রাজেন্দ্রলাল মিত্র (১৬-২-১৮২২ –- ২৬-৭-১৮৯১) শুঁড়া–চব্বিশ পরগনা। জনমেজয়। বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ, পুরাতত্ত্ববিৎ, সমালোচক ও প্রাবন্ধিক। গোবিন্দচন্দ্র বসাকের হিন্দু ফ্ৰী স্কুলে শিক্ষালাভের পর মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন (১৮৩৭)। এখানে মেধা ও প্রতিভার পরিচয় দিলেও কয়েকজন ইংরেজের সঙ্গে বিবাদের ফলে ১৮৪১ খ্রী. কলেজ ত্যাগ করেন। এরপর আইন ও ভাষা শিখতে আরম্ভ করেন এবং হিন্দী, ফারসী, সংস্কৃত ও উর্দু ভাষায় প্ৰগাঢ় জ্ঞান অর্জন করেন। ১৮৪৬ খ্রী. এশিয়াটিক সোসাইটির সহকারী সম্পাদক ও গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত হন। কখনও সহ-সভাপতি, কখনও সম্পাদক এবং সবশেষে প্রথম ভারতীয় সভাপতিরূপে (১৮৮৫) তিনি আমৃত্যু এশিয়াটিক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ করেছেন। ১৮৫৬ খ্রী. সরকার কর্তৃক ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশনের ডিরেক্টর নিযুক্ত হওয়ায় তিনি সহ-সম্পাদকের সবেতন পদ ত্যাগ করেন। ম্যাক্সমুলারের মতে রাজেন্দ্রলাল তাঁর জীবিতাবস্থায় ভারততত্ত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বহুবিধ। তাঁর বহু গবেষণামূলক প্ৰবন্ধ সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। সংস্কৃত গ্রন্থ সম্পাদন ও প্রকাশ তাঁর অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সোসাইটির ‘Bibliotheca Indica’ নামে গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত করে এগুলি প্রকাশ করেন। প্রকাশিত প্ৰবন্ধাবলীর সংখ্যা ১৩। উল্লেখযোগ্য যে, বেতনভুক কর্মচারী হিসাবে পদত্যাগ করার পরই তাকে সোসাইটির সভ্যপদ দেওয়া হয় (৬-২-১৮৫৬) এবং জুন মাসেই তিনি সোসাইটি কাউন্সিলের অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্ৰবন্ধ-নির্বাচনী কমিটির সভ্য ও গ্রন্থাগারিক ছিলেন। ১৮৫১ খ্ৰী. প্রতিষ্ঠিত ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটির তিনি সভ্য হন এবং সোসাইটির অর্থসাহায্যে নিজ সম্পাদনায় ‘বিবিধার্থ সংগ্ৰহ’ নামে সচিত্ৰ মাসিকপত্ৰ প্ৰকাশ করেন। প্ৰথম ৬ পর্ব তাঁর এবং ৭ম ও শেষ পর্বটি কালীপ্রসন্ন সিংহের সম্পাদনায় প্ৰকাশিত হয়। ১৮৬২ খ্ৰী. স্কুল বুক সোসাইটি ও ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি মিশে যায়। এই যুক্ত সমিতির পক্ষ থেকে তাঁর সম্পাদনায় ১৮৬৩ খ্রী. ‘রহস্য সন্দর্ভ’ নামে আর একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১০ বছর পর শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি পত্রিকাটি চালাতে অক্ষম হন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘সারস্বত সমাজ’-এর (১৮৮২) তিনি সভাপতি ও রবীন্দ্রনাথ সম্পাদক ছিলেন। ১৮৫৪ খ্ৰী. আর্ট স্কুল স্থাপনে Hodgson Pratt-কে সাহায্য করেন এবং প্রতিষ্ঠানের সম্পাদকরূপে দেশীয় যুবকগণ যাতে অঙ্কনশিল্প, স্থাপত্য এবং কারিগরিকে বৃত্তি হিসাবে গ্রহণ করে তাঁর জন্য উৎসাহ দেন। তিনি দীর্ঘকাল মিউনিসিপ্যালিটি ও বিশ্ববিদ্যালয় সেনেটের সদস্য ছিলেন। ১৮৫৪ খ্রী. তাঁর চেষ্টায় শিল্পবিদ্যোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে চিৎপুরে পক্ষকালব্যাপী একটি প্রদর্শনীর আয়োজন হয়। ২-১-১৮৫৬ খ্রী. ‘ফোটোগ্রাফিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময় থেকেই তিনি তাঁর কোষাধ্যক্ষ ও সম্পাদক ছিলেন। তাঁর রচিত ৯টি বাংলা ও ২১টি ইংরেজী গ্রন্থের নাম-তালিকা থেকে তাঁর বহু-বিচিত্র মনীষার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। ১৮৫০-৫৮ খ্রী. মধ্যে কলিকাতা স্কুল বুক সোসাইটির সহায়তায় সম্ভবত তিনিই প্ৰথম বঙ্গক্ষেরে মানচিত্ৰ প্ৰকাশ করেন। তাঁর গবেষণামূলক প্ৰবন্ধাবলী যেমন কলিকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির মুখপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তেমনই বিলাতী। পত্রিকা ও এদেশীয় ইংরেজী দৈনিকে এবং মাসিকেও বেরিয়েছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে এবং কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে সর্বপ্রথম সম্মানসূচক ‘ডক্টর অফ ল’ উপাধি প্রদান করেন (১৮৭৬)। বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ কর্তৃক তিনি মোট ১০টি সম্মানে ভূষিত হন। সরকার তাকে রায়বাহাদুর, সিআইই ও রাজা (১৮৮৫) উপাধি দেয়। রবীন্দ্ৰনাথ লেখেন, ‘……রাজেন্দ্ৰলাল মিত্ৰ সব্যসাচী ছিলেন।…তিনি একাই একটা সভা’।
পূর্ববর্তী:
« রাজেন্দ্রলাল আচাৰ্য
« রাজেন্দ্রলাল আচাৰ্য
পরবর্তী:
রাজেন্দ্ৰ মল্লিক »
রাজেন্দ্ৰ মল্লিক »
Leave a Reply