মোহিতকুমার মৈত্র (১৮৯৮ – ১৮-১১-১৯৬৬) নাটোর-রাজশাহী। বসন্তকুমার। প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বিপ্লবী। ছাত্রাবস্থায় শুধু পড়াশুনায় নয়, অভিনয় এবং আবৃত্তিতেও সুনাম অর্জন করেন। ১৯১৫ খ্রী’ নাটোর স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ইতিহাসে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এইসময় বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী আন্দোলনে সতীশ পাকড়াশী প্রমুখ বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন। ১৯১৯ খ্রী. জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করার অপরাধে হস্টেল থেকে বিতাড়িত হন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে এম.এ. ও আইন পড়ার সময় অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। মুক্তির পর দেশবন্ধু প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড কাগজে যোগ দেন। ফরওয়ার্ড ও তৎপরবর্তী ‘লিবার্টি’ অফিস থেকে প্ৰকাশিত দৈনিক ‘বাংলার কথা’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৬ খ্রী. ভারতীয় সাংবাদিক সঙ্ঘের সহ-সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৩০ খ্ৰী. কুখ্যাত প্রেস অ্যাক্টের প্রতিবাদে তাঁর নেতৃত্বে সাংবাদিক সঙ্ঘ দীর্ঘদিন সংবাদপত্র বন্ধ রাখার আন্দোলন চালায়। ১৯৩৭ খ্রী. ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র প্রতিনিধি হয়ে ওড়িশায় যান। সেই সময়ে ভারতে নৃপতিদের নৃশংস অত্যাচারের প্রতিবাদে দেশীয় রাজ্যগুলিতে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তিনি জীবনের ঝুকি নিয়েও ওড়িশার ঢেঙ্কানল, তালচের প্রভৃতি দেশীয় রাজ্য ঘুরে রাজন্যবর্গের অস্বাভাবিক অত্যাচারের কাহিনী ও ফটো সংবাদপত্রে প্রকাশ করেন এবং ঐসব অত্যাচারের তথ্যাদি দীনবন্ধু এভুজ ও ভাইসরয় লর্ড লিনলিথগোকে পাঠান। এ আন্দোলনে তিনি ওড়িশার হরেকৃষ্ণ মহতাব ও নবকৃষ্ণ চৌধুরীর পাশে দাড়িয়ে কাজ করেন। ওড়িশার প্রতিটি গণ-আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত থেকে তিনি আপামর জনসাধারণের ‘মোহিতদা’ নামে পরিচিত হন। অমৃতবাজারের এলাহাবাদ সংস্করণ প্ৰকাশের সময় তাকে এলাহাবাদে যেতে হয়। এর কয়েক বছর পরে অমৃতবাজারের স্পেশাল অফিসার হিসাবে কলিকাতা অফিসে যোগ দেন। কিন্তু শ্রমনীতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে কর্তৃপক্ষের মতবিরোধ ঘটায় পদত্যাগ করেন। ১৯৪৯ খ্রী. শরৎচন্দ্ৰ বসুর ‘দি নেশন’ পত্রিকার বার্তাসম্পাদক-পদে নিযুক্ত হন। কমিউনিস্ট বন্দীদের উপর তখন কারাগারে যে গুলিচালনা হয়, ঐ পত্রিকায় তিনি তা বর্ণনা করেন। এসময়ে শরৎচন্দ্ৰ বসু প্রতিষ্ঠিত ‘সোশ্যালিস্ট রিপাব্লিকান পার্টি’র সদস্য হয়ে দক্ষিণ কলিকাতার উপনির্বাচনে ও সোশ্যালিস্ট অরগানাইজেশনকে সংগঠিত করার কাজে দক্ষতা দেখান। আদর্শ নিয়ে মতান্তর ঘটায় পরে তিনি এই দল ত্যাগ করেন। ১৯৫৩ খ্রী. করপোরেশন নির্বাচনে সংযুক্ত নাগরিক কমিটির প্রথম আহ্বায়ক এবং সেনেট ও সিন্ডিকেটের সদস্য নির্বাচিত হন। এই সময়ে ছাত্র ও অভিভাবক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের প্রতিটি আন্দোলনে যথেষ্ট সহায়তা করেন। ১৯৫৩ খ্রী. ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধি আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে নিবর্তনমূলক আটক আইনে কারারুদ্ধ হন। ১৯৫৫ খ্রীঃ বামপন্থী ও প্ৰগতিশীল ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত ভাষাভিত্তিক পুনৰ্গঠন কমিটির সম্পাদক হন ও ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের বঙ্গ-বিহার সংযুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে এই কমিটি তা রোধ করতে সমর্থ হয়। এই সময়ে বড়বাজার কেন্দ্রের পার্লামেন্ট সদস্য ডঃ মেঘনাদ সাহার মৃত্যু হলে ১৯৫৬ খ্রী. উক্ত কেন্দ্রের কংগ্রেসপ্রার্থী অশোক সেনকে হারিয়ে তিনি সেখানে নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ খ্রী. কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা ও রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৭ খ্রী. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের লেকচারার নিযুক্ত হন। ঐ বছরই রাজ্য বিধান পরিষদেরও সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ খ্ৰী. খাদ্য আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা গ্ৰহণ করেন ও ৩১ আগস্ট মিছিলের নেতৃত্ব দেবার সময়ে গ্রেপ্তার হন। ১৯৬৩ খ্রী. ‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকার, সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন। তখনকার বন্দী মুক্তি আন্দোলনেও তাঁর বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল। ১৯৬৪ খ্ৰী. কলিকাতায় অনুষ্ঠিত দ্বিখণ্ডিত কমিউনিস্ট পার্টির সিপিএম-এর পার্টি কংগ্রেসে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্ৰতিনিধি ছিলেন। ১৯৬৪ খ্রী. ভারত-চীন যুদ্ধের সময় তিনি গ্রেপ্তার হন ও ১৯৬৫ খ্রী. স্বাস্থ্যের কারণে মুক্তি পেয়ে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য প্রেরিত হন। ১৯৬৬ খ্ৰী. ফেব্রুয়ারী-মার্চের আন্দোলনে কিছুদিনের জন্য গ্রেপ্তার হন। মেডিক্যাল কলেজে মৃত্যু হয়। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: ‘History of Indian Journalism’।
পূর্ববর্তী:
« মোহাম্মদ লুৎফর রহমান
« মোহাম্মদ লুৎফর রহমান
পরবর্তী:
মোহিতচন্দ্ৰ সেন »
মোহিতচন্দ্ৰ সেন »
Leave a Reply