রামকিঙ্কর বেইজ (২৫-৫-১৯০৬ –- ২-৮-১৯৮০) যুগীপাড়া—বাঁকুড়া। চণ্ডীচরণ। প্রখ্যাত ভাস্কর্য ও চিত্ৰশিল্পী। দরিদ্র নাপিত পরিবারে জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকায় ঝোক ছিল। দেবদেবীর ছবি আঁকতেন। প্রতিবেশী ছুতোর-কামারদের কাজও তাকে আকৃষ্ট করত। পুতুল গড়তেন। একটু বড় হয়ে পোস্টার এঁকে, থিয়েটারের সীন তৈরি করে সামান্য উপার্জনও করেছেন। স্কুলের পড়া ম্যাট্রিক ক্লাশ পর্যন্ত। ১৯২১ খ্রী. অসহযোগ আন্দোলনের হাওয়াও কিছুটা লেগেছিল। বাঁকুড়ার লোক ‘প্রবাসী’ পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁর শিল্প-প্ৰতিভার পরিচয় পেয়ে তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন (১৯২৫ খ্রীঃ)। তাঁর আঁকা ছবি দেখে নন্দলাল বসু বলেছিলেন, ‘তুমি সবই জানো, আবার এখানে কেন?’ কলাভবনে সতীর্থ হিসাবে পেয়েছিলেন রমেন্দ্ৰনাথ চক্রবর্তী, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, বিনায়ক, মসোজী প্রমুখকে। আমৃত্যু শান্তিনিকেতনেই থেকে যান। প্ৰথমে ছাত্র, পরে শিক্ষক। ভাস্কর্য বিভাগের প্রধান হয়ে ১৯৭১ খ্রী. অবসর নেন। অজস্র ছবি এঁকেছেন, অসংখ্য মূর্তি গড়েছেন। তাঁর চিত্রে, ভাস্কর্যে রাঢ় দেশের মাটি ও মানুষ এসেছে প্রবলবেগে। তাঁর অঙ্কন শক্তিশালী সহজ কিন্তু প্ৰথাসর্বস্ব নয়। প্ৰাচ্য-পাশ্চাত্ত্য শিল্পকলার নানা বিশেষত্ব ধরা পড়েছে তাঁর শিল্পকর্মে। ‘উৎসবী চোখ’, ‘শিলং সিরিজ’, ‘শরৎকাল’, ‘কৃষ্ণের জন্ম’, ‘নতুন শস্য’, ‘বিনোদিনী’, ‘ ‘মহিলা ও কুকুর’, ‘গ্ৰীষ্মের দুপুর’ প্রভৃতি ছবি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রায় সমস্ত মূর্তিই খোলা আকাশের নীচে-বড় আকারের। র্যাদের তিনি সকাল-সন্ধ্যায় দেখতেন তারাই তাঁর মডেল। গতিময়তার প্রাধান্য রয়েছে তাঁর শিল্পসৃষ্টিতে। তাঁর ভাষায় ‘প্রায় সব-কটা মূর্তিই মুভিং।। স্থবিরতায় আমার বিশ্বাস নেই। ‘সুজাতা’, ‘বুদ্ধদেব’, ‘গান্ধীজী’, ‘হাটের সাঁওতাল পরিবার’, ‘কাজের শেষে সাঁওতাল রমণী’, ‘কালের পথে’ প্রভৃতি এবং রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্ৰনাথ ও আলাউদ্দীন খান-এর আবক্ষ মূর্তিগুলি নির্মাণশৈলীতে বিশিষ্ট। কলিকাতা, বোম্বাই ও দিল্লীতে তাঁর ছবির ও মূর্তির প্রদর্শনী হয়েছে। প্যারিস এবং জাপানের প্রদর্শনীতে তাঁর কাজ গিয়েছে। এদেশের প্ৰধান সংগ্রহশালাগুলিতে তাঁর শিল্পকর্ম রক্ষিত আছে। তিনি নিজে যদিও শান্তিনিকেতনের বাইরে বিশেষ কোথাও যাননি। গান এবং অভিনয় ভালবাসতেন। মঞ্চসজ্জা ও পরিচালনা নিয়ে কাজ করেছেন। তাঁর পরিচালনায় শান্তিনিকেতনে ইংরেজী ও বাংলা বহু নাটক অভিনীত হয়েছে। নিজেও অনেক অভিনয় করেছেন। ১৯৪৯ খ্রী. কলিকাতায় অনুষ্ঠিত সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’ নাটকের নির্দেশনা তিনি দেন। ১৯৭০ খ্রী ‘পদ্মভূষণ’ লাভ করেন। ১৯৭৫ খ্ৰী বিশ্বভারতীর ‘এমেরিটাস প্রফেসর’ হন। ১৯৭৬ খ্রী. বিশ্বভারতী তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অকৃতদার, বেহিসাবী এই শিল্পী নিজের কাজ সম্বন্ধে উদাসীন ছিলেন।
পূর্ববর্তী:
« রামকান্ত মুন্সী
« রামকান্ত মুন্সী
পরবর্তী:
রামকিশোর তর্কচূড়ামণি »
রামকিশোর তর্কচূড়ামণি »
Leave a Reply