১২-৭-১৭৯৯ খ্রী তিনি দুইটি বড় তালুক কেনেন। পরের বছর ভাগ্যবিপর্যয়ে তাঁর পিতা হুগলীর দেওয়ানী জেলে আবদ্ধ হন। কিছু পরে জ্যেষ্ঠভ্রাতা জগমোহন অনুরূপ কারণে মেদিনীপুর জেলে আটক থাকেন। একমাত্র রামমোহনই এই বিপর্যয় এড়াতে পেরেছিলেন। তাঁর কোম্পানীর কাগজ কেনাবেচার ব্যবসায় ছিল। ৭-৩-১৮০৩ খ্রী. থেকে দুই মাস কালেক্টর উডফোর্ডের দেওয়ানরূপে যশোহরে কাজ করেন। এই সময়ে পিতারমৃত্যু হয় ও শ্রাদ্ধাদি নিয়ে গোলযোগের ফলে অনুষ্ঠিত তিনটি শ্রাদ্ধের একটি রামমোহন কলিকাতায় করেন। পরিবারের অন্যান্যদের দুৰ্গতি হলেও রামমোহন সম্পন্ন ছিলেন ও তালুক কেনেন (১৮০৩)। কিছুদিন পর মুর্শিদাবাদ যান এবং এখানেই তাঁর একেশ্বরবাদ-বিষয় প্রথম রচনা আরবী ও ফারসী ভাষায় ‘তুহফাৎ উল মুবাহহিদ্দীন’ প্রকাশিত হয় (আনুমানিক ১৮০৩/৪)। সিভিলিয়ান ডিগবীর দেওয়ান বা খাস কর্মচারিরূপে কাজ করার সময়ে (১৮০৫–১৪) বিষয়কর্মে যথেষ্ট উন্নতি করেন। ইংরেজের অধীনে চাকরি করলেও আত্মসম্মান বজায় রাখার জন্য স্যার ফ্রেডারিক হ্যামিলটনের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষ হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে লর্ড মিন্টোর কাছে অভিযোগ করেন (১২-৪-১৮০৯)। এই অভিযোগপত্রটিই তাঁর প্রথম ইংরেজী রচনা বলা যায়। ১৮১৪ খ্রী. থেকে কলিকাতায় বসবাস শুরু করেন এবং চৌরঙ্গী ও মানিকতলায় গৃহ ক্রয় করেন। সেকালের ধনীদের প্রথামত জোবাবা ও চাপকান তাঁর পোশাক ছিল। পান, ভোজন ও বন্ধু ইত্যাদির কারণে গোঁড়া হিন্দুরা তাকে যবন সন্দেহ করতেন। তাঁর গৃহে দেশী-বিদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল। সম্ভবত বৈষয়িক কারণে মাতা তারিণী দেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ক্লিষ্ট হয়। সংসারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তারিণীদেবী পুরী চলে যান এবং দুই বছর দরিদ্র রমণীর মত জগন্নাথ মন্দির বাঁট দিয়ে বৈষ্ণবের বাঞ্ছিত মৃত্যুবরণ করেন (২১-৪-১৮২২)। তাঁর প্রথম জীবনের শিক্ষক হরিহরানন্দের কাছে (১৮১২) রামমোহন গভীরভাবে হিন্দুশাস্ত্র ও দর্শনের পাঠ গ্ৰহণ করেন। কলিকাতায় স্থায়ী বাসিন্দা হয়েই তাঁর জ্ঞান ও বিশ্বাসমত ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উন্নতিবিধানে সচেষ্ট হন। তাঁর একেশ্বরবাদী ধর্মমত-প্রচারে প্রথম কাজ হল, অনুবাদ ও ভাষ্যসহ! বেদান্ত-সূত্র ও তৎসমর্থক উপনিষদগুলি প্ৰকাশ করা (১৮১৫–১৯)। বাংলা ভাষায় বেদান্তের তিনিই প্ৰথম ভাষ্যকার। এই সঙ্গে একেশ্বর উপাসনার পথ দেখাতে ‘আত্মীয় সভা’ প্ৰতিষ্ঠা করেন (১৮১৫)। এই সভাকেই পরে তিনি ‘ব্ৰাহ্মসমাজ’ নাম ও রূপ দেন (১৮২৮)। তিনি নিজ অনূদিত গ্ৰন্থ নিজ ব্যয়ে প্রকাশ করে বিতরণ করেন। বক্তব্য ছিল, ‘হিন্দুধর্মে নিরাকার ব্রহ্মোপাসনাই প্রকৃষ্ট’। অল্পদিনেই তাকে কেন্দ্র করে বিশিষ্ট ও বিদ্বান শহরবাসিগণ সমবেত হন। রক্ষণশীল হিন্দুগণ তাঁর প্রবল শত্রু হয়ে ওঠেন। মূল বাইবেলের পুরাতন অংশ পাঠ করার জন্য তিনি হিব্রু ভাষা শিখেছিলেন। বাইবেলের শিক্ষা সম্বন্ধে বলেন-খ্রীস্ট-জীবনের অলৌকিক কাহিনী নয়, অবতারবাদ নয়, তাঁর উপদেশই বাইবেলের প্রকৃত। শিক্ষা। ফলে পাদরীগণও তাঁর বিরোধিতা আরম্ভ করেন। এই বাদানুবাদের ফলে বিপুল-কলেবর গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। পাদরী উইলিয়ম অ্যাডাম তাঁর দলভুক্ত হন। পত্রিকা প্ৰকাশ করলেন তিনটি-ইংরেজী-বাংলায় দ্বিভাষিক ‘ব্রাহ্মানিক্যাল ম্যাগাজিন ব্ৰাহ্মণ সেবধি’ (১৮২১), বাংলায় ‘সম্বাদ কৌমুদি’ (১৮২১) ও ফারসী ভাষায় ‘মীরাৎ-উল-আখবার’ (১৮২২)। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাহরণের প্রতিবাদে ১৮২৩ খ্রী. ফারসী পত্রিকা বন্ধ করে দেন। আত্মীয়সভায় বেদাদি শাস্ত্ৰ পাঠ, ব্যাখ্যা ও ব্ৰহ্মসঙ্গীত হত। ১৮২১ খ্রী. ইউনিটোরিয়ান কমিটি নামে আর একটি ধর্মসভা স্থাপন করেন। ২০-৮-১৮২৮ খ্রী দ্বারকনাথ ঠাকুর প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সহযোগিতায় ব্ৰাহ্মসমাজ স্থাপন করেন। ২৩-১-১৮৩০ খ্রী. সমাজের নবনিমিত ভবনে উপাসনা হয়। তাঁর সময়ে হিন্দু, মুসলমান, খ্ৰীষ্টান, ইহুদী-সব সম্প্রদায়ের লোক এখানে উপাসনা করতেন। রামমোহন সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে আইনের জন্য চেষ্টা করেন। হিন্দু শাস্ত্রের প্রমাণ দাখিল করে দেখান যে শাস্ত্ৰে সহমরণের নির্দেশ নেই। ৪-১২-১৮২৯ খ্ৰী. লর্ড বেন্টিঙ্ক সতীদাহ বিধি-বহির্ভূত বলে ঘোষণা করেন। ইংরাজী শিক্ষার প্রসারে নিজ ব্যয়ে তিনি অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল স্থাপন করেন (১১-১২-১৮২৩)। রাজনৈতিক মতে তিনি আন্তর্জাতিকতাবাদী ছিলেন। ইউরোপ ও আমেরিকার রাজনীতির খবর রাখতেন। অস্ট্রীয় সৈন্য কর্তৃক নেপলস পুনর্দখলের সংবাদে লেখেন ‘…..I consider the cause of Neapolitans as my own, and their enemies as ours’। স্পেনের শোষণ থেকে দক্ষিণ আমেরিকির উপনিবেশগুলির মুক্তির সংবাদে তিনি স্বগৃহ আলোক-সজ্জিত করেন ও বহু বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে আপ্যায়িত করেন (সেপ্টেম্বর ১৮২৩)। ফ্রান্সে ১৮৩০ খ্ৰী. জুলাই বিপ্লবের সংবাদে উৎফুল্ল হন। এদেশে জুরী প্ৰথা প্রবর্তনে ও উত্তরাধিকার আইন-সংক্রান্ত আন্দোলনগুলিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি রাজা উপাধি সহ দিল্লীর বাদশাহের দূত হিসাবে ইংল্যান্ডের রাজার নিকট প্রেরিত হন। বিলাতযাত্রায় সঙ্গী হন পালিত পুত্ৰ রাজারাম, রামরত্ব মুখোপাধ্যায়, রামহরি দাস ও ভৃত্য শেখ বকস। ৮-৪-১৮৩১ খ্ৰী. লিভারপুল বন্দরে অবতরণ করা মাত্রই বিপুলভাবে সংবর্ধিত হন এবং পার্লামেন্টে বৈদেশিক দূতগণের আসনে বসবার অধিকার পান। মোগল সম্রাটের নির্দিষ্ট কাজ সফল করেন। স্বদেশে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার উন্নতির চেষ্টায় কিছুটা সাফল্য লাভ করেন। ১৮৩২ খ্ৰীষ্টাব্দের শেষের দিকে তিনি প্যারিস যান এবং ফরাসী সম্রাট লুই ফিলিপ কর্তৃক সংবর্ধিত হন। ইংল্যান্ডে ফিরে ব্রিস্টল শহরে বাস করেন। সেখানে আট দিনের জ্বরে তাঁর মৃত্যু হয়। হিন্দু ব্ৰাহ্মণের উপবীত আমৃত্যু তাঁর অঙ্গে ছিল। মৃত্যুর ১০ বছর পরে দ্বারকনাথ ঠাকুর ‘আনরস ডেল’ নামক জায়গায় তাঁকে সমাধি দিয়ে একটি মন্দির নির্মাণ করে দেন। তাঁর পূর্বে বাংলা ভাষায় কবিতা ও গদ্য রচিত হলেও, প্রকৃত অর্থে তাঁকেই বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। প্ৰায় ৩০ টি বাংলা গ্রন্থের তিনি রচয়িতা। তাঁর রচিত ‘ব্রহ্মসঙ্গীত’, ‘গৌড়ীয় ব্যাকরণ’ প্রভৃতি বিখ্যাত। ৩৯টি ইংরেজী রচনার মধ্যে একটি আত্মজীবনীমূলক পুস্তিকা আছে। অন্যান্যগুলির বেশীর ভাগই শাস্ত্রের অনুবাদ। এগুলির কিছু লন্ডনে ও অন্যগুলি কলিকাতা থেকে প্ৰকাশিত। সঙ্গীতজ্ঞ কালী মীর্জার কাছে সঙ্গীত বিষয়ে জ্ঞানলাভ করার পর বাংলায় ধ্রুপদ রচনা ও কলিকাতা সমাজে এই গানের প্রচলনে সাহায্য তাঁর অন্যতম কৃতিত্ব।
পূর্ববর্তী:
« রামমোহন ন্যায়বাগীশ
« রামমোহন ন্যায়বাগীশ
পরবর্তী:
রামরঞ্জন চৌধুরী »
রামরঞ্জন চৌধুরী »
Leave a Reply