মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু (১৭-৩-১৯২০ – ১৫-৮-১৯৭৫) টুঙ্গীপাড়া-ফরিদপুর। শেখ লুৎফর রহমান। স্বাধীন বাঙলাদেশের জনক ও তার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরে জন্ম। ছাত্রাবস্থাতেই রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করেন। ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ থেকে ১৯৪২ খ্রী. ম্যাট্রিক ও কলিকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৪৭ খ্রী. বি-এ পাশ করেন। এ সময়ে ‘নিখিল ভারত মুসলিম স্টুডেন্টস লীগে’র অন্যতম সদস্য ছিলেন। কলিকাতায় তাঁর প্রধান সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, কাজী আহমেদ কামাল, মহিরুদ্দিন প্রভৃতি সেদিনের ছাত্রনেতারা। ১৯৪৩ খ্রী. অবিভক্ত বাঙলাদেশের মুসলিম লীগের কাউন্সিলার নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ খ্রী. সাধারণ নির্বাচনে ফরিদপুর জেলায় মুসলিম লীগের নির্বাচনী কাজে বিশেষ দক্ষতা দেখান। সেপ্টেম্বর ১৯৫২ খ্ৰী. পিকিং-এ অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের অন্যতম প্ৰতিনিধি হিসাবে যোগ দেন। পূর্ব-বাঙলার ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করায় প্ৰায় আড়াই বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। অর্থে পার্জনের জন্য তিনি দীর্ঘদিন ঢাকায় আলফা ইনসিওরেন্স ও গ্রেট ঈস্টার্ন ইনসিওরেন্স কোম্পানীতে কাজ করেছেন। ১৯৫৪ খ্ৰীঃ পূর্ববঙ্গের ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে তিনি তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় দেন এবং ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় (১৫-৫-১৯৫৪) বাণিজ্য, শিল্প ও দুর্নীতি নিবারণ দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ৩১-৫-১৯৫৪খ্ৰী. পূর্ব-পাকিস্তানের এই যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে গেলে বহু রাজনৈতিক কর্মীর সঙ্গে তিনিও গ্রেপ্তার হন। আওয়ামী নেতা আতাউর রহমান পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হলে (৬-৯-১৯৫৬) মুজিবুর ঐ মন্ত্রিসভার বাণিজ্য ও শিল্প দপ্তরের ভার গ্রহণ করেন। ২৭-১০-১৯৫৮ খ্রী. এই মন্ত্রিসভা বাতিল করে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান পাকিস্তানের সর্বেসর্বা হয়ে বসেন। এই সময় থেকে বহুবার তাকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। আওয়ামী লীগের সূত্রপাত থেকেই তিনি তার সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং শহীদ সোহরাবদীর মৃত্যুর পর (৫-১২-১৯৬৩) তিনিই ঐ দলের অপ্ৰতিদ্বন্দ্বী নেতা বলে বিবেচিত হন। ১৯৬৪ খ্রী. খুলনা ও ঢাকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে প্ৰাণপণ চেষ্টা করেন। ১৯৬৬ খ্ৰী. পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সভাপতি নির্বাচিত হন। তার আগে দশ বছর তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই সময় তাঁর ছয় দফা ঘোষণা পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালীকে নব্য-চেতনায় উদ্ধৃদ্ধ করে। এই ছয় দফাকে তিনি বাঙালীর মুক্তির ‘জাতীয় সনদ’ বলে অভিহিত করেন। ১৯৬৮ খ্রী. আগরতলা ষড়যন্ত্রের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান তাকে কুর্মিটোলায় মিলিটারী জেলে বন্দী করে রাখে। ১৯৬৯ খ্রী. ছাড়া পেয়ে কিছুদিনের জন্য লন্ডন যান। ঐ বছরই গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিতে রাওয়ালপিন্ডি উপস্থিত থাকেন। ১৯৬৯ খ্রী. গণ-আন্দোলনের মুখে আয়ুব খানের পতন ঘটলে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসেন এবং ১৯৭০ খ্রী. পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে (৭-১২-১৯৭০) আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে জয়লাভ করে-মুজিবুর ছিলেন এই বিজয়ী দলের নেতা। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হলেও শাসনতন্ত্র রচনার অধিকার তাকে দেওয়া হয় নি। এই কারণে মুজিবুরের নেতৃত্বে ১ মার্চ থেকে ৬ মার্চ ১৯৭১ খ্রী. পূর্ব-পাকিস্তানে ব্যাপক গণ-বিক্ষোভ চলে। এক জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্ৰাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্ৰাম স্বাধীনতার সংগ্ৰাম’। ১৫-৩-১৯৭১ খ্রী. জঙ্গীশাহীর হুমকির জবাবে তিনি একটি ঘোষণার দ্বারা পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণপ্ৰশাসনভার নিজের হাতে গ্ৰহণ করেন। উদ্দেশ্য ‘বাঙলাদেশের জনগণের মুক্তি’। পরদিন থেকেই নির্মম জঙ্গী নিষ্পেষণ শুরু হয়। ২৫ মার্চ মুজিবুরকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আটক করে রাখা, হয়। তবে ঐ তারিখেই বলা যায়, জন্ম নিয়েছিল নূতন এক জাতি। বহু অত্যাচার, অসংখ্য হত্যার পরও মুজিবের নেতৃত্বে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতা-সংগ্রাম সাফল্যমণ্ডিত হয় এবং ‘বাংলাদেশ’ সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় (১৬-১২-১৯৭১)। ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ খ্রী. মুক্ত হয়ে মুজিবুর দেশে ফেরেন এবং প্রধানমন্ত্রিপদে আসীন হয়ে জাতিগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ২৫১-১৯৭৫ খ্রী দেশে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকার চালু হলে তিনি রাষ্ট্রপতি হন। সংশোধিত শাসনতন্ত্র-অনুসারে গঠিত একমাত্র রাজনৈতিক দল ‘বাঙলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ (সংক্ষেপে ‘বাকশাল’)-এর তিনি সভাপতি ছিলেন। ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ খ্রী. এক আকস্মিক অভ্যুত্থানে ভোর পাঁচটায় সামরিক বাহিনীর লোকের হাতে তিনি ঢাকায় তাঁর ৩২নং ধানমণ্ডীর বাড়িতে সপরিবারে নিহত হন।
পূর্ববর্তী:
« মুজফফর আহমদ
« মুজফফর আহমদ
পরবর্তী:
মুনিরুজামান মরহুম »
মুনিরুজামান মরহুম »
Leave a Reply